৬১ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১১ আশ্বিন, ১৪৩০
যে বিপদের মুখে আমরা
সুপ্রতীপ রায়
বিজেপি নেতাদের ঘৃণা ভাষণ চলছেই। সংসদের ভিতরেও তীব্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষপ্রসূত বক্তব্য উত্থাপিত হচ্ছে। আসলে শাসকদলের হাতে আক্রান্ত ভারতের সংবিধান। আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রধান চারটি স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, স্বাধীন বিদেশনীতি, অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব - প্রতিটি স্তম্ভের উপর ক্রমাগত আঘাত করে চলেছে বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার। মূল উদ্দেশ্য ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বদল। আরএসএস’র হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের বাসনা আমাদের দেশের সংবিধানকে বিপদের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা চ্যালেঞ্জের মুখে হিন্দুত্ববাদের বিপদ বাড়ছে। বুলডোজার দিয়ে মুসলিমদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, জোরপূর্বক ধর্মান্তরীকরণ, গোরক্ষার নামে পিটিয়ে হত্যা, লাভ জিহাদ প্রভৃতি প্রমাণ করছে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নির্দেশ শাসক বিজেপি মানবে না।
নাগরিকত্ব আইনে যে পরিবর্তন করা হয়েছে, তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষতাকেই আঘাত করেছে। আমাদের দেশের সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের মানা উচিত। কিন্তু এটা খুবই পরিতাপের বিষয় বর্তমান সংবিধান স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতাকে পদদলিত করে চলেছে শাসক বিজেপি। নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সংবিধানের অন্যতম ভাবনা ধর্মনিরপেক্ষতাকে আঘাত করা হয়েছে।
বিজেপি যে পথে অগ্রসর হচ্ছে তাতে ভারত ভয়ংকর বিপদের মধ্যে। মহাত্মা গান্ধী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ কেউই ধর্মের ভিত্তিতে জাতি বিভাজন মেনে নেননি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনতে মহাত্মাজি নোয়াখালি, কলকাতায় দৌড়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-“দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে, - যাবে না ফিরে -/ এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে”। ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে আরএসএস বিকৃত প্রচার করে চলেছে।
‘সেকুলারিজম’ শব্দটি ইংরেজি শব্দ। ইংরেজি ভাষায় অভিধানে বলা হয়েছে - এটা হলো সেই মতবাদ যেখানে রাষ্ট্র,নৈতিকতা, শিক্ষা ব্যবস্থা প্রভৃতি বিষয়ে ধর্ম বা ধর্মীয় অনুশাসনের আওতা থেকে পুরোপুরি মুক্ত রাখা উচিত। রাষ্ট্র বা রাজনীতি থেকে ধর্মের সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ এবং ধর্ম বা ধর্মীয় আচরণকে ব্যক্তির একান্ত নিজস্ব ব্যাপার বলে গণ্য করা হয়।
ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়টি আধুনিক। বিশ্বের সর্বত্র একথা প্রযোজ্য। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা নির্ভর করে বিভিন্ন ধর্মবিশ্বাসী মানুষ সকলেই আইনের দৃষ্টিতে, সংবিধানে ও সরকারি নীতির প্রশ্নে সমান হিসাবে গণ্য হচ্ছে কিনা তার উপর। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মীয় সম্প্রদায়ের আধিপত্য বা আশা-আকাঙ্ক্ষার স্থান নেই। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র কখনোই কোনো একটি ধর্মের পক্ষে অবস্থান নিতে পারেনা। ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশানো যাবে না। ধর্মনিরপেক্ষতা এমন এক ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক, ন্যায়বিচার পূর্ণ সমাজে পৌঁছাতে পারে। বহুত্ববাদী সমাজে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োজন আবশ্যিক।
ধর্মনিরপেক্ষতা হলো এমন এক ধারণা যেখানে ধর্ম ব্যক্তি মানুষের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার। অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষকে আঘাত না করে একজন ব্যক্তি স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করবে। কোনো ব্যক্তির ধর্মীয় আচরণ পালনে রাষ্ট্র কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করবে না, কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্বও দেখাবে না। প্রত্যেক নাগরিক যাতে তার ইচ্ছানুসারে ধর্মাচরণ করতে পারে তা দেখবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র সকল ধর্ম থেকে আলাদা থাকবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র চূড়ান্তভাবেই গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কি ধর্মকে বাদ দিয়ে চলা? কখনোই না কেউ যদি কোনো বিশেষ ধর্মে বিশ্বাসী হন, তিনি তাঁর ধর্মমত অনুযায়ী জীবন পরিচালিত করবেন, রাষ্ট্র চলবে রাষ্ট্রের মতো করে এবং ধর্ম চলবে ধর্মের মতন করে; দুটোকে মেশানো যাবে না। রাষ্ট্রের কাজে ধর্ম ঢুকবে না, ধর্মগত ব্যাপারে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না।
সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি তাঁর ‘সিউডো-হিন্দুইজম-এক্সপোজড’ (সিপিআই-এম), নয়া দিল্লি ১৯৯৩ প্রকাশনী, শীর্ষক পুস্তিকাতে সঠিকভাবেই লিখেছেন, “শুরুতেই একথা জোর দিয়ে বলা দরকার, ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র এই কারণেই যে, এদেশের বেশিরভাগ হিন্দু আরএসএস’র হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণাকে পরিত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকেই বরণ করে নিয়েছেন। তাঁরা আরএসএস’র ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এইজন্য যে, তা ভারতকে মধ্যযুগে নিয়ে যাবে এবং ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করবে। এই ব্যবস্থা হবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পরিপন্থী”। মোদি জামানায় আরএসএস ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করতে চায়।
প্রত্যেক দেশের সংবিধানেরই নিজস্ব দর্শন থাকে। আমাদের সংবিধানের ভিত্তি হিসেবে দর্শন আছে, সংবিধানে উদ্দেশ্য, সংকল্প আছে। সেই উদ্দেশ্য-সংকল্প ১৯৪৭ সালের ২২ জানুয়ারি সংবিধান সভায় গৃহীত হয়েছিল। উদ্দেশ্য-সংকল্পে অনেকগুলি কথা বলা আছে। যেমন বলা আছে, “ভারতের সকল অধিবাসীকে বিধি ও সর্বসাধারণের নৈতিকতা সাপেক্ষে সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়, প্রতিষ্ঠার ও সুযোগের সমানতা এবং আইনের সামনে সমানতা, চিন্তার, মতপ্রকাশের, বিশ্বাসের, ধর্মের, উপাসনার, বৃত্তির, মিলনের ও কর্মের স্বাধীনতা প্রত্যাভূতি দেওয়া হবে ও তা প্রতিষ্ঠা করা হবে, এবং সংখ্যালঘুদের অনগ্রসর ও উপজাতি অঞ্চলগুলির এবং অবদমিত ও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির পর্যাপ্ত রক্ষাকবচের ব্যবস্থা করা হবে’’। অর্থাৎ সংবিধানে প্রথম থেকে ধর্মীয় স্বাধীনতা যাতে বজায় থাকে সেদিকে নজর দেওয়া হয়েছিল।
১৯৭৬ সালে ৪২তম সংবিধান সংশোধন করা হয়। ১৯৭৬ সালে সংশোধিত প্রস্তাবনায় সংবিধানের উদ্দেশ্য ও বিধেয় সম্বন্ধে সংক্ষেপে বলা হয়েছেঃ “আমরা, ভারতের জনগণ ভারতকে এক সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, লোকতান্ত্রিক গণরাজ্য রূপে গড়ে তোলার জন্য এবং তার সকল নাগরিক যাতে সামাজিক, আর্থিক ও রাজনৈতিক ন্যায়, চিন্তার, মতপ্রকাশের, বিশ্বাসের, ধর্মের ও উপাসনার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার ও সুযোগের সমানতা লাভ করে; এবং তাদের সকলের ব্যক্তি মর্যাদা তথা দেশের ঐক্য ও অখণ্ডতা সুনিশ্চিতকারী সৌভ্রাত্র বৃদ্ধি পায় সেজন্য সত্যনিষ্ঠাভরে সংকল্প করে আজ ১৯৪৯ সালের ছাব্বিশে নভেম্বর আমাদের সংবিধান সভায় এতদ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি ও আমাদের অর্পণ করছি”।
উল্লেখ্য, ৪২তম সংবিধান সংশোধন করে দুটি শব্দ - ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ঢোকানো হয়। ৪২তম সংবিধান সংশোধনের আরও একটা শব্দ যোগ করা হয়েছিল, যেটা আগে ছিল ‘জাতির ঐক্য’ সেখানে যোগ করা হলো ‘এবং সংহতি’। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫ তে বলা আছে - রাষ্ট্র কর্তৃক কেবল ধর্ম, বংশ, জাতি, লিঙ্গ কিংবা জন্মস্থানের ভিত্তিতে এক নাগরিক আর এক নাগরিক থেকে কোনোভাবে পার্থক্য করা অবৈধ ঘোষণা করে। অনুচ্ছেদ ১৭ তে ‘অস্পৃশ্যতার অবসান ঘটিয়ে’ বলা আছে।
আমাদের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে’র আদর্শ যুক্ত করে নানা ধর্মের দেশ ভারতের জনগণের মধ্যে ঐক্য আর সৌভ্রাত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়েছে। ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’-এর অর্থ রাষ্ট্র সকল ধর্মকে সমানভাগে রক্ষা করবে এবং কোনো ধর্মকেই রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে স্বীকার করবে না। ১৯৭৬ সালের সংবিধানে ৪২ তম সংশোধন করে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি যোগ করে রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। সংবিধানের ২৫ থেকে ২৯ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিককে ‘ধর্মের স্বাধীনতা’ সংক্রান্ত মৌলিক অধিকার প্রদান করে প্রত্যেক ব্যক্তিকে ধর্মবিশ্বাসের, ধর্মপালনের ও ধর্মপ্রচারের স্বাধীনতার প্রত্যাভূতি দেওয়া হয়েছে এবং রাষ্ট্রের ও তার সকল প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সমস্ত ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।
আমাদের দেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ, বহুত্ববাদী। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ না হলে দেশটাই থাকবে না। নানা ধর্ম নানা ভাষায় মানুষ বাস করেন। সংবিধানের প্রস্তাবনা পড়লেই বোঝা যায় ধর্মনিরপেক্ষ সাংবিধানের গুরুত্ব কোথায়। সংবিধান পরিষ্কারভাবেই বলেছে রাষ্ট্র হবে সেকুলার, ধর্ম যার যার নিজের। উপস্থাপনায় বলা আছে, ‘আমরা ভারতের জনগণ’। We the People-এর মানে “আমরা হিন্দুরা” কোথাও বলা হয়নি। We the People-এর মধ্যে সব ধর্মের, সব ভাষার মানুষ আছেন। কেউ যদি ভাবেন ভারত মানে হিন্দু তাহলে তিনি ভুল ভাবছেন। এটা ঠিক ৪২ তম সংবিধান সংশোধন করে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেনা এটা বোঝা গেছিল ১৯৪৯ সালেই। সংবিধানের ২৫-২৮ ধারায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যাতে নিরপেক্ষতা বোধ করেন তা বলা আছে। সংবিধানের ৩২৫ নং ধারায় বলা আছে শুধুমাত্র ধর্মের কারণে কাউকে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যাবেনা।আরএসএস বলে - ‘ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটি ভারতে চলে না’। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে দেশের মহাপুরুষেরা বলেছেন - পর ধর্মে ঘৃণা পাপ। রামকৃষ্ণ বলেছিলেন - পরের ধর্মকে ভালো না বাসতে পারলে আমরা ব্যর্থ।
আমাদের সংবিধান রচয়িতারা অত্যন্ত দূরদৃষ্টি নিয়েই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংবিধান রচনা করেছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাঁরা বুঝেছিলেন- ভারতীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রকে একটি সেক্যুলার গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র বলে ঘোষণা করা উচিত। এটা ঠিক ভারতের মতো বহু ভাষা, বহু ধর্ম, জনগোষ্ঠীর দেশে কোনো একটি ধর্ম বা কোনো একটি ভাষার ভিত্তিতে দেশের সংহতি গড়ে তোলা সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন - “কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে কত মানুষের ধারা/ দুর্বার স্রোতে এলো কোথা হতে, সমুদ্রে হল হারা/ হেথায় আর্য, হেথা অনার্য, হেথায় দ্রাবিড় চীন-/ শক-হুন দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন”।এ শুধু কবির কল্পনা ছিল না। ‘হিন্দ স্বরাজ’ (১৯০৯)-এ গান্ধীজি সঠিকভাবেই বলেছিলেন - ‘জাতি’র সঙ্গে কোনো ধর্মের সংস্রব থাকবে না, ভারতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে ‘ঐক্যবদ্ধভাবে’ বেঁচে থাকতে হবে।
দেশ চালাচ্ছে আরএসএস। আরএসএস'র দর্শন হিন্দুত্ব। ‘হিন্দুত্ব! হিন্দু কে?’ শীর্ষক একটি পুস্তিকায় সাভারকর বলেছিলেন - হিন্দু এমন মানুষ যিনি সিন্ধু থেকে সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভারতবর্ষকে নিজের পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমি এবং তাঁর জন্মের স্থানকে ধর্মস্থান বলে মনে করবেন। তিনি আরো বলেছেন - ‘একজন আমেরিকানও ভারতবর্ষের নাগরিক হতে পারেন। তিনি খুব সহজেই আমাদের ভারতীয় হিসাবে, হিন্দু হিসাবে পরিগণিত হতে পারেন। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, নীতি, আদর্শকে মেনে নিলে যেকোনো দেশের মানুষই ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব পেতে পারেন। কিন্তু এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের দেশ তাকে গ্রহণ করার সাথে সাথেই তিনি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতির সাথে কতখানি একাত্মতা অনুভব করতে পারবেন?” গোলওয়ালকরের ‘উই অ্যান্ড আওয়ার নেশনহুড ডিফাইন্ড’ গ্রন্থে যা বলেছেন তার অর্থ দাঁড়ায়, সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের অর্থ অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন। আরএসএস যে ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বাতিল করে ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় এর প্রমাণ মেলে ১৯৪৯ সালের ৩০ নভেম্বর আরএসএস'র মুখপত্র ‘অর্গানাইজার’-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে।
ভারতীয় সংবিধানের নামে শপথ নিলেও বিজেপি’র জনপ্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের প্রতি। আরএসএস যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, জাতীয় পতাকাকেও ওরা মানে না।
ভারতে যদি ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকে তাহলে কী ধরনের বিপদ আসতে পারে? গত কয়েক বছর একাধিক ধর্মীয় সম্মেলনে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিম বিদ্বেষী কথা প্রচার করছে, এটা চলতে থাকলে ভারত টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বিন্যাসও লণ্ডভণ্ড হয়ে যাবে। আরএসএস মনে করে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়ের মানুষ দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, কিন্তু এর জন্য যে মূল্য চোকাতে হবে তা কল্পনাও করতে পারছি না আমরা অনেকে। বিজেপি যে ‘হিন্দুত্ব’র কথা বলে তার সঙ্গে সনাতনী হিন্দুত্বের কোনো মিল নেই। বিজেপি চেষ্টা করছে কেন্দ্রিকরণের, ওরা যা বলে দেবে সেটাই হিন্দুধর্ম। বিজেপি’র ‘হিন্দু’ত্ব মানে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম যা সংহিতা যা বর্ণভেদে বিশ্বাসী। শীর্ষে ব্রাহ্মণ এবং সবচেয়ে নিচে দলিত। বহুজাতিক ভারত ওরা মানেনা। ভাষাভিত্তিক রাজ্য গঠন ওরা মানেনা। তাই সংবিধান বদল করে একই ভাষা ও একই সংস্কৃতি ওরা চাপিয়ে দিতে চাইছে। ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বদলে হিন্দুত্বের সংবিধান হলে দেশ মধ্যযুগীয় অন্ধকারে চলে যাবে। ধর্মনিরপেক্ষতা ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন, প্রাণহীন। ধর্মনিরপেক্ষতা আছে বলেই ভারত ভাগ হয়নি। আরএসএস যে হিন্দু রাষ্ট্রের কথা বলে তাতে কখনোই দেশ এক থাকতে পারে না।
ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। ধর্মনিরপেক্ষতা না থাকলে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত আবার বিভক্ত হবে। ধর্ম নিয়ে দাঙ্গা শুরু হলে সেটা ধর্মেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। আরএসএস-কে নিছক একটা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি হিসেবে দেখা ভুল। আরএসএস কেবল ধর্মীয় বা সামাজিক সংখ্যালঘুদের কাছেই বিপদ নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের কাছেও বিপদ। গণতান্ত্রিক ভারতের কাছেও বিপদ। ‘গণতন্ত্রের অধিকতর প্রয়োজনীয় সত্তার মধ্যেই নীতি ও মূল্যবোধ হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতার স্থান’।
আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ বিপদের মধ্যে আছেন, কিন্তু হিন্দুত্ববাদী শক্তির উল্লসিত হওয়ার কারণ নেই। দীর্ঘ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান। “ভারতের ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা ব্যাপক একটি ধারণার খণ্ডাংশ মাত্র; নানা অর্থেই এদেশ অখণ্ড বহুত্ববাদী, যেখানে আছে নানা ধর্মবিশ্বাস, বিভিন্ন ভাষাভাষী গোষ্ঠী, এবং বিবিধ সামাজিক প্রথা। ধর্মনিরপেক্ষতা এই বিশাল বহুধাবিচিত্র পরিচিতিগুলোর মধ্যে একটি কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যে সাম্প্রদায়িক শক্তি ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়েছে, কেবল এদেশের মুসলমানদের উপস্থিতি এবং অধিকার হরণ করেই তাদের কার্যসিদ্ধি হবে না, ভারতের বিপুল ভৌগোলিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকেও তাহলে ভাঙতে হবে। কিন্তু নানা বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের প্রতি ভারতের সহিষ্ণুতার যে ঐতিহ্য, তাকে এত সহজে পর্যুদস্ত করা যাবে না।’’
[প্রবন্ধ ‘বিপন্ন ভারত’ - অমর্ত্য সেন, অমলেন্দু সেনগুপ্ত সম্পাদিত বই ‘‘বিপন্ন ভারত’’ (পৃষ্ঠা-২১) থেকে উদ্ধৃত]