E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৯ অক্টোবর, ২০২১ / ১১ কার্ত্তিক, ১৪২৮

জাতীয় পরিস্থিতির নানা দিক আলোচনা করে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি


দেশে প্রতিদিন চড়তে থাকা পেট্রোল-ডিজেল-রান্নার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির জেরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়ায় সাধারণ মানুষ অভূতপূর্ব দুর্দশার সম্মুখীন। এর বিরুদ্ধে সর্বস্তরে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম)। নয়া দিল্লির হরকিষান সিং সুরজিৎ ভবনে ২২ থেকে ২৪ অক্টোবর সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির তিন দিনব্যাপী বৈঠকের পর ২৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দিতে হবে দেশের শহর থেকে গ্রাম, তালুক সর্বত্র। বিবৃতিতে ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জ্ঞাপন, দেশের সম্পদ লুটের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে চলা ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের পাশাপাশি আরও বড়ো বিপর্যয়ের হাত থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে টিকাকরণের গতিবৃদ্ধি এবং জম্মু-কাশ্মীরকে ফের রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেবার দাবিও জানিয়েছে সিপিআই(এম)।

মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে সারা ভারতে প্রতিবাদ

পেট্রোল-ডিজেলের প্রতিদিনের দাম বাড়ানোর প্রভাবে নজিরবিহীন দুর্দশার মুখে পড়েছে দেশবাসী। একই সঙ্গে রান্নার গ্যাসের দামও ভয়ঙ্কর হারে বাড়ানো হয়েছে। পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় খাদ্যপণ্য, সবজি, দুধ সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। তীব্র ভাষায় এই মূল্যবৃদ্ধির নিন্দা করে বিবৃতিতে দেশজুড়ে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, এর জেরে সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতিজনিত প্রভাব পড়েছে দেশের অর্থনীতিতে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা পেট্রোপণ্যের অন্তঃশুল্ক বৃদ্ধির সপক্ষে অযৌক্তিক দাবি জানিয়ে বলেছেন, ওই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে বিনামূল্যে টিকাকরণ এবং মোদি সরকারের রূপায়িত নানা ধরনের সামাজিক প্রকল্পে। এটা হাস্যকর যুক্তি। যদি দেশের মানুষকে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয়, তখন টিকাকরণ পরিষেবা বিনামূল্যে মেলেনা। উলটে মানুষকে এরজন্য মূল্য দিতে হয়েছে। তাহলে টিকাকরণের জন্য ৩৫ হাজার কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দ কোথায় গে‍‌ল? আবার বিভিন্ন কেন্দ্র-পোষিত প্রকল্প এবং ভরতুকি বাবদ ৪ লক্ষ কোটি টাকা বাজেট বরাদ্দই বা কোথায় গেল? এইসব অর্থ গেল কোথায়? আসলে মোদি সরকার নিজেদের বেহিসেবি খরচ সামলাতে মানুষের টাকা লুটে রাজস্ব বাড়াচ্ছে। এ‍‌ই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধেই দেশে সর্বস্তরে শক্তিশালী প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন - কৃষি আইন প্রত্যাহার

তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার এবং ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি স্বীকৃতির দাবিতে কৃষকদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে ফের সেলাম জানিয়েছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি। ভারতে স্বাধীনোত্তরকালে এত দীর্ঘ সময় ধরে চলা আন্দোলন কখনও দেখা যায়নি। এই সংগ্রামকে ধ্বংস করতে সব ধরনের প্ররোচনা এবং হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতৃত্বে কৃষকরা শান্তিপূর্ণভাবে উদাহরণযোগ্যভাবে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই আন্দোলনকে ব্যাহত করতে বিজেপি লখিমপুর খেরির মতো জঘন্য হিংসাত্মক ঘটনা ঘটালেও সফল হতে পারেনি। উলটে এই নৃশংসকাণ্ডের পর মানুষের ক্ষোভ আরও বেড়েছে। এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে অথচ প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁকে মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করেননি। বরখাস্তের দাবিকে উপেক্ষা করাই প্রমাণ করে ওই বর্বরতার সমান ভাগিদারী মনোভাব। মন্ত্রীর ছেলে এবং অন্য অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলায় ঢিলেমির জন্য সুপ্রিম কোর্টে তিরস্কৃত হয়েছে উত্তর প্রদেশ সরকার। অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গেই বিচার হওয়া দরকার।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কৃষকদের লড়াইয়ের প্রতি যেভাবে সর্বস্তরে বিশেষত সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এবং খেতমজুররা সংহতি জানিয়েছে তাতে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের কৃষকদের ন্যায্য দাবির পক্ষে সমর্থনের মাত্রা কতটা ব্যাপক?

আগামী ২৬ নভেম্বর কৃষক আন্দোলনের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে সংযুক্ত কিষান মোর্চা এবং কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যাবতীয় লড়াই-প্রতিবাদ কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সংহতি ও সমর্থন জানিয়েছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি। পার্টির সমস্ত শাখাকে এই প্রতিবাদ কর্মসূচির প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানানোর আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম)।

দেশের সম্পদ লুট

বেপরোয়াভাবে দেশের সমস্ত সম্পদের সার্বিক লুট এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের বেসরকারিকরণ চলছে। ন্যাশনাল মানিটাইজেশনের নামে দেশের পরিকাঠামোগত সম্পদ ও যন্ত্রপাতি বেসরকারি কর্পোরেটদের হাতে কার্যত জলের দরে তুলে দেওয়া হচ্ছে। তার সাম্প্রতিকতমটি হলো টাটাদের হাতে কার্যত বিনা পয়সায় উপহার হিসাবে তুলে দেওয়া হলো এয়ার ইন্ডিয়াকে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ আইন সংশোধনের প্রক্রিয়াতেও এগিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এই বিধ্বংসী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সারা দেশেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবাদ আন্দোলন চালাচ্ছে ট্রেড ইউনিয়নগুলি। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও ফেডারেশনগুলি ইতিমধ্যে এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। দেশের শ্রমজীবী জনগণের লড়াই-সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটি।

কোভিড মহামারী

কোভিড মহামারী প্রতিরোধ এবং সর্বজনীন টিকাকরণের ত্রুটি এবং ব্যর্থতা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতেই ১০০ কোটি টিকাকরণ নিয়ে এমন মহা উদযাপনের আয়োজন করেছিল মোদি সরকার। গলাবাজি করে ওই লক্ষ্যমাত্রা পূরণের শ্লাঘাপূর্ণ দাবি করলেও বুঝতে হবে যে দেশে মাত্র ২১ শতাংশের পূর্ণ টিকাকরণ হয়েছে। ডিসেম্বরের শেষেই প্রাপ্তবয়স্কদের টিকাকরণ পূর্ণ হয়ে যাবে বলার পর মোদি সরকার তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসে এখন সেই লক্ষ্যমাত্রা সংশোধিত করে সরকারের তরফে ৬০ শতাংশ পূর্ণ হবে বলা হচ্ছে। এমনকি সেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ অসম্ভব যদি না প্রতিদিন ১.৫ কোটি হারে টিকা দেওয়া যায়। টিকাকরণের হার উলটে কমছে, যা এখন প্রতিদিন ৪০ লক্ষেরও কম। এখন আবার নতুন করে কোভিডের প্রকোপ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রতিদিন প্রায় ১৬ হাজার সংক্রমণ ধরা পড়ছে। এটা আশঙ্কাজনক। প্রতিদিন সাড়ে ছ’শোরও বেশি মৃত্যু হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় কমিটি একারণেই টিকাকরণের হার বাড়া‍‌নোর দাবি জানিয়েছে, যাতে দেশবাসীকে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত আরও ভয়ঙ্কর কোনো দুর্দশার মুখোমুখি না হতে হয়।

জম্মু-কাশ্মীর

ব্যাপক সামরিক বলয় তৈরি করে এবং কয়েকশো মানুষকে আটক করার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘুরে এলেন জম্মু-কাশ্মীর। তিনি জোর গলায় দাবি করলেন ৩৭০ ধারা লোপ এবং জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার পর পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

অথচ সাম্প্রতিককালে বে‍ছে বেছে সাধারণ নাগরিকদের হত্যার ঘটনা গত শতাব্দীর নয়ের দশকের সমান্তরাল পরিস্থিতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার।

মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাজ‍‌নৈতিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে এই সন্ত্রাসবাদী হিংসার উত্থানকে প্রতিরোধ করা অসম্ভব।

কেন্দ্রীয় কমিটি একারণে জম্মু-কাশ্মীরকে অবিলম্বে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া, সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ প্রত্যাহার এবং বিশেষত যুব সম্প্রদায় সহ অন্যান্যদের বেপরোয়া গ্রেপ্তার বন্ধের দাবি জানিয়েছে। একইভাবে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা লোপের সাংবিধানিক বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সিপিআই(এম) সহ বিভিন্ন সংগঠনের দাখিল করা পিটিশন সুপ্রিম কোর্টকে বিবেচনার মধ্যে আনার আরজিও জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি।

বিদ্যুতের মূল্যে নিয়ন্ত্রণ

বেসরকারি কর্পোরেট চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন সংস্থাগুলি আমদানিকৃত কয়লার মূল্যের দায়ভার সম্পূর্ণভাবে চাপিয়ে দিচ্ছে গ্রাহকদের ওপর। আন্তর্জাতিকস্তরে কয়লার দামবৃদ্ধির অজুহাতে বিদ্যুতের ইউনিট পিছু মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। অথচ দেশে কয়লা মজুতের ঘাটতি পড়েনি। মোদি সরকারের বেসরকারিকরণ, বিনিয়ন্ত্রণ নীতি এবং বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের পরিচালন অব্যবস্থার জন্যই এই সংকট তৈরি হয়েছে। যার ফলে মারাত্মক বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যাতে লোডশেডিং না হয় সেটা সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হবে মোদি সরকারকে। কারণ একেই দুর্দশায় থাকা মানুষ যাতে আর কোনো সংকটের মধ্যে না পড়েন। একইভাবে এর ক্ষতিকর প্রভাব যেন না প‍‌ড়ে অর্থনৈতিক কাজকর্মে।

কেন্দ্রীয় সরকারকে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ এবং জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি।

জাতভিত্তিক জনগণনা

২০২১ সালের জনগণনার সঙ্গে জাতভিত্তিক জনগণনার দাবি জানিয়েছে কেন্দ্রীয় কমিটি।

সঠিকভাবে জাতভিত্তিক জনগণনা করার জন্য সংসদ যাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা সুনিশ্চিত করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকেই।

সিপিআই(এম)-র ২৩তম পার্টি কংগ্রেস

কেরালার কান্নুরে আগামী বছর এপ্রিলের পার্টি কংগ্রেসে যে খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব পেশ করা হবে তার রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে কেন্দ্রীয় কমি‍টিতে। পার্টি কংগ্রেসে পেশ করার আগে কেন্দ্রীয় কমিটির অনু‍‌মোদন এবং চূড়ান্ত করার জন্য সেই খসড়া তৈরি করবে পলিট ব্যুরো।