৫৯ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৯ অক্টোবর, ২০২১ / ১১ কার্ত্তিক, ১৪২৮
পাঠক্রমে ‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ - প্রতিরোধের অপেক্ষায়
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
দেশজুড়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি চলছে। ব্যাংক, এলআইসি, রেল, বিমানবন্দর, টেলিফোন কোম্পানি বিএসএনএল, নানান লাভজনক সরকারি সংস্থা বেচে দেওয়ার খবর আসছে। নতুন চাকরির সন্ধান নেই, পুরনো চাকরিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় সব মিডিয়াহাউস কোনো না কোনো সরকারের হাতের মুঠোয়। তাই সংবাদমাধ্যমের পাতায় নাচ-গান, অশালীন আর অলীক কাহিনির ছড়াছড়ি। সরকার একসাথে ৫/১০টা নয়, ১০০টা প্ল্যান নিয়ে মাঠে নেমেছে। প্ল্যান-১ নিয়ে চাপের মুখে পড়লে প্ল্যান-২/.../১০০টা হাজির করা হচ্ছে। কোন্টা নিয়ে মানুষ মাথা ঘামাবে? যেভাবে দেশজুড়ে সম্পত্তি বেচাবেচি শুরু হয়েছে, নতুন কর্মসংস্থানের আকাল দেখা দিচ্ছে, কথা বললে ‘পেগাসাস’এর আতঙ্ক, পাশের দেশের মৌলবাদী রাজনৈতিক কার্যকলাপের সূত্র ধরে এপারেও বাজার গরম করার চোরাগোপ্তা প্রচেষ্টা, এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের দাবিগুলো নিষ্পত্তি করার বিষয়ে সরকারের হিমশীতল নীরবতা, ‘ভোটে হারলেও সরকার, জিতলেও সরকার’ গঠনের ‘মাদারি কা খেল’ ২/৩ টি রাজ্যে, এশিয়ার সবথেকে ক্ষুধার্থ দেশের তকমা, শিশু মৃত্যতেও শীর্ষে থেকে গিয়েও লজ্জাহীনতা, ...এরকম হাজার একটা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে মানুষ চলেছে।
এমনি একটা প্রেক্ষাপটে দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ নিয়ে পাঠক্রম চালু করে দিয়েছে। ইউজিসি’র মাধ্যমে সরকার জানিয়ে দিয়েছে ‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ নিয়ে পাঠক্রম চালু করলে কী কী সুবিধা মিলবে সেই বার্তা। ‘একটা কিনলে একটা ফ্রি’-র মতো ব্যাপার আর কি! এই শতকের গোড়াতেও আমরা দেখেছি একই মনোভাবের সরকারের একই রকমের উদ্যোগ। তাই ২০২১-তে এই পাঠক্রম চালু করাটা শুধু সময়ের অপেক্ষা ছিল।
জ্যোতিষশাস্ত্র চিরকালই শাসকের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। যখনই সমাজে বেকারি, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, স্বাস্থ্যহীনতা ভরে গিয়ে মানুষের ক্ষোভ ফেটে পড়ার উপক্রম হয়, তখন মানুষকে বশে রাখতে নানান অস্ত্র ব্যবহার করা হয়। শাসক মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভয় দেখায়, আবার কখনো কখনো কৌশল করে মানুষের চিন্তা চেতনার জগৎটাকেই এমনভাবে গড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়, যাতে মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে যাওয়া যায় যে, তার সব দুঃখ দুর্দশার জন্য দায়ী মানুষের ভাগ্য। শাসক সবকালেই চেয়েছে মানুষ যাতে লড়াই করতে ভুলে যায়। মানুষ যত কম জানবে ততো শাসকের সুবিধা, কারণ অজ্ঞানতা থেকেই মানুষের মধ্যে জন্ম নেয় কুসংস্কার, ভাগ্যের উপর বিশ্বাস, ভাগ্যের উপর নির্ভরতা। সমাজে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, আত্মসর্বস্বতা, লোভ উত্তরোত্তর বাড়ছে। পরিত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছেন জ্যোতিষী তার পসরা নিয়ে। যে সমাজ ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তা যত বেশি , সেই সমাজ ব্যবস্থায় জ্যোতিষীর ওপর নির্ভরতা তত বেশি।
তবে শাসকের চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে উঠে চিরকালই একদল মানুষ লড়াই করতে করতেই তার শত্রু মিত্র চিনেছে, ভালো-মন্দ বুঝতে শিখেছে, বাঁচতে শিখেছে, বাঁচাতে শিখেছে, লড়াই করার কৌশল শিখেছে, হারতে শিখেছে, জিততে শিখেছে। কিছু মানুষ কোনোকালেই শাসকের ছলা-কলায় আস্থা রাখেন নি। তারা নিজেদের শক্তির ওপর, যুক্তির উপর, বুদ্ধির উপর ভরসা রেখে লড়াইটা চালিয়ে গেছেন। এর জন্য তাঁদের উপর শারীরিক-মানসিক সব ধরনের আক্রমণ হয়েছে। তাদের সামাজিক বয়কট করে সমাজ বিচ্ছিন্ন পর্যন্ত হয়েছে, চরিত্রে কালিমা লেপন তো আকছার করেছে, এমনকি মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে । তাও ব্যাতিক্রমী মানুষদের, ব্যতিক্রমী সংগঠনদের থামানো যায়নি। তারা মাথা নত করেছেন শুধুমাত্র যুক্তির কাছে, ন্যায়-নীতির কাছে, বিজ্ঞানের কাছে। কোনো শাসক কোনো প্রলোভন দেখিয়ে তাদের দমিয়ে রাখতে পারেনি।
গুটিকয়েক মানুষ চাইলেই সমাজ থেকে জ্যোতিষ-নির্ভরতা উঠে যাবে না। এর বিরুদ্ধে লড়াইকে সমাজের সার্বিক প্রেক্ষাপটকে মাথায় রেখেই করতে হবে। দৈনন্দিন জীবনে নানান না পাওয়া যত দিন যাবে তত বাড়বে। কারণ দেশের সরকার পিরামিডের উপরদিকে যারা আছে, শুধু তাদের স্বার্থের কথাই ভেবে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই পিরামিডের নিচের দিকে থাকা অধিকাংশ মানুষের জীবনে না পাওয়া, অসহায়তা, অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ বাড়বে। দেশে বেকারি দারিদ্র্য অশিক্ষা বঞ্চনা শোষণ বেড়েই চলবে।
মানুষের মধ্যে বাড়তে থাকা ক্ষোভ যাতে সংগঠিত রূপ না নিতে পারে সেই কারণেই শাসকের হাতে অন্যতম প্রধান অস্ত্র হলো যেমন বন্দুক, তেমনি পাশাপাশি অশিক্ষা-কুশিক্ষা, কুসংস্কার, জ্যোতিষশাস্ত্রকে প্রশ্রয় দেওয়াটাও একটা অস্ত্র। সমাজের মাতব্বররা এমন অস্ত্র প্রয়োগ করতে চাইছে যাতে সহজে বন্দুকের দরকার না পরে। তাই তারা মানুষের চিন্তা চেতনার জগৎকে তাদের নিজেদের মতো করে ছাঁচে ঢেলে নিতে চাইছে, যাতে করে মানুষ তার সমস্ত দুঃখ দুর্দশার কারণ হিসেবে নিজের মন্দভাগ্যকেই দায়ী করে অথবা মনে করে কোনো অতিন্দ্রীয় শক্তির ইচ্ছাতেই অথবা পূর্ব জন্মের কোনো পাপের ফসল হিসাবে ঘটছে। মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে যে, কপাল খারাপ বলেই তোমার জীবনে খারাপ কিছু ঘটছে। এই বিশ্বাস যদি মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া যায় তাহলে সমাজের শাসকেরা যে ব্যবস্থা চালু রেখেছে তা হয়ে পড়বে বাধাহীন, স্বচ্ছন্দ গতির, আর দীর্ঘস্থায়ী।
তবে সরকারের সম্পর্কে যে যাই বলুন, একটি বিষয়ে সরকারের দূরদর্শিতার প্রশংসা না করে পারছি না। কারণ মানুষের মধ্যে ‘গণ-হতাশা’ যে আগ্রাসী আকারে আসতে চলেছে সেটা তারা আগাম বুঝতে পেরেছে। তাই ‘গণ-হতাশা’ নিরসন করতে ‘ভূতে ধরলে ওঝার ব্যবস্থা’ করার মতো অন্ধকারের পথে বন্ধু খুঁজে নেবার ব্যবস্থা করছেন হয়ত ‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ নিয়ে পাঠক্রম চালু করে। দুঃখের কথা এটাই জ্যোতিষশাস্ত্র সম্পূর্ণরূপে অবৈজ্ঞানিক এটা বারেবারে প্রমাণিত হয়ে যাবার পরও রাষ্ট্রের উদ্যোগে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে কোর্স খুলছে। এটা কুসংস্কার, ওটা অন্ধ বিশ্বাস, সেটা অবৈজ্ঞানিক বলে শুধু চিৎকার করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু নেতিবাচক কথায় মানুষ সাড়া নাও দিতে পারে। শুধু বর্জনের কথা বলব কিন্তু অর্জনের কথা বলব না - এমন হলে কোনো কাজই শেষ পর্যন্ত হবার কথা নয়। এই কারণেই বিকল্পের কথা বলতে হয়। সমাজের আগাপাশতলা অস্থিরতা, বিষণ্ণতা আর অভাববোধের সাথে লড়াই করতে করতে ক্লান্ত। তাও নানান দাবি নিয়ে লাখ লাখ মানুষ পথে নেমেছেন এই ঘরবন্দিদশার আতঙ্ককে পাশে সরিয়ে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে দাবি আদায়ে পথে হাঁটার সঙ্কোচ কাটিয়ে ফেলছেন ঘরোয়া লাজুক মানুষটিও। তাই আশা করা যেতেই পারে যে, ‘জ্যোতিষশাস্ত্র’ নিয়ে পাঠক্রম চালু করার প্রথম উদ্যোগ দেশের প্রগতিশীল মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধে যেভাবে ঠেকিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল, এবারেও নিশ্চয়ই সম্ভব হবে।