৬১ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১১ আশ্বিন, ১৪৩০
ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মাতৃভূমি রক্ষার লড়াই (পর্ব-১)
সুব্রত দাশগুপ্ত
ধর্মীয় পরিচিতি অনুযায়ী ‘হিন্দু’, এরকম মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে প্রায় ১.২ বিলিয়ন অর্থাৎ ১২০ কোটি। ভারত ছাড়াও মূলত এশিয়ার কয়েকটি দেশ এবং আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে এঁদের বাস। এঁদের একটা বড়ো অংশেরই এই ধর্মগত পরিচয় নিয়ে কোনো মাথাব্যাথা নেই। কর্মস্থলে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, চিকিৎসাকেন্দ্রে বা সরকারি কোনো নথিপত্রে ধর্মীয় পরিচিতি ব্যক্ত করতে হলে এঁরা ‘হিন্দু’ লেখেন, কেউ কেউ নিজেদের ঘরগেরস্থালিতে নিষ্ঠার সঙ্গে আরাধ্য দেবতার উপাসনা করেন, ব্যক্তিগত যাপনে একান্ত আপনে ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করেন, কখনো কখনো সম্মিলিত উদ্যাগে পূজাপার্বণের আয়োজন এবং যোগদান করেন - এই পর্যন্ত। এর বাইরে ধর্ম তাঁদের উত্তেজিত করেনা, বা অন্য ধর্মের বিশ্বাসী মানুষদের সম্পর্কে অসূয়ার জন্ম দেয়না। আমাদের দেশের ‘হিন্দু’ জনগণের অধিকাংশের মধ্যেই এই প্রবণতাই বিদ্যমান। এর একটা বড়ো কারণ এই যে, হিন্দু ধর্ম কোনো বিধিবদ্ধ ধর্ম নয়। এই ধর্মে কোনো একক ধর্মগ্রন্থ নেই। কথায় বলে, ৩৩ কোটি দেবতা। ভারতে মোট ‘হিন্দু’ মানুষের সংখ্যা প্রায় ৯৭ কোটি, মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭৯ শতাংশ। এঁদের গরিষ্ঠ অংশের কাছেও ধর্মীয় পরিচিতি কোনো আলাদা ‘মাহাত্ম্য’ বহন করেনা এবং সিংহভাগেরই প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা নির্বাহের চাপ সামলাতে দিনাতিপাত হয়, তাঁরা ‘ধর্মীয় পরিচিতিসত্তা’ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ার মতো আবলুসি ভাবনার সময় পাবেন কোথায়?
প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ একটিমাত্র ধর্মীয় পরিচিতির অন্তর্ভুক্ত হওয়া সত্ত্বেও সুমহান ভারতের সংবিধান ভারতকে একটি ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছে। এবং এই সংবিধানই এদেশের মানুষকে চিন্তা, মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা প্রদান করেছে। সংবিধান প্রদত্ত অধিকার অনুযায়ী আপনি যে কোনো ধর্মে যেমন বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেন, তেমনি কোনো ধর্মের প্রতি অনুরক্ত না থেকে নাস্তিকতাতেও স্থিত থাকতে পারেন। সংবিধান প্রণেতারা দেশের ইতিহাস ও আবহমানকাল ধরে চলে আসা পরিস্থিতি গভীরভাবে অনুধাবন করে এবং ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে দেশের মানুষের ব্যক্তি অধিকারকে সুউচ্চে প্রতিষ্ঠিত করেই সংবিধান রচনা করেছেন। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাকে সংবিধানের মূল কেন্দ্রে স্থাপন করে এই সংবিধান ভারতের জনগণ নিজেরাই নিজেদের অর্পণ করেছেন। এর অতুলন প্রস্তাবনাতেই বিবৃত রয়েছে সংবিধানের সারাৎসার।
স্বাধীনতা অর্জনের পঁচাত্তরতম বর্ষ থেকে শুরু হওয়া ‘অমৃত মহোৎসব’-এর বিজ্ঞাপনী প্রচার সর্বস্ব নিনাদ, যা এখনও চলছে, তারই আড়ালে চলছে সংবিধানের মূল নির্দেশনা – সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাকে পদদলিত করার জঘন্য প্রয়াস। সৌজন্যে আরএসএস-র নির্দেশনায় পরিচালিত নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির সরকার, যারা ‘হিন্দুত্ববাদী ভারতরাষ্ট্র’ গঠনের স্লোগান ও উদ্দেশ্য নিয়ে তেড়েফুঁড়ে মাঠে নেমেছে। শান্তি গণতন্ত্র ও সহিষ্ণুতার প্রতীক আমাদের ভারতভূমি আজ এদের হাতে বিপন্ন।
এখন, এ প্রশ্ন তো সঙ্গত কারণেই উঠতে পারে যে, এই দেশে কেবলমাত্র ‘হিন্দু’ পরিচয়ের জন্য যখন আলাদা করে কোনো সুখসমৃদ্ধির ব্যবস্থা হচ্ছেনা বা এমনকী কোনো দুঃখ-যন্ত্রণাও ভোগ করতে হচ্ছেনা, তখন বাকি পাহাড়প্রমাণ সমস্যার সুরাহা না করে বরং খামোখা বাকি সম্প্রদায়ের মানুষকে ভীত সন্ত্রস্ত করে, ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ পরিচয় মুছে ‘হিন্দুত্ববাদী’ রাষ্ট্রের পরিচয়টা জরুরি হচ্ছে কেন? শোষণের যে জাঁতাকলে বন্দি রয়েছে অনাহারক্লিষ্ট, অশিক্ষাদুষ্ট, আশ্রয়হীন, ভগ্নস্বাস্থ্য কোটিকোটি নরনারায়ণ, তাঁদের বঞ্চনার কি নিষ্পত্তি হবে ‘হিন্দুত্ববাদী’ পরিচয়ে ভারতকে পরিচিত করে? যদি তথাকথিত ‘হিন্দুভারত’ তার জনগণের ক্ষুধা আর দারিদ্র্য, বেদের যুগ থেকেই যা বহাল রয়েছে, তা মোচন করতে না পারে তাহলে এই ‘পরিচয় পালটানো’র প্রয়োজন কোথায়?
‘হিন্দুত্ব’ কী এবং কেন?
আসলে একথা আজ বহুজনগ্রাহ্য যে প্রকৃত প্রস্তাবে হিন্দু ধর্মের সঙ্গে আরএসএস প্রবর্তিত ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর কোনো সম্পর্ক নেই। বিবেকানন্দ থেকে গান্ধীজি – হিন্দুধর্ম সম্পর্কে যাঁদের বহু ব্যাখ্যা ও বিস্তারিত লেখা রয়েছে, তাঁরা নিজেদের লেখা বা বক্তব্যে সহস্রবার হিন্দুধর্মের কথা বললেও ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটি এক বারের জন্যও উচ্চারণ করেননি। ‘হিন্দুত্ব’ শব্দটির উদ্গাতা তা হিন্দু মহাসভার একসময়ের সভাপতি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের অন্যতম অগ্রপুরুষ বিনায়ক দামোদর সাভারকর। ১৯২৩ সালে তিনি তাঁর ‘হিন্দুত্বঃ হিন্দু কে?’ বইতে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই এবং এটি ছিল তাঁর ‘রাজনৈতিক দর্শন’, কারণ তাঁর জীবনীকার ধনঞ্জয় কীরের কথায় (ধনজ্ঞয় কীর, ‘বীর সাভারকর’) সাভারকর নিজেই ঈশ্বর বিশ্বাসী ছিলেন না। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র’র ভাষায় সাভারকর ছিলেন ‘পেশাদার নাস্তিক’, ধর্ম বিষয়ে যাঁর কোনো আগ্রহ ছিলনা। তাহলে হঠাৎ করেই তাঁর এই ‘হিন্দুত্ব’র তত্ত্ব উদ্ভাবন কেন? প্রশ্ন তো উঠবেই।
বিজেপি এবং তার পরিচালিত সরকারের বদান্যতায় বিনায়ক সাভারকরের নাম আজ অনেকের কাছেই পরিচিত। এই তথকথিত ‘বীর’ ভদ্রলোকের বীরত্বের পরিচয় নিয়ে অন্য পরিসরে আলোচনা করা যাবে। প্রাথমিক পরিচয়ে এটুকু জানিয়ে রাখাই যথেষ্ট যে, ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যে এক উগ্র হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীর হাতে খুন হতে হয়েছিল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মতো জননেতাকে, সেই খুনের পিছনে মূল পরিকল্পক ও পরিচালক হিসেবে মনে করা হয় ‘হিন্দুত্ববাদ’-এর উদ্গাতা বি ডি সাভারকরকেই। যদিও এই হত্যা মামলা থেকে সাভারকর এক চুলের জন্য রেহাই পেয়ে যান, কিন্তু তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, যিনি গান্ধী হত্যা-মামলার প্রতিদিনের প্রায় সব খবর রাখতেন, তিনি তাঁর ২৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮-এর চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুকে লিখেছিলেন - ‘‘প্রত্যক্ষভাবে সাভারকরের নেতৃত্বাধীন হিন্দু মহাসভার একটি ধর্মোন্মত্ত অংশ এই ষড়যন্ত্রের (পরিকল্পনা) করেছিলেন ...।’’ অথচ গান্ধীজি ছিলেন একজন প্রবল হিন্দু-অনুরাগী। কিন্তু তাঁর বিশ্বাসের হিন্দু ধর্ম – ‘‘সকল ধর্মের মধ্যে সবচেয়ে সহনশীল। এর নীতি হলো সকলকে সাগ্রহে অন্তর্ভুক্তিকরণ।’’ এবং তাঁর মতে হিন্দু ধর্ম হলো - ‘‘অহিংস উপায়ে সত্যকে অনুসন্ধান করা (What is Hinduism, Young India, 24 April, 1924)।’’ কিন্তু সাভারকরদের ‘হিন্দুত্ব’ এই ধারণার একেবারে বিপরীতে অবস্থান করে। তাই ধর্ম সম্পর্কে উদার দৃষ্টিভঙ্গির এক জননেতাকে খুন করার পরিকল্পনা করতে সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির এক ধর্মোন্মত্তের কোনো সমস্যা হয়নি। হত্যাকারী নাথুরাম গডসে ছিল সাভারকরের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন এবং গোঁড়া সাভারকর পন্থী। এই লোকটি প্রথম জীবনে আরএসএস কর্মী ও পরে হিন্দু মহাসভার নেতা এবং গান্ধীজির অহিংস ও ধর্মনিরপেক্ষ নীতির প্রবল বিরোধী।
(পরবর্তী সংখ্যায়)