৫৯ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৯ অক্টোবর, ২০২১ / ১১ কার্ত্তিক, ১৪২৮
সরকারের দায়িত্বহীনতায় রাজ্যে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা
আংশিকভাবে হলেও খুলছে স্কুল, দরকার কঠোর সতর্কতা
মেদিনীপুর শহরে কনটেনমেন্ট এলাকায় নজরদারি।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ শারদ উৎসব শেষ হবার এক সপ্তাহ পেরোতে না পেরোতেই রাজ্যে করোনা সংক্রমণ মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। উৎসবকে ঘিরে রাজ্য সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপের মাশুল গুনছেন রাজ্যবাসী। দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। করোনা নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা চেপে বা আক্রান্তের সংখ্যা দিনের হিসেবে কম দেখালেও বিশেষজ্ঞদের মতে সংক্রমণ ছড়াচ্ছে মারাত্মকভাবে। প্রকৃত তথ্য সামনে আসছে না। এই পরিস্থিতিতে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য স্কুল খোলার নির্দেশ জারি করেছে সরকার। শিক্ষামহলের বক্তব্য, পরিকাঠামো শুধরে সংক্রমণ থেকে দূরে রাখার যাবতীয় প্রশাসনিক উদ্যোগ নিতে হবে। দাবি উঠেছে পূর্ণাঙ্গ রেল পরিষেবা চালুর অনুমতি দিতে হবে।
শারদ উৎসবের সূচনায় মানুষ মুখ্যমন্ত্রীকে দেখেছেন বিভিন্ন পুজোর উদ্বোধন করতে, দেখেছেন মানুষকে উৎসবে শামিল হতে উৎসাহ দিতে। তার ফল ফলছে হাতেনাতে। রাজ্যের বিভিন্ন মন্ত্রী যে সমস্ত পুজো কমিটির মাথায় আছেন তাঁরাও স্বাস্থ্যবিধি শিকেয় তুলে মেতে উঠেছেন উৎসবে। ভিড় বেড়েছে প্যান্ডেল এবং উৎসব প্রাঙ্গণে। তার জেরেও করোনা সংক্রমণ নীরবে দ্রুত ছড়িয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এমনটাই। করোনা সংক্রমণ এবং রোগীদের বেহাল দশার পুরনো চিত্রই আবার ফিরে আসার আশঙ্কা চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের মতো এবারও বহু তথ্য চেপে দিয়েও পরিস্থিতির বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে পারছে না প্রশাসন।
অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টরস-এর সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মানস গুমটার বক্তব্য, এটা পরিষ্কার ‘ম্যানমেড’ পরিস্থিতি। ক্লাবগুলোকে উৎসাহ দিয়ে বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে সরকারই এতে উৎসাহ ও মদত দিল, তাই তৃতীয় ওয়েভ এলে তার দায় মুখ্যমন্ত্রীকে নিতেই হবে। চিকিৎসকদের এতো আবেদন সত্ত্বেও বিপদ ডেকে আনল সরকার ও প্রশাসনই। সাধারণ মানুষের কিছুটা উদাসীনতা অবশ্যই ছিল। ফলে আগামীদিনে বিপর্যয় ভয়ংকরভাবে বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছি আমরা। পরিস্থিতি আবার হাতের বাইরে না চলে যায়-এটা দেখতে হবে।
উৎসব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঊর্ধ্বগতিতে ছুটছে সংক্রমণের লেখচিত্র। প্রায় আড়াই মাস পরে পজিটিভিটি রেট ছুঁয়েছে তিন শতাংশ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের শেষ পর্যায়ে গত ২৯ জুন পজিটিভিটি তিন শতাংশ হয়েছিল। তারপর থেকে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী কমছিল প্রকোপ। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে, ২৩ হাজার নমুনা পরীক্ষাতেই পজিটিভিটি রেট ৩ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। উৎসবের সময় প্রশাসনের উদাসীনতা, গাফিলতি ও বিধি-নিষেধ শিথিলতার ফল ফলছে হাতেনাতে।
এই মুহূর্তে কলকাতা, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনায় সংক্রমণের তীব্রতা বেশি। আবার রাজ্যে বহু মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েও উপসর্গহীন অবস্থায় রয়েছেন, যার ফলে করোনা আরও ছড়াচ্ছে। হাওড়া, হুগলি, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, পূর্ব বর্ধমান থেকে ঝাড়গ্রাম, পুরুলিয়া, নদীয়া, জলপাইগুড়ি, কালিম্পঙ জেলাগুলিতে করোনা সংক্রমণ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতেও পজিটিভিটি রেট বেড়েছে। বেড়েছে হোম আইসোলেশন-এর চিকিৎসাধীন থাকা মানুষের সংখ্যা। সেফ হোমেও বেড়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। রাজ্য মাইক্রো কনটেনমেন্ট জোন বেঁধে দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করলেও ফল হচ্ছে কমই। চিকিৎসকরা বলছেন পুলিশ ও পৌরসভাগুলি থেকে বড়ো বড়ো হোর্ডিং লাগিয়ে ঠেকানো যাবে না সংক্রমণের ভয়াবহতাকে। রাজ্য সরকারের উদাসীনতা প্রমাণ করেছে যে, হাল ছেড়ে দিয়েছে সরকার। আবার স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে অক্সিজেনযুক্ত বেড, ভেন্টিলেটর, অ্যাম্বুলেন্স, ওষুধপত্র পর্যাপ্ত নেই - এটা রাজ্যের মানুষের পূর্ব অভিজ্ঞতা।
নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজারের কাছাকাছি হওয়া প্রয়োজন সেখানে এখন তা থমকে আছে কুড়ি থেকে পঁচিশ হাজারের মধ্যে। স্বাস্থ্য দপ্তর সুত্রে জানা যাচ্ছে এমনটাই। সংকটজনক রোগী হাসপাতালে গেলে নানা জটিল প্রক্রিয়ার কারণে সময়মতো মিলছেনা চিকিৎসা, শুধু সরকারি ঘোষণাই সার।
এদিকে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ও শিক্ষক সংগঠনগুলির আন্দোলনের চাপে কুড়ি মাস বন্ধ থাকার পর ১৬ নভেম্বর থেকে নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশে ক্লাস শুরু হতে চলেছে। দীর্ঘদিন ক্লাস রুম বন্ধ থাকার কারণে স্কুলগুলির পরিকাঠামো অনেকটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আগাছা, জঞ্জাল পরিষ্কার করে যথাযথ স্যানিটাইজ করার প্রয়োজন যেমন রয়েছে, তেমনি ধারাবাহিকতার অভাবে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে স্বাভাবিক কারণেই শিক্ষণ মানসিকতা তথা সামগ্রিক শৃঙ্খলার কিছু ঘাটতি বা অবনতি ঘটেছে। স্কুল খোলার আগে সেই সকল ঘাটতি পূরণ করে তবেই স্কুল খোলার উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করছে শিক্ষক সংগঠনগুলি। ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করার জন্য বছরভর ব্যবস্থা রাখা জরুরি বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। প্রতিদিন স্যানিটাইজ করার নির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিতে হবে। পঠনপাঠন চলাকালীন কোনো ছাত্র বা ছাত্রী অসুস্থ বোধ করলে তাকে দ্রুত চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়ার জন্য স্কুলগুলির সঙ্গে স্থানীয় প্রশাসনের নিবিড় যোগসূত্র বজায় রাখার উদ্যোগ রাখার ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে করতে হবে বলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। অন্যদিকে শিক্ষকদের বক্তব্য, স্কুলে বিভিন্ন শ্রেণির পঠনপাঠন ও কোনো শ্রেণির একাধিক বিভাগের সময়কাল, স্কুলবাড়ির বিভিন্ন ঘরে পড়ুয়াদের বসার ব্যবস্থা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা এবং নিয়মিত মিড ডে মিল চালু করা দরকার। নিয়মিত পঠনপাঠন চলার সময়ে প্রতিটি স্কুলে কোভিড বিধি যথাযথভাবে মেনে চলা হচ্ছে কি না তা কর্তৃপক্ষের নজরদারির আওতায় আনা একান্ত দরকার। নিখিল বঙ্গ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সুকুমার পাইন জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যবিধি রক্ষা করার পাশাপাশি নিয়মিত পঠনপাঠনের জন্য সরকারকে বেশকিছু জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। বিভিন্ন বিদ্যালয়ের বিভিন্ন শ্রেণিতে পাঠ্যবইয়ের ঘাটতি রয়েছে। তার হিসাব শিক্ষা দপ্তরের কাছে রয়েছে। সেই ঘাটতি পূরণ সরকারকে করতে হবে। প্রয়োজনে প্রতিটি ক্লাসের সিলেবাস যুক্তিনিষ্ঠভাবে কমানো দরকার। সুষ্ঠ পঠনপাঠনের স্বার্থে বর্তমান শিক্ষাবর্ষকে অন্তত দু’মাস বাড়ানো দরকার।
অন্যদিকে সর্বস্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কুল খোলার দাবি ক্রমশ জোরালো হচ্ছে। জোরালো হচ্ছে মিড ডে মিলে ছাঁটাই রদ করারও। বিধানসভা নির্বাচনের কারণে ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল, মে - টানা এই চার মাস মিড ডে মিলের খাদ্যসামগ্রী বাড়িয়ে রেখেছিল তৃণমূলের সরকার। ভোট মিটতেই কমিয়ে দেওয়া হয়েছে মিড ডে মিলের খাদ্যসামগ্রী। ভোটের আগের চার মাসের পর মিড ডে মিলের বরাদ্দ ২৫ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। মিড ডে মিলের খাদ্য সামগ্রী থেকে আগেই বাদ গিয়েছিল সোয়াবিন বড়ি। চলতি মাসে খাদ্যসামগ্রী থেকে ছোলাও বাদ দেওয়া হলো। প্রাথমিকে এক পড়ুয়ার যেখানে মাসে ৯৮ টাকা ৫৬ পয়সা এবং উচ্চ প্রাথমিকে ১৪৮ টাকা ৬২ পয়সার খাদ্যসামগ্রী পাওয়ার কথা সেখানে চলতি মাসে মাত্র ৭৮ টাকার খাদ্যসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে।
মিড ডে মিলে বরাদ্দ কম করে দেওয়ার ব্যাপারে এবিটিএ’র রাজ্য সভাপতি কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, ...কয়েক কোটি টাকা বেঁচে যাচ্ছে মিড ডে মিল থেকে। সেই টাকা সরকার কোথায় খরচ করছে? মিড ডে মিল-এর বাঁচানো টাকা নিয়ে কি পুজো কমিটিকে দেওয়া হচ্ছে? এই লকডাউনের মধ্যে এমনিতে মানুষের রোজগার কমে গেছে। লক্ষ লক্ষ গরিব পরিবারের ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছে না। এই সময় সরকারের উচিত ছিল মিড ডে মিল-এর খাদ্যসামগ্রী আরও বেশি করে দেওয়া। তা না করে কোন্ আক্কেলে খাদ্যসামগ্রী কমানো হলো! রাজ্য সম্পাদক মোহনদাস পণ্ডিত জানান, মিড ডে মিলের টাকা কমিয়ে দেওয়া মানে স্কুল পড়ুয়ার সঠিক পুষ্টি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়া। পড়ুয়াদের পুষ্টির সঙ্গে আপস করা হচ্ছে।
স্কুল খুললেও রেল চালু হওয়ার ক্ষেত্রে এখনো সবুজ সঙ্কেত দেয়নি রাজ্য সরকার। অভিভাবকদের প্রশ্ন লোকাল ট্রেন চলবে কবে। রেল দফতরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে রাজ্য বললেই তারা দ্রুত লোকাল ট্রেন পরিষেবা চালু করতে পারবেন। বহুদিন ধরেই রেল পুরোদমে চালু করার দাবি উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। বহু পড়ুয়া ও শিক্ষকদের যাতায়াতের ক্ষেত্রে মূল যানবাহন লোকাল ট্রেন। লোকাল ট্রেন না চালালে স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হলে সমস্যায় পড়বেন পড়ুয়া থেকে শিক্ষক-শিক্ষিকারা। স্কুল খোলার ঘোষণা হলেও কলকাতা সহ জেলাগুলিতে অপ্রতুল যানবাহন। সরকারি নানা বিধি নিষেধ এবং পেট্রোপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে পরিবহণ ব্যবস্থার ওপর। রুটি-রুজি সহ নানা প্রয়োজনে পথে বেরনো সাধারণ মানুষ নাকাল হচ্ছেন প্রতিদিন যানবাহন না পেয়ে। রেল সহ পরিবহণ ব্যবস্থা নিয়মিতকরণে রাজ্য সরকারের পদক্ষেপ করা তাই অবিলম্বে দরকার।