৫৯ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৯ জুলাই, ২০২২ / ১২ শ্রাবণ, ১৪২৯
পার্থ চ্যাটার্জিকে ছেঁটেও দুর্নীতির দায় এড়াতে পারবেন না মুখ্যমন্ত্রী
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ঘরে বাইরে প্রবল চাপের মুখে পার্থ চ্যাটার্জিকে মন্ত্রীসভা ও দল থেকে তাড়িয়েও অস্বস্তি পিছু ছাড়ছে না মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির। রাজনৈতিক মহলের গরিষ্ঠ অংশের মতামত হলো, কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র কাছে মুখ খোলার জন্যই পার্থ চ্যাটার্জিকে তাড়ালেন তিনি। কারণ শুধু শিক্ষা দপ্তরের নিয়োগে বেনিয়ম নয়, এবার অন্যান্য দপ্তরের নিয়োগের প্রক্রিয়ায় ইডি’র চোখ পড়লে সমূহ বিপদ। কারণ বিভিন্ন দপ্তরের চাকরি বেচে তোলা টাকার ভাগ দলের শীর্ষ স্তরে যেত পার্থ জানেন সেটাও। চেনেন সেই কাণ্ড কারখানার নায়ক-নায়িকাদেরও। তাই বিপদের ঝুঁকি নিয়েও পার্থকে দলছাড়া করলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। দলনেত্রীর বরাভয়ের হাত মাথায় না থাকলে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থেকেও বান্ধবী অর্পিতার মামাবাড়িতে বসে নির্ভাবনায় মাছ ধরতে পারতেন না পার্থ চ্যাটার্জি।
তদন্তকারী সংস্থার সূত্রের দাবি, পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ সহযোগী অর্পিতা মুখার্জিকে চিনতেন মুখ্যমন্ত্রী। অর্পিতা মুখার্জির চারটি বিলাসবহুল গাড়ি বিপুল সম্পত্তির উৎস জানতেন শাসক তৃণমূলের একাধিক নেতাও। ২০১৯ সালের নিয়োগের নজরদারি কমিটি (যা মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় তৈরি) হবার পরেই অবৈধ নিয়োগের দরজা খুলে যায়, আর তাতেই অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আসা শুরু হয় দ্রুত।
হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থীকে বঞ্চিত করে প্রতারিত করেই রাজ্যের মন্ত্রী ও তার বান্ধবীদের সম্পত্তি আকাশ ছুঁয়েছে, দুর্নীতির এক কুৎসিত লজ্জার ছবি রোজ ধরা পড়ছে এ রাজ্যের নিয়োগ কেলেঙ্কারির তদন্তে। ইডি সুত্রের খবর, শুধুমাত্র দেশে নয়, মন্ত্রীর অবৈধ টাকা খেটেছে বিদেশেও, এবিষয়ে নিশ্চিত তদন্তকারী আধিকারিকরা। তাঁর টাকা খাটছে দক্ষিণ কলকাতার রিয়েল এস্টেট সংস্থায়। এর পাশাপাশি কলকাতা ও লাগোয়া জেলায় একাধিক সংস্থায় টাকা ঢালা হয়েছে। রিয়েল এস্টেট সংস্থা শুধু নয়, স্বর্ণ বিপণি সংস্থায় মন্ত্রী ও তাঁর ঘনিষ্ঠের বিনিয়োগ ইডির নজরে রয়েছে। জানা গেছে নিয়োগ দুর্নীতি থেকে উঠে আসা নগদ টাকার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটেও খেটেছিল।
এ পর্যন্ত প্রায় পঞ্চাশ কোটি নগদ টাকার সন্ধান মিলেছে অর্পিতা মুখার্জির দুটি ফ্ল্যাট থেকে। এছাড়াও রয়েছে ৩৯ টি জমি ফ্ল্যাটের খোঁজ। রয়েছে চারটি বিলাসবহুল দামি গাড়ি, আর প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকার নতুন নতুন সম্পত্তি বেড়েছে অর্পিতা মুখার্জির। গত তিন বছরে অর্থাৎ নজরদারি কমিটি তৈরির পর এমনকী লকডাউনের সময়েও অর্পিতা মুখার্জির মোট সম্পত্তির পরিমাণ হয় প্রায় ২০০ কোটি টাকারও বেশি। মন্ত্রী ঘনিষ্ঠ এই অর্পিতা মুখার্জি তদন্তকারী অফিসারদের কাছে স্বীকার করেছেন যে, প্রতিমাসেই নামে ও বেনামে তাকে সম্পত্তি কিনতে বাধ্য করেছেন মন্ত্রী। সেইসঙ্গে বেড়েছে মন্ত্রীর নিজস্ব সম্পত্তির পরিমাণ।
এদিকে এসএসসি-প্রাইমারির পরে গ্রুপ ডি নিয়োগ দুর্নীতিতেও এসেছে পার্থ চ্যাটার্জির নাম। উত্তরবঙ্গের তৃণমূলের নেতা ময়নাগুড়ির বিধায়ক অনন্তদেব অধিকারী সংবাদ মাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন, গ্রুপ ডি-তে নিয়োগের জন্য প্রত্যেক বিধায়কের কাছে পাঁচজন করে নামের তালিকা চেয়েছিলেন পার্থ চ্যাটার্জি। নিজেই সেই তালিকা তিনি দিয়েছিলেন, এমনকী মুখ্যমন্ত্রী ও পার্থ চ্যাটার্জির কাছে তা পাঠাতে বলেছিলেন।
ইডি’র এক আধিকারিক-এর কথায়, শিক্ষা দপ্তরে কোন ভাগ ছিল না প্রথমে। একজনই মন্ত্রী ছিল তৃণমূল সরকারের আমলে প্রথম পাঁচ বছরে। তখন থেকেই শিক্ষক নিয়োগের সমস্ত স্তরের দুর্নীতির অভিন্ন চক্র হিসেবে কাজ করেছে একটা টিম। পার্থ চ্যাটার্জি তার অন্যতম নিয়ন্ত্রক। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডির একটি সূত্রের দাবি, দুর্নীতি মামলায় প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগের নেতৃত্বাধীন কমিটির রিপোর্টে পার্থ চ্যাটার্জির নাম রয়েছে। আরেক কেন্দ্রীয় সংস্থা সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের সময় শিক্ষা সচিব মনীশ জৈনের দাবি ছিল তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর নির্দেশেই সমস্ত শিক্ষক নিয়োগ হয়েছিল। ইডি, মনীশ জৈনকেও তলব করার প্রস্তুতি নিয়েছে।
টেট দুর্নীতিতেও জড়িত হিসেবে যাদের নাম উঠে এসেছিল তাদের মধ্যে প্রথম নামটি ছিল পার্থ চ্যাটার্জির। সে সময় উঠে আসে মুকুল রায়ের নামও। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতির প্রমাণ প্রকাশ্যে এনেছিলেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের তৎকালীন সভাপতি সুরঞ্জনা চক্রবর্তী। তৃণমূলের তৎকালীন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার তৃণমূল নেতা প্রদীপ মণ্ডল এর স্ত্রী মমতা মণ্ডলের চাকরি না হওয়ায় দুর্নীতির সমস্ত তথ্য ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। প্রদীপ মণ্ডল আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার পরই সুরঞ্জনা চক্রবর্তীর অডিয়ো প্রকাশ্যে আসে। অডিয়ো পেয়ে শোনা গিয়েছিল সুরঞ্জনা চক্রবর্তী সে সময় বলেছিলেন যা হয়েছে দলের নির্দেশেই হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের মেরিট লিস্ট অ্যানালিসিস হয়েছে তৃণমূল ভবনে। শোনা গেছে কোন পরীক্ষার্থীকে দু'নম্বর দেওয়া হবে আর কোন পরীক্ষার্থীকে নয় নম্বর দেওয়া হবে সেটা আমাদের ব্যাপার। তিনি জানিয়েছিলেন পার্থ চ্যাটার্জি, শোভন চ্যাটার্জি সহ জেলার বিধায়করা সবটাই জানেন। এক দশক আগের সেই দুর্নীতির নথি পাওয়া গেছে পার্থ চ্যাটার্জির বাড়ি থেকে।
পার্থ চ্যাটার্জির বাড়ি থেকে অবৈধ শিক্ষক নিয়োগের অনেক সুপারিশ পত্র উদ্ধার হয়েছে এমনকী শিক্ষকদের বদলির সুপারিশ পত্র ও মিলেছে সেই সুপারিশ পত্র এসেছে শাসক তৃণমূলের একাধিক নেতা মন্ত্রী সাংসদদের তরফে। এমনকী দলের অন্যতম ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক শীর্ষ সাংসদের কাছ থেকেও সুপারিশ এসেছিল বলে জানা গেছে।
রীতিমতো তালিকা পাঠিয়ে দেওয়া হতো তার ভিত্তিতে টাকা যদিও আগেই তুলে নেওয়া হতো। তা নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পৌঁছানোর পরেই সেই সুপারিশ ফরোয়ার্ড করা হতো মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির তরফে ইডি’র সূত্রে জানা গেছে। একাধিক পরীক্ষার্থীর অ্যাডমিট কার্ডও মিলেছে পার্থ চ্যাটার্জির বাড়ি থেকে।
অর্পিতা মুখার্জির ইচ্ছে অ্যান্টারটেনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের চুক্তি নথিপত্র উদ্ধার হয়েছে মন্ত্রীর বাড়ি থেকে। ইডি আধিকারিকদের বক্তব্য দক্ষিণবঙ্গ ও উত্তরবঙ্গের খুব কম জেলা আছে যেখানে পার্থ চ্যাটার্জি অর্পিতা মুখার্জি এবং আরো প্রায় পাঁচ জন মহিলার নামে সম্পত্তি নেই, প্রতিজনের সঙ্গে পার্থ চ্যাটার্জি যোগাযোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারী আধিকারিকরা।
এস এস সি-গ্রুপ ডি দুর্নীতির কালেকশন ও ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টার হয়ে উঠেছিল হরিদেবপুর থানা এলাকার ডায়মন্ড সিটি আবাসনে অর্পিতার ফ্ল্যাট। এই আবাসনে মোট তিনটি ফ্ল্যাট রয়েছে অর্পিতা মুখার্জি ও পার্থ চ্যাটার্জির নামে। এই বাড়িতেই বেআইনি নিয়োগের সুপারিশ জমা পড়তো এখান থেকেই বেআইনি নিয়োগে প্রার্থীর নাম সহ তালিকা জমা পড়তো। এখানেই জমা পড়তো জেলায় জেলায় অবৈধ নিয়োগের জন্য তোলা কোটি কোটি টাকা। সেই টাকা এখানে থেকেই নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছেছে।
এদিকে রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলে ১৮ হাজার শুন্য পদ রয়েছে এবং আদালতের নির্দেশের ফলে সেই সব পদে নিয়োগ আটকে আছে - এমন মন্তব্য করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একুশে জুলাই।
মুখ্যমন্ত্রীর এই দাবির প্রেক্ষিতে সবিস্তার তথ্য চান বলে জানিয়েছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর নির্দেশ ১৮ হাজারের মধ্যে প্রাথমিক উচ্চ প্রাথমিক মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক এবং মাদ্রাসার কোথায় কত পদ শূন্য রয়েছে, রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দপ্তরের সচিব কে তা আদালতে জানাতে হবে। কোর্টের কোন নির্দেশের ফলে ওইসব পদে নিয়োগ করা যাচ্ছে না তাও বলতে হবে সচিবকে। এসব জানিয়ে স্কুল শিক্ষা সচিবকে ২৯ জুলাইয়ের মধ্যে হাইকোর্টে হলফনামা পেশ করতে হবে। বিচারপতি স্পষ্ট করে দিয়েছেন নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে হলফনামা না দিলে অতিরিক্ত সময় দেওয়া হবে না।