৫৮ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ৩০ এপ্রিল, ২০২১ / ১৬ বৈশাখ, ১৪২৮
করোনা মোকাবিলায় ব্যর্থ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার
সরকারের চরম ব্যর্থতায় দেশময় অনিয়ন্ত্রিত কোভিড মহামারী
ক্ষমাহীন অপরাধের জন্য দায়ী মোদী-শাহ জুটি
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ অতিমারী কোভিড-২-র থাবায় বেসামাল দেশ। স্বীকৃত পরিসংখ্যানে স্পষ্ট, আক্রান্তের সংখ্যা আগামী দিনদশেকের মধ্যেই ছাড়াবে দু'কোটির গণ্ডি। সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে অপ্রতুল শয্যা সংখ্যা, অক্সিজেনের জোগানে ঘাটতি, ওষুধের কালোবাজারি, সর্বজনীন টিকাকরণের দূরদৃষ্টির অভাব এবং অসংখ্য মৃত্যুর জেরে খোলা জায়গায়, পার্কে করোনার মৃতদেহ দাহ কোভিড আক্রান্ত মানুষকেই শুধু নয়, তার পরিবার সহ দেশের মানুষকে দাঁড় করিয়েছে বহুমুখী সঙ্কটের সামনে। স্বাস্থ্য সচেতনতা থেকে চিকিৎসা পরিকাঠামোর প্রতিটি ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্তের অস্বচ্ছতা এবং বহুতর ব্যর্থতা মানুষের যাবতীয় আতঙ্ক বহুগুণ বাড়াচ্ছে। সংক্রমণের এই দ্বিতীয় ঢেউ দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার রেখাচিত্রকে কার্যত অধোগামী করে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাড় করিয়েছে। তাই ২৭ এপ্রিল করোনাজনিত এই পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন সুপ্রিম কোর্ট অতিমারী পরিস্থিতিকে ‘জাতীয় সঙ্কট’ আখ্যা দিয়েছে। শুধু এটুকুই নয়, দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাইয়ের মতো দেশের আধডজন হাইকোর্ট বিভিন্ন রাজ্যের প্রেক্ষিতে সরকারগুলি সহ বিভিন্ন সাংবিধানিক সংস্থাকে অক্সিজেন সরবরাহ, নির্বাচনী জনসমাবেশ ইত্যাদি বিষয়ে তিরস্কার করার পাশাপাশি নির্দেশও জারি করেছে।
দেশে সংক্রামিতের সংখ্যার গত ছয়দিনের(২২ থেকে ২৭ এপ্রিল) হিসেব খতিয়ে দেখলে চিত্রটা অনেকটা পরিষ্কার হবে। ২২ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ১ কোটি ৬২ লক্ষ ৬৩ হাজার ৬৯৫ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর ২৭ এপ্রিল সংখ্যাটা বেড়ে দাঁড়ায় ১ কোটি ৭৬ লক্ষ ৩৬ হাজার ৩৬০ জন। অর্থাৎ দিন প্রতি নথিভুক্ত আক্রান্তের সংখ্যা দু’লক্ষর কিছু বেশি হারে বাড়ছে। দৈনিক নতুন সংক্রমণের তালিকায়ও প্রথমে মহারাষ্ট্র তারপরে উত্তর প্রদেশ এবং কর্ণাটক।
অন্যদিকে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে দেশে সুস্থতার হার ছিল ৯৭.৩৩শতাংশ, তা এখন কমে দাঁড়িয়েছে ৮২.৬২ শতাংশ। মৃতের সংখ্যা প্রায় দু লক্ষ ছুঁয়েছে। সংক্রামিতের মোট ৬৯.১ শতাংশ দেশের দশটি রাজ্যের নাগরিকদের অংশ। এই ১০ টি রাজ্য হলো, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি, কর্ণাটক, কেরালা, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাডু, গুজরাট এবং রাজস্থান।
মৃত্যুর সংখ্যা অবশ্য কমিয়ে দেখানো হচ্ছে অধিকাংশ রাজ্যেই। গুজরাটের সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিনই সরকারি হিসাবের সঙ্গে পার্থক্য চোখে পড়েছে। উত্তর প্রদেশের সরকার ভয়ের বাতাবরণ তৈরি করেছে পরিসংখ্যান প্রকাশের ক্ষেত্রে। এই রক্তচোখের নিষেধাজ্ঞার জেরে ঘোষিত মৃতের চেয়ে ১০ গুণ বেশি কোভিড মৃতদেহ দাহ করা হয়েছে। শেষকৃত্যের জন্য দীর্ঘসময় লাইন দিয়ে থাকতে হচ্ছে উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, দিল্লি সহ বেশ কয়েকটি শহরে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রথমত অনেক বড়ো হাসপাতালেও কোভিডে মৃত্যুকে কোভিড বলে ঘোষণা করা হচ্ছে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অমান্য করেই কোভিড আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে তার আগে থাকা অসুখের কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। একই ঘটনা ঘটছে পশ্চিমবঙ্গেও।
২০২০ সালের অতিমারীর প্রথম পর্বের বিপর্যয় থেকে সরকার যে কোনো শিক্ষাই নেয়নি তার প্রমাণ কেন্দ্রের বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট। এর ফলে তীব্রতর হচ্ছে সঙ্কট, তৈরি হচ্ছে জটিলতা। দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো কেন্দ্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে সমালোচনায় মুখর। প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা কেন্দ্রীয় সরকার সমালোচনা সম্পর্কে চিন্তিত এমন নজির অবশ্য এখনও খালি চোখে ধরা পড়েনি। যদিও এই সরকার টিকা প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এবং দাম নিয়ন্ত্রণের পথে না হেঁটে বেসরকারি সংস্থার এবং খোলা বাজারের মুনাফার প্রতি যত্নবান হয়েছেন শ্রেণি স্বার্থে। এই সঙ্কট মুহূর্তে ভারতের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীনসহ জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন। এমনকি পাকিস্তানের মতো দেশও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ওষুধের কাঁচামাল রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলা সহ বিভিন্ন বিষয়ে ধোঁয়াশা বজায় রেখেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু করা এক মামলার শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ ২৭ এপ্রিল করোনা পরিস্থিতিকে ‘জাতীয় সঙ্কট’ বলার পাশাপাশি শীর্ষ আদালতের ভূমিকাকে ‘সহায়ক শক্তি’ হিসেবে তুলে ধরে বলেছে, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমারেখায় করোনা পরিস্থিতির বিচার-বিশ্লেষণ সবচেয়ে ভালো করতে পারবে সংশ্লিষ্ট হাইকোর্টগুলি।
আগামী ১ মে থেকে ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সীদের টিকাকরণ শুরু হবার কথা। কিন্তু তৃতীয় পর্যায়ের টিকাকরণের দাম নির্ধারণ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে কেন্দ্র। এই পর্বে উৎপাদক সংস্থাগুলি। কোভ্যাকসিন-এর ভারত বায়োটেক এবং কোভিশিল্ডের সেরাম ইনস্টিটিউটকে ৫০ শতাংশ সরাসরি রাজ্য এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ওই দুই সংস্থা কেন্দ্রকে টিকা বিক্রি করেছে দেড়শ টাকা প্রতি ডোজ দরে। কিন্তু রাজ্যগুলোকে তা কিনতে হবে ৪০০ টাকা দরে। আর কোভিশিল্ড সংস্থা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ৬০০ টাকা এবং কোভ্যাকসিন বারোশো টাকা দরে বিক্রি করবে। টিকার দামের ক্ষেত্রে কেন্দ্র-রাজ্য বৈষম্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা সরব হয়েছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের বেসরকারি সংস্থার ওপর নির্ভরশীলতার নীতির প্রেক্ষিতে অভিযোগ উঠেছে কোভ্যাকসিনের প্রস্তুতকারী সংস্থা ভারত বায়োটেক এবং কোভিশিল্ডের প্রস্তুতকারী সেরাম ইনস্টিটিউটকে অনায্য উপায়ে এক লক্ষ কোটি টাকা বাড়তি মুনাফার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। যদিও শোনা যাচ্ছে ৪০০ টাকার টিকা ৩০০ টাকা হতে পারে।
এদিকে টিকার আলাদা দাম ধার্যের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের ব্যাখ্যা চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ কেন্দ্রকে বলেছে, টিকার দাম নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে পেটেন্ট আইন প্রয়োগ বিবেচনা করা যেতে পারে। বিচারপতি ডিআর চন্দ্রচূড়, এল নাগেশ্বর রাও এবং রবীন্দ্র ভাটের ডিভিশন বেঞ্চ কেন্দ্রের আইনজীবীকে বলেছে, জাতীয় স্তরে মহামারী সঙ্কটের সময়ে কীভাবে এক একটি সংস্থা একেক দাম ঠিক করছে তা জানা দরকার। জানতে চাওয়া হয়েছে তৃতীয় পর্বের জন্য টিকা জোগানের পরিকল্পনা কী।
বয়স্ক মানুষদের টিকাকরণের প্রক্রিয়া টিকার তীব্র অভাবের দরুণ প্রশ্নের মুখে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছিল দিনে ৩৫ লক্ষ টিকা দেওয়ার পরিকাঠামো রয়েছে, কিন্তু বাস্তব অবস্থা হলো গত কয়েকদিন গড়ে দৈনিক টিকাকরণের সংখ্যা ২২ থেকে ২৪ লক্ষ ছাড়াচ্ছে না। কিন্তু প্রকৃত চিত্র হলো, এ পর্যন্ত দু’টি ডোজ দেশের এক শতাংশ মানুষও পাননি। প্রশ্ন রয়েছে টিকাকরণের জন্য টিকার জোগান এবং বিগত দিনগুলির ঢিমে গতি নিয়ে। দ্বিতীয় ডোজ সঠিক সময়ে না মেলায় টিকাকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে মহারাষ্ট্র কর্ণাটক তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলি। কারণ দু’টি ডোজের ব্যবধান অনির্দিষ্ট রাখা যায় না, এ ক্ষেত্রে দেরি হলে প্রথম ডোজের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা ও উদ্দেশ্য ধাক্কা খাবে।
কোভিড ১৯-র দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের এই অভূতপূর্ব স্বাস্থ্য এবং মানবিকতার সঙ্কটের পরিস্থিতি সুনামিতে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে সমস্ত হাসপাতালে যেকোনো মূল্যে চিকিৎসা পরিষেবায় ব্যবহৃত অক্সিজেন সরবরাহ এবং বিনামূল্যে সর্বজনীন টিকাকরণের কর্মসূচির জন্য ভারতীয় ভ্যাকসিন উৎপাদনকে জরুরি ভিত্তিতে জোগানের জন্য নিতে হবে এবং সমস্ত রকম উৎস থেকে টিকা আমদানি করে রাজ্যগুলিকে দিতে হবে এবং আরও মৃত্যু রুখতে এই দু’টি বিষয়কে সুনিশ্চিত করতে হবে। সর্বজনীন টিকাকরণের প্রসঙ্গে অর্থের জোগান বিষয়ে তিনি ৩৫ হাজার কোটি টাকা বাজেটের বরাদ্দের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছেন। এর পাশাপাশি তিনি অতিরিক্ত ব্যয় রাশ টানতে এবং সেন্ট্রাল ভিস্টা নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করতে বলেছেন এবং পিএম কেয়ারস ফান্ডের টাকা স্বচ্ছতার সঙ্গে অক্সিজেন এবং ভ্যাকসিন খাতে বরাদ্দ করতে বলেছেন। পরিশেষে আরও ভারতীয়ের মৃত্যু আটকাতে এই দায়িত্ব পালন না করতে পারলে আপনার সরকার থাকার নৈতিক অধিকার হারাবে বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
করোনা সংক্রমণে ভয়াবহ অবস্থা উত্তর প্রদেশের। ইতিমধ্যেই উত্তর প্রদেশে মৃতের সংখ্যা গোপন করার অভিযোগ উঠেছে। পঞ্চায়েত ভোটের ডিউটি করতে গিয়ে এখনও পর্যন্ত ১৩৫ জন শিক্ষক, শিক্ষামিত্র এবং সহকারি করোনা সংক্রমণের জেরে মৃত্যুর ভয়ঙ্কর তথ্য সামনে এসেছে। এ প্রসঙ্গে নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলেছে যোগী সরকার। সরকারের সাফাই, হাইকোর্টের নির্দেশে ভোট হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, আদালতের নির্দেশেই যখন ভোট হচ্ছে তখন সংক্রমণের ভয়াবহতার কথা বলে ভোট স্থগিত রাখতে সরকার কেন আদালতে গেল না?
দেশে অক্সিজেনের ঘাটতির প্রেক্ষিতে হাসপাতালগুলোতে বহু মানুষের মৃত্যু প্রবল সমালোচনার মুখে দাঁড় করিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারকে। দিল্লির দু’টি হাসপাতালে দু’দিনে ৫০ জনের মৃত্যু আলোড়ন ফেলে দেয় গোটা দেশে। এরপরই পিএম কেয়ার তহবিলে করোনা মহামারীর অজুহাতে যে ২,৫৭৬ কোটি টাকা জমা পড়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন এবং তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। এতদিন প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দপ্তর এ ব্যাপারে কিছু না বললেও সম্প্রতি বলেছে, ওই তহবিলের ২০১.৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে ১৬২ টি অক্সিজেন উৎপাদক কেন্দ্র গড়ে তুলতে। কিন্তু এপর্যন্ত গড়ে উঠেছে মাত্র ৩৩ টি প্লান্ট। প্রধানমন্ত্রীর তরফে আশ্বাস মিলেছে, ৫৫১ টি প্লান্ট গড়ে তোলা হবে কিন্তু সেটা কতদিনে হবে সে সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
এই পরিস্থিতিতে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিচালিত কেরালা সরকার কোভিড চিকিৎসার বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে দেশে নজির সৃষ্টি করেছে। বিনা মূল্যে টিকা দেওয়ার কথা আগেই ঘোষণা করেছে তারা। বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নিজের রাজ্যের অক্সিজেন মজুতের পরিমাণ বাড়িয়ে ৫১০ টন করেছে এবং তামিলনাডু এবং গোয়ার মতো রাজ্যকে অক্সিজেন পাঠিয়ে সাহায্য করেছে। মহামারীর প্রথম পর্যায়ের সাফল্যের মতো দ্বিতীয় পর্বেও সাফল্যের উদাহরণ হয়ে উঠেছে কেরালা।