৬১ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১১ আশ্বিন, ১৪৩০
কলকাতায় বিশাল খেতমজুর সমাবেশের আহ্বান
দাবি আদায়ে ১১ অক্টোবর দেশব্যাপী আন্দোলনে শামিল হন
রানি রাসমণি রোডে খেতমজুর সমাবেশে বলছেন সর্বভারতীয় নেতা বিজয়রাঘবন।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দ্বিগুণ করতে হবে ১০০ দিনের কাজের মেয়াদ। তৃণমূলের চুরি আর বিজেপি’র সঙ্গে ওদের নকল লড়াইয়ের দায় খেতমজুর এবং গরিব মানুষ বইবেন না, বকেয়া দিতে হবে দ্রুত। সব খেত মজুরের কাজ চাই। ‘৪ক ফর্ম ফিল আপ করো, কাজ চাও।’ ওরা কাজ না দিলে রাস্তার লড়াইয়ের পাশাপাশি চলবে আইনি লড়াই - ২৫ সেপ্টেম্বর কলকাতার ধর্মতলায় খেতমজুরদের এক সুবিশাল সমাবেশে এই সব দাবিগুলি নিয়েই সোচ্চার হলেন সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন সহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। এদিনের সভা থেকে কেন্দ্রের মোদি সরকার এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে হটানো সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ১১ অক্টোবর দেশব্যাপী আন্দোলনে শামিল হওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
বছরে ২০০ দিনের কাজ, দৈনিক ৬০০ টাকা মজুরি, সব গরিবের জন্য পাকা ছাদযুক্ত বাড়ি, ষাটোর্ধ্ব বয়সের শ্রমজীবীদের জন্য মাসিক ৩ হাজার টাকা পেনশন, নারী পুরুষের সমকাজে সমমজুরি, অবিলম্বে ১০০ দিনের কাজ চালু এবং বকেয়া মজুরি পরিশোধের দাবিতে কলকাতার রানি রাসমণি রোডে এই প্রথম সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির ডাকে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলো।
মাঝপথে নামা বৃষ্টিতে অনড় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি এ বিজয়রাঘবন, সাধারণ সম্পাদক বি ভেঙ্কট, সর্বভারতীয় সহসভাপতি অমিয় পাত্র, রাজ্য সভাপতি তুষার ঘোষ, সম্পাদক নিরাপদ সর্দার, সংগঠনের নেত্রী বন্যা টুডু এবং সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য। সভাপতিত্ব করেন তুষার ঘোষ।
পুলিশি অসহযোগিতা উপেক্ষা করে হাওড়া এবং শিয়ালদহ থেকে খেতমজুরদের আসা দু’টি মিছিল রানি রাসমণি রোডে ঢুকতেই অ্যাভিনিউর তিনটি লেনই বন্ধ হয়ে যায় ভিড়ে। খেতমজুর, গ্রামের গরিব আদিবাসীরা ধামসা মাদল নিয়ে নেচে গেয়ে এই অধিকার আদায়ের সমাবেশে যোগ দিয়েছেন প্রবল স্বতঃস্ফূর্ততায়।
বক্তব্য রাখছেন বন্যা টুডু।
সভার শুরুতে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গণনাট্য সংঘের গানে উঠে আসে আজকের গ্রাম বাংলার নিদারুণ ছবি।
‘কাজ নাই কাজ নাই ঘরে ঘরে, নিত্য হাহাকার
অর্ধাহারে থাকি কেউ তো, কারো অনাহার
আমরা খেত মজুর, খেতমজুর আমরা খেতমজুর।
ছেলেগুলো কাজের খোঁজে চলে যায় বিভূঁইয়ে,
হায় হায় হায় হায় ফিরে আসে, কফিনেতে শুয়ে
মরব না মরব না আমরা যত দুখের বান
রুখব আমরা লক্ষ হাতে নিয়ে লাল নিশান।’
প্রবীণ গণশিল্পী দেবীদাস তরফদারের গাওয়া এই গানে দৃশ্যতই রক্ত পতাকা হাতে গলা মেলাতে দেখা গেছে সমাবেশে আসা তরুণদের। রাজ্যে লাগাতার বৃষ্টি, উত্তরের জেলাগুলিতে বন্যা পরিস্থিতি সত্ত্বেও জেলাগুলি থেকে বহু মানুষ জেদকে সঙ্গী করে এদিন এসেছিলেন কলকাতায়।
সমাবেশ থেকে রাজ্যের খেতমজুরদের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে, ‘৪ক ফর্ম ফিল আপ করো, কাজ চাও। সেই ফর্ম-এর কপি খেতমজুর ইউনিয়নকে পাঠাও। কাজ না দিলে খেতমজুর ইউনিয়নের পক্ষ থেকে মামলা করা হবে। রাস্তার লড়াইয়ের পাশাপাশি চলবে আইনি লড়াই। একশো দিনের কাজের প্রকল্প অনেক লড়াই করে আদায় করা আইনি অধিকার। খেতমজুরদের তার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না।’
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তৃণমূলের সন্ত্রাস সত্ত্বেও গ্রাম থেকে আসা হাজারো মানুষের সমাবেশকে অভিনন্দন জানিয়ে বিজয়রাঘবন বলেন, দিল্লিতে মোদি আর এখানে দিদির রাজত্ব। দুই রাজত্বই গরিব বিরোধী। এদের সবক শেখাতে ১১ অক্টোবর সারা দেশে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কাজের দিন বাড়ানো ও মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন হবে। বাংলার বুকেও এই আন্দোলন গড়ে তুলুন।
তিনি তৃণমূলের উদ্দেশ্যে বলেন, বাংলার বামফ্রন্ট সরকার গরিবদের অধিকার রক্ষায় যে সব উদ্যোগ নিয়েছিল এখন সেগুলো কোথায়? কেরালায় বাম গণতান্ত্রিক মোর্চা সরকার একশো দিনের কাজ চেয়েও কেউ না পেলে তাকে ক্ষতিপূরণ দেয়। কেরালায় ভূমিহীন গৃহহীন খুঁজে পাওয়া যাবে না, গরিবদের জল বিদ্যুৎ পাকা বাসযোগ্য বাড়ি দিয়েছে কেরালা সরকার। মমতা ব্যানার্জির সরকার বাংলায় গরিবের টাকা লুটের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে। তৃণমূল সরকার দুর্নীতিতে ব্যস্ত। গরিবের জন্য ভরতুকি কমিয়ে বিজেপি সরকার বিভাজনের রাজনীতি করছে।
আইনজীবী ও সাংসদ বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য সমাবেশে বলেন, সরকারের দায় গরিব প্রান্তিক মানুষকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ন্যায় দেওয়া। অনুদান নয়, চাই কাজের অধিকার। গরিব মানুষ এরাজ্যে কাজ না পেয়ে ভিন রাজ্যে গিয়ে কফিন বন্দি হয়ে ফিরে আসবেন এটা আমরা চলতে দেব না। বলতে লজ্জা লাগে মজুরির টাকা খেতমজুরদের হকের টাকা - তা চুরি হয়েছে। তা না দেওয়ায় আমরা মামলা করেছি। রাজ্য সরকার আর্থিক হিসাব দিচ্ছে না বলে কেন্দ্রীয় সরকার একশো দিনের কাজের প্রকল্পের টাকা দিচ্ছে না! ওদের চুরি, ওদের ঝগড়া, ওদের মামলা, ওরা নিজেরা বুঝে নিক। প্রাপ্য টাকা আমরা আদায় করে আনবই।
অমিয় পাত্র বলেন, বিজেপি-তৃণমূল গরিবের অধিকারকে মর্যাদা দেয় না। বামপন্থীদের চাপে ইউপিএ সরকার আইন করে যে একশো দিনের কাজের অধিকার দিয়েছিল সেটাও মানছে না। কাজের টাকা চুরি করল তৃণমূল আর শাস্তি পাচ্ছে গরিব খেতমজুর। এখন বলছে তৃণমূল নেতারা নাকি প্লেনে চেপে দিল্লিতে গিয়ে এসি হোটেলে থেকে বকেয়া না দেবার প্রতিবাদ করতে যাবে। এসব প্রতিবাদ নাকি প্রহসন? ঘর, বকেয়া, পেনশন আদায়ের জন্য বাংলার খেতমজুরদের শ্রমিক সহ গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
এদিনের সমাবেশে বাংলার খেতমজুরদের দুর্দশায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বি বেঙ্কট বলেন, কেন্দ্রের মোদি সরকার এবং রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে হটানোর সংগ্রামে শ্রমজীবীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ১১ অক্টোবর সারা দেশে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে কাজের দিন বাড়ানো ও মজুরি বাড়ানোর দাবিতে আন্দোলন হবে। বাংলার বুকেও এই আন্দোলন গড়ে তুলুন। রাজ্যের ১৬ লক্ষ খেতমজুরের লড়াইয়ে পাশে আছে গোটা দেশ।
খেতমজুর আন্দোলনের আদিবাসী নেত্রী বন্যা টুডু সমাবেশে বলেছেন, মোদি চারশো টাকার রান্নার গ্যাস বারোশো টাকায় নিয়ে গেছেন। মমতা ব্যানার্জি কি ভেবেছেন ক্লাব ঘরে টিভি দিয়ে খেতমজুরদের মুখ বন্ধ করে রাখবেন? আজ খেতমজুররা এখানে এসেছেন, এরপরে দাবি আদায়ের জন্য নবান্নে যাবেন।
সমাবেশের সভাপতি সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভাপতি তুষার ঘোষ বলেছেন, বাংলার গ্রামে কোনো কাজ নেই। কৃষক চাষ করে ঋণের দায়ে গলায় দড়ি দিচ্ছে, খেতমজুর কাজ না পেয়ে অন্য রাজ্যে গিয়ে বিপদে পড়ছে, মরছে। আর তৃণমূল লুটেরা বাহিনী তৈরি করে গ্রামের গরিবদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। এই অবস্থা চলতে পারে না।
এদিন নিরাপদ সর্দার বলেন, এই সমাবেশে আসা মানুষের ঢল প্রমাণ করছে গ্রামের গরিব মানুষ জাগছে। তাই ঘুম ছুটেছে তৃণমূল বিজেপি’র। এই সুবিশাল সমাবেশের সাফল্যের বার্তা পৌঁছে দিতে হবে গ্রামে ফিরে গরিব মানুষের কাছে। আরও শক্তিশালী করতে হবে সংগঠনকে। পঞ্চায়েতের পর যেসব ঐক্যবদ্ধ কর্মসুচি নেওয়া হয়েছে তা সফল করতে হবে। বাংলার সবচেয়ে গরিব খেতমজুরের পরিবারের ছেলে-মেয়েরা শিক্ষার আঙিনা থেকে ছিটকে গেছে মোদি মমতা সরকারের নীতির জন্য। অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ২০২৪-এর নির্বাচনে হারিয়ে দিতে হবে গরিবের শত্রু তৃণমূল-বিজেপি’কে।