৫৯ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ২৯ জুলাই, ২০২২ / ১২ শ্রাবণ, ১৪২৯
যে বিপদের মুখে ভারত
সুপ্রতীপ রায়
বিজেপি মুক্ত ভারত কেন প্রয়োজন? এটা কী কেবলমাত্র বিজেপি-কে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার জন্য জরুরি? দেশকে বাঁচাতে গেলে বিজেপি-কে জনবিচ্ছিন্ন করা এই মুহূর্তের কাজ। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশজুড়েই মুক্ত চিন্তা, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর হামলা চালাচ্ছে বিজেপি। শিক্ষা-সংস্কৃতি-শিল্পচর্চা কেন্দ্রগুলি সংঘ পরিবারের নিশানা। হামলা, মিথ্যা মামলা, গ্রেপ্তার স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সংঘ পরিবার নানা কায়দায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকারের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। ওদের এই হামলার পরিকল্পনা চলছে বহু বছর ধরে।
প্রত্যাহৃত তিন কৃষি আইন, শ্রমকোড, নয়া শিক্ষানীতি, সিএএ-এনআরসি এসবই সাংবিধানিক অধিকারের উপর আক্রমণ। বহুত্ববাদী ভারতের উপর ’হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের’ ধারণা চাপিয়ে দিতে চাইছে। অন্যান্য বুর্জোয়া দলগুলির থেকে বিজেপি সম্পূর্ণ পৃথক। আগ্রাসী দক্ষিণপন্থার অভিযান দেশজুড়ে আরএসএস পরিচালনা করছে, বিপদটা এখানেই। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল, পূর্বতন জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সমস্ত সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা, নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের প্রচেষ্টা আসলে আরএসএস’র হিন্দুরাষ্ট্রের পরিকল্পনা কার্যকর করার একটি পদক্ষেপ। আরএসএস’র রণকৌশলের অঙ্গ হলো - নেশনের সংজ্ঞা বদলে দেওয়া, নাগরিকত্বের পরিভাষা বদলে দেওয়া।
দেশজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিধন যজ্ঞ চলছে। দ্বিতীয়বার কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তীব্রগতিতে আরএসএস তার অ্যাজেন্ডাকে কার্যকর করতে চাইছে। হিংসার মধ্যে দিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করে দিয়ে কেন্দ্রীকরণ অভিযান চলছে। আরএসএস কার্যত রাষ্ট্রব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আরএসএস নির্দেশিত রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করার লক্ষ্যে মোদি কাজ করছেন।
বিজেপি জমানায় গণতান্ত্রিক পরিসর ক্রমশই সংকুচিত হচ্ছে। সংবিধানের নির্দেশাবলিকে ক্রমাগত লঙ্ঘন করা হচ্ছে। বিজেপি বিভিন্ন রাজ্যের বিধায়কদের কিনে নির্বাচিত সরকারগুলির পতন ঘটিয়ে চলেছে। সংসদে বিনা আলোচনা, বিনা ভোটে জোর করে আইন পাশ করিয়ে নিচ্ছে। এগুলির মধ্য দিয়ে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলা হচ্ছে। সংবিধান প্রদত্ত সমস্ত অধিকারই আক্রান্ত, বিপন্ন।
মোদি আমলে আক্রান্ত মৌলিক অধিকারগুলি। আমাদের দেশের সংবিধানের ১৯(১)(এ)-তে মানবাধিকার সংক্রান্ত ধারায় বাক স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের মৌলিক অধিকারের কথা বলা আছে। এই মৌলিক অধিকারের ওপর একের পর এক হামলা নামিয়ে এনেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ঘৃণা ভাষণের সঙ্গে যারা যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা না নিয়ে উৎসাহিত করা হচ্ছে। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার সম্পর্কে এক বিকৃত ধারণা হাজির করার চেষ্টা করছে।
মোদি-শাহ রাজত্বে মানবাধিকারের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হওয়ার পথে। মানবাধিকার যে বিজেপি’র না-পছন্দ তা প্রতিরক্ষা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান প্রয়াত বিপিন রাওয়াতের মন্তব্যের মধ্য দিয়ে অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছিল। ‘টাইমস নাও’-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিপিন রাওয়াত বলেছিলেন, “কাশ্মীরের মানুষজন বলছে যে তাঁরা সন্ত্রাসবাদীদের গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলবেন, তাঁরা এমন ব্যবস্থা করবেন বলছেন যার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদীরা গণপ্রহারের শিকার হয়। এটা ইতিবাচক লক্ষণ। সন্ত্রাসবাদীদের হত্যা করলে সেটা মানবাধিকারের লঙ্ঘন হবে কেমন করে? আপনার এলাকায় কোনো সন্ত্রাসবাদী সক্রিয় হলে তাকে আপনি হত্যা করতে পারবেন না কেন?” আসলে প্রয়াত বিপিন রাওয়াত নিজের কথাগুলি কাশ্মীরের মানুষের কথা বলে বসিয়ে দিয়েছিলেন।
গত কয়েকবছর ধরে কাশ্মীরের নিরীহ মানুষের উপর যথেচ্ছ নির্যাতন, বিনা কারণে গ্রেপ্তার, অপরাধের সঙ্গে যুক্ত নন এমন মানুষদের হত্যা, ভুয়ো সংঘর্ষে হত্যা করা হচ্ছে। ৩৭০ ধারা বিলোপের পর গণতান্ত্রিক অধিকার আরও সংকুচিত হয়েছে। মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক, গুজরাটের মতো রাজ্যগুলিতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। মুসলিমদের দোকান ও ঘরবাড়ি ভাঙার লক্ষ্যেই মধ্যপ্রদেশের খরগোন বা দিল্লির জাহাঙ্গীর পুরীতে বুলডোজার নামানো হয়েছিল।
পছন্দের জিনিস খাওয়ার উপরও নিষেধাজ্ঞা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে আরোপ হয়েছে। চৈত্রর নবরাত্রিতে দিল্লি পুরসভার মেয়র ও বিজেপি নেতৃত্ব সমস্ত মাংস ও মাছের দোকান বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কারণ ওই সময় হিন্দু ধর্মের মানুষরা নাকি নিরামিষ খান। ‘দ্য প্রাইস অব দ্য মোদি ইয়ার্স’ নামক একটি বই লেখার অপরাধে ভারতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রাক্তন প্রধান আকর প্যাটেলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া বন্ধ করা হয়। গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলিকে দুর্বল করে দেওয়া হচ্ছে।
আইনজীবী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে দমন পীড়ন নামিয়ে আনা হয়েছে। ২০২১ সালের ৩ নভেম্বর দিল্লির আইনজীবী মুকেশ ও আনসার ইন্দোরিয়র বিরুদ্ধে একটি নোটিশ পাঠানো হয়। নোটিশটিতে পশ্চিম আগরতলা থানার তদন্তকারী আধিকারিক এসআই শ্রীকান্ত গুহ’র সই ছিল। গত কয়েকমাস ত্রিপুরা পুলিশের অপরাধ দমন বিভাগের সাইবার অপরাধ দমন শাখা সোশ্যাল মিডিয়াতে সরকার বিরোধী পোস্ট করা হয়েছে বলে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা নথিভুক্ত করেছে।
সংখ্যালঘুদের বিরূদ্ধে ঘৃণা সরকার অনুগত গণমাধ্যমগুলিতে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। মোদির নেতৃত্বে হামলা চলছে হিন্দুত্বের। অতি সম্প্রতি উত্তরাখণ্ডের রুরকিতে তিনটি গ্রামে হনুমান জয়ন্তী শোভাযাত্রায়, মসজিদের সামনে মুসলিম বিরোধী স্লোগান দেওয়া হয়। কী ছিল সেই স্লোগান -“হিন্দুস্তানমে রহেনা হ্যায়, তো জয় শ্রীরাম কহনা হ্যায়” (ভারতে যদি থাকতে চাও, তো রামকে পুজো দাও)। বিভিন্ন রাজ্যে আরএসএস-বিজেপি’র দুষ্কর্মে পুলিশি সহযোগিতাও মিলছে। বিভিন্ন রাজ্যের (কেরালা বাদে) বিভিন্ন ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অস্ত্র বহন করা হচ্ছে ও সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে হুমকি, যথেচ্ছ গালিগালাজ দেওয়া হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে পুলিশ নিশ্চুপ থাকছে।
বিজেপি নামিয়ে এনেছে বুলডোজার রাজ। খতম মানবাধিকার। যোগী আদিত্যনাথ “বুলডোজার বাবা”। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বিজয় মিছিল হিসেবে ভারতবাসী দেখেছে “বুলডোজার মার্চ”। এনকাউন্টার আর বুলডোজার যোগীর হাতিয়ার। বুলডোজার আজ মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকদের যথেচ্ছ গ্রেপ্তার প্রমাণ করছে দেশে গণতন্ত্র নেই। বিজেপি সরকার যে কতটা প্রতিহিংসাপরায়ণ হতে পারে তা প্রমাণ হয়েছে মানবাধিকার কর্মী তিস্তা শীতলবাদ, সাংবাদিক জুবেইর, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক আর বি কুমারের গ্রেপ্তারের মধ্যে দিয়ে। ২০১৮ সালের এক টুইটের অপরাধে সাংবাদিক জুবেইরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৭ জুন মহম্মদ জুবেইরকে দিল্লি পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পিছনে কারণ-১৯৮৩ সালের একটি ছবি ‘কিসিসে না কহনা’র একটি ইমেজ নিয়ে ২০১৮-তে টুইট করা। আরএসএস-র অনেক দিনের টার্গেট ছিলেন জুবেইর।
ত্রিপুরাতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিরুদ্ধে হিংসা ছড়ানো নিয়ে পুলিশের মিথ্যাচারকে উন্মোচিত করার অপরাধে ২০২১ সালে দু’জন সাংবাদিক স্বর্ণ ঝা ও সমৃদ্ধি শাকুনিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। গত বছর ২৪ জন সাংবাদিককে তাদের কাজের জন্য হত্যা করা হয়। বেশ কয়েকজনকে জেলখানায় পাঠানো হয়- সিদ্দিক কাপ্পান, আসিক সুলতান, মানান গুলজার দার, রাজীব শর্মা প্রমুখ।
‘ফ্রি-স্পিচ কালেকটিভ’ সংস্থার প্রতিনিধি গীতা সেসু তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন, ২০২০ সালে ভারতে ৬৭ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং দৈহিক অত্যাচারের মুখে পড়েছিলেন দু’শতাধিক। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের মধ্যে পড়েছেন কাশ্মীরের অনলাইন সংবাদপত্র ‘কাশ্মীর ওয়ালা’র প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক ফাহাদ সাহা। তিনি একমাসের মধ্যে তিনবার গ্রেপ্তার হন (ফেব্রুয়ারি-মার্চ ২০২২)। কোভিড পরিস্থিতিতে গুজরাটে ২০২০ সালে ৫০ জন সংবাদকর্মী আরএসএস’র গুন্ডাদের হাতে আক্রান্ত হয়েছেন। সাংবাদপত্রের স্বাধীনতা সূচকে ভারত ক্রমশ নিচে নেমে চলেছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (RSF) প্রকাশিত সূচকে ভারতের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৫০তম।
বিপজ্জনক দিক হলো, যে সমস্ত সংবাদ মাধ্যম সাম্প্রদায়িক হিংসাতে মদত দেয়, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত মিথ্যা সংবাদ প্রচার করে, ঘৃণা ছড়িয়ে সংখ্যালঘুদের বিপদে ফেলছে তাদের মদত দিচ্ছে মোদি সরকার। গোদি মিডিয়া আরএসএস নেতাদের বিকৃত, বিভেদমূলক, বিদ্বেষমূলক বক্তব্যগুলিকে প্রচারের আলোতে নিয়ে আসছে। উল্টোদিকে যে সাংবাদিকরা সাম্প্রদায়িক ঘৃণা সৃষ্টির বিরুদ্ধে কলম ধরছেন, সরকারের নীতির সমালোচনা করছেন তাদের মাওবাদী, শহুরে নকশাল, পাকিস্তানপন্থী, চীনের চর বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
হিন্দুত্ববাদী শক্তি গত কয়েক বছরে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সংকুচিত করেছে। সংবাদ মাধ্যমের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর দুটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিউজক্লিক ও নিউজলন্ড্রির দপ্তরে হানা দেয় আয়কর দপ্তর। এ ধরনের অসংখ্য উদাহরণ আছে। ২০১৪ সালে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সংবাদমাধ্যমের উপর চাপ বাড়িয়েছে বিজেপি-আরএসএস। ২০১৯ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে পুলিশি হিংসা, হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা আক্রমণ, আধাসামরিক বাহিনীর হয়রানি বেড়েছে। সরকারের অনুগত না হওয়ার জন্য বেশ কিছু চ্যানেল বন্ধে অতি সক্রিয়তা দেখিয়েছে মোদি সরকার। যা হয়েছিল কেরালার মালয়ালাম ভাষায় চ্যানেল মিডিয়া ওয়ানের ক্ষেত্রে।
শাসক বিজেপি-করপোরেট-সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে এক আঁতাত গড়ে উঠেছে। এই আঁতাতের পরিণতিতে সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। বিজ্ঞাপন প্রিয় প্রধানমন্ত্রী প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন সংবাদজগতে বিজ্ঞাপন বাবদ। ২০২১-২২ অর্থবর্ষে ব্যয়িত অর্থের পরিমাণ ১৩ হাজার কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমাণ অর্থের দিকে করপোরেটদের নজর থাকে। ৭০টির বেশি সংবাদ প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিয়ন্ত্রণ করে রিলায়েন্স ইন্ডাস্ট্রিজ গ্রুপ। করপোরেট-শাসক আঁতাতে বিপন্ন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।
কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই-র ভূমিকা প্রশ্ন চিহ্নের মুখে। পশ্চিমবাংলায় বৃহত্তম অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি সারদা চিট ফান্ড নিয়ে তদন্ত কবে শেষ হবে? বিজেপি আমলে সিবিআই কতটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করছে তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। বিজেপি জমানায় সিবিআই, ইডি-কে ব্যবহার করা হচ্ছে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের দমিয়ে রাখার যন্ত্র হিসাবে। সিবিআই’র বিশ্বাসযোগ্যতা তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে।
কয়েকটি উদাহরণ দিলেই বোঝা যায় সিবিআই আসলে বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে আতঙ্কের মধ্যে রাখতে চাইছে। তামিলনাডুর বিধানসভা নির্বাচনের আগে ডিএমকে নেতা স্টালিনের কন্যার বাড়িতে সিবিআই হানা দিয়েছিল। একই ঘটনা ঘটে কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেস নেতা ডি কে শিবকুমার ও তার ভাই সুরেশের বিরুদ্ধে, অখিলেশ সিং-এর বিরুদ্ধে। হয়রানি ও অপদস্থ করাই আজ সিবিআই’র প্রধান কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু কর্ণাটকে ইয়েদুরাপ্পা বা রেড্ডি ভাইদের দুর্নীতির বিষয়ে সিবিআই’র সত্য উদঘাটনে অনাগ্রহ দেখা গেছে। বিপুল দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও রেড্ডি ভাইদের বিরুদ্ধে সিবিআই কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ২০২১ সালের ১৭ অক্টোবর জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক অভিযোগ করে বলেছিলেন - রাজ্যপাল থাকার সময় ৩০০ কোটি টাকার ঘুষের বিনিময়ে দুটো ফাইলে অনুমোদনের প্রস্তাব এসেছিল। এই ফাইল দুটির একটি ছিল অনিল আম্বানির। যদিও তিনি ফাইল দুটিতে অনুমোদন দেন নি। এতবড়ো অভিযোগ করার পরও কোনো সক্রিয়তা ছিল না তদন্তকারী সংস্থাগুলির। আরএসএস’র নির্দেশে বিজেপি রাষ্ট্রের চরিত্রের আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে সরকার পরিচালনা করছে। বিজেপি সরকারের অবস্থান-গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, স্বৈরাচারের পক্ষে।
বিচারবিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি’র বিরুদ্ধে আন্দোলন করার অপরাধে উমর খলিদের বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ এনে বলেছিল, “খলিদ দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার চক্রান্তে যুক্ত”। দিল্লির একটি সেশন কোর্ট খলিদের জামিন নাকচ করে দেয়। কারারুদ্ধ অবস্থাতেই স্ট্যান স্বামী মারা যান। আদালত বারংবার তাঁর জামিনের আবেদন নাকচ করে দেয়। কিন্তু নীরজ বিষ্ণোই ও ওঙ্কারেশ্বর ঠাকুর মুসলিম মহিলাদের অনলাইন ’নিলামের’ উদ্দেশে অ্যাপ তৈরির অভিযোগে অভিযুক্ত হলেও দিল্লির একটি সেশন কোর্ট তাঁদের জামিন মঞ্জুর করে। বিজেপি নেতা ও মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর এবং বিজেপি সাংসদ পরবেশ বর্মা নির্বাচনী ভাষণে “বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করে মারো” বললেও আদালত কার্যত প্ররোচনাকারীদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে। ধারাবাহিকভাবে মুসলিম গণহত্যার প্ররোচনা দিলেও নরসিংহানন্দ জামিন পান, লখিমপুর খেরিতে কৃষকদের গাড়ির চাকায় পিষে মারলেও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর ছেলে জামিন পেয়ে যান।
মোদি শাসিত ভারত চরম বিপদে। যে পরিস্থিতি চলছে তাকে যদি চলতে দেওয়া হয় তাহলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতার যতটুকু অবশিষ্ট আছে তাও থাকবে না। বিজেপি’র সর্বোচ্চ নেতৃত্ব ও বর্তমান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন হিংসার সমর্থনে বক্তব্য রাখেন তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না দেশ কোন্ বিপদের মুখে।
২০১৪ সালে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে একটি সভায় ভাষণে অমিত শাহ বলেছিলেন, “একটা সম্প্রদায় যখন আমাদের ঘরের মেয়ে-বোনেদের শ্লীলতাহানি ঘটায় এবং প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়না, জনগণ তখন দাঙ্গা করতে বাধ্য হয়।” বিজেপি নেতা তেজস্বী সূর্য মুসলিমদের ‘লিক সারানোর লোক’ আর অমিত শাহ ওদের ‘উইপোকা’ (অর্থাৎ পরগাছা) বলে বিদ্রূপ করেন তখন বিপদের গভীরতা সহজেই অনুমান করা যায়। আরএসএস’র মতাদর্শে বহুত্ব ও সহিষ্ণুতা অনুপস্থিত। এটাই ভারতের সামনে বড়ো বিপদ।