৬১ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১১ আশ্বিন, ১৪৩০
বিজেপি’র দুর্নীতি
সুশোভন পাত্র
সবচেয়ে বেশি জোরে কেঁদেছিলেন হারুর ঠাকুরমা। তিনি আবার কানে শোনেন কিছু কম। তাঁকে সবাই জিজ্ঞেস করল, “আপনি এত কাঁদছিলেন কেন?” তিনি বললেন, “আমি কি অত জানি? দেখলুম ঝিয়েরা কাঁদছে, বৌমা কাঁদছেন, তাই আমিও কাঁদতে লাগলুম - ভাবলুম একটা কিছু হয়ে থাকবে।”লিখেছিলেন সুকুমার রায়।
বাংলার বিজেপি’র তৃণমূলের দুর্নীতির সম্পর্কে অভিযোগ করা দেখলে তাই মনে হয়। দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ করছেন কে? না, শুভেন্দু অধিকারী। যিনি নিজে ক্যামেরার সামনে ঘুষ খাওয়ার নারদা স্টিং অপারেশনে অভিযুক্ত। দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগ করছেন কে? না, অনুরাগ ঠাকুর, যিনি হরিয়ানা ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতির মাস্টারমাইন্ড, আর স্বজন পোষণের প্রাইম একজামপল। দুর্নীতির অভিযোগ করছেন কে? না, অমিত শাহ, যার ডাইরেক্টরশিপে গুজরাটের সমবায় ব্যাঙ্কে নোটবন্দির সময় জমা পড়েছে সবচেয়ে বেশি টাকা। দুর্নীতির অভিযোগ করছেন কে? না, নরেন্দ্র মোদি যিনি আদানি-আম্বানির চাটার্ড বিমানে ভোট প্রচার করেন।
কথায় বলে, চালুনির নাকি ছুঁচের বিচার করতে নেই। সম্প্রতি সিএজি-র রিপোর্টে ব্যাপক দুর্নীতি প্রকাশ্যে এসেছে মোদি সরকারের। যে রাস্তা নির্মাণের প্রকৃত খরচ হওয়ার কথা ১৮ কোটি/কিমি, সেটা দেখানো হয়েছে ২৫০ কোটি/কিমি। এভাবেই দ্বারকা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ৭.৫ লক্ষ কোটি টাকা লোপাট। ভুয়ো আধার কার্ড ও মোবাইল নম্বরে ৭.৩৯ লক্ষ রোগীর নাম নথিভুক্ত হয়েছে। ৮৮ হাজার রোগীর মৃত্যুর পরও চলেছে চিকিৎসা। স্বাস্থ্য বিমাতেও আর্থিক কারচুপি। ওলড এজ পেনশন প্রকল্পে পেনশন গ্রাহকের সংখ্যা বাড়িয়ে বেশি ব্যয় দেখানো হয়েছে। এমনকী মোদির সাধের অযোধ্যা উন্নয়ন প্রকল্পেও ঠিকাদারদের বেআইনিভাবে ১৯.১৭ কোটি টাকা পাইয়ে দেওয়া হয়েছে। ২-জি কেলেঙ্কারির সময় সিএজি-র রিপোর্ট নিয়ে শোরগোল ফেলা বিজেপি এখন চুপ কেন? একেই বলে, নিজের বেলায় আঁটিশুটি অন্যের বেলায় দাতকপাটি!
।। দুই ।।
বিজেপি’র দুর্নীতি কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়। বরং সিসটেম্যাটিক। এর আগে সন্তর্পণে আড়াল করা হয়েছিল ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের মুকুটে নবতম সংযোজন রাফায়েল যুদ্ধ বিমান ক্রয় সংক্রান্ত প্রতিরক্ষা দুর্নীতি। ২০১২’র রাফায়েল চুক্তিতে যেখানে ১২৬টি বিমানের প্রতিটি ৫২৬ কোটি টাকায় কেনার ব্যাপারে উভয়পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া হয়, প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে ১০৮টি বিমান রাষ্ট্রায়ত্ত হ্যাল তৈরি করবে বলে দাসাল্টের সঙ্গে আলোচনাও চূড়ান্ত হয়; সেই চুক্তির রুমাল ২০১৫’র প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ফ্রান্স সফরের পর আমূল বদলে হয়ে যায় বেড়াল। আগের ১২৬টি বিমান কেনার সিদ্ধান্ত বদলে হয়ে যায় ৩৬টি। প্রতিটি বিমানের ক্রয়মূল্য প্রায় তিনগুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১,৬৭০ কোটি। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘হ্যাল’-কে সরিয়ে চুক্তিতে ব্যাক ডোর এন্ট্রি নেয় অনিল আম্বানির রিলায়েন্স ডিফেন্স লিমিটেড।
সামরিক উৎপাদনে যে রিলায়েন্সের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, যুদ্ধ বিমান তৈরির জন্য যার কোনো পরিকাঠামো নেই, এমনকী দাসাল্টের সহযোগী হবার ঘোষণার মাত্র দশদিন আগেও সরকারি নথিতে যে সংস্থার কোনো অস্তিত্বও নেই; সেই রিলায়েন্সের সাথেই দাসাল্টের যৌথ সংস্থা গড়ার সিদ্ধান্ত হয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। আর ‘আত্মনির্ভরের’ মেকি স্লোগানের আড়ালে ব্রাত্য হয়ে গেল গত ২০ বছর ধরে দাসাল্টেরই তৈরি মিরেজ ২০০০ যুদ্ধবিমান রক্ষণাবেক্ষণ ও আপগ্রেডেশন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত, চতুর্থ প্রজন্মের ২৫টন ওজনের সুখোই ৩০ যুদ্ধবিমান তৈরিতে সিদ্ধহস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যাল।
প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরের যে সফরে খোদ প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গী ছিলেন না, সেই সফরে কোন জাদু বলে উপস্থিত ছিলেন অনিল আম্বানি? উত্তর নেই, কারণ সাধারণ দেশবাসীর কষ্টার্জিত ট্যাক্সের পয়সায় পুষ্ট সরকারি কোষাগারের সম্পদ, সমস্ত নিয়ম নীতি বিসর্জন দিয়ে, দেশের নিরাপত্তার সঙ্গে আপোশকারী চুক্তির মাধ্যমে আম্বানিদের পকেটে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে খোদ এই সরকার।
।। তিন।।
বিজেপি’র আমলে উল্কার বেগে উত্থান হয়েছে ব্যবসায়ী রামদেবের। সেটাও দুর্নীতির অন্যতম উদাহরণ। বিজেপি’র ফেভারিট বাবা রামদেব ২০১৪-তে মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময় মন্তব্য করেছিলেন, ‘নিজের মুখে নিজের প্রশংসা না করাই ভালো। তবু বলি, যে উর্বর জমিতে এই বিশাল রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হলো আমি সেই জমিতে লাঙল দিয়েছিলাম।’
অবশ্য কেবল লাঙলই দেননি; জমির উর্বরতার জন্য সেদিন যে ১১ লক্ষ টাকা বিজেপি’র পার্টি ফান্ডে ডোনেশন হিসেবে জমাও করেছিলেন ‘বাবা রামদেব’, আজ ‘আচ্ছে দিনে’র উর্বর জমিতে, সেই বিনিয়োগেরই ফসল ঘরে তুলছেন ‘ব্যবসায়ী রামদেব’। (ইন্ডিয়া টুডে, ১১ই মার্চ, ২০১১)
২০১৩’র আর্থিক বছরে যে পতঞ্জলির ‘অ্যানুয়াল টার্নওভার’ ছিল মাত্র ৪০০ কোটি, বিস্ময়করভাবে, ২০১৬’র আর্থিক বছরে সেই পতঞ্জলিরই ‘অ্যানুয়াল টার্নওভার’ বেড়ে দাঁড়ায় ৫,০০০ কোটি টাকা। ২০১৩’র মার্চে যে পতঞ্জলির ‘রেভেনিউ’ ছিল ১,০০০ কোটি, ২০১৭’র মে মাসে সেই পতঞ্জলির ‘রেভেনিউ’ এখন ১০,২১২ কোটি। গত চারবছরে হিন্দুস্থান লিভার, গোদরেজ, ডাবর’দের ‘গ্রোথ রেট’ মোটামুটিভাবে যেখানে ৮-১২শতাংশ, পতঞ্জলির সেখানে ২০ শতাংশ। চুলকানি থেকে দাদ-হাজা, শ্যাম্পু থেকে ফিনাইল, এমনকী বার্ধক্য রোধের ওষুধ কিংবা ত্বক চকচকে করার কসমেটিক্স-বাবার ঝুলিতে পণ্য প্রায় ৩৫০টি। শিল্পা শেঠির সাথে কপালভাতি কিংবা অনুলোমবিলোম এখন অতীত; রামদেব এখন পুরাদস্তুর ‘করপোরেট বাবা’। (স্ক্রল, ৩ মে ২০১৭)
বিজেপি সরকার ক্ষমতায় এসেই নব্য বিজনেস টাইকুন বাবাকে জেড ক্যাটাগরির নিরাপত্তা দেয়। বছরে ৪০ লক্ষ টাকা খরচা করে হরিয়ানার পঞ্চকুলার সাম্রাজ্যে মোতায়েন হয় ৩৫জন সশস্ত্র প্রহরী। সেই পঞ্চকুলা, যার ৫২,০০০ একর জমি, মনোহর লাল খট্টরের সরকার, ‘ওয়ার্ল্ড হারবাল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্টের’ অজুহাতে বিনামূল্যেই তুলে দিয়েছে রামদেবের হাতে। (ইকনমিক টাইমস, ১৮ জানুয়ারি ২০১৭) । অবশ্য শুধু হরিয়ানা নয়, সাধের ‘নরেন্দ্র ভাই’-এর ক্ষমতায়নের পর, বিজেপি শাসিত রাজ্যে মোট ২০০০ একর জমি নতুন করে অধিগ্রহণ করেছে পতঞ্জলি। পূর্ব আসামের চিরাঙে, ১২০০ একর জমিতে ‘পতঞ্জলি যোগপীঠ’ গড়ে তোলার জন্য রামদেবের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করে বিজেপি’র জোটসঙ্গী বড়োল্যান্ড পিপলস ফ্রন্ট নিয়ন্ত্রিত টেরিটরিয়াল কাউন্সিল। মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহান বাজার দরের থেকে ৮৮শতাংশ ডিসকাউন্টে ৪০ একর জমি বিলিয়ে দিয়েছেন পতঞ্জলির চরণতলে। উত্তরাখণ্ডের বিজেপি সরকারের অনুমোদনে গড়ে উঠছে ৫০০ কোটি’র “গোরু গবেষণা কেন্দ্র”। নাগপুরে যেদিন ২৫৮ কোটি টকা বাজার দরের ২৩৪ একর জমি, ৭৮শতাংশ ডিসকাউন্টে জলের দরে মাত্র ৫৮ কোটি তে কিনে নিয়েছিলেন রামদেব, সেদিন উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং কেন্দ্রীয় পরিবহণ মন্ত্রী নীতিন গড়করি। আর তাই সরকারি বদান্যতায় আজ ফরেনসিক ল্যাবে গুণমান পরীক্ষায় ডাহা ফেল করে পার্লামেন্ট থেকে সেনা ক্যান্টিন - রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে পতঞ্জলির পণ্য।
।। চার ।।
বিজেপি’র দুর্নীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ইলেক্টোরাল বন্ড। কিন্তু বিষয়টা এরকম মনে করার কারণ নেই যে, তার আগে ভারতের রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে করপোরেট ডোনেশনের চল ছিল না। কিন্তু তার আগে ২০,০০০টাকার বেশি যে কোনো ডোনেশন গ্রহণ করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলিকে তার বিশদ তথ্য নির্বাচন কমিশনে জমা করতে হতো। ২০১৭-১৮ সালে মোদি সরকার ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত আইন পাশ করে। সঙ্গে এফসিআরএ আইনে রেট্রোস্পেক্টিভ ভাবে সংশোধনী আনা হয়। গোদা বাংলায় এই দুটো আইনের বদলে ঠিক কী বলা হয়?
প্রথমত, ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে যে কেউ (ব্যক্তি বা কোম্পানি) যে কোনো রাজনৈতিক দলের তহবিলে অনুদান দিতে পারেন। অনুদান, অনুদানকারী এবং অনুদানের পরিমাণের মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গোপন থাকবে। প্রকাশ্যে আনার কোনো দায় রাজনৈতিক দলগুলির আর থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, এফসিআরএ আইনের রেট্রোস্পেক্টিভে সংশোধনী অনুযায়ী বিদেশি কোম্পানিগুলির রাজনৈতিক অনুদানে বৈধতা দেওয়া হয়।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলির তহবিলে যে কোনো অনুদানের ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বসীমা প্রত্যাহার করা হয়।
এখন আদানি সাম্রাজ্যের যে রমরমা আমরা দেখছি তার অন্যতম কারণ এই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি’র পার্টি ফান্ডে তাদের অনুদান এবং বিনিময়ে সরকারি নীতি প্রণয়নে বিজেপি সরকার আদানি গোষ্ঠীকে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার সমীকরণ।
।। পাঁচ ।।
পুঁজিবাদী সমাজের বাই প্রোডাক্ট হলো দুর্নীতির স্বাভাবিকীকরণ। সংখ্যাগুরু মানুষের কাছে দুর্নীতি এখন একটা নিপাট নিরীহ এবং স্বাভাবিক বিষয়। স্কুলে ভরতির ডোনেশন কিংবা বেসরকারি হাসপাতালের বিল, পঞ্চায়েতের সামাজিক প্রকল্পের বরাত কিংবা পৌরসভার পোস্তা-মাঝেরহাট ব্রিজের টেন্ডার, বাগড়ি মার্কেটের অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা সার্টিফিকেট কিংবা আপনার ড্রাইভিং লাইসেন্সের অনুমোদন - দুর্নীতি এই সমাজ ব্যবস্থার ছত্রে ছত্রে।
আপনি অফিসের প্রিন্টার ব্যবহার করে মেয়ের স্কুলের অ্যাসাইনমেন্ট প্রিন্ট করবেন, আপনি ফেক বিল জমা করে অফিসের মেডিক্লেম আদায় করবেন, আপনি রেলের টিকিট কাউন্টারের লাইনে সাইড থেকে হাত বাড়িয়ে টিকিট কাটার চেষ্টা করবেন, ট্যাক্স বাঁচাতে বিল ছাড়া জিনিস কিনবেন, উবের চড়লে কোনো এক অজানা কারণে এসি চলবে না, হলুদ ট্যাক্সিতে চাপলে মিটারে গাড়ি ছুটবে না - এরকম প্রতিদিন হাজার একটা দুর্নীতির সাথে আমরা আপোশ করে নিয়েছি। নিজেরা দুর্নীতি করাটাকে আত্মস্থ করেছি।
সাধারণ মানুষ ভাবেন রাজনীতি করছে, নেতা হয়েছে একটু দুর্নীতি তো করবেই। ভাবখানা এমন যেন রাজনীতি তো লোকে দুর্নীতি করার জন্যই করে। আদর্শের জন্য রাজনীতি করছে শুনলে সাধারণ মানুষ যে বিশ্বাস করেন না তাই না, বরং হাসেন। এই খুব বিষাক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করাটাই পুঁজিবাদের সাফল্য।
তাই বিজয় মালিয়া টু রাফালে - এ দেশে দুর্নীতি কোনো বিক্ষিপ্ত বিষয় নয়। নোট বাতিল টু সারদা - সংগঠিত লুঠের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইটা কোনো বিচ্ছিন্ন লড়াই নয়। বরং লড়াইটা যে আর্থিক ব্যবস্থা এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতিকে প্রোথিত করার চেষ্টা করছে, সেই আর্থিক ব্যবস্থা উপড়ে ফেলার লড়াই। যে রাজনীতি এই দুর্নীতিকে সযত্নে ভরণপোষণের দায়িত্ব নিয়েছে, সেই রাজনীতিকে পরাজিত করার লড়াই। লড়াইটা আসলে, যে সমাজ ব্যবস্থা আমাকে-আপনাকে প্রতিনিয়ত এই দুর্নীতির সাথে আপোশ করতে শেখাচ্ছে, সেই সমাজটা বদলে ফেলার লড়াই।