E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ / ১১ আশ্বিন, ১৪৩০

পরিবেশ চিন্তা

জিএম সরিষাঃ আশঙ্কা ও ভবিষ্যৎ

তপন মিশ্র


৩০ আগস্ট মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের জিএম সরিষা সম্পর্কিত একটি মন্তব্য আমাদের দেশের জিএম শস্যের ভবিষ্যৎ গবেষণার দিক নির্দেশ করে দিল। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মন্তব্য ছিল যে, দেশের খাদ্য সুরক্ষা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র রক্ষা। আদলতের কাছে সরকারের আবেদন ছিল যে, এবছর সরিষার মরসুমে জিএম সরিষার পরীক্ষামূলক উন্মুক্ত চাষ করতে দেওয়া হোক এবং এর পরিবেশের প্রভাব সম্পর্কিত পরীক্ষা করা হোক। সর্বোচ্চ আদালতের বিশেষ বেঞ্চ শুনানিকে পিছিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে এই পরিপ্রেক্ষিতে যে মন্তব্য করেছে তা এককথায় যুগান্তকারী।

জিএম সরিষা কী ও কীভাবে?

জিএম অর্থাৎ জেনেটিক্যালি মডিফায়েড। কোনো কোষ, কলা, বীজ ইত্যাদির মধ্যে (ক্রোমোজোমে) যদি অন্য কোনো জীবের জিন জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলভাবে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া যায় তাহলে তাকে ট্রান্সজেনিক বা জিএম জীব বলা হয়। এটি এক ধরনের হাইব্রিড বা সংকর। সাধারণভাবে সংকরায়নের পদ্ধতি ছিল অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ কেবল একটি প্রজাতিতে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ভ্যারাইটির মধ্যে সংকরায়ন করা সম্ভব হতো। একই গনের দুটি প্রজাতির মধ্যে সংকরায়নের ক্ষেত্রেও অনেক বাধা রয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো পরের প্রজন্মের বন্ধ্যাত্ব। অভীষ্ট গুণ নির্ধারণের ক্ষেত্রেও সংকরায়ন পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা করতে হতো। কিন্তু জৈব প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিএম শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বাধা থাকে না। জিএম শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে কোনো জীবের কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে থাকা ক্রোমোজোম থেকে নির্দিষ্ট জিনটি সংগ্রহ করে অন্য একটি জীবে প্রবেশ করানো হয় এবং এভাবে তৈরি উদ্ভিদের বীজ সংগ্রহ করা হলে তাকে জিএম বীজ বলা হয়।

এই ট্রান্সজেনিক সরিষা দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বীজ গবেষণাগারে তৈরি করা হয় এবং এবং বাণিজ্যিক মুক্তির আগে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত করা হয়। এই ক্ষেত্রে ন্যাশনাল ডেয়ারি ডেভেলপমেন্ট বোর্ড অব ইন্ডিয়া এবং ডিপার্টমেন্ট অব বায়োটেকনোলজি গবেষণার জন্য অর্থ জোগান দেয়। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপরাইশাল কমিটি গত ১৮ অক্টবের, ২০২২ তারিখে তার ১৪৭তম সভায় আইসিএআর-এর পদ্ধতি মেনে এই বীজের উৎপাদন এবং পরীক্ষার সুপারিশ করে। এই সুপারিশের ভিত্তিতে এবছর অক্টোবর মাসে পরিবেশ মন্ত্রক ধারা সরিষা হাইব্রিড (ডিএমএইচ-১১)-কে পরিবেশগত মুক্তি অর্থাৎ উন্মুক্ত পরিবেশে চাষের অনুমতি দেয়।

এটি একটি হার্বিসাইড টলারেন্ট (HT) সরিষার জাত যার মধ্যে জেনেটিক পরিবর্তন করা হয়েছে। এই ট্রান্সজেনিক শস্যে (ডিএমএইচ-১১) বার (Bar), বারনেস (Barnase) এবং বারস্টার (Barstar) জিন সিস্টেম প্রবেশ করানো হয়েছে। ডিএমএইচ-র মধ্যে বার জিন গ্লুফসিনেট নামক আগাছা নির্মূলকারী (হার্বিসাইড) বিষ সহ্য করার ক্ষমতা রাখে। হার্বিসাইড অর্থাৎ আগাছা নির্মূল করার ঔষধ। মাঠে আগাছা থাকলে সরিষা গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। কিন্তু হার্বিসাইডে যে বিষ থাকে তাতে সরিষারও ক্ষতি হয়। তাই এই জিন থাকলে সেই ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। বার জিন স্ট্রেপ্টোমাইসেস (Streptomyces hygroscopicus) নামক ব্যাকটেরিয়া থেকে নেওয়া। বারনেস (Bacterial RiboNucleASE) জিনের কাজ হলো পুরুষ বন্ধ্যাত্ব অর্থাৎ পরাগ রেণুকে বন্ধ্যা করে নিষেক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করা। এর ফলে যে বীজ উৎপাদিত হয় তা অঙ্কুরোদ্গমের ক্ষমতা হারায়। বারস্টারের কাজ ঠিক তার উলটো। ডিএমএইচ-১১ ভারতীয় সরিষার জাত ‘বরুণ’ এবং পূর্ব ইয়োরোপের জাত ‘আর্লি হিরা-২’-র সংকরায়নের ফসল। এর সঙ্গে ব্যাকটেরিয়া থেকে জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে জিন প্রবেশ করানো হয়েছে। বরুণের মাধ্যমে আসা বার্নেস জিন অস্থায়ী বন্ধ্যাত্বের কারণ এবং হীরার মাধ্যমে আসা বারস্টার জিন বার্নেসের প্রভাবকে আটকাতে সক্ষম করে।

এক্ষেত্রে দুটি জিন যেগুলির নাম ‘বারনেস’ এবং ‘বারস্টার’, ব্যাসিলাস অ্যামাইলোলিকফেসিয়েন্স নামে মাটির একটি ব্যাকটেরিয়া থেকে সংগ্রহ করা হয় এবং উচ্চ ফলনশীল প্রজনন সক্ষম সংকর সরিষা তৈরি করা হয়। বারনেস জিনটি বীজে একটি অস্থায়ী বন্ধ্যাত্ব সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা হয়। ফলে এটি প্রাকৃতিকভাবে স্ব-পরাগ সংযোগ করতে সক্ষম হয়না। প্রথমে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে এই বীজ তৈরির পর প্রাথমিক কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তার ফল সহ জিইএসি (পরিবেশ, অরণ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তন দপ্তরের অধীনে)-তে মুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা এবং তার পর বাজারে নিয়ে আসার আবেদন করা হয়। ভারত সরকারের পরিবেশ দপ্তর সেই অনুমোদন দিয়েছে।

উদ্বেগ কেন?

কয়েকটি কৃষক সংগঠন এবং কয়েকজন বিশেষজ্ঞ যৌথ উদ্যোগে মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের কাছে এই পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষা বন্ধ করার নির্দেশ চেয়ে দ্বারস্থ হন। আবেদনকারীদের উদ্বেগের কারণের পক্ষে বেশ কয়েকটি যুক্তি দেখানো হয়েছে। এই উদ্বেগগুলি দেশের সমস্ত মানুষের।

১। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় (প্রস্তুতকারী সংস্থা) এবং ভারত সরকারের পরিবেশ দপ্তর (নিয়ন্ত্রক সংস্থা)-র বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ হলো তারা ট্রায়াল সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক তথ্য কোনো এক অজ্ঞাত কারণে গোপন রেখেছে। প্রাথমিক পর্যায়ে কী পরীক্ষা হয়েছে, তার ফলাফল কী, কোন যুক্তির ভিত্তিতে পরিবেশ দপ্তর মুক্ত অবস্থায় পরীক্ষার অনুমোদন দিল - এই সমস্ত কিছু জানার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। সুপ্রিম কোর্ট এবং কেন্দ্রীয় তথ্য কমিশনের নির্দেশ সত্ত্বেও জনসাধারণের কাছে সমস্ত তথ্য প্রকাশ করা দরকার মনে করা হয়নি। এর কারণ হলো, একবার মুক্ত অবস্থায় পরীক্ষা শুরু হলে এই শস্যের মধ্যেকার বার, বারনেস এবং বারস্টার জিনগুলি ছড়িয়ে পড়বে। সাধারণ মানুষের ফিল্ড ট্রায়ালের পর্যায়গুলির পদ্ধতিগত দিকগুলি জানা উচিত। এই তথ্য থাকলে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই সংক্রান্ত ধারণা তৈরি হতো। মনে করার কোনো কারণ নেই যে, সাধারণ মানুষের মধ্যে কোনো বিশেষজ্ঞ নেই।

২। জিএম সরিষা একটি আগাছানাশক-সহনশীল ফসল এবং গাছে বিষাক্ত রাসায়নিক স্প্রে করা হলে তা সরিষার ক্ষতি করবে না ঠিকই কিন্তু এই আগাছানাশক ঔষধ সরিষার উপর জমা থাকবে এবং এই বীজ খাদ্যে ব্যবহৃত হলে তা মানুষের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলবে।

৩। বিশেষজ্ঞদের যুক্তি হলো যে, এটি পরিবেশগতভাবে টেকসই নয় কারণ যেমন আগাছানাশকের পরিবেশগত কুপ্রভাব আছে তেমনই যে ব্যাকটেরিয়া জিন তিনটি ব্যবহার করা হচ্ছে তার পরিবেশগত প্রভাব অর্থাৎ কতটা জিন দূষণ করবে তা আমাদের জানা নেই। কিন্তু সরিষা প্রজাতির মধ্যেকার জিনগত বৈচিত্র্য যে নষ্ট হয়ে যাবে সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। আমাদের দেশে কৃষকরা পাশাপাশি একই শস্যের বিভিন্ন জাত রোপণ করেন। জিএম সরিষা একটি ক্রস পলিনেটেড শস্য অর্থাৎ হয় বাতাস বা পরাগ সংযোগকারী পোকার দ্বারা (যেমন মৌমাছি) এর পরাগরেণু এক গাছ থেকে অন্যটিতে যায়। এই জিএম সরিষার পরাগরেণু বীজের অঙ্কুরোদ্গম বন্ধ করার জিন পরাগরেণুর মাধ্যমে বহন করবে। ফলে ধীরে ধীরে জাতের পর জাতের বীজের অঙ্কুরোদ্গম ব্যাহত হবে। এই প্রক্রিয়ায় দেশের সরিষার জিন বৈচিত্র্য অর্থাৎ ভ্যারাইটিগুলি শেষ হয়ে যাবে। আমরা আমাদের অমূল্য জিন সম্পদ হারিয়ে ফেলব।

৪। ভারতে সরিষার প্রজাতি (Brassica juncea) জিনগত বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। এদেশে সরিষার ঐতিহ্য রয়েছে কারণ এই ফসলের উৎপত্তি কেন্দ্র (center of origin) হলো ভারত। এদেশে সরিষার ৬৫টি জাত (variety) রয়েছে যা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। জিএম বেগুন সংক্রান্ত বিতর্কের সময়ে সুপ্রিম কোর্টের নিযুক্ত বিশেষজ্ঞ কমিটি এবং জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটির একটি সাধারণ সুপারিশ ছিল যে, যে সমস্ত শস্যের উৎপত্তি কেন্দ্র ভারত, তার জিএম এদেশে ব্যবহার করা ঠিক হবে না।

এদেশে সরিষা

যদি অনুমোদন পায় তাহলে আমাদের দেশে জিএম সরিষা প্রথম জিএম খাদ্য শস্য হিসাবে বিবেচিত হবে। এর আগে জিএম বেগুন অনেকটা এগোলেও দেশ জুড়ে জনশুনানির পর সরকার এই বীজের ব্যবহার বিগত ২০১০ সাল থেকে সাময়িক বাতিল করে। জিএম তুলো খাদ্য শস্য নাহলেও এই বীজের ব্যবহার যে সুখকর হয়নি তা দেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে বোঝেন। বর্তমানে ভারতে সরিষা রবি (শীত) মৌসুমে প্রায় ৫৫ লক্ষ থেকে ৭০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়। জিএম সরিষার ফলনকে ভাল দেখাতে কম ফলনশীল জাতের সাথে তুলনা করা হয়। দাবি করা হয় যে, জিএম সরিষা সাধারণ সরিষা থেকে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ বেশি ফলনশীল। আসলে নন-জিএম সরিষার যে হাইব্রিড বীজ এখন চাষ হয় তার তুলনায় এটা আহামরি কিছু নয়।

২০১৩ সালে যখন এই বিতর্ক প্রথম সামনে আসে, ভারতের মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট একটি টেকনিক্যাল এক্সপার্ট কমিটি (টিইসি) নিযুক্ত করেন। তারা যে রিপোর্ট পেশ করে তাতে আগাছানাশক-সহনশীল ট্রান্সজেনিক ফসল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার সুপারিশ করা হয়। টিইসি’র উদ্ধৃত কারণগুলির মধ্যে একটি হলো - কৃষকরা তাদের ফসলে উদারভাবে আগাছানাশক প্রয়োগের ফলে কৃষকদের এবং অন্যান্যদের উপর নেতিবাচক স্বাস্থ্য প্রভাবের সম্ভাবনা রয়েছে।

অধিক ফলন মানে কৃষকের অধিক আয় নয়

তথ্য বলছে, ২০০৬-০৭ সালের তুলনায় সরিষা চাষের এলাকা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও সারা ভারতে ফলন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৬-১৭ সালে উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ৮০ লক্ষ টন। ২০২২-২৩ সালে উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১১৫.২৫ লক্ষ টন। সমস্যা হলো, কৃষকদের কাছে ফসলের সরকার ঘোষিত ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) পৌঁছায় না। তাই জিএম সরিষার ফলন বাড়লেও বাজারে ন্যায্যমূল্য নিয়ে চাষিদের প্রতারণা অব্যাহত থাকবে।

জিএম সরিষার উপর নির্ভরশীলতা মানে দেশের সরিষার চাষে সম্পুর্ণ করপোরেট নির্ভরশীলতা। কারণ একবার এই চাষ শুরু হলে একদিকে যেমন সরিষার জাতের বৈচিত্র্য নষ্ট হবে তেমনই যেহেতু বন্ধ্যা বীজ উৎপাদিত হবে তাই পরের মরশুমে চাষের জন্য বহুজাতিক বীজ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির উপর কৃষকদের নির্ভর করতে হবে। আমাদের দেশে কৃষকরা সাধারণভাবে ফসল তোলার সময় বীজ আলাদা করে সংগ্রহ করেন এবং তা সংরক্ষণ করে পরের মরশুমে ব্যবহার করেন। এই অধিকার লোপ পেয়ে যাবে। তখন কেবল বীজ নয় তার সঙ্গে থাকবে আগাছানাশক, কীটনাশক, সার ইত্যাদির ‘কমবো’ প্যাক কৃষকদের নিতে বাধ্য করা হবে। আমাদের দেশে ভৌগোলিক অবস্থার বৈচিত্র্যের সাথে সাথে সরিষার জাতের বৈচিত্র্য জরুরি। কারণ সব অঞ্চলে সব ধরনের সরিষা চাষ হয় না। একটি জাতের আধিপত্য এই প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের পরিপ্রেক্ষিতে কৃষি ব্যবস্থার বৈচিত্র্য রক্ষার অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করবে। ভবিষ্যতে এই মামলার গতি প্রকৃতি কোনদিকে যাচ্ছে তার উপর আমাদের নজর থাকবে, কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের এবারের মন্তব্য যে যুগান্তকারী সেখানে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।