৫৯ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৯ জুলাই, ২০২২ / ১২ শ্রাবণ, ১৪২৯
লঘু মশকরা নয়, আর্থিক কেলেঙ্কারি চর্চা হোক
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
কোনো সৃজনশীল কাজে মন বসানোর উপায় নেই। পেপারে, টিভিতে খবরে, মোবাইলে মেসেজের ছড়াছড়ি। তবে অধিকাংশ মিডিয়াই আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনাকে হালকা করে দেবার জন্যে প্রেমের কাহিনিকে পল্লবিত করে চলেছে। একের পর এক ঘটনাপ্রবাহ দেখে শুনে মানুষ চূড়ান্ত বিরক্ত, কিন্তু প্রতিকারের পথ বুঝে উঠতে পারছেন না। কোটি কোটি টাকা আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে সদ্য প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী জেলে। টাকা পয়সা সরানোর জন্যে কয়েকমাস সময় পেয়েছেন। বেশিরভাগ টাকাই সরিয়ে ফেলেছেন সেটাই অনেকে অনুমান করছেন। অনেক টাকা পয়সা সরিয়েও যে ছিটেফোঁটা পাওয়া গেল সেটাই বা কম কী ২১ কোটি ! ট্রেনে, বাসে, চায়ের টেবিলে আড্ডায় আলোচনার একটা খাসা বিষয় পাওয়া গেছে। আর্থিক কেলেঙ্কারির সাথে প্রেমের মিশেল - দুইয়ে মিলে একেবারে জমজমাট আইটেম। মন্ত্রীর সন্তানের বয়সি দুই বান্ধবীর (মতান্তরে সংখ্যাটা বাড়তেও পারে) ঠিকুজি ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে। নানান ঠাট্টা, মজা চলছে চারদিকে। দাদুর নামে মজার মিম, ছড়া, নিন্দা, জেলযাত্রা আটকাতে চেনা ছকে অসুস্থ, হাসপাতালে ভরতি – সব ঘটে গেছে। জেল গেটে ওষুধ নিয়ে এখনো কোনো ক্রন্দনরতা ‘বৈশাখী’ দাঁড়িয়ে নেই সত্যি, তবে থাকবে না এমন নিশ্চয়তা কোথায়!
লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছে অনেকেই। দিনরাত আলোচনা চলছে প্রেম নিয়ে, দাদু-নাতনির রসালাপ নিয়ে - পিছনে চলে গেছে আনিস খানের মৃত্যুর বিচার, অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, কর্মসংস্থানের বিষয় নিয়ে চর্চা। সামনে চলে আসছে হাবিজাবি সব প্রশ্ন ! এত মোটা কেন পার্থ? অর্পিতা ভালো বন্ধু হলে সে নিজের স্বাস্থ্য মেইন্টেন করে, অথচ পার্থর মেদ কমে না কেন ? মোবাইল খুললেই অর্পিতার নাচের ছবি। এসব দেখে হাসাহাসি চলছে। মানুষের মনে নানা স্রোতের ভিড় বাড়ছে। কেউ দেখায় যোগাসনে বসে মেয়েটি, কেউ দেখাচ্ছে আগুনে নাচ, কেউ চিন্তিত ভুড়ি ও ভালোবাসার সম্পর্ক নিয়ে, মায়ের বিবৃতি - মেয়ের উচ্ছৃঙ্খলতা নিয়ে, বাগান বাড়ির ছবি যার নাম অপা, বাগান বাড়ির সাথে মানুষদের মনে উঁকি মারছে পুরানো জমিদার, রাজাদের সেই হুল্লোড়ে জীবনের গল্প। সমাজতত্ত্বের বিশেষজ্ঞরা বলছেন - সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মাফিক তৈরি হচ্ছে ‘ভুড়ি আর নারী’ নিয়ে রসালো আলোচনা, শোভন-বৈশাখীর সাথে তুলনামূলক আলোচনা। উদ্দেশ্য যৌনতার আলোচনায় মানুষের মন ডুবিয়ে দাও, ধীরে ধীরে দুর্নীতির জন্যে মানুষের মনে থাকা রাগ কমে যেতে বাধ্য। তাই এইসব তো চলবে জানা কথাই। থেমে যাবে রাজ্যের উন্নয়ন নিয়ে প্রকৃত চেষ্টা। কেউ বলে বেড়াচ্ছে দেশের সরকার কত মহান, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কবে থেকে লড়ে যাচ্ছে সিবিআই, ইডির সাহায্যে।
সব আলোচনাই চলছে। কিন্তু যে আলোচনাটা মানুষের মগজের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না যে, ইডি, সিবিআই যা করছে সব কিছু আদালতের নির্দেশে করছে। চাকরি থেকে বঞ্চিত প্রার্থীদের হয়ে আদালতে লড়ছেন আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য। এই জায়গাটাই প্রচারের আলোয় হারিয়ে যাচ্ছে সচেতনভাবেই। বাইট দিচ্ছেন সরকারের পক্ষের লোকরা, তাঁরা তোপ দাগছেন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আর সরকারের উলটোদিকের রাজ্যের নেতারা কেউ কেউ দিব্যি বাহবা নিয়ে চলেছেন। বাস্তবে যা ঘটছে সবটাই আদালতের নির্দেশে ও আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যের ধারাবাহিক উদ্যোগে।
‘জোকার’ বানানো হচ্ছে ভুড়িওয়ালাকে আর শেষ পর্যন্ত আসলে বোকা বানানো হচ্ছে সাধারণ মানুষ সবাইকে। আড়াল থেকে এই সব সংগঠিত শক্তি চায় মানুষ মিম বানিয়ে, মজা করে, হাসাহাসি করে মনের ভিতর জ্বলতে থাকা আগুনটাকে যেন সংহত করতে না পারে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একটাই - গাছের আসল ডালে যেন পাখি বসতে না পারে, এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াক।
অনেক বছর আগে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কাণ্ডে দেখা গিয়েছিল সুজেট নামের নির্যাতিতা মেয়েটির চরিত্র নিয়ে প্রভাবশালীদের বাণী আর দেখা গিয়েছিল তদন্তকারী আধিকারিককে নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, যা রাজ্যের মানুষের অনেকের পছন্দ হয় নি। সেদিন যদি তদন্তকারী আধিকারিককে সরিয়ে না দিয়ে সম্মাননা জ্ঞাপন করা হতো, তাহলে রাজ্যের সাধারণ ছাপোষা মানুষ সাধুবাদ জানাতেন। যেদিন রায়গঞ্জ ইউনিভার্সিটি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে প্রকাশ্যে কিছু সমাজবিরোধী চেহারার ছেলে নির্যাতন করেছিল, সেদিন সেই কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলের মিষ্টি ছেলেগুলোর পক্ষ না নিলে আজকে শিক্ষাক্ষেত্রে এই বিপর্যয় দেখতে হতো না এটা নিশ্চিত। উপাচার্যকে আটকে রাখার সাহস ছাত্রদের আসে কোত্থেকে এটাই অবাক করে। কামদুনির ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় স্বচ্ছ ভূমিকা নিলে একের পর এক ধর্ষণ কাণ্ডে রাজ্যের মুখ পুড়তো না এটা নিশ্চিত। রাজ্যজুড়ে পৌরসভা নির্বাচনে দরকার ছিল না দখলদারির। এইসব ঘটনার পরম্পরার নিশ্চিত অভিমুখ যা হবার কথা সেটাই হয়েছে। চূড়ান্ত অধঃপতিত একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে জমিদার, রাজাদের আমলের সাথে যুক্ত শব্দগুলো ফিরে আসছে সমাজে - বাগানবাড়ি, সংসার বহির্ভূত একটা সমান্তরাল জীবন, দেশে-বিদেশে ভ্রমণ, উপঢৌকন, সুরা ইত্যাদি প্রভৃতি।
আজকে আবার রাজ্যের সামনে একটা সুযোগ এসেছে সঠিক পক্ষ বেছে নেবার। রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী এবং বর্তমান শিল্পমন্ত্রীর গ্রেপ্তার কোনো ছোটোখাটো বিষয় না, এটা সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতেই হবে। দলীয় বৃত্তের প্রেক্ষাপটে ভাবলে কোনো সৎ পরামর্শ আসার সম্ভাবনা কম, এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। সব পরিস্থিতি দেখে যে কথাটা বারবার মনে হচ্ছে যে, রাজ্য একটা খুব বড়ো বাঁকের সামনে দাঁড়িয়ে। সঠিক রাস্তা বেছে নিলে অনেক জটিলতার সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়া সহজ হবে। নাহলে ভবিষ্যতে অনেক মূল্য দিতে হতেই পারে। রাজ্যের সম্মান নষ্ট হলে দেশে-বিদেশে থাকা রাজ্যের সব মানুষের কাছেই তা যন্ত্রণার, অপমানের। মাথা হেঁট হয়ে যায় মানুষের। যারা ভোট দিয়েছেন তাঁদেরও মাথা হেঁট হয়, যারা দেননি তাঁদেরও হয়। যেমন, রাজ্য ঋণ ভারে নুইয়ে পড়ছে এই খবর জেনে শাসক, বিরোধী সব পক্ষের সচেতন নাগরিকের সমান উদ্বেগ হয়। রাজ্যের মুখ উজ্জ্বল হলে যেমন দল, মত, রং, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার আনন্দের শেষ থাকে না।