৫৮ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ৩০ এপ্রিল, ২০২১ / ১৬ বৈশাখ, ১৪২৮
পুঁজির ভাইরাস
কৌশিক মুখোপাধ্যায়
এই দুনিয়ায় কোনো বৃহৎ ঘটনা নয়, তা সে দাঙ্গা হোক বা যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ হোক বা মহামারী, তার সাথে বড়ো পুঁজির সরাসরি সম্পর্ক থাকবে না, তা হতে পারে না। অতীতেও হয়নি, আজ তা আরও বেশি বেশি করে হয় না। দেশে দেশে, বিশেষত বড়ো বাজারওয়ালা (ক্রেতা-বিক্রেতার নিরিখে) দেশগুলোতে কেমন সরকার হবে, সেই সরকারের নীতি কোন্ পথে পরিচালিত হবে, গণতন্ত্রকে শুধুমাত্র নির্বাচনী নিরিখে অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠতার আঙ্গিকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক নানা প্রতিষ্ঠান (যেমন সেনা, পুলিশ, আদালত, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি) থেকে সমগ্র মিডিয়া হাউসকে পর্যন্ত কীভাবে সর্বগ্রাসী কর্পোরেট পুঁজির দাস বানিয়ে ফেলতে হয়, তার ভুরি ভুরি উদাহরণ প্রতিনিয়ত তামাম বিশ্বজুড়ে দৃশ্যায়িত হয়ে চলেছে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যক্তি মানুষের সমস্ত চিন্তা-চেতনার গতিবিধির নিয়ন্ত্রক তার আপন মগজাস্ত্র নয়, বরং অনেকাংশেই তার নিয়ন্ত্রণ অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা একটা ব্যবস্থার হাতে। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত ও নির্ধারিত প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করে এরাই প্রতিনিয়ত হীরক রাজার দেশের ‘মস্তিষ্ক প্রক্ষালক যন্ত্র’-এর মতো আমাদের চিন্তার জগৎকে আবেশিত করে রেখেছে। আর শাসকের সুযোগ্য সহায়তায় আমাদের চিন্তা-চেতনা, চৈতন্য বিকাশের সমস্ত সম্ভাবনা যাতে বিকাশ লাভ করতে না পারে, তার আয়োজন পরিপূর্ণ হচ্ছে। কার্যত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে একমেরু এ বিশ্বে আজ কর্পোরেট পুঁজি নিয়ন্ত্রিত পাপেট শো-ই দেশে দেশে বিরাজমান।
ঠিক এ কারণেই বিগত এক বছরের অধিক সময় জুড়ে এবং বিশেষত বিগত কয়েকদিনে তথাকথিত করোনা মহামারীকে কেন্দ্র করে যে চিত্রপট গোটা বিশ্বে এবং আমাদের দেশে গড়ে তোলা হয়েছে, তা নির্ভেজাল যুক্তির বিচারে মান্যতা দিতে নিতান্তই অসুবিধা হচ্ছে। জনমানসে, গোটা সমাজে একে কেন্দ্র করে সবথেকে বেশি করে যা সংগঠিত হয়েছে, তা হলো ভয়ঙ্কর এক আতঙ্ক, মৃত্যুর এই ভয়ানক আতঙ্ক সমাজে এমনভাবে সংগঠিত করা হচ্ছে, যার সাথে বৃহৎ পুঁজির স্বার্থবাহী সম্পর্ককে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যাচ্ছে না। বরং প্রতিনিয়ত তা প্রকট হতে প্রকটতর হয়ে উঠছে। কৃত্রিম মৃত্যু আতঙ্ক সৃষ্টি করার এই প্রবণতাই প্রমাণ করে দিচ্ছে যে, যা ঘটছে, তার পিছনে অর্থনীতির অনেক বড়ো হিসাব-নিকাশই লুকিয়ে আছে। মনে রাখতে হবে দেশ-বিদেশে গত এক বছরে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক মন্দার যে চিত্র উঠে এসেছে, তার অভিঘাত মূলত সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত সাধারণ শ্রেণির মানুষকেই গ্রহণ করতে হয়েছে। অক্সফ্যামের ২০২০ সালের রিপোর্টও বলছে, আমাদের দেশ বলুন আর গোটা বিশ্বে বৃহৎ কর্পোরেট শ্রেণি করোনা মহামারীর এই সময়কালে রেকর্ড পরিমাণ মুনাফা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। আতঙ্কের আবহের মধ্যেই দেশে দেশে তাদের স্বার্থবাহী নীতি প্রণয়নের কাজ যেমন এগনো হয়েছে, একইভাবে আজকের এই আতঙ্ক সৃষ্টির সাথে আগামীদিনে ভ্যাকসিনের বাজার তৈরি ও তার স্থায়ীকরণের কর্পোরেট স্বার্থও যে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সে সত্যও ইতিমধ্যেই চিহ্নিত।
আসুন দেখে নেওয়া যাক, কেন এই মৃত্যু আতঙ্ককে কৃত্রিম বলে চিহ্নিত করতে চাইছি। মহামারী শব্দের আভিধানিক অর্থ মড়ক অর্থাৎ যে রোগের প্রকোপে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে। কিন্তু হু (WHO) বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত সংজ্ঞায় কোনো রোগের প্রভাব বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে যাওয়াকেই প্যানডেমিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে, সে সংজ্ঞায় মৃত্যুর সাথে মহামারীর কোনো সম্পর্ক সংযুক্ত নেই। কেন নেই, কবে এই সংজ্ঞার পরিবর্তন ঘটিয়ে মৃত্যুর বিষয়টাকে প্যানডেমিক হতে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে বৈকি! আর হু যেহেতু কোভিড-১৯-এর সংক্রমণকে মহামারী বলছে, তাই মানুষের বিশ্বাসও দৃঢ়তর হয়েছে। কিন্তু তা করতে গিয়ে মৃত্যুভয়ের আতঙ্ককে জাগ্রত রাখতে এমন ভঙ্গিমায় প্রতিনিয়ত এ সংক্রান্ত তথ্য পরিবেশিত হয়ে চলেছে, যা অর্ধসত্য এবং অবশ্যই আংশিক সত্য। কর্পোরেট পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন এই ব্যবস্থার অধীনেই যে তথ্যভাণ্ডার উঠে আসছে, তার ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, গোটা বিশ্বে ১৭ এপ্রিল, ২০২১ তারিখে মোট কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ কোটি ৭৬ লক্ষ ৭ হাজার ১২ জন। অর্থাৎ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৭৯০ কোটির নিরিখে ডিসেম্বর, ২০১৯ থেকে ১৭ এপ্রিল, ২০২১ পর্যন্ত অর্থাৎ বিগত ১৬ মাসে সারাবিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৮ শতাংশ এই রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। ওয়ার্ল্ড মিটার-এর তথ্য অনুযায়ী উক্তদিন পর্যন্ত মোট আক্রান্তের মাত্র ১২.৯৬ শতাংশ (১ কোটি ৮২ লক্ষ ৪৫ হাজার ৬৭৬ জন) অ্যাক্টিভ রোগী, যার আবার ৯৯.৪ শতাংশের শারীরিক অবস্থাই স্বাভাবিক বা মাঝারি অবস্থায় এবং মাত্র ০.৬ শতাংশ রোগীর পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আর সেরে ওঠা এবং মৃত রোগীর সংখ্যা মোট আক্রান্তের ৮৭.০৮ শতাংশ, যার মধ্যে ৯৮ শতাংশই সম্পূর্ণ সুস্থ এবং আক্রান্তের মধ্যে মৃত্যুর হিসাবকে মান্যতা দিলে (যদিও এটাকে প্রকৃত মৃত্যুহার বলা চলে না) মাত্র ২শতাংশ (৩০ লক্ষ ১৫ হাজার ৮৭৯জন) এ রোগে মারা গেছেন। যদিও এদের মৃত্যুর কারণ যে কোভিড-১৯-ই, সে নিয়েও বহু প্রশ্ন রয়েছে, যার কোনো উত্তর দেবার দায় কারো নেই। যাইহোক, এই ব্যবস্থার মধ্যেই উঠে আসা তথ্যে লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে, এখনও পর্যন্ত (১৭ এপ্রিল, ২০২১) কোভিড-১৯-এ গোটা বিশ্বের আক্রান্তদের ৫৩.৩১ শতাংশই মাত্র ৬টি দেশের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২২.৯৫ শতাংশ, ভারত ১০.৩৮ শতাংশ, ব্রাজিল ৯.৮৩ শতাংশ - এই তিনটে দেশ মিলেই ৪৩.১৬ শতাংশ, ফ্রান্স ৩.৭১ শতাংশ, রাশিয়া ৩.৩৩ শতাংশ এবং গ্রেট ব্রিটেন ৩.১১ শতাংশ)। অর্থাৎ বৃহৎ পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন সবথেকে লোভনীয় ও প্রতিষ্ঠিত বাজার যেখানে যেখানে বিরাজমান, সেখানেই কোভিড-১৯-এর বাড়বাড়ন্ত লক্ষণীয়। তুলনামূলকভাবে যদি এবার আমরা আফ্রিকা মহাদেশের চিত্র দেখি, যেখানে আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে দুর্বল, সেখানে মোট জনসংখ্যার মাত্র ০.৩৩ শতাংশ এ রোগে আক্রান্ত (মোট জনসংখ্যাঃ ১৩৬ কোটি ৫৯ লক্ষ ১০ হাজার ৮৪৯ জন এবং আক্রান্ত ৪৪ লক্ষ ৫৯ হাজার ৫৯০ জন, ১৭ এপ্রিল, ২০২১) যা গোটা বিশ্বের সব মহাদেশের মধ্যে সর্বনিম্ন। এবার একটু নিচের সারণিতে চোখ বোলানো যাক, যেখানে ১৭ এপ্রিল, ২০২১-কে ভিত্তি করে বর্তমান বিশ্বের সবথেকে গরিব দশটি দেশের কোভিড-১৯ পরিস্থিতি দেখানো হয়েছে -
দেশের নাম | মোট জনসংখ্যা | মোট আক্রান্ত | মোট মৃত্যু |
সিয়েরা লিওন | ৮১,০৪,৯৫৯ | ৪,০২০ | ৭৯ |
দক্ষিণ সুদান | ১,১২,৯৭,৬২০ | ১০,৪৫২ | ১১৪ |
লাইবেরিয়া | ৫১,৫১,৩৩৭ | ২,০৪২ | ৮৫ |
মোজাম্বিক | ৩,১৯,৪৪,০২০ | ৬৯,১৩৪ | ৭৯৮ |
মালাউই | ১,৯৫,১৯,০২৫ | ৩৩,৯৩৪ | ১,১৩৮ |
নাইজার | ২,৪৮,৯৩,২৫০ | ৫,১১৬ | ১৯০ |
ইরিত্রিয়া | ৩৫,৮৫,২৪৬ | ৩,৪৯১ | ১০ |
কঙ্গো | ৯,১৭,০০,৩২৪ | ১০,০৮৪ | ১৩৯ |
সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক | ৪৮,৯৮,৭২০ | ৫,৭৮৭ | ৭৫ |
বুরুন্ডি | ১,২১,৬৯,০৫৩ | ৩,৪৭৭ | ০৬ |
মোট | ২১,৩২,৬৩,৫৫৪ | ১,৪৭,৫৩৭ | ২,৬৩৪ |
উপরোক্ত পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে দেখা যাচ্ছে, বর্তমান বিশ্বের সবথেকে গরিব ১০টি দেশের প্রায় সাড়ে ২১ কোটি জনসংখ্যার মাত্র দেড় লক্ষের কাছাকাছি অর্থাৎ মাত্র ০.০৬৯ শতাংশ মানুষ তথাকথিত এই ‘মারণ রোগ’ কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, এতগুলো গরিব দেশ, যাদের নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সবচেয়ে ভঙ্গুর, যে দেশগুলোর মানুষ স্বাভাবিক পুষ্টি মানের তুলনায় অনেক কম পুষ্টির সুযোগ পান এবং যে কারণে তাদের স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও অনেকাংশে কম, সেখানে এমন ‘মারণ’ ভাইরাসে আক্রান্তের হার এত কম কেন? গোটা আফ্রিকা মহাদেশ এবং বিশেষ করে গরিবস্য গরিব দেশগুলোতেও কেন এমন বিপরীত চিত্র, তা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বিজ্ঞানী, গবেষক মহলের কী বক্তব্য? এদেশগুলোতে ভ্যাকসিনের খোলাবাজার, ক্রেতা-বিক্রেতা থেকে সরকারগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষমতার সাথে কোথাও কি আক্রান্তের সংখ্যার একটা পারস্পরিক তুল্যমূল্য সম্পর্কের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হওয়া নিতান্তই অস্বাভাবিক? একইভাবে দেখা যাবে, আমাদের দেশেও করোনা-কেন্দ্রীক এই আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়েছে মূলত শহরাঞ্চল ও মফস্সল ভিত্তিক এলাকাগুলোতে, যেখানে উচ্চবিত্ত থেকে উচ্চমধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষদের বসবাস ও যাদের ক্রয়ক্ষমতা গ্রামীণ জনগণের তুলনায় বহুলাংশে বেশি। যত মৃত্যু, যত হাহাকার, যত আতঙ্কের ছবি মূলত তা শহরাঞ্চল কেন্দ্রিকই কেন? গ্রাম ভারতে, কোটি কোটি গ্রামের মানুষের কাছে কার্যত এই প্রলয়ঙ্কর মারণ রোগের কোনো বাস্তব প্রভাবের ছবি উঠে আসছে কি? এই প্রশ্নগুলো কি সত্যিই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব?
আসুন, এবার একটু আমাদের দেশের বাস্তবতায় চোখ বোলানো যাক। নিচের সারণিতে আমরা ১৭ এপ্রিল, ২০২১ অর্থাৎ মিডিয়ার ভাষায় এদেশে করোনা সংক্রমণের এই দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন কিছু তথ্য তুলে ধরছি।
মোট আক্রান্ত | ১,৪৬,১৯,১৪৬ |
মৃতের সংখ্যা | ১,৭৬,৫৪৩ |
সরকারি হিসাবে মৃতের হার | ১.২১ শতাংশ |
মোট পরীক্ষা | ২৬,৬৫,৩৮,৪১৬ |
ETCR (মোট আক্রান্ত/টেস্ট সংখ্যা) | ৫.৪৮ শতাংশ |
দেশের মোট জনসংখ্যা | ১,৩৯,০৯,৭১,৪৪১ |
CTC (মোট জনসংখ্যা × ETCR) | ৭৬,২২,৫২,২৩৫ |
প্রকৃত অর্থে মৃত্যু হার (মৃতের সংখ্যা/মোট জনসংখ্যার নিরিখে আক্রান্ত) - ০.০০২৩
বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে একটা বিষয় খুব পরিষ্কার যে, কোভিড-১৯-এর এই ভয়াবহতা প্রমাণের জন্য বর্তমানে একমাত্র মৃত্যুকেই বারে বারে তুলে আনা হচ্ছে। তাই প্রতিনিয়ত মৃত্যুর সংখ্যা, মৃত্যুর ছবি, শ্মশানঘাট, কবরস্থানের ছবি, ছেলে হারা মায়ের অশ্রুসজল ছবি, স্বামী হারা স্ত্রীর বিপর্যস্ত ছবি খবরের কাগজের প্রথম পাতার প্রথম কলম থেকে হরেক মিডিয়ার সমস্ত খবরে পালা করে বারে বারে প্রচারের ব্যবস্থা চলেছে। কিন্তু উপরের সারণি অনুযায়ী আমাদের সামনে সরকারি তথ্য ভাণ্ডারের নিরিখেই যে চিত্র উঠে আসছে যুক্তির বিচারে, সাধারণ বুদ্ধির অঙ্কে তা কতটা ভয়ানক? ১৭ এপ্রিল, ২০২১-এর ভিত্তিতে প্রাপ্ত টেস্ট কেস আনুপাতিক হার (ETCR বা Effective Test Case Ratio) বা ৫.৪৮ শতাংশ, অর্থাৎ এ দেশে ১০০জনের কোভিড-১৯ সনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হলে প্রায় সাড়ে ৫জন সংক্রমিত পাওয়া যাচ্ছে। আবার ভারতের মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে যদি সব ভারতীয়র লালারসের পরীক্ষা করা হতো, তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা (CTC বা Calculated Test Case) দাঁড়াতে পারতো ৭ কোটি ৬২ লাখের কিছু বেশি। অর্থাৎ সাধারণ অঙ্কের হিসাবে প্রাপ্ত আক্রান্তের সংখ্যার (CTC) ভিত্তিতে মৃত্যুহার প্রকৃত অর্থে দাঁড়ায় মাত্র ০.০০২৩। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে ১০০০ জন মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকতে পারে মাত্র ২ জনের, ৯৯৮ জনই সুস্থ থাকবেন। একইভাবে আমাদের রাজ্যের দিকে তাকালেও যে চিত্র উঠে আসে -
মোট আক্রান্ত | ৬,৫১,৫০৮ |
মৃতের সংখ্যা | ১০,৫৪০ |
সরকারি হিসাবে মৃতের হার | ১.৬১ শতাংশ |
মোট পরীক্ষা | ৯৭,৬২,০৮৬ |
ETCR (মোট আক্রান্ত/টেস্ট সংখ্যা) | ৬.৬৭ শতাংশ |
রাজ্যের মোট জনসংখ্যা | ১০,৫০,০০,০০০ |
CTC (মোট জনসংখ্যা × ETCR) | ৭০,৩৫,০০০ |
প্রকৃত অর্থে মৃত্যু হার (মৃতের সংখ্যা/মোট জনসংখ্যার নিরিখে আক্রান্ত) - ০.০০১৫
এ রাজ্যের ক্ষেত্রেও পরিষ্কার, সরকারি হিসাবে মৃত্যুহারের (১.৬১ শতাংশ) সাথে প্রকৃত অর্থে মৃত্যুহারের (০.০০১৫ বা প্রতি ১০০০জনে মৃত্যুর সম্ভাবনা ১.৫জনের, গোটা দেশের হারের চেয়েও কম) আসমান-জমিন ফারাক। তবে এরপরেও এই মৃত্যুহার নিয়ে বহু প্রশ্নের অবকাশ রয়েছে যার উত্তর দিতে চায় না মিডিয়া থেকে প্রশাসন কেউই। কারো লালারসের নমুনায় কোভিড-১৯-এর সন্ধান পাওয়া গেলে এবং পরবর্তী সময়ে উক্ত রোগীর মৃত্যু হলে তার মৃত্যুর কারণ হিসাবে শুধুমাত্র কোভিড-১৯-কেই চিহ্নিতকরণ করা হচ্ছে কীভাবে? কোন্ যুক্তিতে? এটাও করা হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশে এবং আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও তা মেনে চলতে স্বাস্থ্যমন্ত্রক থেকে নির্দেশিকা জারি হয়েছে। যেকোনো রোগীর মৃত্যুর ক্ষেত্রেই নির্দিষ্ট কোন্ কারণ তার মৃত্যুর জন্য দায়ী তা সঠিকভাবে নিরূপণ করতে অটোপসি ছাড়া কোনো পথ নেই। কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে কোভিড রোগীর মৃতদেহের অটোপসির দাবি উঠলেও তাতে কর্ণপাত করা হয় নি। বলা হচ্ছে এত বিপুল সংখ্যক দেহের অটোপসি করার পরিকাঠামো কোথায়? কিন্তু এই মৃতদেহগুলোর মধ্যে কিছু সংখ্যক নমুনাকেও তো অটোপসির আওতায় আনা যেত? তাহলে অন্তত কোভিড আক্রান্তের প্রকৃত মৃত্যুর কারণ চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে একটা দিশা পাওয়া সম্ভব হতো। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে এর ফলে কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন উঠে যেত। তাই সে পথকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, কারণ এতে জনমানসে মৃত্যু আশঙ্কায় লাগাম পড়ার একটা সম্ভাবনা থাকত।
আজ এ দেশে করোনা সংক্রমণের এই যে দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়ঙ্কর চিত্রায়ণ প্রতিমুহূর্তে হয়ে চলেছে তাতে কয়েকটি বিষয় ইতিমধ্যেই সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভে সক্ষম হয়েছে। এক, করোনাতে আক্রান্ত হওয়া মানেই মৃত্যুর সমূহ সম্ভাবনা। দুই, যেকোনো মূল্যে এই মুহূর্তে টিকা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তিন, টিকার বিপুল আকাল এবং চার, টিকা জোগানোর দায় সরকারের নয়, বাজারের। অর্থাৎ বাজার অর্থনীতির চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে উপযুক্ত পরিস্থিতি বিরাজমান। কিন্তু একটু তলিয়ে ভাবলেই দেখা যাবে কীভাবে ধীরে ধীরে এই ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ আতঙ্ককে গত এক বছরে সংক্রমণকালে বারে বারে লালন করা হয়েছে। বিভিন্ন দেশে তার ভয়াবহতার চিত্র প্রচার করা হয়েছে। আমাদের দেশে ২০২০ সালের মার্চের ২৪ তারিখ লকডাউন ঘোষণা হবার পর থেকে প্রতি দু-তিন মাস অন্তরই এই ‘দ্বিতীয় ঢেউ’-এর হিড়িক তোলা হয়েছে। কখনও ‘জুন-জুলাই থেকে পরিস্থিতি ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে’, কখনও ‘বাস-ট্রেন চালু হলে কি ভয়াবহ অবস্থা হতে পারে’, কখনও ‘শারদোৎসবের পর মড়ক লাগবে’, কখনও ‘শীতকালে পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করতে চলেছে’ সহ ক্রমাগত এই ‘দ্বিতীয় ঢেউ’-এর আগমনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে।
অবশেষে বাজারে ভ্যাকসিনও এলো, কিছুদিন ভ্যাকসিনের সুপ্রভাবের প্রচার অর্থাৎ করোনার বিভিন্ন স্ট্রেনের ক্ষেত্রেও তার কার্যকারিতা নিশ্চিত এমন প্রচার (অথচ পৃথিবীর ইতিহাসে আজ পর্যন্ত কোনো আরএনএ ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কারের নিদর্শন নেই) চলার পর মোটামুটি এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে মাত্র ৬-৭ দিনের মধ্যে দৈনিক সংক্রমণ লাখ ছাড়িয়ে দু-লাখ, তিন লাখের গণ্ডি অতিক্রম করে এই ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ কার্যত আজ সুনামির আকার ধারণ করেছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অব্যাহত মৃত্যু মিছিলের ধারাবাহিক চিত্রায়ণ। কিন্তু খুব সাধারণভাবেই যে প্রশ্নটা আসে এবং যার কোনো যথার্থ উত্তর আজ পর্যন্ত পাওয়া সম্ভবপর হলো না, তা হলো নির্দিষ্ট কোনো কারণে এভাবে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে দেশের নানাস্থানে সংক্রমণ থেকে অ্যাক্টিভ রোগী এবং মৃত্যু প্রতিটা লেখচিত্রই প্রায় একই প্রবণতায় এমন হারে (প্রায় ৩-৪ গুণ) ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে? কোন্ প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় হঠাৎ করে লেখচিত্রের এ ধরনের প্রবণতা পরিবর্তন বিজ্ঞানের স্বাভাবিকতার সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ। অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সের (এইমস্) প্রধান এমন প্রবণতার সাপেক্ষে গোদা গোদা ভাষায় যে দু’টি কারণের ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার একটি হলো সাধারণ মানুষের করোনা বিধি না মেনে চলা, আর অপরটি নাকি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে নানা উৎসব ও কয়েকটি রাজ্যের ভোটগ্রহণ পর্ব। এ দেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ সংস্থার ব্যাখ্যায় উঠে আসা এই কারণ দু’টি কি প্রকৃত অর্থে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে এত স্বল্প সময়ে এই হারে সংক্রমণ বৃদ্ধিকে মান্যতা দেয়? করোনাবিধি না মানার কারণেই যদি এমন ভয়ানক সংক্রমণ চিত্র উঠে আসে তাহলে তার প্রভাব হঠাৎ করে এত অল্পদিনের ব্যবধানেই ঘটে কোন্ বাস্তবতার ভিত্তিতে? আর আমাদের দেশে উৎসবের মরসুম সাধারণভাবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকে নভেম্বর-ডিসেম্বর পর্যন্ত, কোনোভাবেই জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে এ দেশের কোথাও তেমন বড়ো উৎসবের নজির থাকে না। আর ভোট হচ্ছে না এমন বহু রাজ্যেই যেমন মহারাষ্ট্র, দিল্লি, রাজস্থান, গুজরাটে এই ‘দ্বিতীয় ঢেউ’-এর লক্ষণীয় প্রকোপও দৃশ্যমান। তাহলে স্বয়ং এইমস্-এর ডিরেক্টর সাহেবের যুক্তিই বা মান্যতা দিই কিসের ভিত্তিতে?
আসলে এমন বহু প্রশ্নেরই প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানসম্মত, যুক্তিনির্ভর কোনো উত্তর নেই। সামগ্রিকভাবে সমগ্র বিশ্বজুড়েই একটা বিরাট অংশের বিজ্ঞানী, ডাক্তার থেকে সামাজিক আন্দোলনের মানুষ এবং নানা সংগঠন বিশ্বব্যাপী সংগঠিত এই প্যানডেমিকের জন্ম থেকে তার বিস্তার, ভ্যাকসিনের আবিষ্কার সহ আগামীদিনে একে কেন্দ্র করে বিশ্ববাজারে কি পরিস্থিতি তৈরি হতে চলেছে, তার প্রতিটা বিষয়কেই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছেন এবং মানবতার বিরুদ্ধে সংগঠিত এ ঘৃণ্য চক্রান্তকে উন্মুক্ত, বিবস্ত্র করে দিয়েছেন। গোটা বিষয়টার সাথে যে বিশ্ব অর্থনীতির তাবড়ো ধনকুবেরদের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে, তার সাপেক্ষেও নানা তথ্য, প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু কর্পোরেট হাউস নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব পুঁজিবাদী শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন মূল ধারার মিডিয়া থেকে তার পৃষ্ঠপোষক নানা দেশের সরকার সহ সামগ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থা এই ষড়যন্ত্র যাতে কোনোভাবেই বৃহত্তর মানবসমাজকে প্রভাবিত করতে না পারে, তার জন্য যতটা সম্ভব নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছে। সোস্যাল মিডিয়ার সমস্ত ক্ষেত্র - যেমন ফেসবুক, ট্যুইটার, ইন্সট্রাগ্রাম, হোয়াটস অ্যাপ এমনকি গুগল সহ এদের নিয়ন্ত্রণাধীন সব মাধ্যম থেকে কোভিড-১৯ ষড়যন্ত্র-কেন্দ্রীক সমস্ত প্রতিবেদন ও তথ্য যাতে কোনোভাবে প্রকাশ্যে না আসে, তার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। যদি প্রকৃতই এ প্রসঙ্গে উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর উত্তর থাকতো, তাহলে কি এমনভাবে খিল আঁটার প্রয়োজনীয়তা পড়তো? স্বাভাবিক যুক্তি, বুদ্ধি কী বলে?
সামগ্রিকভাবে গোটা সমাজে বিগত কয়েকদিনে মৃত্যুভয়ের এক ভয়ঙ্কর গণ-হিস্টিরিয়া তৈরি হয়েছে। কেরালা ছাড়া গোটা দেশে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার বেহাল দশা এমনিতেই কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় বে-আব্রু। তাই মূল ধারার মিডিয়া থেকে প্রশাসন মৃত্যু বিভীষিকার স্থানে যদি এ সময়ে ন্যূনতম সচেতনতার প্রচার ও প্রসারে উদ্যোগী হতো, তাহলে হয়তো এ লড়াইয়ের ভিত্তি অনেক বেশি শক্তিশালী হতো। অন্তর থেকে, মানসিকভাবে প্রতিনিয়ত মানুষকে যেভাবে দুর্বল করে তোলা হচ্ছে, তাই হয়তো অনেক মৃত্যুর ক্ষেত্রে অনুঘটকের ভূমিকা গ্রহণ করছে। কোভিড-১৯ ছাড়িয়ে কোথাও কি কোভিডের মৃত্যুভয় মানুষকে আরও বেশি করে মৃত্যুপথে এগিয়ে দিচ্ছে না তো? যে-কোনো ক্ষেত্রেই জিততে গেলে জয় করতে হয় ভয়কে, ইতিহাস সাক্ষী দেয় মৃত্যুভয় দিয়ে কখনও কোনো যুদ্ধ জেতা যায়নি। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় মৃত্যুর ভয় দেখিয়েই যুদ্ধ জয়ের যে গল্প রচনা চলেছে, হয়তো সে গল্পের প্লট বহু অগেই রচিত। আমরা শুধুমাত্র এ যুদ্ধের ঢাল তলোয়ারহীন কুশীলব মাত্র, আসলে জেতার অপেক্ষায় এ পৃথিবীর সবথেকে সংখ্যালঘু সেই ১ শতাংশ ধনকুবেররাই - যাদের মুষ্ঠিবদ্ধ এ পৃথিবীর ৯৯ ভাগ সম্পদ।