E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৯ অক্টোবর, ২০২১ / ১১ কার্ত্তিক, ১৪২৮

উত্তরবঙ্গ জুড়ে শিশুমৃত্যু অব্যাহত

সফরে গিয়েও মুখ্যমন্ত্রী তার খোঁজ নিলেন না, যোগ দিলেন বিজয়া সম্মেলনীতে

সন্দীপন দত্ত


জলপাইগুড়ি হাসপাতালে অসুস্থ শিশুদের নিয়ে মায়েরা।

উত্তরবঙ্গ জুড়ে শিশুদের মৃত্যু মিছিল। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু হচ্ছে একের পর এক শিশুর। খালি হচ্ছে রাজ্যের উত্তর প্রান্তের বহু মায়ের কোল। তবুও নিরুত্তাপ রাজ্য সরকার। নিরুত্তাপ রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তর। যে দপ্তরের মন্ত্রী আমাদের রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং।

মুখ্যমন্ত্রী অতি সম্প্রতি উত্তরবঙ্গ সফর করেছেন। শিলিগুড়ি বাঘাযতীন পার্কে বিজয়া সম্মেলনী করে উত্তরকন্যায় আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি জেলার প্রশাসনিক বৈঠক সেরে কার্শিয়াঙ টাউন হলে প্রশাসনিক বৈঠক করেছেন দার্জিলিঙ ও কালিম্পঙ জেলার আধিকারিক ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে। বৈঠক শেষে কালিম্পঙ সার্কিট হাউসে থেকে শিলিগুড়ি হয়ে উড়ে এসেছেন কলকাতায়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, পাঁচ দিনের উত্তরবঙ্গ-পাহাড় সফরে শিশুমৃত্যু নিয়ে একটিও শব্দ খরচ করেননি মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি।

তবে উত্তরকন্যায় আলিপুরদুয়ার ও জলপাইগুড়ি জেলার প্রশাসনিক বৈঠক চলাকালীন রাজ্যের কয়েকটি সংবাদপত্রকে আক্রমণ করে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতে শোনা গিয়েছে, ‘‘এখানে শিশুমৃত্যু নিয়ে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল কয়েকটি সংবাদপত্র। অজানা জ্বর বলে নানারকমভাবে প্যানিক তৈরি করা হয়েছিল। এটা কোনো কাগজের কাজ নয়। আমি রিকোয়েস্ট করব প্লিজ ডোন্ট ক্রিয়েট এনি প্যানিক। একদিনের জন্য কাগজের বিক্রি বাড়ানোর জন্য করতে পারেন, কিন্তু এটা ঠিক নয়। এটা সমাজের জন্য অবক্ষয়।’’

মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফর চলাকালীন শিশুমৃত্যু অব্যাহত থেকেছে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। প্রায় এক মাসের বেশি সময় ধরে উত্তরবঙ্গ জুড়ে বাচ্চারা প্রবল জ্বরের সাথে শ্বাসকষ্টের সমস্যায় ভুগছে। বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও চিকিৎসাধীন শিশুর সংখ্যা বাড়ছে। এই সময়কালে এআরআই অর্থাৎ ‘অ্যাকিউট রেসপিরেটোরি ইনফেকশন’ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে অনেক শিশুর। মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, অধিকাংশ শিশুই মারা যাচ্ছে বিভিন্ন রোগজনিত সমস্যার কারণে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিশুরই জন্মের সময় কম ওজন ও নানা সমস্যা থাকার কারণে মৃত্যু হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই মায়েদের অপুষ্টির কারণে শিশুরা জন্মের সময় থেকেই নানান অসুখে ভুগছে। তবে এআরআই’র কারণেও বেশকিছু শিশুমৃত্যু ঘটেছে, দাবি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের। যদিও বিভিন্ন মহল উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের এই যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের দাবি, ডেঙ্গু এবং কোভিডের মতো শিশুমৃত্যু নিয়েও তথ্য গোপন করছে স্বাস্থ্য দপ্তর। শিশুমৃত্যু নিয়ে সঠিক তথ্য সামনে আনা হচ্ছে না।

দু’মাস আগেই মুখ্যমন্ত্রীর দার্জিলিঙ সফরের সূচি তৈরি হয়। কিন্তু ভবানীপুর উপ নির্বাচন ঘোষণা হওয়ায় তা বাতিল হয় পরে। মুখ্যমন্ত্রীর পাহাড় সফরের উদ্দেশ্য ছিল প্রবল বর্ষণ ও ধসে বিধ্বস্ত পাহাড়ের পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখা। যদিও প্রবল বর্ষণের ফলে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার জেলাতেও বিপুল পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে। সেই সমস্ত এলাকা অবশ্য তিনি পরিদর্শন করেননি। কোচবিহার জেলায় উপ নির্বাচন চললেও জলপাইগুড়ি জেলায় অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর যাবার ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাধা ছিল না।

২৪ অক্টোবর শিলিগুড়িতে পৌঁছানোর পর মুখ্যমন্ত্রী যোগদান করেন বাঘাযতীন পার্কে রাজ্য সরকার আয়োজিত বিজয়া সম্মেলনীতে। এদিনের অনুষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ক্যাটাগোরিতে ‘বিশ্ব বাংলা শারদ সম্মান’ দেওয়া হয় ৫৯টি সংগঠনকে। রাজ্যবাসীকে তাঁর নিজের লেখা বিভিন্ন বই পড়ার উপদেশ দেন। উত্তরবঙ্গবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার কথাও বলেন মুখ্যমন্ত্রী।

অথচ এই উত্তরবঙ্গেই গত প্রায় দু’মাস ধরে বহু মায়ের কোল খালি হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে শতাধিক শিশুর। শারদোৎসবেও অব্যাহত ছিল শিশুমৃত্যু। শারদোৎসবের পাঁচদিনে শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালেই ১৫টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে লাফিয়ে বাড়ছে জ্বর ও শ্বাসকষ্টের সমস্যায় আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা। উত্তরবঙ্গের অন্যান্য সরকারি হাসপাতালগুলোতেও একই চিত্র ধরা পড়ছে। একই উপসর্গ নিয়ে নার্সিংহোমগুলোতেও ভরতি হচ্ছে অনেক শিশু। তবুও হুঁশ নেই স্বাস্থ্য দপ্তরের। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন শিশুমৃত্যু ঘটছে। অথচ মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, মায়েদের অপুষ্টির জন্য কম ওজনের বাচ্চা জন্মাচ্ছে। অপুষ্টি, কম ওজন সহ নানান শারীরিক সমস্যার কারণেই মৃত্যু হচ্ছে একের পর এক শিশুর। বিভিন্ন মহলের দাবি, দায় এড়াতেই এই ধরনের মন্তব্য করছে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য দপ্তরের একটি বিশেষজ্ঞ দল উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। কিন্তু এর মধ্যেই বেশ কয়েকটি শিশুর মৃত্যু হয় জ্বর ও শ্বাসকষ্টের সমস্যায়। এই উপসর্গ নিয়ে বাইরে থেকে রেফার হয়ে আসা এক শিশুকে চিকিৎসা করে ছেড়ে দেওয়ার পর মেডিক্যাল কলেজ চত্বরেই মৃত্যু হয়। এই ঘটনা নিয়ে হইচই শুরু হলেও স্বাস্থ্য দপ্তর ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল নিজেদের দায় এড়িয়ে যায়। নানা মহল থেকে দাবি উঠছে শিশুমৃত্যু ও শিশুদের অসুস্থ সংক্রান্ত পরিসংখ্যান গোপন করছে মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ। শিশুমৃত্যু নিয়ে একটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হলেও মুখে কুলুপ এঁটেছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কর্তারা। শিশুমৃত্যু নিয়ে দার্জিলিঙ জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের কোনো প্রতিক্রিয়া প্রথম থেকেই পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় গোটা উত্তরবঙ্গ জুড়ে এক ভয়ঙ্কর উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই অবস্থার মোকাবিলায় প্রশাসন, বিশেষকরে স্বাস্থ্যবিভাগের অপদার্থতায় সংকট ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে।