৬০ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৪ পৌষ, ১৪২৯
দেশের অর্থনীতির অধোগতিতে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর উদ্বেগ প্রকাশ
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের মোদী সরকারের যাবতীয় বাগাড়ম্বর অসার প্রমাণ করে দেশের অর্থনীতিতে যে অধোগতি চলছে তাতে গভীর উদ্বেগ জানালো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পলিট ব্যুরো। নয়াদিল্লিতে দু’দিনের বৈঠকের পরে পলিট ব্যুরোর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মন্দার কারণে দেশে শিল্পোৎপাদন কমছে। বাড়ছে কর্মহীনতা, মুদ্রাস্ফীতি। বিশেষত খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর দুর্দশা আরও বাড়ছে। এই অবস্থায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সহায়ক পরিকাঠামো ক্ষেত্রগুলিতে সরকারি বিনিয়োগ ব্যাপক হারে বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে পলিট ব্যুরো।
সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর বৈঠক গত ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই বৈঠক শেষে বৈঠকে দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে পলিট ব্যুরো বলেছেঃ
অর্থনীতিঃ ভারতীয় অর্থনীতির গভীর মন্দা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ও বিনিয়োগ বাড়ছে বলে সরকারের যাবতীয় বাগাড়ম্বর এবং দাবি সত্ত্বেও, ভারতের উৎপাদন ক্ষমতার বৃদ্ধি হচ্ছে না।
গত অক্টোবরে দেশের শিল্পোৎপাদন ৪ শতাংশ নেমেছে। তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার এই ঘটনা ঘটল। বার্ষিক তথ্য অনুযায়ী, কারখানার পণ্য উৎপাদন তাৎপর্যপূর্ণভাবে ৫.৪ শতাংশ কমেছে। অক্টোবরে শিল্পোৎপাদন সূচক (আইআইপি) ছিল ১২৯.৬, যা ২০২১’র সেপ্টেম্বরের পরে সর্বনিম্ন। ক্ষয়িষ্ণু ভোগ্যপণ্য (কনজিউমার ডিউরেবলস) উৎপাদন কমেছে ১৫.৩ শতাংশ, অ-ক্ষয়িষ্ণু ভোগ্যপণ্য (নন-কনজিউমার ডিউরেবলস) উৎপাদন কমেছে ১৩.৪ শতাংশ। ভারতবাসীর ক্রয়ক্ষমতা যে কমেই চলেছে, এসব তথ্যই তার ইঙ্গিত।
ক্রমবর্ধমান বেকারত্বঃ দেশে কর্মহীনতার হার বেড়েই চলেছে। সবচেয়ে খারাপ হলো, এর সঙ্গেই নেমে চলেছে শ্রমিকদের অংশগ্রহণের হার এবং কর্মসংস্থানের হার। চলতি ডিসেম্বরে বেকারত্বের হার বেড়ে হয়েছে ৮.৮ শতাংশ, নভেম্বরেও যা ছিলো ৮শতাংশ। ঊর্ধ্বগামী শহুরে বেকারত্ব পৌঁছেছে ৯.৬ শতাংশে, গ্রামীণ বেকারত্ব ৭.৮ শতাংশে।
দ্রব্যমূল্যঃ মুদ্রাস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী হার অব্যাহত রয়েছে। খাদ্যপণ্যের মুদ্রাস্ফীতি জনগণের জীবনযাপনের ওপর আরও বেশি বেশি করে দুর্দশা চাপিয়ে চলেছে।
এই অবস্থায়, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির সহায়ক পরিকাঠামো ক্ষেত্রগুলিতে সরকারি বিনিয়োগ ব্যাপক হারে বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে পলিট ব্যুরো। তারা বলেছে, অন্যথায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিও হবে না, দেশবাসীর ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে না।
খাদ্য নিরাপত্তা আইনের সঙ্গে পিএমজিকেএওয়াই’র সংযুক্তিঃ ২০১৩ সালের খাদ্য নিরাপত্তা আইনের অধীনে দেশবাসীর দুই তৃতীয়াংশকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ‘বিনামূল্যে’ রেশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর অর্থই হলো, দেশজুড়ে ক্ষুধার হাহাকার মোকাবিলায় এছাড়া যে আর কোনো পথ নেই তা স্বীকার করে নিচ্ছে সরকার। আসলে, এটাই সত্য। অথচ ভারতে ক্ষুধা-পরিস্থিতি ‘খুবই গুরুতর’ বলে বিশ্ব ক্ষুধা সূচকের তথ্যের বিরোধিতায় গলা ফাটিয়ে চলেছে মোদি সরকার!
দেশের ৮১.৩৫ কোটি মানুষকে বিনামূল্যে ৫ কেজি করে খাদ্যশস্য দেওয়ার কথা বলা হলেও, চলতি খাদ্য নিরাপত্তা আইন মোতাবেক ভরতুকিতে ৫ কেজি খাদ্যশস্য ৩ টাকা কেজি দরে চাল, ২ টাকা কেজি দরে গম এবং ১ টাকা কেজি দরে দানাশস্য এখন আর দিতে অস্বীকার করছে মোদি সরকার। এর ফলে পুষ্টির মাত্রা বজায় রাখতে জরুরি এই ৫ কেজি খাদ্যশস্যের ঘাটতি মেটাতে মানুষ খোলা বাজারে যাবেন, যেখানে ৩০ টাকার বেশি দরে কেজিপ্রতি গম, ৪০ টাকার বেশি দরে কেজিপ্রতি চাল বিক্রি হয়। এদেশে টিঁকে থাকতে সংগ্রাম করে চলে যে কোটি কোটি পরিবার, মোদি সরকারের এই পদক্ষেপ তাদের জন্য একটি নিষ্ঠুর ধাক্কা হিসেবেই পরিগণিত হবে।
এই অবস্থায়, বর্তমানে পিএমজিকেএওয়াই প্রকল্পে বিনামূল্যে যে ৫ কেজি খাদ্যশস্য এবং খাদ্য নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী ভরতুকি মূল্যে যে ৫ কেজি খাদ্যশস্য দেওয়া হয়, দু’টিই বজায় রাখার দাবি জানাচ্ছে পলিট ব্যুরো।
তীক্ষ্ণতম সাম্প্রদায়িক মেরুকরণঃ কেন্দ্রের শাসকদলের এক সাংসদ সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর হিংসাত্মক আক্রমণ চালানোর যে প্ররোচনামূলক হুমকি দিয়েছে, তা চরম নিন্দাজনক। বিষ্ময়করভাবে, এই হুমকির পরপরই যখন স্বতঃস্ফূর্ত নোটিস দিয়ে ফৌজদারি মামলা দায়ের করা উচিত ছিল, তখন কর্তৃপক্ষ বললো এই ভাষণের বিরুদ্ধে ‘অভিযোগ’ জমা না পড়লে তারা এগোতে পারবে না! এই ঘটনায় ফের স্পষ্ট হলো, সমাজে যারা বিষাক্ত ঘৃণা-প্রচার, হিংসা এবং সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তাদের কীভাবে খোলাখুলি মদত ও সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে মুসলিম ছাত্রদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ প্রচার মারাত্মকভাবে তীব্র করা হচ্ছে বলে ক্রমবর্ধমান খবর আসছে। খ্রিস্টান সংখ্যালঘুদের ওপরেও আক্রমণের ঘটনা বেড়ে চলেছে।
মুসলিম ছাত্রদের জন্য মৌলানা আজাদ ন্যাশনাল ফেলোশিপ (এমএএনএফ) নামাঙ্কিত সব স্কলারশিপ ও ফেলোশিপ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। সংসদে সরকার সাফাই দিয়েছে, এমএএনএফ’র সঙ্গে নাকি অন্যান্য নানান স্কলারশিপ প্রকল্পের মিল রয়েছে! এটি একেবারেই নির্লজ্জ মিথ্যা। মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বিভিন্ন রাজ্যে ওবিসি হিসেবে বিবেচিত হন না। তাই এই স্কলারশিপ প্রকল্প ফের চালু করতে হবে।
বিচারব্যবস্থাঃ বিচারপতিদের নিয়োগ ও বদলির ব্যাপারে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ন্যাশনাল জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন (এনজেএসি) চালু করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে মোদি সরকার। বিচারপতিদের নিয়োগের চলতি কলেজিয়াম পদ্ধতি বাতিল করতে চাইছে কেন্দ্র। এর পরিণতিতে বিচারবিভাগ এবং সরকারের মধ্যে সঙ্ঘাত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কারণ স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল জুডিসিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্টস কমিশন গঠনের প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছে।
বিচারবিভাগীয় নিয়োগ ব্যবস্থার ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় মোদি সরকারের যাবতীয় উদ্যোগের তীব্র বিরোধিতা করছে সিপিআই(এম)। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা আপসহীনভাবেই রক্ষা করা দরকার।
ভীমা কোরেগাঁও বন্দীদের মুক্ত করোঃ ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি ভীমা কোরেগাঁওয়ে হিংসার ঘটনার তদন্তকারী এক শীর্ষস্থানীয় পুলিশ অফিসার শপথ নিয়ে জানিয়েছেন, পুনে শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে এলগার পরিষদের অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিলো। হিংসায় কোনো ভূমিকাই ছিলো না সেই কর্মসূচির।
এই পরিস্থিতিতে, ইউএপিএ ধারায় গ্রেপ্তার সমস্ত বন্দীর নিঃশর্ত মুক্তি চাই অবিলম্বে।
সমবায় বিল - যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর আক্রমণঃ মাল্টি স্টেট কোঅপারেটিভ সোসাইটিজ অ্যামেন্ডমেন্ট বিল, ২০২২’র তীব্র বিরোধিতা করছে সিপিআই(এম)। এই বিল আসলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং রাজ্যগুলির অধিকারের ওপর আক্রমণ। সমবায় রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়। কোঅপারেটিভ সোসাইটিগুলি রাজ্যের আইন মোতাবেক কাজ করে। প্রস্তাবিত বিল এখন সেই কোঅপারেটিভ সোসাইটিগুলির ওপরেই নির্লজ্জভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইছে। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ কোঅপারেটিভ সোসাইটিগুলিকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর মাধ্যমে নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির অধিকার খাটো করা হবে এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপর আঘাত আসবে।
ত্রিপুরাঃ ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, সিপিআই(এম) এবং অন্যান্য বিরোধী শক্তির ওপর হিংসাত্মক আক্রমণ ততই তীব্র করছে শাসক বিজেপি।
বিজেপি সরকারের অত্যাচারী আমলে ত্রিপুরায় আইনের শাসন এবং গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এই অবস্থায় রাজ্যে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবি যৌথভাবে জানিয়েছে সিপিআই(এম) সহ বামপন্থী দলগুলি এবং কংগ্রেস।
এই অবস্থায় ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচন যাতে প্রহসনে পরিণত না হয়ে যায়, তা সুনিশ্চিত করতে সক্রিয় ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। ত্রিপুরায় যদি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হয়, তাহলে সেখানে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুরোপুরি পুনরুদ্ধার করতে হবে।
কেন্দ্রীয় কমিটির সভাঃ আগামী ২৮ থেকে ৩০ জানুয়ারি কলকাতায় সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সভা হবে।