৫৯ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৯ অক্টোবর, ২০২১ / ১১ কার্ত্তিক, ১৪২৮
ছিন্নমূল মানুষের বেদনার চিত্রকরঃ এবারের নোবেল জয়ী আবদুল রাজাক গুর্নাহ
পল্লব সেনগুপ্ত
আবদুল রাজাক গুর্নাহ
‘‘তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আমাদের প্রায় অচেনা এক আফ্রিকার ছবি মূর্তিমন্ত হয়ে উঠেছে... ক্রীতদাস প্রথা আর উৎপীড়নে ক্লিন্ন ভারত মহাসাগরের উপকূলের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সেই রূপচিত্রে।’’ ...ক’দিন আগে ইংল্যান্ড প্রবাসী-তানজানীয় কথা সাহিত্যিক আবদুল রাজাক গুর্নাহকে নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করার ঘোষণাপত্রে ওই উদ্ধৃত কথাগুলি বলেছিলেন পুরস্কারদাতা সুইডিস আকাদেমির বিশেষজ্ঞ বিচারকরা। শুধু ওটুকুই নয়, তাঁরা আরও যা যা বলেছিলেন তার তাৎপর্য আরও অনেক বেশি। পুরস্কার ঘোষণা করার সময়ে আকাদেমির সচিব ম্যাটস মালম বলেছিলেনঃ ‘‘অদম্য এক সাহসে-ভরা মানসিকতা নিয়ে সুতীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে তিনি বিভিন্ন দেশ এবং সংস্কৃতির দোরোখা উপস্থিতির মধ্যে বন্দি ছিন্নমূল মানুষদের কণ্ঠস্বর আমাদেরকে শুনিয়েছেন মর্মস্পর্শী অনুভবময়তা এবং সুদৃঢ় সাহসের মাধ্যমে।’’
ছিন্নমূল মানুষের জীবনের বেদনা এবং অজস্র রকমের সমস্যার সঙ্গে আমরাও খুব অপরিচিত নই। সেই নিয়ে বাংলার এবং পাঞ্জাবের - সিন্ধুরও - লেখকরা অনেকই লিখেছেন। তবে, ১৯৪৬-এর পর থেকে দফায়-দফায় ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের জনজীবনে ওই ছিন্নমূল মানুষদের অভিঘাত যেভাবে পড়েছে - আফ্রিকা কিংবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে উদ্বাস্তু হয়ে পশ্চিমি দেশগুলিতে - মূলত ইয়োরোপেই যাঁরা যেতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের সেই অভিবাসনের লব্ধফল বহুলাংশেই আলাদা। ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক মূল্যবোধ - সব কিছুই ওই অভিবাসীদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অচেনা। ফলে যন্ত্রণার স্বরূপটাও, ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যেই ছিন্নমূল হয়ে আসা মানুষগুলির বেদনা-সমস্যা-জটিলতার সঙ্গে ব্যাপকভাবেই পৃথক। সেই পার্থক্য, আমাদের অচেনা। তাই গুর্নাহ যাঁদের দুঃখ-অবমাননাকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন, সেটাও আমাদের অপরিচিত।... কিন্তু, একুশ শতকের পৃথিবীতে সেগুলো অনিবার্যভাবেই উপস্থিত রয়েছে তো! ভবিষ্যতে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার ইতিবৃত্তে তার অবশ্যম্ভাবী ছাপ যে পড়বেই। আর সেই জন্যেই গুর্নাহের মতো লেখকরা সেই আগামী ইতিহাসের পথদিশারি বলেই মান্য হবেন। নোবেল কমিটিও উপলব্ধি করেছেন সেটাই।
।। দুই ।।
আবদুল রাজাক গুর্নাহের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২০ ডিসেম্বর। তাঁর জন্মভূমি ভারত মহাসাগরের জাঞ্জিবার দ্বীপমালা। তখন ওই দ্বীপরাজ্য ছিল ব্রিটিশ রক্ষণাধীন একটি স্থানীয়ভাবে শাসিত সুলতানি এলাকা। পরে ব্রিটিশরা ১৯৬০ সালে যখন পূর্ব আফ্রিকি দেশ তাঙ্গানিকা ছেড়ে চলে যায়, তখন যাবার আগে জাঞ্জিবার এবং তাঙ্গানিকাকে একটাই রাষ্ট্র হিসেবে যুক্ত করে। এর পরিণামেই কিছুকালের মধ্যে উগ্র আফ্রিকি এবং জাঞ্জিবারের আরবি বংশজদের মধ্যে তীব্র জাতি সংঘর্ষ শুরু হলে তরুণ আবদুল রাজাক দেশ থেকে বাধ্য হন চলে যেতে। এবং অবশেষে তিনি ইংল্যান্ডে গিয়ে সেখানেই পড়াশুনো করে স্থিত হন। তাঁর জীবনের বৃহত্তম সময়টা কেটেছে কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে।
অর্ধশতাব্দীর ওপর সময়ে ইংল্যান্ডে থেকে তিনি অবশ্য বাদামি-সাহেব হয়ে উঠতে পারেননি; হতে চানও নি। পরভূমে প্রবাসী হয়েই তিনি নিজের ওই ‘‘কোনও খানেই সাকিন নাই’’ অবস্থার যন্ত্রণাকেই ব্যক্ত করেছেন একটির পর একটি উপন্যাসের কুশীলবদের মাধ্যমে। বলার কথা এই যে, তাতেও কিন্তু তাঁর লেখায় ক্লান্তিকর পৌনঃপুনিকতা আসে নি; প্রতিটি কাহিনিই কিছু না কিছু নতুন সমস্যা, নতুন বেদনা, হতাশা, নতুন অবমাননার ব্যঞ্জনাকে ব্যক্ত করেছে। তবে সবটা মিলিয়ে কিন্তু তাঁর লেখার প্রধান স্বরগ্রাম ছিন্নমূল, অনাহূত অতিথির যন্ত্রণার বাঙ্ময়তা, বিড়ম্বিত-নিরুপায়তার মধ্যেই দিশা অন্বেষণের আকুলতা।
।। তিন ।।
গুর্নাহ’র এ অবধি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে দশটিঃ ‘মেমরি অব ডিপার্চার’ (১৯৮৭); ‘পিলগ্রিম’স ওয়ে’ (১৯৮৮); ‘ডোটি’ (১৯৯০); ‘প্যারাডাইজ’ (১৯৯৪); ‘অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স’ (১৯৯৬); ‘বাই দ্য সী’ (২০০১); ‘ডেজারশন’ (২০০৫); ‘দ্য লাস্ট গিফ্ট’ (২০১১); ‘গ্র্যাভেল হার্ট’ (২০১৭); ‘আফটার লাইভ্স’ (২০২০)। এছাড়াও বেশ কিছু ছোটগল্পও আছে তাঁর। যেগুলোর মধ্যে ‘কেজেস’ (১৯৮৪); ‘বসি’ (১৯৯৪); ‘এস্কর্ট (১৯৯৬); ‘মাই মাদার লিভ্ড অন এ ফার্ম ইন আফ্রিকা’ (২০০৬); ‘দ্য ফটোগ্রাফ অব দ্য প্রিন্স’ (১৯১২); ‘দ্য অ্যারাইভার’স টেল’ (২০১৬) এবং ‘দ্য স্টেটলেস পার্সন’স টেল’ (২০১৭) যথেষ্টই পরিচিত। গুর্নাহের মাতৃভাষা সোয়াহিলি হলেও (যদিও তাঁর বংশধারা আরবিক), তিনি বরাবরই লিখেছেন ইংরেজিতে। গবেষণা ও অধ্যাপনাও মূলত ইংরেজি সাহিত্য ও উত্তর ঔপনিবেশিক সাহিত্য নিয়েই। কিন্তু তাঁর রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট্য ইংরেজির সঙ্গে সোয়াহিলি (এবং কখনও বা আরবিক) শব্দ, বাক্যবন্ধ, ইডিয়ম ইত্যাদির বিচিত্র বিন্যাস। এমনকি হিন্দিও বিরল নয়। নোবেল কমিটি তাঁকে ইংরেজি সাহিত্যের ঐতিহ্যের উত্তরসূরী বলে উল্লেখ করেছেন ঠিকই, তবে যেভাবে তাঁরা সেখানে এক নিঃশ্বাসে শেকসপিয়র এবং ভি এস নইপলের নাম করেছেন তাতে পরিহাস করতেই ইচ্ছে করে! ভাষাটা ইংরেজি হলেও গুর্নাহ বস্তুত পুরোপুরি আফ্রিকারই লেখক - সোয়াহিলি এবং আরবিক ঐতিহ্যও তাঁকে আপ্লুত করে রেখেছে দেশছাড়ার এতকাল পরেও।
আবদুল রাজাক গুর্নাহ আধুনিক পৃথিবীর একটি অত্যন্ত গুরুতর এবং জটিল সমস্যা নিয়ে তাঁর সাহিত্যিক-জীবনের পুরোটাই যদিও ব্যস্ত থেকেছেন, তবু এক অর্থে তিনি খুবই ‘আন্ডার রেটেড’ বা অবহেলিত লেখক। নোবেল প্রাইজ পাবার পর রাতারাতি তাঁর বিশ্বজোড়া নাম ছড়িয়ে পড়েছে ঠিকই, কিন্তু তার আগে অবধি ব্রিটেন ও তাঞ্জানিয়ার (বিশেষত, জাঞ্জিবার অঞ্চলের) কিছু গ্রন্থকীট মানুষ এবং জনাকতক সমাজবিজ্ঞানী ছাড়া তাঁর লেখা নিয়ে কেউ আগ্রহী হননি। অথচ, এ অবধি সাহিত্যে যাঁরা নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, তাঁদের অনেকের - অনেকেরই তুলনায় তিনি ঢের ঢের বেশি বড়ো মাপের লেখক। বস্তুতপক্ষে তাঁর লেখায় সাম্রাজ্যবাদী কুটিল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে যেভাবে তর্জনী-চিহ্নিত করা হয়েছে িছন্নমূলদের দুর্দশার জন্যে, তাতে এটাই তো স্বাভাবিক। বুর্জোয়া অর্থনীতির দ্বারা পরিচালিত তথাকথিত ‘প্রথম’ বিশ্বের অঙ্গুলি নির্দেশে যে পুরস্কার প্রদত্ত হয় - সেটা তাঁর পক্ষে সাধারণ বিচারে তো পাওয়া অসম্ভব ছিল! তবু এবারে যে কীভাবে ব্যাপারটা ঘটে গেল, সেটাই বিস্ময়জনক!... তবে তাঁর লেখার উপজীব্য যে কতখানি গভীরতাস্পর্শী, সেটা যদি একবার অন্তত কেউ অন্বেষণ করেন, তাহলে তিনি একমত হবেন যে, এবারের পুরস্কারটা যোগ্য মানুষকেই অর্পণ করা হয়েছে।
।। চার ।।
গুর্নাহ’র বইগুলি নিয়ে এই সূত্রে কিছু চকিত অবলোকন করা যেতে পারে অবশ্যই। তাঁর প্রথম নভেল ‘মেমোরি অব ডিপার্চার’ (১৯৮৭), হাসান নামে এক আরবি-আফ্রিকি তরুণ স্বদেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়ে কীভাবে একটি অতিস্বচ্ছল দেশের সমাজের মধ্যে নিজেকে নিরূপায় বিপন্নতার মধ্যে উপলব্ধি করছে - তার কাহিনি। স্পষ্টতই, আত্মজৈবনিক।
পরের বই ‘পিলগ্রিম’স ওয়ে’ (১৯৮৮) - আত্মপ্রক্ষেপ এতে আরও স্পষ্ট। দাউদ একটি তানজানিয়া থেকে ইংল্যান্ডে অভিবাসী যুবক। নগণ্য কিছু কাজকর্ম করে সেখানে। কিন্তু প্রতিনিয়ত অপমানিত হয় জাতিবিদ্বেষী ব্রিটিশদের কাছে। ক্যাথারিন নামে এক নার্সের সঙ্গে তার হৃদয়াবেগের সম্পর্ক তৈরি হয় ঠিকই, কিন্তু তবুও তার মানসিক বেদনা থাকে অনিরসিতই।
তৃতীয় উপন্যাসের নাম ‘ডোটি’ (১৯৯০)। এর নায়ক ডোটি বালফুর অবশ্য প্রবাসী নয়; কিন্তু একটি সাদা-কালো-মিশ্রিত পরিবারের ছেলে, জন্মেছেও ইংল্যান্ডেই। তবুও তার জীবনেও এক ধরনের অসম্মানের অস্বস্তির আতঙ্ক সব সময়েই হানা দেয়। আর তার মধ্যেই তার দিন কাটে মায়ের মৃত্যুর পর ছোটো ছোটো দুই ভাইবোনের দেখভাল করেই। দেশ থেকে ‘ডিপার্চার’ এর নস্টালজিয়া, বা আশ্রয়-নেওয়া দেশকে ‘পিলগ্রিমেজ’ ভেবে নির্মমভাবে হতাশ হওয়া সত্ত্বেও আত্মপ্রতিষ্ঠায় অদম্যতা না থাকলেও এই বইও এক রকমের পারিপার্শ্বিকের-উপেক্ষার-সঙ্গে লড়াই করার মানসিক চিত্রায়ণ।
চতুর্থ উপন্যাস ‘প্যারাডাইজ’ (১৯৯৪) অবশ্য তাঁর পাঠকমহলে জনপ্রিয় হয় বুকার পুরস্কারের মনোনয়ন তালিকায় থাকার জন্য। এর নায়ক ইউসুফ - তানজানিয়ার ছেলে, বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে তার জন্ম। দেনার দায়ে তার বাবা তাকে বেচে দেয় আজিজ নামে এক নচ্ছার ব্যবসায়ীর কাছে। ইউসুফ সেখানে প্রায় ক্রীতদাসের মতোই থাকে। আজিজের ব্যবসার সূত্রে যে-কাফেলা মধ্য আফ্রিকা, কঙ্গো প্রভৃতি অঞ্চলে যেতো, ইউসুফও তাতে থাকতো ভৃত্য হয়ে। পথে বারবার তাদের কাফেলাকে আক্রমণ করেছে আরণ্যক জনজাতির মানুষেরা, হিংস্র পশুর দল; এবং দুর্গম পাহাড়িয়া পথও তাদের প্রবল অসুবিধার মধ্যে ফেলেছে।... ওরা একদিন ফিরেও আসে পূর্ব আফ্রিকায়; আর তখনই শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মান সৈন্যরা তাঙ্গানিকা দখল করে - ইউসুফ দেখে তারা ওখানকার মানুষদের বন্দি করে নিজের বাহিনীতে সৈনিক হিসাবে ব্যবহার করছে। এই মানুষদের বেদনা সে অনুভব করে। সে তো নিজেও গৃহহারা, ছিন্নমূল। তার মনকে ভারাক্রান্ত করে রাখে নিজের দেশের, বাড়ির স্মৃতিগুলো। সেগুলো তো তার কাছে যেন অভিশপ্ত কিছু উপলব্ধির মতো হয়ে ওঠে। দেশে ফিরেও, তার ঘর তো মেলে না!
গুর্নাহ’র পঞ্চম উপন্যাস ‘অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স’ (১৯৯৬)। এখানেও আছে ফিরে আসার পরের যন্ত্রণা - আশাভঙ্গের বেদনা।... অনামা এক জাঞ্জিবারি যুবক, ইংল্যান্ডে অভিবাসী। সেখানে সে শিক্ষকতা করে, স্বচ্ছল জীবন তার। একটি ব্রিটিশ মেয়ে আমেলিয়ার সঙ্গে থাকে সে। ওদের দু’জনের একটি কন্যাও হয়েছে, এমা, তাকে বড়ো করছে ওরা। বিশ বছর পরে, প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে সেই মানুষটি ফেরে নিজের জন্মভূমিতে। কিন্তু কিছুই আর আগের স্মৃতির সঙ্গে মেলে না - একমাত্র প্রাকৃতিক পারিপার্শ্বিক ছাড়া - তাও আংশিকভাবে। এখন সে নিজভূমেই পরবাসী! এই বেদনা বাঙ্ময় নয়। গুর্নাহ কিন্তু তাকে ভাষায় রূপ দিয়েছেন। এ বইও অনেকখানিই আত্মজৈবনিক।... সে ইংল্যান্ডে ফেরে - কিন্তু সেখানেও তার শূন্য ঘর; প্রেমিকা এবং মেয়ে - তারাও চলে গেছে। জন্মভূমি এবং প্রবাসভূমি - দুই-ই তার কাছে তখন নিঃশব্দ বেদনার স্মৃতিময়তায় ভরা।
ওঁর পরের বই হলো, ‘বাই দ্য সী’ (২০০১)। এটিও প্রাথমিকভাবে বুকার পুরস্কারের তালিকায় গৃহীত হয় বটে, তবে ‘প্যারাডাইজ’ বা ‘অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স’-এর মতো পরিচিত নয় এই বই। সালেহ ওমর একটা জাল পাসপোর্ট নিয়ে, নাম ভাঁড়িয়ে আফ্রিকা থেকে ইংল্যান্ডের ব্রাইটন শহরে এসে ওঠে। তখন তার পরিচয় হয় জনৈক রজব শাবান মাহমুদ। এই কাহিনির কিছু অংশের কথক হলো আসল রজব শাবান মাহমুদের ছেলে লতিফ মাহমুদ। সে আবার অতি-নচ্ছার একটি লোক! ছদ্মনামেই সালেহ ওমর পূর্ব জার্মানিতেও যায় স্টুডেন্ট ভিসা জুটিয়ে। সেখানের পাঠ সেরে আসে ব্রাইটনে। কিন্তু কোথাওই সে আর নিজের আসল পরিচয়কে ব্যক্ত করতে পারে না - আর ক্রমে যেন নিজের প্রকৃত সত্তাকেও হারিয়ে ফেলে। স্মৃতি আছে, অতীত আছে - কিন্তু বর্তমান নেই, কারণ তার আসল পরিচয় তো সেই প্রবাসে বিলুপ্ত। হারানো অতীত এবং মিথ্যা বর্তমান নিয়ে তার অস্তিত্ব তখন নিজের কাছেই সংকটময়।
গুর্নাহ এরপর লেখেন ‘ডেজারশন’ (২০০৫)। এই বইয়ের মধ্যে গুর্নাহ’র একটা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ কথা উচ্চারিত হয়েছে, যা তাঁর সমস্ত লেখার সারাৎসার বলা যায়ঃ ‘‘There is, as you can see, an I in this story, but it is not a story about me, It is one about all of us…” গুর্নাহ’র সব আত্মজৈবনিক-সৃষ্টিরই অলক্ষ্য নায়ক শুধু তিনি নন, বিশ্বের সমস্ত অভিবাসীরই, সমস্ত ছিন্নমূল মানুষেরই কথা সেগুলি। ‘ডেজারশন’-এর কাহিনিটির মুখ্য কথক রশিদ, খানিকটা তার দাদা আমিনের জবানিতে। ওদের দিদি, ফরিদা। বিশ শতকের ’৫০-এর দশকে ওরা সবাই বড়ো হচ্ছে জাঞ্জিবার দ্বীপমালায় - তখন সেটি ব্রিটিশ উপনিবেশ।
তবে কাহিনির মুখপাত অর্ধশতাব্দী আগেঃ ১৮৯৯-তে। এক ইংরেজ পর্যটক পিয়ার্স মুমূর্ষু অবস্থায় মরুভূমি পেরিয়ে এসে আশ্রয় পায় হাসান আলির কাছে - কেনিয়ার একটি ছোটো শহরের উপকণ্ঠে ছোটো এক ব্যবসায়ী সে। পিয়ার্সকে শুশ্রূষা করার মধ্যে ওই এলাকার সাহেব শাসনকর্তা এসে হাসানকে অভিযুক্ত করে অহেতুকভাবেই - সে নাকি পিয়ার্সের সবকিছু চুরি করেছে, এই অভিযোগে! পিয়ার্সকে নিয়ে যায় বড়ো সাহেবটি নিজেদের হেপাজতে।... কিছুটা সুস্থ হবার পর পিয়ার্স তার দেশোয়ালি বড়োকর্তার কাণ্ড জেনে খুবই লজ্জিত হয় এবং অবশেষে ক্ষমা চাইতেই ফেরে তার প্রাণদাতা হাসান আলির বাড়িতে। সেখানে ওর সঙ্গে দেখা হয় হাসানের বোন রেহানার। এবং অচিরেই দু’জনের প্রেম ঘটে যায়! হাসান, রেহানা - ওরা আদতে ছিল প্রবাসী ভারতীয় এবং এক জাঞ্জিবারি মেয়ের সন্তান। কিন্তু সাহেবের সঙ্গে রেহানার সম্পর্কটা পাড়াপড়শিরা ভালো চোখে দেখল না। তাদের উচাটনে ওরা অন্যত্র গিয়ে সংসার পাতলো।
এর পঞ্চাশ বছর পরে, কাহিনির দ্বিতীয় পর্ব। আমিন স্কুলে পড়ায়। রশিদ ইংল্যান্ডে গিয়ে অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে পড়তে চায়। ফরিদা একটা মেয়েদের পোশাকের দোকান চালায়। সেইখানে তার সঙ্গে আলাপ হয় জামিলার - পিয়ার্স এবং রেহানার নাতনি সেই মেয়ে। বোনের পরিচিত এই মেয়েটির সঙ্গে আবার আমিনের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্কুলমাস্টার বাবা (এবং মা-ও) আমিনদের এই প্রেমটাকে মানতে পারে না। তাদের কথায়, জামিলা হলো এমন একজন মেয়ে, যার দিদিমা ছিল এক ভারতীয় ব্যবসাদার, আর জাঞ্জিবারি মেয়ের অবৈধ সন্তানঃ ‘ছোতারা’! সে আবার কোনো সাহেবেরও ‘রক্ষিতা’ ছিল। তারও আগে এক মজঙ্গুর অবৈধ সন্তানের মা হয় সে। আর জামিলাও সচ্চরিত্রা মেয়ে নয়, ইত্যাদি ইত্যাদি। চাপে পড়ে আমিন সম্পর্কটা ভেঙেও দেয়। এরপরে জাঞ্জিবার স্বাধীনতা পেলে গল্পের তৃতীয় পর্ব। রশিদ বিলেতে গেছে, কিন্তু সেখানে নিজেকে একেবারেই মানাতে পারছে না; অবাঞ্ছিত অভিবাসী হয়ে প্রবল বিচ্ছিন্নতার বোধে জর্জর হচ্ছে সে। পরিবারের সঙ্গে শুধু চিঠিচাপাটির মাধ্যমেই তার সম্পর্ক। দেশের স্বৈরতন্ত্রী শাসনব্যবস্থা। সেখানে ওদের মা এবং দাদা আমিন - দুজনেই অন্ধ হয়ে দিন কাটাচ্ছে।
বহু বছর পরে, রশিদ নিজের স্মৃতি আর আমিনের রোজনামচার ডায়েরি থেকে সমস্ত ইতিবৃত্তটা সংকলন করে। পিয়ার্স আর রেহানার আর এক উত্তর-প্রজন্মের সঙ্গেও তার পরিচয় হয় আকস্মিকভাবে। সবটা মিলিয়ে তৈরি হয় এই উপন্যাস।
এখানে গুর্নাহা’র রচনার মূল সুর - অভিবাসীর মর্মবেদনা - আছে অবশ্যই। কিন্তু কাহিনির প্লট অনেক ব্যাপ্ত, পৌনে একশো বছরের পটভূমিতে একটা একদা একদা-উপনিবেশের সমাজ কীভাবে পালটে গেছে, সেটাও এতে সুচিত্রিত। এদিক থেকে ‘ডেজারশন’ নিঃসন্দেহেই গুর্নাহ’র উপন্যাসগুলির মধ্যে অন্য ধরনের যে, তা মানতেই হবে।
পরের বই, ‘দ্য লাস্ট গিফট’ (২০১১)। এর মূল চরিত্র ৬৩ বছরের বৃদ্ধ আব্বাস, বহুদিন আগে যে দেশ ছেড়ে ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। একটা হার্ট অ্যাটাকের পর সুস্থ হয়ে হঠাৎ সে প্রবল অপরাধবোধে ভোগে - কেন যে দেশ ছেড়ে এই পরবাসে এসেছিল সে ৪০ বছর আগে! মৃত্যুর আগে সে তার বাল্য-কৈশোর-প্রথম যৌবনের স্মৃতিগুলো উপহার দিতে চায় বউ মরিয়ম আর ওদের দুই সন্তান হানা এবং জামালকে। সেই স্মৃতির সম্ভার তার শেষ উপহার তাদেরকে ‘দ্য লাস্ট গিফট’।
গুর্নাহর সাম্প্রতিক দুটি বইঃ ‘গ্র্যাভেল হার্ট’ (২০১৭) এবং ‘আফটার লাইভস’ (২০২০)। ‘গ্র্যাভেল হার্ট’-এর নায়ক সেলিম। তার মা মারা গেছেন এই খবর পেয়ে সে ইংল্যান্ড থেকে তাঞ্জানিয়ায় ফিরছে। দেশে ফিরে ও বাবার কাছে যায়। বাল্য-যৌবনের স্মৃতি, মায়ের স্মৃতি, প্রবাসের অভিজ্ঞতা - এইসব নিয়ে সে কথা বলে বাবার সঙ্গে। অজস্র টুকরো-টুকরো পারিবারিক আশা-হতাশার কথা, বিদেশের সুখ-ভাবা-দুঃখের জীবন এসব নিয়ে আলোচনা চলে পিতাপুত্রের মধ্যে। হঠাৎই সেলিম একটা বড়োই চমকে দেবার মতো কথা বলে বাবাকে। সে বলে যে, তারা নিজেদের দেশ এবং তার ইতিহাসকে জানতে গিয়ে দ্বারস্থ হচ্ছে সেই বিদেশিদেরই কাছে - যারা তাদেরকে উপনিবেশের বেড়াজালে বেঁধে রেখেছিল এতকাল - আর তখন যেমন, এখনও তেমনই - যারা তাদেরকে ঘেন্না করে, তাচ্ছিল্য করে! আর সেই উপনিবেশী কালের পরিপ্রেক্ষাতেই তাদের পরিবারেরও অধিকাংশ সমস্যা গড়ে উঠেছিল, এখনও উঠছে। কিন্তু সেই থেকে পরিত্রাণ করবে কে? কেউ না!
শেষ বই ‘আফটার লাইভস’-এর রচনাকাল মাত্র গতবছর হলেও, কাহিনীটা এক শতাব্দীরও বেশি আগেরঃ ১৯০৪-’০৭। উপনিবেশিক জার্মান বাহিনীর ব্যাপক গণহনন, রুখে দাঁড়ানো হেরেরো গণ-অভ্যুত্থান, মাজি-মাজি আন্দোলন, জার্মানদের তাঁবেদার তাঙ্গানিকার সৈন্যদের উৎপীড়ন - এইসবই হলো এর প্রেক্ষিত। খলিফা এবং আমুর রিয়াশায়ার - এরা হলো দুটি প্রধান চরিত্র - আরও বহু চরিত্র এসেছে পরে। জার্মান-অধিকার, ব্রিটিশ শাসন একদিন ঘুচেছে সে দেশে। কিন্তু ঔপনিবেশিকতার প্রেতচ্ছায়া মানুষের অন্তর থেকে বিলুপ্ত হয়নি - সে যেন নির্মঞ্ছনীয়ই। দেশের মানুষ তাই নিজভূমে থেকেও যেন পরগাছা, পরবাসী - মনের দিক থেকে!
গুর্নাহ তাঁর এই ১০টি উপন্যাসের এবং অধিকাংশ গল্পের মধ্যে মানুষ কীভাবে স্বদেশে ও বিদেশে - ছিন্নমূল, অভিবাসী বলে আত্মোপলব্ধি করে - তারই রূপচিত্রণ করেছেন।... এ তো বিশ্বের সাহিত্যে নতুন এক ভাবনা, নতুন এক জঁরের (বর্গ) অভিব্যক্তি। তাই না? এবারে নোবেল প্রাইজ ঠিক লোকের হাতেই পড়েছে।