৫৮ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ৩০ এপ্রিল, ২০২১ / ১৬ বৈশাখ, ১৪২৮
কোভিডকালে অক্সিজেন রাজনীতি
তপন মিশ্র
এদেশে করোনাকালে অনেক ধরনের নিম্নমানের রাজিনীতির কথা শোনা যায়। সম্প্রতি অক্সিজেন নিয়ে বিজেপি সরকারের রাজনীতি যে ঘৃণ্য রূপ নিয়েছে তা লিখতেও হাত কাঁপে। আমি, আপনি বা আমাদের পরিবারের কোনো এক সদস্য আমাদের অজান্তেই এই রাজনীতির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে পারেন। করোনা প্রথম তার প্রকোপ দেখাতে শুরু করলে প্রথম যে জিনিসটির চাহিদা বৃদ্ধি পায় তা হলো অক্সিজেন। অক্সিজেন রোগের নিরাময়ের জন্য নয় বরং রুগীর জীবনদানের প্রথম উপকরণ।
ঘটনাটি সবার সামনে আসে গত ১৭ এপ্রিল যখন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে ফোন করে তাঁর রাজ্যে চিকিৎসার জন্য অক্সিজেনের অভাবের কথা বলতে চান। তাঁকে বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন প্রচারের মতো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত আছেন, তাই তিনি মুখ্যমন্ত্রী ঠাকরের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। প্রধানমন্ত্রীর মনে না থাকার কথা নয় যে, মহারাষ্ট্র এখন কোভিডের মারাত্মক আক্রমণের মুখে। তাই নিশ্চয়ই খোশগল্পের জন্য নয়, কোনো জরুরি প্রয়োজনে ফোন, এটা প্রধানমন্ত্রীর বোঝা উচিত ছিল। এহেন অমানবিক রাজনীতি এদেশে আগের কোনো প্রধানমন্ত্রী করেছেন কিনা জানা নেই।
কিছু সময় পূর্বে, মহারাষ্ট্রে অক্সিজেনের সহজলভ্যতার বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল উদ্ধব ঠাকরেকে আক্রমণ করে বলেছিলেন যে, মহারাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত ভারতে অক্সিজেনের সর্বাধিক সরবরাহ পেয়েছে এবং কেন্দ্র তাদের সমস্ত প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন করবে। কবে থেকে গোয়েল সাহেব দেশের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিলেন তা আমাদের জানা নেই। ইতিমধ্যে রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলট প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনের প্রচারপর্ব বাদ দিয়ে করোনায় দেশের পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করার পরামর্শ দেন।
মহামারী চলাকালীন প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের উপর নজরদারি করতে কেন্দ্রীয় সরকার এমপাওয়ার্ড গ্রুপ-২ তৈরি করে। ১২ টি রাজ্য যেমন মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, রাজস্থান, কর্ণাটক, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, ছত্তিশগড়, কেরল, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় চিকিৎসার জন্য অক্সিজেনের প্রয়োজনীয়তা অনেকটা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই রাজ্যগুলিতে এখনই ১৭,০০০ টনেরও বেশি অক্সিজেন চাহিদা মেটাতে পাঠানোর দরকার হয়ে পড়েছে।
যে সমস্ত সংস্থা এই অক্সিজেন তৈরি করে তারা হলো, আইনক্স এয়ার প্রোডাক্ট, লিনডে ইন্ডিয়া, গোয়েল এমজি গ্যাসেস প্রাঃ লিঃ, ন্যাশনাল অক্সিজেন লিমিটেড। এর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে বেসরকারি সংস্থাগুলি।
অক্সিজেন উৎপাদন এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারি প্রস্তুতির কতটা অভাব তা নিম্নলিখিত কয়েকটি তথ্য থেকে বোঝা যেতে পারে। কিছুদিন পুর্বেও এই চাহিদা মেটানোর ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারগুলির স্বাধীনতা ছিল। এখন কিন্তু সবটাই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে। এই তথ্যের আগে দু’একটি বিষয়ে লেখকের সঙ্গে পাঠকের ঐকমত্য হওয়া জরুরি।
১। ভারতে যে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ আসবে সেটা সম্পর্কে সরকার অবগত ছিল।
২। প্রথম ঢেউ একটু হ্রাস হওয়ার পর সরকার অন্তত গত ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ থেকে মার্চ মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত একটা বড়ো সময় পেয়েছিল পরের আঘাতের পূর্বে প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। কেরলের সরকারকে বাদ দিলে অন্য কোনো রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার তার সদ্ব্যবহার করেনি।
৩। দ্বিতীয় আঘাত যে ভয়ঙ্কর হবে তা অন্য দেশের অভিজ্ঞতা থেকে জানার পরও সরকার তার রাজধর্ম পালন না করে কেবল জাতিগত এবং রাজনৈতিক বিভাজনের ধর্ম পালন করেছে।
এবার দেখা যাক কেবল মুমূর্ষু করোনা আক্রান্তদের অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য কি কি প্রস্তুতির দরকার ছিল।
১। আমাদের দেশে অক্সিজেন এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে পরিবহণের (২৪×৭) জন্য যথেষ্ট শীতল ট্যাঙ্কার (ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার) নেই। এই ব্যবস্থাকে উন্নত করার কোনো প্রয়াস রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করেনি।
২। বিভিন্ন কারণে করোনার আগে অক্সিজেন তৈরির কারখানা থেকে রুগীর বিছানা পর্যন্ত গড়ে যে সময়টা ৩ থেকে ৫ দিন লাগত কয়েকদিন আগে পর্যন্ত, সেই সময়টা ৬ থেকে ৮ দিন লাগছে। দূরবর্তী বা গ্রামীণ এলাকার কথা তো বাদই দিলাম। উৎপাদন ত্বরান্বিতকরণের প্রস্তুতির অভাবে এই অঘটন।
৩। দেশে অক্সিজেন সরবরাহকারীদের কাছে পর্যাপ্ত সিলিন্ডার (জুম্ব বা ডুরা) নেই। ফলে কারখানা থেকে হাসপাতালে বহন করার কাজ ব্যাহত হচ্ছে।
৪। করোনাকালের পূর্বে একটি সাধারণ সিলিন্ডারে রিফিল করার খরচ ছিল ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এখন এটা দাঁড়িয়েছে ৫০০ থেকে ২০০০ টাকা। এবং কখনো কখনো কালোবাজারিদের হাত ঘুরে ১০,০০০ টাকা। সরকারের এর উপরে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই বা তার কোনো প্রস্তুতিও সরকার নেয়নি।
ইতিমধ্যে দেশের কয়েক হাজার (?) মানুষের মৃত্যুর পর সরকার কিছু ব্যবস্থা নিয়ে বাহবা তুলতে চাইছে। কিন্তু এখনও যে ফাঁক-গুলি রয়ে গেছে সেগুলির মধ্যে গ্রাম গঞ্জের ছোটো হাসপাতাল বা ব্যক্তি মালিকানাধীন চিকিৎসা ব্যবস্থাগুলিতে কোনো এক সরকারি ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। বড় সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে শষ্যা সংখ্যা বাড়ন্ত। গ্রামে গঞ্জের সক্রামণ মোকাবিলা করার বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থাই এখন একমাত্র সমাধান।
এগুলি ছাড়াও রেমডেসিভির (Remdesivir), টিকা, হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বৃদ্ধি, ভবিষ্যতে আরও বড়ো মহামারী মোকাবিলার ক্ষেত্রে সরকারি পরিষেবাকে আরও উন্নত করার জন্য প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি কোনো ক্ষেত্রেই সরকারের প্রস্তুতি নেই।