৫৯ বর্ষ ১১ সংখ্যা / ২৯ অক্টোবর, ২০২১ / ১১ কার্ত্তিক, ১৪২৮
পরিবেশ আলোচনা
খোলা চোখে গ্লাসগোর দিকে
তপন মিশ্র
অর্ধশতক আগে ১৯৭২ সালের ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ রক্ষার আন্তর্জাতিক প্রয়াসের গোড়াপত্তন ঘটে সুইডেনের স্টকহোম শহরে। গত ৫০ বছরে পৃথিবীর বায়ু, জল যতটা দূষিত হয়েছে তার থেকে বেশি উত্তপ্ত হয়েছে পৃথিবী। ইতিমধ্যে অনেক আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্রপ্রধানদের অনেক প্রতিশ্রুতি শোনা গেছে। কিন্তু পৃথিবীর অসুখ গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে। এবছর ৩১ অক্টোবর স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে রাষ্ট্রনায়ক এবং নীতি নির্ধারকদের ১৩ দিন ব্যাপী সভা (কনফারেন্স অব পার্টিজ ২৬ - সিওপি ২৬) ঘটা করে অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ইতিমধ্যে বিশ্বজুড়ে নতুন প্রজন্ম আগামী বিশ্বের জন্য আওয়াজ তুলেছেঃ “Change the system, not the climate - Uproot the system” - অর্থাৎ “ব্যবস্থার পরিবর্তন করো, জলবায়ুর নয় - ব্যবস্থার মূলোৎপাটন করো”। এ কোনো সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী দলের স্লোগান নয় বা কমিউনিস্টদের স্লোগানও নয়। এ হলো অষ্টাদশী গ্রেটা থুনবার্গ (Greta Thunberg) এবং তাঁর সংগঠন ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ (‘Fridays for future’)-এর আহ্বান। কোন ব্যবস্থার পরিবর্তনের কথা বলছেন ওঁরা?
এক। সেই ব্যবস্থা যেখানে আমেরিকার নেতৃত্বে শিল্পোন্নত দেশগুলি তাদের ঐতিহাসিক নির্গমনের কারণে আগে থেকে বায়ুমণ্ডলে জমে থাকা কার্বনের দায়ভার না নেওয়ার স্পর্ধা দেখায়; আর সংখ্যাগুরু উন্নয়নশীল দেশগুলি বাজার অর্থনীতির চাপে এই স্পর্ধার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে সাহস পায় না।
দুই। সেই ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা, যেখানে প্রকৃতির সমস্ত নিয়মকে লঙ্ঘন করে প্রাকৃতিক সম্পদ যথেচ্ছ লুট করা হয় মুনাফা বৃদ্ধির জন্য। সেই আত্মঘাতী প্রক্রিয়ায় সাথে থেকেছে রাষ্ট্র। তারা মানুষকে এই বলে ভুল বুঝিয়েছে যে, উৎপাদন ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হলে প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করতে হবে এবং প্রকৃতিকে লুট করতে হবে।
সমস্যা কিন্তু মানবতার নয় - ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার
থমাস রবার্ট মালথস-এর কথায় (The theory of exponential population and arithmetic food supply growth, 1798) - মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক সবসময়ে বৈর (antagonistic)। ফলে প্রকৃতির ধ্বংস অপরিহার্য। একারণে প্রকৃতিকে তার পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হলে মানুষের সংখ্যা কমিয়ে দিতে হবে। তাঁর মতে, ‘বাস্তুতন্ত্র বিজ্ঞানে’র মূল কাজ হলো - এই নেতিবাচক মিথষ্ক্রিয়ার সমাধান করার জন্য মানুষের সংখ্যার জ্যামিতিক বৃদ্ধি রোধ করা, না হলে পৃথিবী তার ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।
এই তত্ত্ব খারিজ করে মার্কস লিখলেনঃ “Nature is man’s inorganic body, that is to say, nature in so far as it is not the human body. Man lives from nature... and he must maintain a continuing dialogue with it if he is not to die. To say that man’s physical and mental life is linked to nature simply means that nature is linked to itself, for man is a part of nature.” (Karl Marx, Economic and Philosophical Manuscripts of 1844, in Marx and Engels Collected Works, vol. 3 (New York: International Publishers, 1975, pp 276). - মানুষের অজৈব দেহ হলো প্রকৃতি। মানুষ যদি বিনাশ না চায় তাহলে তাকে নিরন্তর প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য বজায় রাখতে হবে। মানুষের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল এবং তাই মানুষ প্রকৃতির অংশবিশেষ।
মানুষ এবং প্রকৃতির যে অভিন্ন সত্তা তা মার্কস এবং এঙ্গেলসের বিভিন্ন প্রকাশনার মধ্যে পাওয়া যায়। ক্যাপিটাল গ্রন্থে মানুষের শ্রম সম্পর্কে মার্কস লেখেনঃ “...by which man, through his own actions, mediates, regulates, and controls the metabolism between himself and nature. He confronts the materials of nature as a force of nature. (Karl Marx, Capital, vol. 1, Vintage Books, 1977 pp, 283)”। “মানুষের শ্রম হলো এমন একটি কাজ যার মধ্যদিয়ে সে প্রকৃতি জগতের সঙ্গে ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া করে, মধ্যস্ততা করে, নিয়ন্ত্রণ করে, এবং প্রকৃতির সঙ্গে তার মিথষ্ক্রিয়াকে বুঝতে চেষ্টা করে। মানুষ প্রকৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য শক্তি হিসাবে প্রকৃতির মোকাবিলা করে।”পাঠকদের এই শেষ বাক্যটি অনুধাবন করতে অনুরোধ করব। প্রকৃতির সম্পদ যা মানুষ বেঁচে থাকার মুখ্য উপাদান হিসাবে ব্যবহার করে, সেই প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ করার সময় মানুষ প্রকৃতির অংশ হিসাবে কাজ করে। এই সম্পর্ক কখনোই বৈর নয় বরং প্রকৃতির মধ্যে অন্তর্নিহিত এক সত্তা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক সর্বক্ষেত্রেই অবৈর (non-antagonistic)।
পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় ইচ্ছাকৃতভাবে এই বোধের অভাব তৈরি করা হয়। এর ফলে যে আপাত-বৈরতার সম্পর্ক প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের হয় বলে মনে হয় তা হলো, পুঁজিবাদী দর্শনের ফসল। আমাদের বোঝানো হয়ঃ “মার্কসবাদ প্রকৃতির সঙ্গে সংগ্রামের কথা বলে এবং উৎপাদন করতে গেলেই তো এই সংগ্রাম অপরিহার্য”। ‘বাস্তুতন্ত্র বিজ্ঞানে’র গবেষকদের মার্কসের চিন্তার সঙ্গে পরিচিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি। কেবল সর্বসাধারণকে নয় যারা মার্কসবাদের নিরন্তর চর্চা করেন তারাও একইভাবেই বিভ্রান্ত হয়ে যান। প্রকৃতিকে সুস্থ এবং জীবজগতের উপযোগী রাখতে গেলে একথা অবশ্যই বুঝতে হবে যে, মার্কসবাদ হলো সদা বিকাশমান এক বিজ্ঞান যা কেবল মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনের সময়ে আটকে থাকেনি বরং প্রতিনিয়ত বিকশিত হচ্ছে।
আর একটি উদাহরণ দিয়ে তত্ত্বগত এই আলোচনা শেষ করতে হবে। এঙ্গেলস তাঁর প্রবন্ধ ‘বানর থেকে মানুষের বির্বতনে শ্রমের ভূমিকা’ (‘The Part Played By Labour in the Transition from Ape to Man’)-এ তখনকার কিউবার একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। সেখানে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল পুড়িয়ে অতি লাভজনক কফির একটিবারের চাষের জন্য কিউবার স্পেনীয় বাগিচা মালিকেরা যখন পর্বতের বুকের অরণ্য ভস্মীভূত করে ছাই থেকে সার জোগাড় করেছিল এবং পরের বছর ভীষণ বৃষ্টিপাতের ফলে সমস্ত ছাই ধুয়ে পাহাড়ের ঢাল বন্ধ্যা হয়ে যায় এবং আর কফি চাষের উপযোগী থাকে না। ঘটনাটির বাখ্যা দিয়ে এঙ্গেলস লেখেনঃ “In relation to nature, as to society, the present mode of production is predominantly concerned only about the immediate, the most tangible result; and then surprise is expressed that the more remote effects of actions directed to this end turn out to be quite different”। অর্থাৎ “ যেমন প্রকৃতি তেমনি সমাজের দিক থেকে বর্তমান উৎপাদন পদ্ধতি প্রধানত শুধু নগদ ফলাফল নিয়েই ভাবিত। অথচ এই দেখেও লোকে অবাক হয় যে, এই উদ্দেশে চালিত কার্যাবলির সুদূর ফলাফল একেবারে ভিন্নতর এবং এমনকী একেবারে উল্টো ধরনের হচ্ছে;” - ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা যে কতটা সর্বনাশী এবং আত্মঘাতী হতে পারে তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো এটি।
১৯৭২-র পর
১৯৬৮ সালে সূচনা হওয়া সুইডেন সরকারের উদ্যোগে ৭ দিন ব্যাপী এই আন্তর্জাতিক আলোচনার প্রস্তুতি শুরু হয় রাষ্ট্রসঙ্ঘকে দেওয়া এক চিঠির মধ্যদিয়ে। তার আগে বিজ্ঞানীদের অনেক সম্মেলনই হয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রনেতাদের নিয়ে এটাই ছিল বিশ্বের প্রথম পরিবেশ সম্মেলন। তখনও ইউনাইটেড নেশসনস ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন ওন ক্লাইমেট চেঞ্জ - ইউএনএফসিসি বা ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল ওন ক্লাইমেট চেঞ্জ - আইপিসিসি তৈরি হয়নি। ১৯৬৮ সালের ২০ মে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারি জেনেরালকে লেখা এই চিঠিতে বলা হয়ঃ “The changes in the natural surroundings, brought about by man, had become an urgent problem for developed as well as developing countries, and that these problems could only be solved through international co-operation. The Swedish Government proposed to convene a conference under the auspices of the United Nations, to work on a solution for the problems of human environment.”
১৯৭০-র দশকে বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে অনেক গবেষণার ফল সামনে আসতে থাকে। ফলে আশঙ্কার মেঘ যতই ঘনীভুত হয় মানুষ ততই উপায় খোঁজার চেষ্টা করে। রিও ডি জেনেইরো-তে ১৯৯২ সালের ৩ জুন থেকে ১৪ জুন পর্যন্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘ পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক (United Nations Conference on Environment and Development বা ইউএনসিইডি) সম্মেলন বা বসুন্ধরা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৫৪ টি দেশ সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন, বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা সেই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এখানেই গুরুত্বপূর্ণ ৫ টি চুক্তির মধ্যে দুটি চুক্তি ছিল জলবায়ু পরিবর্তন (ইউএনএফসিসি) এবং জৈববৈচিত্র্য সম্পর্কিত চুক্তি (কনভেনশন ওন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি বা সিবিডি)। মূল নথিতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ স্বাক্ষর করলেও এই দুটি চুক্তিতে আমেরিকা স্বাক্ষর করেনি। অর্থাৎ জলবায়ু পরিবর্তন এবং জৈববৈচিত্র্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে কোনো বাধ্যবাধকতায় যেতে আমেরিকা রাজি হয়নি। এই চুক্তিগুলি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে তৈরি হয়। সাম্রাজ্যবাদী উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থার চালিকাশক্তি আমেরিকা কখনওই কী প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের উপর নিয়ন্ত্রণ সহ্য করতে পারে?
এর পর দুই মেরুতে অনেক বরফ গলেছে। বছর বছর ইউএনএফসিসি’র মোট ২৫টি আলোচনা হয়েছে। ১৯৮৮ সালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের তৈরি আইপিসিসি গঠিত হওয়ার পর মোট ৫টি বিশদ রিপোর্ট এবং অনেকগুলি বিশেষ রিপোর্ট জমা পড়েছে। এগুলি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতাদের - কী ঘটছে, কেন ঘটছে এবং কী করা উচিত তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ১৯৯৭ সালে জাপানের কিয়োটো শহরে শিল্পোন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে কার্বন নিঃসরণের কী পদ্ধতি হওয়া উচিত সে নিয়ে একটি গ্রহণযোগ্য চুক্তিও তৈরি হয়েছিল। যথারীতি আমেরিকা এবং তার সাকরেদরা নুতন ফন্দি খুঁজেছে। ইতিমধ্যে কার্বন বাণিজ্য ইত্যাদির মধ্যদিয়ে কার্বন এক পণ্যে পরিণত হয়েছে। এই বাণিজ্যে বনবাসীরা যাতে উপেক্ষিত হয় তার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। ২০১৫ সালে প্যারিসে ২১তম ‘কনফারেন্স অফ পার্টিজ’-এ স্বঘোষিত নির্গমন (ন্যাশনালি ডিটারমাইন্ড কনট্রিবিউশন)-এর মাধ্যমে যে প্রতিশ্রুতি বিভিন্ন দেশ দিয়েছে সেটিও লঙ্ঘিত হচ্ছে।
গ্রেটা থুনবার্গ এবং তার সংগঠন সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কীনা তা জানা নেই। এটাও জানা নেই যে, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যাঁরা এক সুস্থ পৃথিবীর জন্য আন্দোলন করছেন তাঁরা এটা বিশ্বাস করেন কীনা যে - ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা বজায় রেখে পৃথিবীর অসুখের নিরাময় করা যাবে। গ্লাসগো আলোচনার পূর্বেই পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী সংগঠন আওয়াজ তুলেছে - ‘এই সাড়ম্বর আলোচনা আর নয় - এবার চাই নিজ নিজ দেশের সরকারের উপর চাপ দেওয়া’। যে কেউ চোখ খুলে রাখলে বুঝতে পারবেন যে, এই সমস্ত আলোচনা বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়। সংগঠিতভাবে দেশের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি না করতে পারলে অর্ধশতকের অভিজ্ঞতা বলছে, সমস্যা আরও বাড়বে বৈ কমবে না।