৬১ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১১ আশ্বিন, ১৪৩০
নতুন মোড়কে কেন্দ্রের শিক্ষানীতির প্রতিচ্ছবি
সুকুমার পাইন
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০: বিপন্ন সময়ে শিক্ষার শব সাধনা
সারা বিশ্ব যখন এই শতাব্দীর ভয়ঙ্কর মহামারী করোনায় বিপর্যস্ত, বিধ্বস্ত, সারা দেশ যখন আতঙ্কিত, দেশের দোকান-পাট, হাট-বাজার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ, যে সময় মাসে ৫০ লক্ষ মানুষ কাজ হারিয়ে সরকারি এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবি সংস্থার সাহায্যে অনিয়মিত ভাবে দু-মুঠো ভাত পাচ্ছেন, ঠিক সেই সময় জুলাই মাসের ২৯ তারিখ, যে মাসে নতুন করে ১১ লক্ষ মানুষ করোনায় আক্রান্ত, ২০ হাজার সহ-নাগরিক কোভিডে মৃত - ঠিক সেই মুহূর্তে ‘শিক্ষাদরদি’ মোদির সর্বজনীন শিক্ষার জন্য প্রাণ আকুল হয়ে উঠলো। যেভাবে ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার রেল, বিমান, খনি, ব্যাঙ্ক, কৃষি রাতের অন্ধকারে করপোরেটদের কাছে বেচে দিতে শুরু করেছিল, ঠিক তেমনিভাবে সারা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিক্ষার বাজারে ‘জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০’-এর নাম করে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বিজেপি সরকারের শ্রেণিমিত্র একচেটিয়া পুঁজির হাতে সঁপে দেবার নীল নকশা তৈরি করে। শিক্ষা সাংবিধানিকভাবে যুগ্ম তালিকাভুক্ত হলেও দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নীতি নির্ধারণে রাজ্যগুলির মতামত নেওয়া হলো না, ব্রাত্য রইল শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রী আর অভিভাবকেরা। দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, বহুমাত্রিক সংস্কৃতি, বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্যের বহুত্ববাদী ধারাকে অস্বীকার করে নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি গোল গোল কথার পাহাড় তৈরি করে দেশের প্রান্তিক মানুষের শিক্ষা পাবার অধিকারকে খর্ব করার চক্রান্ত করলো কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। এ হলো আরএসএস-এর নির্দেশিত পথে দেশের শিক্ষাকে সংকীর্ণ ধর্মীয় আধিপত্যবাদের চেষ্টায় নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন। একদিকে সকলের জন্য সমমানের শিক্ষার গল্প ফেঁদে প্রাথমিক শিক্ষা যা একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার ভিত্তিভূমি তৈরির আসল জায়গা, তাকে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের হাতে ফেলে দিয়ে অঙ্কুরেই সাধারণ এবং প্রান্তিক মানুষের শিশুপুত্র কন্যাকে বুনিয়াদি শিক্ষার উৎকর্ষতা থেকে বঞ্চিত করার নীতি গ্রহণ করেছে দেশের সরকার। মৌলিক শিক্ষার পরিবর্তে কর্মমুখী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ, মাধ্যমিক পরীক্ষার অবলুপ্তি, স্কুল স্তরে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সেমেস্টার পদ্ধতি প্রচলন, হিন্দি ও সংস্কৃতকে চাপিয়ে দেবার উদগ্র বাসনা, সাধারণের বিদ্যালয় ব্যবস্থার পরিবর্তে অনলাইন শিক্ষা পদ্ধতির উপর গুরুত্ব, রুগ্ণ ছাত্রাল্পতায় ধুঁকতে থাকা স্কুলকে অন্য স্কুলের সাথে যুক্ত করে স্কুল কমপ্লেক্স তৈরি করার নামে শিক্ষক নিয়োগ এবং পরিকাঠামোগত দায় থেকে নিজেদের মুক্ত করার প্রয়াস, ইউজিসি, এআইসিটিই প্রভৃতি উচ্চশিক্ষার নিয়ামক ঐতিহ্যশালী সংস্থাগুলির অবলুপ্তি ঘটিয়ে একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার মাধ্যমে শিক্ষাক্ষেত্রে খবরদারিকে নিশ্চিত করা, হিন্দুত্ব ও ভারতীয়ত্বকে সমার্থক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা, শিক্ষাখাতে ব্যয় হ্রাস করে বড়ো বড়ো বুলি আউড়ে দেশি-বিদেশি করপোরেটদের হাতে শিক্ষাকে অর্পণ করার প্রয়াস আর জাতীয়তাবাদী সংগঠনের হাতে শিক্ষাকে ছেড়ে দিয়ে আরএসএস-এর উগ্র হিন্দুত্ববাদকে প্রশ্রয় দেওয়াই বিজেপি’র সর্বনাশা নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০-এর মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষানীতিঃ ২০২০ - বিরোধিতার আড়ালে কেন্দ্রের শিক্ষানীতি প্রয়োগের কৌশল
ভারতীয় সংবিধানে শিক্ষাকে যুগ্ম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ফলত দেশের শিক্ষানীতি প্রণয়নে রাজ্যগুলির মতামত গ্রহণ কেন্দ্রের সরকারের একপ্রকার বিধিবদ্ধ কর্তব্য। দেশের শিক্ষাক্ষেত্রের বিরাট বাজারকে করপোরেটদের কাছে খুলে দেবার জন্য উদগ্র কেন্দ্রের মোদি সরকার কোনো রাজ্য সরকার বা মুক্তমনা শিক্ষাবিদ বা শিক্ষকদের মতামত নেয়নি। এই প্রশ্নে দাঁড়িয়ে সাংবিধানিক চৌহদ্দির মধ্যে থেকেই কেরালা, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক পৃথক পৃথক ভাবে শিক্ষানীতি গ্রহণ করেছে। ঠিক একইভাবে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারও তড়িঘড়ি নিজেদের অনুগত কিছু শিক্ষাবিদকে দিয়ে ১৭৩ পাতার শিক্ষানীতি হাজির করেছে। আপাতদৃষ্টিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই শিক্ষানীতি কেন্দ্রের শিক্ষানীতির থেকে পৃথক।
নির্বিষ বিরোধিতা
মূলগতভাবে কেন্দ্রের সর্বনাশা শিক্ষানীতির বিরোধিতা বা তার বিষবাষ্প থেকে রাজ্যের শিক্ষাকে বাঁচাবার কোনো দিশা দেখাতে পারেনি পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষানীতি-২০২৩। কিছু ক্ষেত্রে প্রকরণগত, পদ্ধতিগত, শিখন কাঠোমোগত বিষয়ে কেন্দ্রের নীতির বিপ্রতীপে হাঁটলেও তৃণমূল কংগ্রেস সরকার কৌশলে আরএসএস-র কৌশলগত অংশীদার হিসাবে আরএসএস নির্দেশিত পথে প্রণীত দেশের শিক্ষানীতির সর্বনাশের মূলে কোনো আঘাত করার চেষ্টা করেনি, বরং সযত্নে শিক্ষা বেসরকারিকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণকে মদত দিয়েছে।
● জাতীয় শিক্ষানীতিতে ৫+৩+৩ ধারায় ছাত্র-ছাত্রীদের শ্রেণি বিন্যাস করা হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষানীতিতে এটি ৫+৪+২+২ অক্ষুণ্ণ রাখার পক্ষে।
● জাতীয় শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক পরীক্ষার অবলুপ্তির কথা বলা হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক বহাল থাকবে।
● দেশের শিক্ষানীতিতে নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সেমেস্টার পদ্ধতি চালু রাখার কথা বলা হয়েছে। রাজ্য একই ধারায় অষ্টম শ্রেণি থেকে এই পদ্ধতি চালু করার কথা বলেছে। এক্ষেত্রে নীতিগত কোনো বৈরিতা নেই।
● জাতীয় শিক্ষানীতিতে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ত্রিভাষা সূত্র আরোপ করা হয়েছে। আমাদের রাজ্যে পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ত্রিভাষা চালু করার প্রস্তাব আছে।
● জাতীয় শিক্ষানীতিতে আন্ডার গ্রাজুয়েটদের একটি অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাজ্যের শিক্ষানীতি এই মতের বিরোধিতা করে বলেছে - তাতে গ্রামীণ ছাত্র-ছাত্রীরা উচ্চ শিক্ষায় পিছিয়ে পড়বে এবং এগিয়ে থাকা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা তাদের জন্য বন্ধ থাকবে।
● জাতীয় শিক্ষানীতি সারা দেশে একইরকম কারিকুলাম ও পদ্ধতি চালু করতে চায়, রাজ্য শিক্ষানীতি বাংলার সংস্কৃতির বিভিন্নতা ও ঐতিহাসিক পরম্পরাকে গুরুত্ব দিয়ে তা শিক্ষায় অঙ্গীভূত করতে চায়।
বিরোধিতার মাঝে ঐক্যের সুর
● কেন্দ্রীয় নীতি অনুসরণ করেই প্রাথমিক শিক্ষার একটা বড়ো অংশের দায়িত্ব অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এই রাজ্যে। যে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের সরকারি কর্মী বলে মান্যতা নেই, যাদের বেতন কাঠামো নেই, অত্যন্ত কম ভাতায় যাদের কাজ করতে হয়; ন্যূনতম যোগ্যতায় যে কাজে যুক্ত হওয়া যায় তাদের উপর শিশু পরিচর্যা, খাওয়ানোর পাশাপাশি অনলাইনে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা জাতীয় শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে। বাস্তবে, মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবকেরা অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে তাঁদের শিশুদের পাঠাবেন কী? গোড়াতেই সামাজিক ধন-বৈষম্যের শিকার হবে না তো দরিদ্র, প্রান্তিক পরিবারের শিশুরা? - এ বিষয়ে রাজ্য সরকার দায় এড়িয়ে সবার জন্য শিক্ষার গল্প শোনালেও উৎকর্ষ শিক্ষার তত্ত্ব বাস্তবে টিকবে তো?
● ত্রিভাষার ক্ষেত্রে শিক্ষাবিদদের অভিমতঃ শৈশবে মাতৃ ভাষাই শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হওয়া উচিত। বর্তমানে সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে তৃতীয় ভাষা চালু আছে। শিক্ষাবিজ্ঞান অনুযায়ী ত্রিভাষা সূত্র প্রয়োগে রাজ্য কি যথাযথভাবে কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির বিরোধিতা করতে পারলো? প্রথম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি থেকে তৃতীয় ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হলো - এটা কি বিজ্ঞানসম্মত?
● জাতীয় শিক্ষানীতির মতো রাজ্য শিক্ষানীতিতেও অনলাইন ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করা হয়েছে। আধুনিক সময়ে প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া আবশ্যক; কিন্তু তা কখনো শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষিকার দ্বারা পাঠদানের বিকল্প হতে পারে না, যতই নরম সুরে রাজ্য শিক্ষানীতিতে এ বিষয়ে ভালো ভালো কথা বলা হোক না কেন, আদতে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত ভরসা রাখা শিক্ষাঙ্গনে ধনী-দরিদ্র শিক্ষার্থীর ধন বৈষম্যকে প্রকট করে তুলবে।
● কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির মতো ছাত্র-ছাত্রীদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে অত্যন্ত ইতিবাচক কথা লিপিবব্ধ আছে রাজ্য শিক্ষানীতিতে। এক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষানীতির সাথে রাজ্য শিক্ষানীতির তফাত থাকার কথা নয়। বাস্তবে রাজ্যের ৮৪,০০০ স্কুলের ১ কোটি ১৫ লক্ষ শিশুর মিড ডে মিল প্রদানে দুর্নীতির যে পাহাড় তৈরি হয়েছে এবং মাথা পিছু যা বরাদ্দ করা হয়েছে তাতে পুষ্টিকর কেন, সাধারণ খাবারও দেওয়া বেশ কঠিন। রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর বেআবরু চেহারা প্রতিদিন আমাদের সামনে প্রকাশিত হচ্ছে। এই স্বাস্থ্য পরিকাঠামো নিয়ে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, টিকাকরণ - সব সম্ভব তো?
● কেন্দ্রের শিক্ষানীতির অন্ধ অনুকরণ করতে গিয়ে পশ্চিমবাংলায় অষ্টম শ্রেণি থেকে সেমেস্টার পদ্ধতি প্রচলন বাংলার শিক্ষাকে ধ্বংস করবে। এমনিতেই বিভিন্ন কারণে পশ্চিমবাংলায় প্রকৃত শিখন দিবস সংখ্যা শিক্ষার অধিকার আইনে নির্দিষ্ট দিন সংখ্যার চাইতে অনেক কম, ঘনঘন বিভিন্ন কারণে বিদ্যালয়ের ছুটির ফলে কর্মদিবস ক্রমশ কমছে - সে অবস্থায় দাঁড়িয়ে সেমেস্টার পদ্ধতির মতো একটি বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিকে সার্থকভাবে রূপায়ণ করা বেশ কঠিন। একদিকে গ্রামাঞ্চলে ছাত্র-ছাত্রী অনুপাতে শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা ভীষণভাবে কম, পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে যুক্ত করার ফলে শ্রেণি শিখন ভীষণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলত, সেমেস্টার পদ্ধতিতে হাতে গোনা কয়েকটি অধ্যায় আলোচনা করে সেখান থেকেই পরীক্ষা নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের বেশি নম্বর দেবার প্রবণতার ফলে শিক্ষা ব্যবস্থার চূড়ান্ত অবনমন ঘটবে।
● কেন্দ্রীয় শিক্ষানীতির মতো রাজ্য শিক্ষানীতিতেও মুক্ত বিদ্যালয় ও মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে উৎসাহিত করা হয়েছে।
● সারা বিশ্বের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পথ চলতে বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রয়োজন আছে। চীন, জাপানে যেখানে প্রশিক্ষিত শ্রমিক শক্তির হার ৫৫ শতাংশ ও ৯০ শতাংশ, সেখানে ভারতে এই হার ২ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্টভাবে পরিকল্পনামাফিক পথে এগোনো দরকার। জাতীয় শিক্ষানীতিতে আন্ডার গ্রাজুয়েটে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি কোর্স চালু করার উদ্ভট চিন্তাকে রাজ্য শিক্ষানীতি মান্যতা দিয়েছে। কিন্তু এর পরিকাঠামো, শিক্ষক, বীক্ষণাগার, ওয়ার্কশপ - কোনো কিছুর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নেই। রাজ্য শিক্ষানীতিতে শুধুমাত্র গ্রীষ্মাবকাশে বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিদর্শন, হস্তশিল্প কেন্দ্রে ভ্রমণ ইত্যাদির কথা বলা হলেও তার সুনির্দিষ্ট কোনো দিশা নেই। বর্তমানে রাজ্য সরকারের পরিচালনাধীন বৃত্তিমূলক শিক্ষা সংসদের কর্ম পদ্ধতি প্রমাণ করে যত ভালো কথাই খসড়ায় বলা হোক না কেন, বাস্তবে এগুলি আকাশ-কুসুম কল্পনাই হয়ে থাকবে শিল্পহীন এই বাংলায়।
● বহুদিন আগে থেকেই শিক্ষাকে ‘পণ্য’ হিসাবে গণ্য করার প্রবণতা দেশের সরকারের আছে তা লক্ষ করা গেছে। আমাদের দেশে শিক্ষা পেশা নয়, একটি ব্রত। এবারের রাজ্য শিক্ষানীতিতে সেই দার্শনিক ধারণা ব্ৰতকে পুরোপুরি আর পাঁচটা ট্রেডের মতো গণ্য করা হয়েছে। তাই শিক্ষককে “প্রফেশনাল ক্যাডার” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিজেপি সরকার ও মমতা ব্যানার্জির সরকারের মূলগত, নীতিগত কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
● জাতীয় শিক্ষানীতিকে শিরোধার্য করে রুগ্ণ বিদ্যালয়কে বাঁচানো নয় বরং কোঠারি কমিশনের ধারণার আড়ালে ক্লাস্টারের মাধ্যমে তা তুলে দেবার ছক রয়েছে রাজ্য শিক্ষা নীতিতেও।
● জাতীয় শিক্ষানীতির মূল কথা কেন্দ্রিকতা ও একচেটিয়া আধিপত্য কায়েম। রাজ্য শিক্ষানীতিও একই পথের পথিক। প্রশাসনিক বদলি এবং হিং টিং ছট কায়দায় প্রমোশনের খুড়োর কল দেখিয়ে শিক্ষকদের কাবু করার নিদান এই নীতিতে রয়েছে।
দুই শিক্ষানীতিঃ বাজার ও রাষ্ট্রের সমীকরণ
১৯৮০ সালের পর থেকে বিশ্বব্যাঙ্কের মতো একটি বাণিজ্যিক সংস্থা দেশে দেশে জনসেবার নামে শর্তসাপেক্ষে আর্থিক সাহায্য করতে থাকে। তাদের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রের ভূমিকাকে গৌণ করে বাজার দখলের চেষ্টা। আমেরিকা ও চীনের পর ভারতের শিক্ষার বাজার অত্যন্ত বৃহৎ ও সম্ভাবনাময়। ২০০০ সালে বিড়লা-আম্বানি শিক্ষা রিপোর্টে মুক্ত শিক্ষার জয়গান করে এবং শিক্ষায় বিদেশি পুঁজির পক্ষেই মত দেন। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরপরই ‘স্বয়ম’ বলে একটি সংস্থার মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করিয়ে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে দূরভাষে ডিগ্রি অর্জন করার সুযোগ এসে যায়। বাস্তবে এটি টাকা দিয়ে ডিগ্রি কেনা ছাড়া আর কিছু নয়। সারা দেশের সঙ্গে হই হই করে আমাদের রাজ্যেও দেশি-বিদেশি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ডানা মেলছে। দেশের ও রাজ্যের সরকার বেশ বুক ফুলিয়ে GER (Gross Enrolment Ratio) ১০০ শতাংশ করার কথা বলছে। মোদি ক্ষমতায় আসার পর ৫২,০০০ উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান ১৫০০-এ পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে তৃণমূল সরকার খুব পিছিয়ে নেই। ২০১১-২০১২ সালে রাজ্যে স্কুল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল ৭৪,৭১৭ আর ২০২১-২০২২-এ তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭, ৬৯৯। আসলে সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীকে স্কুলমুখী করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। এর উলটো চিত্র হওয়ার অর্থ ফাঁকা জায়গা পূরণের জন্য বেসরকারি উদ্যোগকে নীরবে মদত দেওয়া। স্কুল, কলেজে পরিকাঠামোর অভাব, শিক্ষকের অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত ক্লাস রুমের ঘাটতি, শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব সার্বিক ভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাধারণ শিক্ষার্থীর অনাস্থা তৈরি হওয়া। এক্ষেত্রে ধনীরা বিকল্প পথে শিক্ষা কিনে নেবার প্রতি আগ্রহী হয়। আর কৌশলে সেই বাজার তৈরি করার কাজ করে চলেছে কেন্দ্র ও রাজ্যের সরকার।
কোন্ পথে রাজ্যের শিক্ষা?
আমাদের রাজ্যে স্কুল স্তরে মোট পড়ুয়ার ৮৪ শতাংশ সরকার নিয়ন্ত্রিত ও পোষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ গ্রহণ করে থাকে। শিক্ষার মানোন্নয়ন বা সার্বিক শিক্ষার সঙ্গে বৃহত্তর সমাজ ও অর্থনৈতিক স্বয়ম্ভরতা নির্ভর করে। দেশের সরকার বা রাজ্যের সরকার শিক্ষার সাথে অভিভাবকদের আর্থিক ক্ষমতায়নের বিষয়টি কখনোই গুরুত্ব দিচ্ছে না। ফলে পরিমাণগত ও গুণগত মানের শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষার্থীরা। ১৯৬৬ সাল থেকে জিডিপি’র ৬ শতাংশ শিক্ষাখাতে ব্যয়ের কথা বলা হলেও এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় সরকার ২.৯ শতাংশ ব্যয় করছে। প্রতি বছর শিক্ষাখাতে ব্যয় হ্রাস করা হচ্ছে। রাজ্যের সরকারও পরিকাঠামো উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, শূন্য পদে স্বচ্ছ নিয়োগে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছে। রাজ্যের ৬৯ শতাংশ বিদ্যালয় গ্রামীণ এলাকায় অবস্থিত। অস্বচ্ছ, দুর্নীতিযুক্ত বদলি নীতির ফলে গ্রামীণ স্কুলগুলি ধুঁকছে। রাজ্যে ১,১০,০০০ শিক্ষকপদ শূন্য। নজিরবিহীন নিয়োগ দুর্নীতিতে প্রতিদিন শিরোনামে আজকের বাংলা। অযোগ্য নিয়োগে শিক্ষাদানের গুণগত মান নিম্নমুখী। অভিভাবকদের আর্থিক স্বয়ম্ভরতা অদৃশ্য, শ্রমজীবী মানুষের আয় কমেছে, বেকারি বাড়ছে, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম নেই - সার্বিক নৈরাজ্যে বিভ্রান্ত শিক্ষার্থীরা ও তাদের অভিভাবকেরা। একদা ছাত্র-ছাত্রীতে কোলাহল মুখরিত স্কুলগুলিতে আজ নিঃসীম নীরবতা। ৩০-এর কম ছাত্র-ছাত্রী আছে এমন ৮,২০৭টি স্কুল উঠে যাবার মুখে। এদের বড়ো অংশ গ্রামীণ এলাকার। বিদ্যালয় শিক্ষার সার্বিক সাফল্যের জন্য তিনটি ‘A’ আবশ্যক - এগুলি হলো - Access, Attendance এবং Achievement। সব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ছে রাজ্য শিক্ষার অধিকার আইন-২০১০ অনুযায়ী বাড়ির অদূরে শিক্ষা পাবার অধিকার হারাচ্ছে শিশু শিক্ষার্থী।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, দারিদ্র্যের কারণে স্কুলছুট বাড়ছে। ২০২২ সালে নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করেও ২ লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী মাঝপথে হারিয়ে গেছে। বাংলার শিক্ষার পোর্টালে সংখ্যাতত্ত্বের জাদুতে পরিসংখ্যানে ‘এগিয়ে বাংলা’, বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। রাজ্য শিক্ষানীতির কালো অক্ষরে অনেক ইতিবাচক সুখস্বপ্নের আবেশ থাকলেও এই মুহূর্তে প্রায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চলা বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় কোনো আলোর রেখা নেই। একমাত্র শিক্ষার্থী-অভিভাবক - শিক্ষাদরদি আর শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীর যৌথ উদ্যোগে হক বুঝে নেবার জান কবুল লড়াই-ই ফিরিয়ে দিতে পারে সে আলো। আলোর পথযাত্রীদের অপেক্ষায় দিন গুনছে বাংলার শিক্ষার ভবিষ্যৎ।
তথ্যঋণঃ
১। গণশক্তি, ৩১ মে, ২০২৩; ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩; ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৩
২। সহমন, ২২ আগস্ট, ২০২০
৩। আনন্দবাজার পত্রিকা, ২২ মার্চ, ২০২৩
৪। নতুন শিক্ষানীতি, শিঞ্জিনী বসু
৫। এই সময়, ৩০ মে, ২০২৩