৬০ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৪ পৌষ, ১৪২৯
আবাস যোজনায় দুর্নীতি ঘিরে তোলপাড় রাজ্যে
৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা কি সম্পূর্ণ হবে!
আবাস যোজনায় দুর্নীতির প্রতিবাদে কুমারগঞ্জে সিপিআই(এম)-র বিক্ষোভ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ আবাস যোজনার প্রাপক তালিকায় ব্যাপক দুর্নীতির জেরে রাজ্যজুড়ে ক্ষোভে উত্তাল বঞ্চিত মানুষ। প্রকৃত গরিব গৃহহীন প্রাপককে বঞ্চিত করে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার তালিকায় নজিরবিহীন দুর্নীতি করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। উত্তরে আলিপুরদুয়ারের মাল থেকে দক্ষিণে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশপুর পর্যন্ত বাড়ি থেকে বঞ্চিত মানুষের প্রবল-বিক্ষোভের মুখে সর্বত্র নাজেহাল বিডিও সহ জেলা প্রশাসন। দীর্ঘ সময় ধরে অবরুদ্ধ থাকছে গ্রাম পঞ্চায়েতের দপ্তর থেকে বিডিও অফিস। হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত পথ অবরোধ। ক্ষুব্ধ হকদার মানুষ বিহিত পেতে তালা লাগিয়ে দিচ্ছেন দপ্তরে। পুলিশ দিয়ে দপ্তর ঘিরে রেখে, গরিব মানুষের ওপরে লাঠি চালিয়ে বা হুমকি দিয়ে বঞ্চিত মানুষকে দমিয়ে রাখা বা ঘরমুখো করা যাচ্ছে না। তারা লালঝান্ডা আঁকড়ে ধরে সোচ্চার হয়ে দাবি জানাচ্ছেন প্রতিকারের। জমায়েত থেকে উঠছে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল নেতাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারের দাবিও। আবার গত ২৬ ডিসেম্বর অমিত শাহের সঙ্গে গদগদ ভঙ্গিতে হাত ধরে তোলা ছবিতে যত স্পষ্ট হয়েছে তৃণমূল-বিজেপি’র বোঝাপড়া, তেমনই বিজেপি এবং তৃণমূল পরিচালিত পঞ্চায়েতগুলিতে প্রকৃত প্রাপকদের বঞ্চিত করার প্রশ্নে যে কোনও তফাত নেই স্পষ্ট হয়েছে সেটাও।
বিভিন্ন স্তরের সংবাদমাধ্যমের প্রকাশিত খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যেই রাজ্যকে চূড়ান্ত অনুমোদন দিতে হবে কেন্দ্রীয় আবাস প্লাস যোজনার ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৪৮৮টি বাড়ির। অন্যথায় বাড়ির বরাদ্দ যা বাকি থাকবে তা বাতিল হতে পারে। এবং সেই বরাদ্দের ওপর জরিমানা হিসেবে চড়াহারে সুদ আদায় করবে কেন্দ্র।
জেলাওয়াড়ি হিসেবে দেখা যাচ্ছে, চূড়ান্ত ছাড়পত্র যা দেওয়া হয়েছে সে ক্ষেত্রে সংখ্যাটা মাত্র ১ লক্ষ ৮১ হাজার। ভূমিহীন উপভোক্তাদের জন্য ৩১শে ডিসেম্বরের পরেও আরও কিছুটা সময় দেওয়া হবে বলে কেন্দ্র জানিয়েছে। এক্ষেত্রে ভূমিহীনদের বাড়ি তৈরির জন্য পাট্টাও দেওয়া হবে। জেলাস্তরে অ্যাফিলিয়েট কমিটির কাছে থাকা আবেদনের নথি অনুযায়ী, তালিকাভুক্ত নামের সংখ্যা ৩৭ লক্ষ ৯০ হাজার বলে শোনা যাচ্ছে যার অধিকাংশ ভুয়ো বলছেন অভিজ্ঞরা। প্রসঙ্গত, নভেম্বর মাসেই আবাস যোজনার বরাদ্দ যা অনুমোদন হয়েছে সে ক্ষেত্রে একগুচ্ছ শর্ত চাপানো হয়েছিল কেন্দ্রের তরফে।
জানা যাচ্ছে আবাস যোজনায় নথিভুক্ত ৮৪ শতাংশ উপভোক্তার তথ্য যাচাই এখনো সম্পূর্ণ করতে পারেনি রাজ্য সরকার। এই অবস্থায় আগামী তিন দিনের মধ্যে ৯ লক্ষ বাড়ির অনুমোদন চূড়ান্ত করার সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে নবান্ন। সময়ের মধ্যে টাকা খরচ করতে না পারলে কেন্দ্রীয় সরকারের চাপ আবার দ্রুত কাজ করতে গিয়ে দুর্নীতিতে জেরবার হয়ে থমকে রয়েছে প্রশাসন, বিপরীতমুখী পরিস্থিতিতে কার্যত অচল অবস্থা রাজ্য সরকারের। আরও জানা গেছে, চলতি অর্থবর্ষে (২০২২-২৩) ১১ লক্ষ ৩৬ হাজার ৪৮৮টি বাড়ির মধ্যে ৫ লক্ষ ৯১ হাজার বাড়ি নথিভুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ এ পর্যন্ত লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১৬ শতাংশ বাড়ি আবাস যোজনার ছাড়পত্র পেয়েছে।
তথ্য এবং অঙ্কের হিসেবে যাই থাক, বেলাগাম দুর্নীতির জেরে বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। জনরোষের আঁচে হিমশিম গোটা প্রশাসন। নিশ্চুপ মুখ্যমন্ত্রী। নিশ্চুপ এ রাজ্যের তাঁবেদার সংবাদ মাধ্যম। একশ্রেণির বিডিও এবং প্রশাসনিক কর্তাও পরোক্ষে জড়িত তালিকার কারচুপিতে। ঘটছে ক্ষোভের নানা ধরনের বহিঃপ্রকাশ। যেমন, পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনার দু’নম্বর ব্লকের বসনছেড়া পঞ্চায়েত দপ্তরে প্রধান-উপপ্রধানের অনুপস্থিতির জেরে ক্ষিপ্ত জনতা পঞ্চায়েত দপ্তরে তালা লাগিয়ে রাজ্যসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান। পরে পুলিশি প্রহরায় তৃণমূলের প্রধান-উপপ্রধান দপ্তরে আসেন। সেখানে আবাস যোজনার প্রকাশিত তালিকায় দেখা যায় বাতিল তালিকার ৪৭২ জনের মধ্যে ৪৩৯ জনই প্রকৃত প্রাপক। বঞ্চিত এই প্রকৃত প্রাপকদের অনেকেই ত্রিপল টাঙিয়ে কোনোরকমে দিন গুজরান করেন। জালিয়াতি সম্পর্কে কোনো জবাব দিতে পারেননি প্রধান-উপপ্রধান। পরে রাস্তা অবরোধের জেরে বিডিও দপ্তরের দুই প্রতিনিধি এসে দুর্নীতির তালিকা সহ অভিযোগপত্র গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।
নদীয়ার চাকদহ ব্লকের চাউলিতে আবাস যোজনায় ঘর না পেয়ে গ্রাম পঞ্চায়েত অবরোধ করেন চারটি গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। দেউলি, কুণ্ডলিয়া, সরাপপুর - এই গ্রামগুলির বঞ্চিত মানুষ ২৮ ডিসেম্বর দুপুর বারোটা থেকে দেউলি জিপি ঘেরাও করে রাখে। অভিযোগ, পাকা বাড়ি থাকা সত্ত্বেও তালিকায় অনেকেরই দু’বার করে নাম উঠেছে, অথচ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের একজনেরও নাম নেই। দুপুর ১২টা থেকে তিনটে পর্যন্ত ঘেরাও করে রাখার পর দেউলি জিপিতে তালা দিয়ে দেন গ্রামবাসীরা।
পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া দু’নম্বর ব্লক অফিস অভিযান করেন স্থানীয় বঞ্চিত ও তৃণমূলী অত্যাচার ও দুর্নীতির শিকার হওয়া মানুষজন। সিপিআই(এম) কাটোয়া দু’নম্বর এরিয়া কমিটির ডাকে বহু মানুষ সমবেত হয়েছিলেন দাঁইহাটে ব্লক অফিসের সামনে। তাঁরা দাবি করেন, গ্রাম সংসদের সভা না করে কোনোভাবেই ব্লক সংসদ সভায় আবাস যোজনার তালিকা চূড়ান্ত করা যাবে না। প্রকৃত গরিব মানুষকে আবাস প্লাস প্রকল্পে যুক্ত করতে হবে। গ্রামবাসীদের মেজাজ দেখে এবং আন্দোলনের চাপে নতিস্বীকার করে পরে বিডিও দাবিগুলির যথার্থতা মেনে নেন ও আগামী এক মাসের মধ্যে গ্রাম সংসদের সভা করার কথা দেন। গ্রাম সংসদের সভায় চূড়ান্ত করা হবে আবাস প্লাস যোজনার ঘরের তালিকা।
বাঁকুড়ার সারেঙ্গায় একের পর এক আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের মানুষজনকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ির তালিকা থেকে নির্বিচারে বাদ দেওয়া হয়েছে। বাদ গেছেন এই ব্লকের ছ’টি অঞ্চলের অসংখ্য গরিব মানুষ। তাঁদের মাথা গোজার ঠাঁই নেই। পঞ্চায়েত এসব দেখে শুনেও তাঁদের পরিবর্তে অবস্থাপন্নদের বাড়ির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এর প্রতিবাদে সারেঙ্গা ব্লকে ডেপুটেশন দিয়ে প্রকৃত প্রাপকদের বাড়ি দেওয়ার জোরালো দাবি জানানো হয়। মানুষের আন্দোলনের জেরে বিডিও জানাতে বাধ্য হন কারা বাড়ি পেল তাঁদের নাম নেটে জানিয়ে দেওয়া হবে। বেছে বেছে বিরোধীদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে এখানে। রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে বড়ো আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন পার্টি নেতৃত্ব।
পুরুলিয়া জেলার আবাস যোজনার তালিকা সামনে আসতেই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, শাসকদলের বেলাগাম দুর্নীতি, যোগ্য প্রার্থীদের বাদ দিয়ে পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলনে নেমেছে বামপন্থী সংগঠনগুলি। অযোগ্য প্রাপকদের নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়ে যারা আবাস যোজনায় ঘর পাওয়ার উপযুক্ত তাদের নাম তালিকাভুক্ত করার দাবিতে আদিবাসী অধিকার মঞ্চ, সামাজিক ন্যাযয় মঞ্চ, সারা ভারত কৃষক সভা সহ বেশ কয়েকটি সংগঠনের ডাকে বিডিও-কে ডেপুটেশন দেওয়া হয়।
তালিকা নিয়ে অসন্তোষ আলিপুরদুয়ার জেলাতেও। ফালাকাটার কুঞ্জনগরে পথ অবরোধ করেন দেড়শ স্থানীয় বাসিন্দা। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মহিলারা। বাঁশের ব্যারিকেড করে ফালাকাটা কুঞ্জনগর রাস্তা আটকে দেওয়া হয়। স্থানীয় মহিলারা রাস্তায় শুয়ে পড়ে বিক্ষোভ জানান। রাস্তা অবরোধে জেরে যানবাহন আটকে পড়ে। পরে পুলিশের আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেয় আন্দোলনকারীরা, তবে পাকা বাড়ির মালিকদের নাম তালিকা থেকে বাদ না পড়লে আগামী দিনে বৃহত্তর আন্দোলন করবেন বলে জানিয়েছেন ওই মহিলারা। এর পাশাপাশি ২৮ তারিখ সিপিআই(এম)’র তরফ থেকে মাল এরিয়া কমিটি ও মেটেলি এরিয়া কমিটির পক্ষ থেকে বিডিও অফিসে বিক্ষোভ এবং ডেপুটেশন দেওয়া হয়। কুমারজল গ্রামে বহু যোগ্য এবং প্রকৃত প্রাপকের আবাস যোজনার তালিকায় নাম নেই। অথচ এই ব্লকেরই তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ। উপপ্রধানের বাড়ির পরিবার থেকে গোয়াল ঘরের জন্য আবাস যোজনায় নাম উঠেছে।
উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা থেকে বাদুড়িয়া সর্বত্র আবাস দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন গরিব মানুষ। এখানে বিডিও দপ্তরের তালা বন্ধ গেটের সামনে হকের পাওনা থেকে বঞ্চিতরা ক্ষোভ উগড়ে দেন। দেগঙ্গা ব্লকের ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েতের গরিব পরিবার যোগ দিয়েছিলেন জমায়েতে। এর আগে ২৭ তারিখ বিডিও দপ্তরে স্মারক জমা দেওয়ার কর্মসূচিতে দপ্তরের প্রাঙ্গণে ঢুকে তুমুল বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীরা। ক্ষোভ আছড়ে পড়ে টাকি রোডেও। অবরোধ করা হয় টাকি রোড। স্মারকলিপির সঙ্গে ছবি সহ প্রায় ২০০০ বঞ্চিত গরিব পরিবারের ঘর পাওয়ার আবেদনপত্র জমা দেওয়া হয়। এখানে তৃণমূলীরা অবৈধভাবে যার নামে ঘর দেওয়া হয়েছে সেই গরিব মানুষের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে জমা দিয়েছেন। বেড়াচাঁপা দু’নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের থেকে অভিযোগ কেবলমাত্র ঘর পাওয়ার আবেদন পত্র নেওয়ার জন্যই ৫০০ টাকা করে নিয়ে ঘর প্রকল্পের প্রতারণা করেছে তৃণমূলের।
জামবনি এবং কেশপুরে আবাস যোজনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করেও বঞ্চিত গরিব মানুষের রোষ সামলানো যায়নি। গলদে ভরা আবাস যোজনার নোটিশ বোর্ড ভেঙে গ্রাম পঞ্চায়েত দপ্তর থেকে সরিয়ে রাস্তায় ফেলে দেয় ক্ষিপ্ত মানুষ। বেলা দু’টো পর্যন্ত গ্রাম পঞ্চায়েত দপ্তর ঘেরাও করে রাখে জনতা। অচল হয়ে পড়ে সব কাজকর্ম। পুলিশ লাঠিচার্জ করে ভিড় হটিয়ে দিলেও গরিব মানুষের পথ অবরোধের জেরে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুলিশ হুমকি দিয়েও ফেরত পাঠাতে পারেনি হকের পাওনা থেকে বঞ্চিত মানুষগুলিকে। ত্রিপল টাঙিয়ে থাকেন যারা তেমন মানুষদের বঞ্চনা করা হয়েছে তাই তাঁরা লালঝান্ডা আঁকড়ে ধরে বিক্ষোভ প্রতিবাদে অংশ নেন। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই বহু মানুষ এসে দলে দলে শামিল হন এই কর্মসূচিতে। ঝাড়গ্রামে সরডিহা গ্রামে সংসদের সমস্ত সংখ্যালঘু মানুষের নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে বিজেপি’র পঞ্চায়েত নিশ্চুপ তৃণমূল।
আবাস যোজনার দুর্নীতির অভিযোগে পাঁচলায় তীব্র বিক্ষোভ দেখান বঞ্চিত মানুষ। লাল ঝান্ডা নিয়ে বিডিও অফিস ঘিরে ফেলেন তারা। বিক্ষোভ সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় প্রশাসনকে। গরিব মানুষ আবাস যোজনার ঘর পাননি অথচ পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার না করে বঞ্চিত মানুষদেরই আটকাচ্ছে - এমন অভিযোগের সোচ্চার হন তারা। পাঁচলার বিডিও অফিস ঘেরাও করে নতুন তালিকার দাবিতে বিক্ষোভ দেখায় সারা ভারত কৃষক সভা, খেতমজুর ইউনিয়ন এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলার সমিতি।