E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৯ জুলাই, ২০২২ / ১২ শ্রাবণ, ১৪২৯

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই হবে শেষতক

ইন্দ্রজিৎ ঘোষ


নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে বসিরহাটে ছাত্র-যুবদের মিছিল।

দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, বেআইনি ভুয়ো নিয়োগের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই। পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি প্রকাশ্যে প্রমাণিত। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, বর্তমান শিল্পমন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর বাড়ি থেকে পাওয়া গেছে ২১ কোটি ৪০ লক্ষ নগদ টাকা, সাথে প্রায় ৮০ লক্ষ টাকার সোনা, বিদেশি মুদ্রা, বাড়ি ফ্ল্যাট, পরবর্তীতে তাঁর বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট থেকে আরও ৩০ কোটি টাকা এ পর্যন্ত উদ্ধার করেছে ইডি। এক কথায় বিপুল পরিমাণের আর্থিক দুর্নীতি। আরও ঘনিষ্ঠদের সন্ধান মিলছে।

বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীকে সিবিআই জেরা করছে। চাকরি খোয়া গেছে তাঁর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারীর, ফেরত দিতে হয়েছে বেতন বাবদ নেওয়া সমস্ত টাকা।

সিবিআই, ইডি জেরা করেছে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান, তৃণমূল দলের বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্যকে।

কেবল মন্ত্রী বা নেতা নন সিবিআই, ইডি’র জেরার সম্মুখীন হয়েছেন শিক্ষা দপ্তরের সচিব আইএএস অফিসার মনীশ জৈন, একাধিক বিসিএস অফিসার, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব যিনি বর্তমানে শিল্পমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব।

ভুয়ো নিয়োগের কারণে ৬০৯ জন শিক্ষাকর্মী এবং প্রায় ২৮৫ জন হাই স্কুলের শিক্ষক, ২৬৯ জন প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকের চাকরি বাতিল করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। কেবল চাকরি থেকে বরখাস্ত নয়, ওরা যত দিন থেকে যে টাকা বেতন হিসেবে তুলেছে তা সুদ সহ ফেরত দেবার নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

তদন্তে অগ্রগতির সাথে সাথে আরও অনেক তৃণমূল বিধায়ক নেতা-মন্ত্রীদের নাম আসছে। কেবল তৃণমূল নয়, একাধিক বিজেপি’র বিধায়ক-নেতা যারা প্রাক্তন তৃণমূল - তাদেরও নাম আসার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।

এই সমস্ত ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর অনেকের মনে হতে পারে, এই বার চোর ধরা পড়েছে। কিন্তু এই দুর্নীতির অভিযোগগুলি প্রথম নয়। ২০১৩ সাল থেকে স্বচ্ছতার সাথে নিয়োগের দাবিতে লড়াই চলেছে ধারাবাহিকভাবে। কখনও আন্দোলন হয়েছে এসএফআই - ডিওয়াইএফআই-এর পতাকাতলে, আবার অনেক আন্দোলন হয়েছে চাকরি প্রার্থীদের ব্যানারে।

দুর্গাপুরে এসএসসি দুর্নীতির প্রতিবাদে ছাত্র-যুবদের মিছিল।

২০১৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাইমারি টেট পরীক্ষা হয়। ওই দিন এমন বিশৃঙ্খলা হয় যে, পরীক্ষা দিতে গিয়ে ট্রেন থেকে পড়ে মারা যায় জয়নগরের যুবতী রীতা দাস। এসএফআই - ডিওয়াইএফআই’র আন্দোলনের ফলে পুনরায় পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়।

২০১২ সালের ২৯ জুলাই তৃণমূল সরকারের সময় প্রথম আরএলএসটি মানে এসএসসি পরীক্ষা হয়।

২০১৩ সালের ৬ আগস্ট দ্বাদশ মানে এসএসসি’র কমন মেধা তালিকা প্রকাশিত হয় ও পরে দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসে। তারপরে র‌াঙ্ক জাম্প করে অসংখ্য প্রার্থীদের কাউন্সেলিং ও চাকরি দেওয়া হয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হয় এসএসসি কমিশন অফিস ও কলেজ স্ট্রিটে চাকরিপ্রার্থীদের ধরনা-অবস্থান। তৎকালীন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র চাকরিপ্রার্থীদের নিয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর কাছে যান। এর পর একটা প্যানেল প্রকাশ করে। কিন্তু সকলের চাকরি হয় না।

তারপর শুরু হয় আন্দোলন। প্রকাশ্যে আসে দুর্নীতি। সেই দায়ে কমিশন উপদেষ্টা অমিতেশ বিশ্বাস পদত্যাগ করেন এবং তারপরে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের চাপে তৎকালীন চেয়ারম্যান চিত্তরঞ্জন মণ্ডল পদত্যাগ করেন।

২০১৪ সালের পর আর পরীক্ষাই হচ্ছিল না। আবার শুরু হয় আন্দোলন। আন্দোলনের চাপে ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট আপার প্রাইমারি ও ৯ আগস্ট প্রাইমারির পরীক্ষা হয়। কিন্তু পরীক্ষা হলেও রেজাল্ট প্রকাশ হচ্ছিল না।

১০ আগস্ট এই ইস্যু নিয়ে বিশাল মিছিল করা হয়। ধর্মতলায় চপ ভেজে বিক্ষোভ জানান চাকরিপ্রার্থীরা।

এরপর প্রাইমারি ও আপার প্রাইমারির রেজাল্ট প্রকাশ হয় ২০১৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর।

২০১৭ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্যাপক দুর্নীতি সামনে আসে। এসএমএস-এর মাধ্যমে ডাকা হয়। কোনো পিডিএফ ফরমেটে প্যানেল প্রকাশ করা হয়নি।

রাজ্য জুড়ে তীব্র আন্দোলনে নামে এসএফআই - ডিওয়াইএফআই।

তখনই নাম জড়ায় তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর।

শিক্ষামন্ত্রীর নামে দুর্নীতির অভিযোগ। প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে টানা ১৪ দিন প্রেসিডেন্সি সেন্ট্রাল জেলে আটকে রাখা হয় ৮ জন এসএফআই - ডিওয়াইএফআই নেতৃত্বকে। তাতে আন্দোলন দমে না বরং বাড়ে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও যোগ্যদের স্বচ্ছভাবে নিয়োগের দাবিতে রাস্তার সংগ্রাম আরও বৃহত্তর রূপ ধারণ করেছে দিনের পর দিন।

আন্দোলনের প্রথম দিন থেকেই স্বচ্ছভাবে দ্রুত নিয়োগের দাবি সোচ্চার হয়ে ওঠে। প্রতিটি অভিযানে স্বচ্ছভাবে ও এম আর পরীক্ষা, কার্বন কপি, প্রশ্ন পত্র প্রদান ও উত্তরপত্র ওয়েবসাইটে আপলোড করা এবং প্রত্যেক প্রার্থীর ব্রেক আপ স্কোর নম্বর সহ ইন্টারভিউ ও মেধা তালিকা প্রকাশ এবং নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এবং সঠিক তালিকার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দাবিতে দপ্তরে দপ্তরে ডেপুটেশন দেওয়া হয় ও সংবাদ মাধ্যমে জানানো হয়।

২০১৫-১৬ একাধিক আন্দোলন কর্মসূচির পরে কমিশন এসএলএসটি আপার প্রাইমারি, নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও পরীক্ষা নেয়। ঠিক একইভাবে আন্দোলনের জেরে ২০১৭ সালের ২ মে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ফলপ্রকাশে কমিশনকে বাধ্য করা হয়। ২০১৭-২০১৮-র আন্দোলনের ফলস্বরূপ মেধা তালিকা ও কাউন্সেলিং শুরু হয়।

২০১৮ সালের ২২ জুন বিকাশ ভবন অভিযান কর্মসূচি গ্রহণের ফলে নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির নিয়োগ শুরু হয়।

২০১৮ সালের ২০ নভেম্বর বিধানসভা অভিযানের ফলে কর্ম ও শারীর শিক্ষায় নিয়োগ প্রক্রিয়া সচল হয়।

২০১৯ সালের ৭ ফ্রেব্রুয়ারি রাতভোর কমিশন অফিসে বিক্ষোভ-অবস্থানের জেরে আপার প্রাইমারি ভেরিফিকেশন নোটিশ জারি হয়।

প্রতিটা অভিযানে পুলিশ চাকরিপ্রার্থীদের অন্যায়ভাবে থানায় আটক রেখে শুরু করে লাঠিচার্জ ও হেনস্থা। তারপরও আন্দোলন বিন্দুমাত্র স্তব্ধ না হয়ে বেড়েছে প্রতিদিন।

এই প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ধর্মতলার গান্ধী মূর্তির পাদদেশে টানা ৫০০ দিন ধরে অবস্থান করছেন নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক-চাকরিপ্রার্থীরা। এর আগে বিকাশ ভবনের সামনে ১৮৭ দিন ধরে আন্দোলন চলেছে।

শীত গ্রীষ্ম বর্ষা সব কিছু উপেক্ষা করে ধারাবাহিক লড়াই চলেছে। আপার প্রাইমারি চাকরি প্রার্থীদের আন্দোলনকে দমানোর জন্য বিগত ২ ডিসেম্বর কনকনে শীতের রাতে জল কামানের ব্যবহার করে পুলিশ। তারপর সেই চাকরিপ্রার্থীদের মধ্য রাতে শিয়ালদহে ছেড়ে দেয়। ভয় না পেয়ে ওই রাতে ভিজে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মিছিল শুরু হয়। পথ অবরোধ করা হয়। পরের দিন আবার বিকাশ ভবনের সামনে শুরু হয় অবস্থান। এটাই আন্দোলনের তেজ।

আন্দোলন করতে গিয়ে চাকরি প্রার্থীরা পুলিশের হেনস্তার শিকার তো হয়েছেনই, তার সাথে অনেক সময় স্থানীয় তৃণমূলের আক্রমণও প্রতিহত করতে হয়েছে।

নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ ও আপার প্রাইমারি এবং গ্ৰুপ-ডি এবং সি - সমস্ত নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পথে নেমে সোচ্চার হয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা।

কিন্ত বারবার আন্দোলন, চেয়ারম্যানকে ডেপুটেশন দেওয়ার পরও দুর্নীতি থামেনি। তখন একাধিক মামলা করেন চাকরিপ্রার্থীরা এবং আজ আদালতে সমস্ত অভিযোগ ও দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে বেআইনি শিক্ষক নিয়োগ, মন্ত্রী কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীর নাম মেধা তালিকার প্রথমে থাকা ইত্যাদি নিয়ে একাধিক অভিযান হয়েছে ও সংবাদ মাধ্যমে এসব তুলে ধরা হয়। আজ সমস্ত অভিযোগই প্রমাণিত সত্য।

একথা সত্য বিভিন্ন আঙ্গিকে লড়াই-আন্দোলন চলছে। রাস্তায় অবস্থান বিক্ষোভ, অনশন, ও ন্যায় বিচারের দাবিতে আদালতেও অবস্থান বিক্ষোভ হয়েছে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, দ্রুততার সাথে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে নিয়োগের আন্দোলন চলবে। যোগ্যদের বঞ্চিত করা যাবে না। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে এই আন্দোলন চলবে।

আর যারা দুর্নীতি করে চাকরি পেলো তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে। বেতন হিসাবে যা টাকা পেয়েছে তা সুদ সহ ফেরত দিতে হবে। তার সাথে যথোপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। এখানে থামলে হবে না, যে অফিসাররা দুর্নীতি করে চাকরি দিয়েছেন তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে, এর সাথে তাদের কারাদণ্ড দিতে হবে।

আর যে মন্ত্রী-নেতাদের কথায় আধিকারিকরা এই কাজ করেছেন তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে জেলে অবশ্যই পাঠাতে হবে। আর যে সরকারের মন্ত্রীরা চুরি করে জেলে যায়, যে সরকারে আমলারা দুর্নীতির সাথে যুক্ত, সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতেই হবে।

এই সমস্ত দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে। লড়াই চলবে শেষতক।