E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৯ জুলাই, ২০২২ / ১২ শ্রাবণ, ১৪২৯

আদানি-তৃণমূলের অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে ফারাক্কার মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই

জামির মোল্লা


গণকনভেনশনে বক্তব্য রাখছেন বিকাশ ভট্টাচার্য।

মুর্শিদাবাদের ফারাক্কায় আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করতে নখ দাঁত বের করে সাধারণ গ্রামবাসীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে মমতা ব্যানার্জি সরকারের পুলিশ প্রশাসন। গ্রামবাসীদের ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই, পুলিশ দিয়ে মেরে গ্রামবাসীদের সরিয়ে দিয়ে জমি, আমবাগানের উপর হয়ে আদানির হাইটেনশন বিদ্যুতের তার টাঙানো হয়েছে। আন্দোলনে রুখে দাঁড়াচ্ছেন গ্রামের মানুষ। আদানির হয়ে কাজ করছে পুলিশ, প্রশাসন, তৃণমূল কংগ্রসের বিধায়ক থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান, তৃণমূলের ছোটো বড়ো নেতারা। আন্দোলনকারীদের ভয় দেখানো হচ্ছে, হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এসবের মধ্যেই তীব্রতর হচ্ছে নায্য ক্ষতিপূরণের দাবিতে জমি মালিকদের লড়াই।

আদানির এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের পিছনে আসলে মদত রয়েছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা জেলায় আদানির পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য নরেন্দ্র মোদি তাঁর ‘ছোটো ভাই’এর মতো আদানিকে বগলদাবা করে নিয়ে চলে যান ঢাকা শহরে ২০১৪ সালে। তারপর হাসিনা সরকারের সাথে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য চুক্তি হয় । এই চুক্তি নিয়ে বাধা এসেছে বাংলাদেশের অন্দরেও। কথা ছিল, ২০২১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজ সম্পূর্ণ হবে। ঝাড়খণ্ডের গোড্ডা থেকে ফারাক্কা হয়ে বাংলাদেশ সীমান্তের দূরত্ব আনুমানিক ১৩০-১৪০ কিলোমিটার।

এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে তার নিয়ে যেতে হলে ফারাক্কা ব্লকের ইমামনগর ও বেনিয়াগ্রাম অঞ্চলের ৪টি মৌজা ও ১১টি গ্রামের উপর দিয়ে হাই টেনশন বিদ্যুতের তার নিয়ে যেতে হবে।

এই কাজে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় এক হাজার বিঘার আম ও লিচুবাগানের। ৪০০ কেভি’র (চার লক্ষ ভোল্ট) হাইটেনশন তার যাওয়ার জন্য কয়েক হাজার আম ও লিচুর গাছ কাটা হয়েছে। সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ৪০০ জনের বেশি চাষি। আর তারের দু’পাশে ২০ মিটার করে ধরলে এই সংখ্যাটা হাজারের বেশি ছাড়িয়ে যাবে।

ফলন্ত বড়ো বড়ো আম লিচুর গাছ কাটা পড়লে যেমন ভয়ঙ্করভাবে পরিবেশের ক্ষতি হবে, অন্যদিকে চাষিরা আর্থিকভাবে বিপন্ন হবেন। গাছ পিছু এক সিজনে আয় হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। অথচ বিদ্যুতের তার নিয়ে যাওয়ার জন্য জমি অধিগ্রহণের কোনো আইন মানা হয়নি। উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। গ্রামবাসীর স্পষ্ট জানিয়েছেন, কোনো রকম নোটিশ ও পাননি তারা। জমি নেওয়া নিয়ে ব্লক, পঞ্চায়েত স্তরেও কোনো শুনানি হয়নি।

বসত বাড়ি, জমি ও বাগানের উপর দিয়ে হাই টেনশন তার নিয়ে যাওয়ায় এবং গাছ কাটার জন্য কোনোরকম অনুমতিও নেওয়া হয়নি। ক্ষতিপুরণের নামে গাছ কাটা পড়লে ৫০ হাজার এবং না কাটা পড়লে ২০-২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও সেটাও জোটেনি। প্রশ্ন উঠছে কীভাবে ঠিক হলো এই ক্ষতিপূরণের পরিমাণ? যারা টাকা নিয়েছেন, তাদের কার্যত টাকা নিতে বাধ্য করা হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা বলেছেন, এই প্রকল্প সরকারি প্রকল্প। কিন্তু আসলে এই বিদ্যুতের তার নিয়ে যাওয়ার প্রোজেক্ট আদানি কোম্পানির নিজস্ব প্রকল্প। এতে লাভবান হবে শুধু কোম্পানিই। জনস্বার্থের সাথে এই প্রোজেক্টের কোনো সম্পর্কই নেই। আর ক্ষতিপুরণের অঙ্কের সাথে বিজ্ঞানসম্মত কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পূর্ণ অযৌক্তিকভাবে এই টাকার অঙ্ক ঠিক করা হয়েছে।

যদি ধরা যায়, প্রতিবছর একটি লিচুগাছ থেকে আয় হয় গড়ে ১০ হাজার টাকা, আর গাছের ফলন গড়ে ৫০ বছর,তাহলে গাছ পিছু ৬ লক্ষ টাকা হয়। চাষিরা কি তা পেয়েছেন? উলটোদিকে জমি হাঙরদের জমি দিতে অনিচ্ছুক হলে পুলিশ-তৃণমূল মিলে চলেছে শাসানি এবং পানি কেস (এনডিপিএস), এউএপিএ’র হুমকি।

বেআইনিভাবে জমি দখলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান ক্ষতিগ্রস্ত জমি মালিক লুৎফর হক। তাঁর ছেলে কাজ করতেন সিভিক ভলান্টিয়ার হিসেবে। সেই কাজ কেড়ে নিয়েছে ফারাক্কা থানার পুলিশ। আদানির কাছে পুলিশ ও তৃণমূলের উপর তলার নেতা থেকে চুনোপুঁটি নেতারা টাকা খেয়েছে। আনুগত্যের প্রমাণ দিতে ভয় ভীতি দেখানো হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।

জমি দখলের প্রতিবাদ করলে গত ২ জুলাই দাদানটোলা সমশপুর এবং ইমামনগরের মানুষের উপর অত্যাচার করেছে পুলিশ। মহিলাদের ঘরের ভিতরে ঢুকে মেরেছে পুলিশ। অবর্ণনীয় অত্যাচার। এমনকী রক্ষা পায়নি কোলের শিশুও।

প্রথমদিকে মানুষ কিছুটা ভয় পেলেও সাহস জুগিয়েছে বামপন্থী নেতৃবৃন্দ। এই ঘটনার পর বামপন্থীরা গ্রামে ছুটে গিয়েছেন। বাড়ি বাড়ি কথা বলে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন বামপন্থী আন্দলনের কর্মীরা। সেভ ডেমোক্রেসির নেতৃবৃন্দ গ্রামে গিয়ে ভরসা দিয়েছেন।

ভরসা পেয়ে জোট বেঁধেছেন সাধারণ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক-খেতমজুর-ভূমিহারা মানুষের উদ্যোগে সমশপুরে গণ কনভেনশন হয়েছে ২৪ জুলাই। হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে ভাষণ দিয়েছেন বিশিষ্ট আইনজীবী,সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য।

বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে পাশে পেয়ে ফারাক্কার মানুষ বাড়তি উৎসাহ পেয়েছেন। গণভেনশনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, পুলিশের বাড়াবাড়ি কেউ বরদাস্ত করবেন না। আইনি লড়াই বিনা খরচায় লড়বেন তিনি।

যে অনিচ্ছুক কৃষকরা হাইকোর্টে কেস করেছিলেন তাদের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কোর্ট ক্ষতিপূরণের বিষয়টি দেখার জন্য জেলা শাসককে দু’মাস সময় দিয়েছেন। অথচ তিনি এই বিষয়ে সক্রিয় নন। আসলে প্রশাসনের ব্যবস্থাটাই আদানির স্বার্থে কাজ করছে, মানুষের স্বার্থে নয়।

বিকাশ ভট্টাচার্য সেদিনের কনভেনশনে স্পষ্টই বলেন, “মাঠঘাটের লড়াই আপনারা তীব্রতর করুন। আমরা আইনি লড়াই লড়ব। আর যারা আদানির হয়ে কাজ করার জন্য আদানির কাছ থেকে পার্থ চ্যাটার্জির মতো টাকা নিয়েছে, তাদের সব টাকা আদায় অরে ছাড়ব। চাষিরা যাতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পান সেই চেষ্টাই করবেন বামপন্থীরা।’’

এখন যিনি মুখ্যমন্ত্রী, তিনি ২০১১ সালে শিল্পের জন্য জমি নেওয়ার বিরোধিতা করেছিলেন। অথচ সেখানে হাজার হাজার যুবক যুবতীর চাকরি হতো। আর এখানে চাকরির কোনো সুযোগ নেই। আদানির ব্যবসায়িক এই প্রোজেক্টে রাজ্যের মানুষের কোনো লাভ হবে না। কোনো কর্মসংস্থান হবে না। শুধুমাত্র কর্পোরেটদের সুবিধা করে দিতে চাইছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। আদানির সাথে বন্ধুত্ব অটুট রাখতে,আদানির সুবিধা করে দেওয়ার জন্য চাষিদের উপর পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু এইভাবে মানুষের অধিকারকে দমন করা যাবে না। সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে ন্যায্য ক্ষতিপূরণের বদলে সামান্য কিছু টাকা মানুষের হাতে দিয়ে কাজ সারতে চাইছে আদানি। এই কাজে মদত দিচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস, পুলিশ। প্রশাসন কোম্পানির এজেন্টের কাজ করছে। পরিবেশের প্রশ্নটিও সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত।

ফারাক্কার লড়াকু মানুষ নির্দিষ্টভাবে তিনটি দাবি করছেন। সেগুলি হলঃ
১) জমি অধিগ্রহণের আইন মেনে চাষিদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।
২) আদানি গোষ্ঠী, তৃণমূল কংগ্রেস এবং পুলিশের অসাধুচক্র ভাঙতে হবে।
৩) পুলিশি নির্যাতনের সাথে যুক্ত অফিসারদের শাস্তি দিতে হবে, জেলবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে, মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

এই দাবিগুলো নিয়েই মাঠে-ময়দানে সামনে জোর লড়াই। একদিকে সাধারণ মানুষের শক্তি উলটোদিকে আদানি, রাজ্য প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, তৃণমূল কংগ্রেসের বাহিনী। এই লড়াইকে তীব্র করতে জোট বাঁধছেন গ্রামের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ।