৫৮ বর্ষ ৩৭ সংখ্যা / ৩০ এপ্রিল, ২০২১ / ১৬ বৈশাখ, ১৪২৮
মন্দ থেকে ভালোর পথে ধনতন্ত্র - সোনার পাথরবাটি
বিশ্বম্ভর মণ্ডল
আর্থিক মন্দার সময়ে সব থেকে বেশি অসুবিধায় পড়েছে গরিব মানুষ। অতিমারীতে রোগের ধাক্কা সামলানোর ক্ষমতা গরিবের নেই বললেই চলে। মন্দার সময়ে সবার আগে কাজ হারায় তারা। ভাঁড়ে মা ভবানী, ফলে কাজ চলে যাবার ধাক্কা সামলাতে তাদের সব থেকে বেশি হিমশিম খেতে হয়। বাস্তব অভিজ্ঞতা এটাই যে, ধনতন্ত্রের চাকা যত জোরে ছুটতে থাকে, তত ফুলে ফেঁপে ওঠে ধনী দেশগুলো আর গরিব দেশের ধনীরা। ধনতন্ত্রের পূজারিরা আজ লিখতে বাধ্য হয়েছেন যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিপন্নতা বেড়েই চলেছে, অধিকতর মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই। রোগ নির্ণয়ে ভুল নেই এক ফোঁটা। কিন্তু মরার আগে হারতে রাজি না ধনতন্ত্র। তাই ধনতন্ত্রকেও তার বাহিনীকে মাঠে নামিয়ে প্রচার করতে হচ্ছে যে, ধনতন্ত্র কি কি পারেনি, কেন পারেনি। শেষে এটাও জানিয়ে দিচ্ছে ‘সঙ্কটের একমাত্র উত্তর দায়িত্বশীল ধনতন্ত্র’। এই অসত্যের বিরুদ্ধেই দেশে দেশে দাবির ঝড় উঠছে, ‘সমাজতন্ত্র পারছে অতিমারী সামলাতে, ধনতন্ত্র পারছে না কেন’। দেশে দেশে যেখানে যেখানে রাষ্ট্র পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে সেসব দেশ অতিমারীতে চরম সঙ্কটে পড়ে গেছে। ভালো ধনতন্ত্র, সমাজমুখী ধনতন্ত্র, গরিবের প্রতি ধনতন্ত্রের দায়িত্ব পালন, বর্তমান সঙ্কটের একমাত্র উত্তর দায়িত্বশীল ধনতন্ত্র, এই সব কাহিনির অবতারণা করা হয়েছে নিরপেক্ষতার আড়ালে নিজেকে রেখে, ধনতান্ত্রিক শিবিরের সহায়ক ও অন্যতম কাণ্ডারি নানা গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে। ধনতন্ত্রের ব্যর্থতা লোকের মুখে মুখে ঘুরছে। এই প্রেক্ষাপটে ধনতন্ত্রকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা শুরু হয়েছে যেন সিস্টেমটা তো ভালোই, এর প্রয়োগে রাষ্ট্রের দুর্বলতাই হলো যত সমস্যার কারণ। তাই মানুষের ব্রেনওয়াশের প্রক্রিয়া শুরু করে দেওয়া হয়েছে। ওদের কাছে মানুষের মনোযোগটাও একটা পণ্য। ধনতন্ত্র জানে কীভাবে তা দখল করতে হয়, আর কেন তা দখলে রাখাটা জরুরি।
উদার শব্দের “মাদকতাই” আলাদা। স্বাধীনতা শব্দের দ্যোতনাও কম না। ধনতন্ত্রের পূজারিরা তাই বলেন, দেশের উন্নতির জন্যে উদার বাণিজ্য প্রয়োজন, বাজারের স্বাধীনতা প্রয়োজন। এদের বক্তব্য, ধনতন্ত্রের সাফল্যের কারণেই দেশে দেশে আর্থিক সম্পদের পরিমাণ বহু গুণ বেড়েছে। সাথে সাথেই ওরা যুক্ত করেছেন যে, ওই সম্পদের বণ্টনের সমস্যা আছে, তাই নাকি দেশে দেশে এত আর্থিক বৈষম্যের প্রাদুর্ভাব। রাষ্ট্র নাকি সম্পদ বণ্টনে ব্যর্থ, তাই এত সমস্যা, আর আর্থিক বৈষম্যের কারণও রাষ্ট্রের অপদার্থতা। ধনতান্ত্রিক শিবিরের এই যুক্তি পড়াশোনা জানা বা চেতনাসম্পন্ন মানুষের কাছে নিতান্তই হাস্যকর, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। যে প্রশ্নটা সামনে চলে এসেছে - তাহলে পৃথিবী জুড়ে এত অব্যবস্থা, এত অভাব, এত বৈষম্য, এত অবিচার, এত অন্যায় কেন। তখন উত্তর দেওয়া হচ্ছে - রাষ্ট্র সেই সম্পদের বণ্টন করতে পারছে না। এদের দাবি রাষ্ট্র সঠিক ভূমিকা নিতে পারছে না বলেই নাকি যে কোনো অর্থনৈতিক ধাক্কায় সারা পৃথিবীতে গরিব মানুষের জীবন একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। অতিমারীতে সারা পৃথিবীতে যেখানে যেখানে রাষ্ট্রের হাতে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ আছে সে দেশের মানুষ বেঁচে গেছে, বিশেষত সমাজতান্ত্রিক দেশে। ধনতান্ত্রিক দুনিয়ার মুখ লুকোবার জায়গার বড়ো অভাব। তাদের কর্তাব্যক্তিদের দেশগুলো তো অতিমারী মোকাবিলায় চরম ব্যর্থ। মানুষের বিরক্তি এতটাই যে, ভোটে গদি থেকে টেনে নামিয়ে দিয়েছে আমেরিকার নবাবকে। তাই আজকে ওই শিবিরের মাথারা বুঝতে পারছেন যে, মানুষ বিরক্ত, বিব্রত, চিন্তিত নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ে। সাধারণ মানুষ ধনতন্ত্রের কঙ্কালসার চেহারা যে ধরে ফেলেছে সেটা আন্দাজ করেই ওরা ওদের পোষা প্রচারযন্ত্রকে ব্যবহার করে বলতে শুরু করেছে যে, ধনতন্ত্রকে আরও ভালো ভূমিকাতে ব্যবহার করা যায়, যদি রাষ্ট্র তার ভূমিকাটা ঠিকঠাক পালন করে। অর্থাৎ দোষটা ধনতন্ত্রের না। ধনতন্ত্র থাকলে যাদের উপকার হয় তাদের পোষা কলমচিরা বলতে শুরু করে দিয়েছেন, বা তাদের দিয়ে বিশ্ব জুড়ে বলানো শুরু হয়ে গেছে যে, বিশ্বজুড়ে যে সঙ্কট চলছে তার একমাত্র সমাধান নাকি ধনতন্ত্রের আরও প্রসারিত আর দায়িত্বশীল ভূমিকা। উপায়ের দিশাও পোষা কলমচিরা বলে দিয়েছেন। সেটা কি? তাদের মতে সঙ্কটের সমাধান সম্ভব যদি গরিব মানুষগুলোর দায়িত্ব স্বীকার করে রাষ্ট্র ধনতন্ত্রের সৃষ্টি করা অপর্যাপ্ত সম্পদকে সঠিকভাবে বণ্টনের ব্যবস্থা করতে পারে। এই সমাধান সূত্রটাই হলো আসলে ‘ভাবের ঘরে চুরি’। তলিয়ে না দেখলে অনেকেই ধনতন্ত্রের মানবিক বা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠার চেষ্টা বলে ভাবতে শুরু করতে পারেন। কারণ যে সম্পদ রাষ্ট্রের না, সেই সম্পদ অধিগ্রহণ করে রাষ্ট্র বণ্টন করতে গেলে যে কোমরের ও মতাদর্শের জোর লাগে তা কি আদৌ আছে ধনতন্ত্রের ধ্বজাধারী রাষ্ট্রের? লেখায় বা বক্তৃতায় বলা হচ্ছে ‘দায়িত্বশীল ধনতন্ত্র’ মানে গরিবের জন্যে দায়িত্ব গ্রহণ করা, আর বাস্তবের অভিজ্ঞতায় ‘দায়িত্বশীল ধনতন্ত্র’ মানে হচ্ছে ধনীদের সুরক্ষার জন্যে চৌকিদারি করা। রাষ্ট্র কি? শোষণ ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার যন্ত্র। ধনতান্ত্রিক শিবির রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে পুঁজিপতিদের স্বার্থকে রক্ষা করতে চাইছে। সমাজতন্ত্রীরাও রাষ্ট্রের কথা বলে, তবে সে রাষ্ট্র হলো সর্বহারার রাষ্ট্র।
পৃথিবীজুড়ে এক অভূতপূর্ব আর্থিক বৈষম্য লক্ষ করা যাচ্ছে। এটা পুঁজিবাদী শিবির মেনে নিচ্ছে প্রকাশ্যে, সেটাই খুব আশ্চর্যের বিষয়। এটাও ঠিক পুঁজিবাদী শিবিরের ছলনার তো শেষ নেই। নিজেকে ‘মহান’, ‘গরিবের বন্ধু’, ‘সন্ত্রাসবাদ বিরোধী’, ‘যুদ্ধবিরোধী’, ‘মানবিক’ - এমন হাজারো মুখে পৃথিবীজুড়ে দাপিয়ে চলেছে ধনতন্ত্র। তার হাতে অধিকাংশ মিডিয়া। তার দখলে তেল দুনিয়ার একটা বড়ো অংশ। তার দালালে ভরে আছে সারা পৃথিবী। কেনা ‘মাথা’ তার হয়ে ‘রোবট’-এর কাজ করে যায় প্রতিনিয়ত। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বয়স তার থেকে অনেক কম। অভিজ্ঞতাও অনেক কম। এই শিবিরের অর্থের জোরও কম। ‘ভোগ’ পছন্দ করলে যায় ধনতন্ত্রে, ত্যাগী মানুষের স্বাভাবিক পছন্দ সমাজতন্ত্র। তাই প্রভাবশালী, ধনসম্পদের অধিকারী লোকের সংখ্যাও কম সমাজতান্ত্রিক শিবিরে।
ধনতন্ত্রে পুঁজিপতি চায় মুনাফা বাড়িয়ে যেতে। শ্রমিকের সংখ্যা কম রাখলে তার সুবিধা, কারণ তাতে শ্রমিকের দর কষাকষির ক্ষমতা কমে যায়। পুঁজিপতি যত বেশি শ্রমিকদের শোষণ করে, শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা তত কমে যেতে থাকে। তাহলে বাজারে পণ্য কিনবে কে? এই অর্ন্তবিরোধের মীমাংসা ওরাই করে ওদের মতো করে। কিভাবে করে সে আলোচনা এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য না। ধনতন্ত্রের শিবিরের কথায় চমক থাকতে পারে, কিন্তু সত্য নেই। কারণ সত্য হলো এটাই যে, এই সঙ্কটের একমাত্র স্থায়ী সমাধান হতে পারে যখন উদ্বৃত্ত মূল্যের মালিক হয়ে উঠবেন শ্রমিকরাই, যা একমাত্র সম্ভব হতে পারে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের মাধ্যমেই। সব বিষয়ে রাষ্ট্রের দায়িত্ব থাকবে না, আর দেশ উন্নতির দিকে এগিয়ে যাবে এ কোনো কালে কোনো দেশে হয়নি, কি করে হবে। শিক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবে না, স্বাস্থ্যের দায়িত্ব রাষ্ট্র নেবে না, বাসস্থানের দায়িত্ব নেবে না, আর মানুষ দেশের জন্য জান লড়িয়ে দেবে এটা কখনোই সম্ভব না। বেয়াড়া শ্রমিকগুলোকে, কৃষকদের জব্দ করতে পারলেই এসে যাবে ‘আচ্ছে’ দিন, ভাবলে সেই দেশের মাথা তুলে দাঁড়ানো কঠিন। একই সাথে রাষ্ট্র কার পক্ষে আছে তার উপরেই নির্ভর করে দেশ উন্নতির দিকে গেলে কেমন ধরনের উন্নতি হবে? পিরামিডের উপরের অংশের না পিরামিডের নিচের অংশের? খারাপ মানুষ থেকে ভালো মানুষ হয়, একথা সত্য। কিন্তু পচা আমকে ভালো আম করার কোনো উপায় বিজ্ঞানীদের জানা নেই। ধনতন্ত্র দেখতে চকচকে, কিন্তু তার ফল বাইরে থেকে সুন্দর হলেও, ভিতরে পচা-গলা-হিংস্রতা-লোভ-লালসায় পরিপূর্ণ। তাই খারাপ ধনতন্ত্র থেকে ভালো ধনতন্ত্রে পৌঁছানোর পথ বলে কিছু হয় না।