E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ৩০ এপ্রিল, ২০২১ / ১৬ বৈশাখ, ১৪২৮

একের পর এক বন্ধ হচ্ছে চটকল কাজ হারাচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক


নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রাজ্যের চটশিল্পে সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ২৫ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। এছাড়া কাঁচা পাটের অনিয়মিত সরবরাহ ও চটের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির অজুহাতে বিভিন্ন জুটমিলে দৈনিক কাজের ঘণ্টা ও দিন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে একের পর এক চটকল বন্ধের নোটিশ দিচ্ছে মালিক কর্তৃপক্ষ। এরফলে চটশিল্পের শ্রমিকদের জীবনে চরম সঙ্কট তৈরি হয়েছে। সামগ্রিকভাবে সঙ্কট নেমে এসেছে চটশিল্পে।

কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের নীতির ফলেই চটশিল্পের এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে।

কোনো কোনো চটকলে তিনটি শিফটের পরিবর্তে দু’টি শিফটে কাজ হচ্ছে। আবার কোনো কোনো চটকলে সাতদিনের পরিবর্তে পাঁচদিন কাজ হচ্ছে। কিছু চটকলে কাজের সময়ও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে রাজ্যে চটশিল্পে সঙ্কটের পাশাপাশি লক্ষাধিক শ্রমিকের রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে বহু শ্রমিকের মজুরিও অনেক কমে গেছে। এই পরিস্থিতিতে চটশিল্পের সঙ্কট মোকাবিলায় এবং প্রয়োজনে বাইরে থেকে পাট এনে মিলগুলির উৎপাদন স্বাভাবিক করা ও পাটের কালোবাজারি রুখতে হস্তক্ষেপ করার দাবি জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যের শ্রমমন্ত্রী এবং মুখ্য সচিবকে চিঠি দিয়েছে ২১টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন। একই দাবিতে শ্রম কমিশনার, জুট কমিশনার ও বস্ত্র মন্ত্রকের কাছেও ইউনিয়নগুলির পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এই বছর পাট উৎপাদন কম না হওয়া সত্ত্বেও কৃত্রিমভাবে চটকলে পাটের জোগান কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই অজুহাতে সম্প্রতি দক্ষিণ ২৪ পরগনার বজবজ জুট মিল বন্ধ করে দিয়েছে মালিকপক্ষ। এই জুটমিল বন্ধ হওয়ার ফলে প্রায় ৯ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। এছাড়া পাটের জোগান কম দেখিয়ে হুগলির ওয়েলিংটন জুট মিল, নর্থব্রুক জুট মিলের কাজ সপ্তাহে ২দিন কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই জুটমিলে এখন পাঁচদিন কাজ করছেন শ্রমিকরা।

কাঁচা পাটের অনিয়মিত সরবরাহ ও চটের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে গত ১৮ এপ্রিল হাওড়া জুট মিলের শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের বদলে ৫ ঘণ্টা কাজ ও সপ্তাহে ৭দিনের বদলে ৫দিন কাজ হবে বলে নোটিশ দেয় হাওড়া জুট মিল কর্তৃপক্ষ। এদিন কাজে আসা শ্রমিকরা এই নোটিশ দেখেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁরা মালিকের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করেন। এদিনই কর্তৃপক্ষ মিলের বিভিন্ন ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের সাথে মিলিত হয়ে এই সিদ্ধান্তের কথা জানালে বেঙ্গল চটকল মজদুর ইউনিয়ন (বিসিএমইউ)-র প্রতিনিধিরা তার তীব্র বিরোধিতা করেন।

প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর গত বছরের আগস্ট মাসের শেষে শ্রমমন্ত্রীর ঘরে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মধ্য দিয়ে জুট মিল খুললেও চুক্তির কোনো শর্তই মালিক কর্তৃপক্ষ মানছে না জানিয়ে বহুবার শ্রমমন্ত্রী ও লেবার কমিশনারের কাছে চিঠি দেয় বিসিএমইউ। ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বলা হয়, রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের কোনো কথাই শোনা হয়নি। গতমাসে মিল কর্তৃপক্ষ নোটিশ দিয়ে একই অজুহাতে কাজের দিন কমিয়ে ৫দিন করায় বিসিএমইউ’র পক্ষ থেকে সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে লেবার কমিশনারের কাছে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। ১৮ এপ্রিল নতুন করে কাজের দিন ও ঘণ্টা কমিয়ে মিল চালানোর নোটিশের তীব্র বিরোধিতা করে শ্রমিকরা দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কর্তৃপক্ষের এই শ্রমিকবিরোধী সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নেবেন না। কর্তৃপক্ষের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এদিন বিকালেই হাওড়া জুট মিল গেটে প্রতিবাদ-বিক্ষোভসভা অনুষ্ঠিত হয়।

সাঁকরাইলের ডেল্টা জুট মিলেও একইভাবে কাজ বন্ধের নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। ১৯ এপ্রিল সকালে কাজে যোগ দিতে এসে জুট মিলের গেটে সাসপেনশন অব ওয়ার্কের নোটিশ দেখে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন শ্রমিকরা। এখানেও অনিয়মিত পাটের জোগান ও পাটের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে মিল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার নোটিশ দেওয়া হয়। এর ফলে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহতার মধ্যে ডেল্টা জুট মিলের প্রায় ৩৫০০ শ্রমিক পরিবার পরিজন নিয়ে বিপন্ন হয়ে পড়েন।

বিগত কয়েক মাস ধরে পাটের অনিয়মিত সরবরাহ ও দাম বৃদ্ধির অজুহাতে শ্রমিকদের কাজের দিন ও কাজের ঘণ্টা কমিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও শ্রমিকরা মিল চালু রাখার জন্য কাজ করছিলেন। এর আগে দু’বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৬ সালে ডেল্টা জুট মিলে কাজ শুরু হয়। বিসিএমইউ’র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের পর থেকে শ্রমিকদের কাছ থেকে পিএফ-র টাকা কেটে নেওয়া হলেও মালিকপক্ষ তা সরকারি দপ্তরে জমা দেয়নি। এর ফলে ২০১৭ সাল থেকে যাঁরা কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন, তাঁরা পিএফ-র টাকা পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে বারবার সরকারি আধিকারিকদের চিঠি দিয়ে জানানো হলেও কোনো সুরাহা হয়নি।

গত ১৮ এপ্রিল মিল কর্তৃপক্ষ সমস্ত ইউনিয়নের সাথে সভা করে মিল বন্ধ করার কথা বললে বিসিএমইউ’র প্রতিনিধিরা তার বিরোধিতা করেন। সভায় মিল শ্রমিকদের স্বার্থে মিল বন্ধ না করে চালু রাখার দাবি জানায় বিসিএমইউ। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস পরিচালিত মিল শ্রমিকদের ইউনিয়ন মালিক কর্তৃপক্ষের এই শ্রমিক-বিরোধী সিদ্ধান্তকে পরোক্ষভাবে সমর্থন জানায়।

এদিকে উত্তর ২৪ পরগনার শিল্পাঞ্চলে ভোটপর্ব মেটার দু’দিন যেতে না যেতেই ২৫ এপ্রিল ভাটপাড়া রিলায়েন্স জুট মিলে সাসপেনশন অব ওয়ার্কের নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে শ্রমিকরা তীব্র বিক্ষোভ দেখান। অন্যদিকে চটকলের সমস্ত ইউনিয়ন অফিসে ভাঙচুর ও আসবাবপত্র বার করে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, মালিকপক্ষের পেটোয়া বাহিনীকে দিয়ে এই কাজ করানো হয়েছে বলে অভিযোগ। যাতে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধভাবে মালিকের এই একতরফা কারখানা বন্ধের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে না পারে। এআইটিইউসি নেতা ইন্দ্রজিৎ সাউ জানিয়েছেন, মিলটা বন্ধ থাকার পর মাস তিনেক হলো খুলেছিল। তারপর কিছুদিন ধরে মিলে কাঁচা পাট জোগান নেই - এই অজুহাতে শ্রমিকদের কাজের সময় কমিয়ে ছ’দিন করা হয়। অন্যদিকে মিল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি দিতে চাইছিল না। ইউনিয়নগুলির দাবি ছিল, গ্র্যাচুইটি মিটিয়ে দিতে হবে। ভোটের পর ম্যানেজমেন্টের সাথে বসার কথা ছিল। ২১ এপ্রিলও মি‍‌লে কাজ হয়েছে। ২২ এপ্রিল ভোটের জন্য মিল বন্ধ ছিল। দু’দিন ছুটির পর ২৫ এপ্রিল মিলে কাজে গিয়ে শ্রমিকরা কাজ বন্ধের নোটিশ দেখেন।

শ্রমিকদের অভিযোগ, তাঁদের দাবি ও প্রাপ্য মেটানোর দাবি এড়াতেই কর্তৃপক্ষের তর‍‌ফে এই নোটিশ দিয়ে ইউনিয়ন অফিস দু’টি ভাঙচুর করানো হয়েছে। গত নভেম্বর মাস থেকে শ্যামনগর ওয়েভারলি জুট মিলটিও বন্ধ রয়েছে।

বর্তমানে হাওড়ার হনুমান জুটমিল, ডেলটা জুটমিল, হাওয়া জুট মিল, বালি জুট মিল, ভারত জুট মিল ও মহাদেব জুটমিলে ৭ দিনের বদলে ৫ দিন কাজের সুযোগ পাচ্ছেন শ্রমিকরা। হাওড়ার এই ৬টি জুট মিলে সপ্তাহে ২দিন কাজ কমিয়ে দেওয়া ছাড়াও প্রতিদিনের শিফট কমানোর ফলে শ্রমিকদের মজুরি কার্যত অর্ধেক হয়ে গেছে। এছাড়া এই ৬টি জুট মিলে প্রতিদিন তিনটি শিফটের বদলে দু’টি শিফটে কাজ করতে পারছেন শ্রমিকরা। এই মিলগুলির মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়া জুটমিল, রিলায়েন্স জুটমিল সহ চারটি মিল বন্ধ হয়ে গেছে।

রিলায়েন্স জুট মিলে শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার, হাওড়ার বন্ধ ডেলটা জুট মিলে শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৪০০০, হাওড়ার বন্ধ থাকা হনুমান জুট মিলে শ্রমিক সংখ্যা ছিল ৪০০০, হগলির বন্ধ থাকা ওয়েলিংটন জুট মিলে শ্রমিক সংখ্যা ৪০০০, দক্ষিণ ২৪ পরগনার বন্ধ বজবজ জুটমিলের শ্রমিক সংখ্যা ৪৫০০। অধিকাংশ মালিকরাই কাঁচা পাটের অভাবে মিলগুলো বন্ধ করে দেওয়ায় কাজ হারানো শ্রমিকদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২১,৫০০। সর্বশেষ বন্ধ হয়েছে প্রবর্তক জুট মিল। এখানেও কাঁচা মাল সরবরাহের অভাব ও শ্রমিকদের অনুপস্থিতির মিথ্যা অজুহাতে গত ২৮ এপ্রিল অনির্দিষ্টকালের জন্য কাজ বন্ধের নোটিশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কামারহাটি বিধানসভা এলাকার অন্তর্গত বেলঘরিয়া দেশপ্রিয়নগর এলাকার এই মিলটিতে কর্মরত ছিলেন প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে হঠাৎ করে এই মিলটি বন্ধ হওয়ায় এই মিলটির উপর নির্ভরশীল শ্রমিক ও তাঁদের পরিবার ও আশেপাশের মানুষ চরম দুর্ভোগের কবলে পড়েছেন। শ্রমিক সংগঠনগুলির অভিযোগ, চটকলগুলির এই সঙ্কট ও কর্মহীন শ্রমিকদের নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই।

রাজ্যে চটকলের এই সঙ্কটের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইটিইউ’র পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সাধারণ সম্পাদক অনাদি সাহু জানিয়েছেন, পাট উৎপাদন প্রয়োজনমাফিক হওয়ার পরেও কৃত্রিমভাবে পাটের জোগান কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে চটকলগুলিতে কাঁচামাল সরবরাহ কমের অজুহাতে উৎপাদন কাটছাঁট করা যায় এবং চটকলগুলি বন্ধ করে শ্রমিকদের বেকার করে দেওয়া যায়। তিনি জানিয়েছেন, পাট নিয়ে কালোবাজারি হচ্ছে। এ নিয়ে কেন্দ্রের সরকারের অধীন জুট ক‍‌র্পোরেশন অব ইন্ডিয়া চুপ কেন? নির্বাচনের নামে রাজ্য সরকারও কেন উদাসীন? এতগুলি জুটমিল বন্ধ হতে বসেছে, শিফট কমিয়ে সপ্তাহে ২ দিন উৎপাদন বন্ধ রেখে চটকলের শ্রমিকদের রুটি-রুজি বন্ধের দিকে ঠেলে দেওয়ার পরেও সরকার নিশ্চুপ কেন? কেন রাজ্য সরকার হস্তক্ষেপ করে পুরোদমে উৎপাদন চালু করার জন্য মিল মালিকদের বাধ্য করবে না? তিনি দাবি জানিয়েছেন, এই পরিস্থিতির মোকাবিলায় প্রয়োজনে বাংলাদেশ থেকে পাট নিয়ে আসার জন্য ব্যবস্থা নিক কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার।