৬০ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৪ পৌষ, ১৪২৯
সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির ত্রয়োদশ সম্মেলনের আহ্বান
মালিনী ভট্টাচার্য
আগামী ৬-৯ জানুয়ারি, ২০২৩ কেরালার তিরুবনন্তপুরম্-এ হতে চলেছে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির (AIDWA) সর্বভারতীয় ত্রয়োদশ সম্মেলন। এই সম্মেলনে আলোচনায় অংশ নিতে আসবেন বিভিন্ন রাজ্য থেকে ৮৫০জনেরও বেশি প্রতিনিধি ও পরিদর্শক, ২৩টি রাজ্যে প্রায় ৯৮ লক্ষ সদস্যের হয়ে যাঁরা অভিজ্ঞতা ও মতামত বিনিময় করবেন। এছাড়া জম্মু-কাশ্মীর ও নতুন রাজ্য পণ্ডিচেরি থেকেও আসবেন কিছু নতুন সদস্য। ২০১৯-এর শেষে মুম্বাইতে অনুষ্ঠিত আমাদের শেষ সর্বভারতীয় সম্মেলনের কয়েকমাস পরেই কোভিড অতিমারীর কারণে দেশজোড়া লকডাউন ঘোষিত হয়, যা ছিল আমাদের সাংগঠনিক কাজকর্মের পক্ষে একটি বিরাট ধাক্কা। এই অতিমারীর সময়ে আমরা যে শুধু আমাদের বেশকিছু দক্ষ কর্মীকে হারাই তাই নয়, অনেকের রুজিরোজগার বন্ধ হয়ে যায়, পারিবারিক সংকট তাঁদের জীবনকে এতটাই বিপর্যস্ত করে যে, সাংগঠনিক কাজ থেকে তাঁরা সরে যেতে বাধ্য হন। রাজ্যস্তর থেকে শুরু করে একেবারে মাটির কাছাকাছি যে সাংগঠনিক শিকড়গুলির সাহায্যে আমাদের সংগঠন নিত্য সঞ্জীবিত থাকে তাদের পারস্পরিক ব্যাপক চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার ফলে কী করে তাকে আবার বাঁচিয়ে তুলব সেই উৎকণ্ঠা আমাদের ওপর ছায়া ফেলে। লকডাউনের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ার সাহায্যে যোগাযোগ বহাল থাকলেও আমাদের সন্দেহ ছিল না যে, এই পরোক্ষ যোগাযোগ কোনোমতেই নিত্য প্রত্যক্ষ উপস্থিতির বিকল্প হতে পারে না। তাই লকডাউন ওঠার পরেই আমরা রাজ্যে রাজ্যে এই বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলাম যে, আর দেরি নয়, ঘরের বাইরে বেরোতে হবে, রাস্তায় নামতে হবে, এলাকায় এলাকায় মেয়েদের সঙ্গে সংযোগের ছিঁড়ে-পড়া সূত্রকে অবিলম্বে জোড়া লাগাতে হবে। পরিবারের বাধা ছিল, এলাকাগুলিতে ভয় ও অনীহার পরিবেশ ছিল, রাজনৈতিক প্রতিকূলতা ছিল, তবু অনেক জায়গাতেই আমাদের কর্মীরা এই আহ্বানে সাহসের সঙ্গে সাড়া দেবার ফলে অতিমারীর সময়ের নিষ্ক্রিয়তার কিছুটা অন্তত ক্ষতিপূরণ আমরা করতে পেরেছি।
সর্বভারতীয় সম্মেলন উপলক্ষে সাংগঠনিক দপ্তর উদ্বোধন তিরুবনন্তপুরমে।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে সম্ভাব্য ক্ষতির সঙ্গে পাল্লা দেওয়া যাবে তবেই যদি ক্ষতিপূরণের ক্ষমতা আমরা একশোগুণ বাড়াতে পারি; সেটাই আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। সর্বাধিক সক্রিয়তাও এখন যথেষ্ট নয়, কারণ অতিমারীর বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে দেশের বিজেপি-আরএসএস সরকার নিজের সমস্ত কাজকর্মেই যে শুধু লকডাউন নামিয়ে এনেছিল মানুষকে অসহায়তায় ফেলে তাই নয়, স্বাধীনতার সময় থেকে সংগ্রামী মানুষ - বিশেষত সংগ্রামী মেয়েরা - বহু রক্তঘামের বিনিময়ে যে মৌলিক অধিকারগুলিকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, যার নিদর্শন বহন করেছিল আমাদের দেশের সংবিধান, সে অধিকারগুলিকেই সেই ফাঁকে তার রাষ্ট্রীয় শক্তি নিয়ে খাস্তা কাগজে পরিণত করার খেলায় ব্যস্ত ছিল। আমরা দেখলাম, ব্যাপারটা শুধু এই নয় যে, আনাজপত্রের দাম, রান্নার গ্যাসের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে,ব্যাপারটা এই যে, মানুষকে খাদ্য জোগানোর দায় থেকেই সরকার বলেকয়ে অব্যাহতি নিচ্ছে। আমাদের শিশুরা ব্যাপকহারে স্কুলছুট হচ্ছে কথাটা শুধু এই নয়, কথা এই যে সরকারপোষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে সরকারই অচল করে দিচ্ছে, স্কলারশিপগুলি তুলে দেওয়া হচ্ছে; লকডাউনে কর্মসংস্থানের বিপুল সংকট, তারই মধ্যে সরকারি ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের যেটুকু ব্যবস্থা ছিল তাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে; হাসপাতালের, ওষুধের, পরিষেবার নিদারুণ আকাল যখন তখনই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রগুলিকে নয়া শিক্ষানীতির অজুহাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে আমরা কর্মক্ষেত্রে সমকাজে সম আইনের দাবি তুলছিলাম, সেখানে কর্মক্ষেত্র থেকেই মেয়েদের নতুন শ্রমনীতিতে বহিষ্কার করা হচ্ছে। একদিকে বাড়ছে কোটিকোটিপতির সংখ্যা, অন্যদিকে ভুখা মানুষের সংখ্যা। ক্ষুধা, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য থেকে মুক্তির অধিকার, নাগরিকত্বের অধিকার আজ আর অধিকার নেই, বিশেষ সুবিধায় পরিণত। সেই সুবিধার মূল্য নিশ্ছিদ্র বশংবদতা। আর ভিন্জাতের, ভিন্ধর্মের মানুষ সম্বন্ধে সন্দেহ ও ঘৃণা সেই বশংবদতারই অপর পিঠ। অর্থাৎ স্বাধীনতার পরে অনেক আশা নিয়ে আমাদের যাত্রা ছিল সমতার দিকে; কিন্তু এখন আমাদের বাধ্য করা হচ্ছে অসাম্যের দিকে উলটোযাত্রায়।
সর্বভারতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে প্রচার কর্মসূচি তেলেঙ্গানায়।
এই উলটোযাত্রাকে ত্বরান্বিত করার জন্য নামিয়ে আনা হয়েছে অতিমারীর চাইতেও বড়ো এবং ব্যাপক ভয়ের জমানা, যারা প্রান্তিকতার ফলে যত বিপন্ন ভয় তাদের আরও বেশি। মেয়েরা এই বিপন্নতার অবশ্যম্ভাবী অংশ। তাদের ভয়ে রাখে তাদের পরিবারের চোখরাঙানি, সামাজিক আচার-আচরণ থেকে বিচ্যুত হবার ভয়; ঘরের ভিতরে থাকলে বাড়ে গার্হস্থ্য নির্যাতন, বাইরে বেরোলে খারাপ মেয়ের তকমা পেয়ে ধর্ষিত বা লাঞ্ছিত হবার আশঙ্কা; তারা জানে আইন থাকলেও সে আইন কাজ করে বাহুবলীদের জন্য যদি তারা ক্ষমতাসীনের সাঙ্গোপাঙ্গদের দলে পড়ে। ধর্মের অজুহাত দিয়ে তাদের পড়াশুনো বন্ধ করা যায়; জাতের অজুহাত দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাদের জীবনসঙ্গী বাছার ক্ষমতা। নারীসুলভ স্নেহশীলতার অজুহাত দিয়ে ঘরে আটক করা যায় তাদের। নিজেদের হীন ভাবার মনুবাদী কুসংস্কার তাদের মজ্জায় পচন ধরায়। হীন হয়ে বাঁচা, ভয়ে ভয়ে বাঁচাটাকে অভ্যাসে পরিণত করার চাপ মেয়েদের ওপরে যে আরও বেশি এই সংকটের সময়ে তা আমাদের সংগঠন বেশি করে বুঝেছে। আর সেইজন্যই যখন আমাদের সামনে আরও অনেক বেশি শক্তিসঞ্চয় করার চ্যালেঞ্জ তখন আমরা এই সম্মেলনে বিশেষভাবে স্মরণ করছি আমাদের সংগঠনের দুঃসাহসী পূর্বসূরিদের শুধু নয়, এই সংকটের বছরগুলিতে নিজেরা বেঁচে থাকার জন্য এবং অন্যদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য যেসব হাজার হাজার নামহীন মেয়েদের দুরন্ত লড়াইয়ের কথা রাজ্যে রাজ্যে আমাদের অভিজ্ঞতায় উঠে আসছে সেইসব অকুতোভয় নারীদেরও।
সর্বভারতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে প্রচার কর্মসূচি বিহারে।
এই সর্বভারতীয় ত্রয়োদশ সম্মেলনে আমাদের কর্মীদের কাছেই শুধু নয় দেশের সমস্ত মেয়েদের কাছে, সব গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের কাছে তাই আমাদের আহ্বান - এক হয়ে লড়ো সমতার লক্ষ্যে। আমাদের সংগঠন একটি শ্রেণিসংগঠন নয়, সেখানে নানা বর্গের, বিভিন্ন সামাজিক কোঠা থেকে আসা মেয়েদের প্রবেশাধিকার রয়েছে; তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, রুজি এবং আচার-আচরণের বহুবিধ তরিকা আছে। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য অরাজনৈতিক নয়; যে শ্রমজীবী মানুষের ওপর দুনিয়ার সব সম্পদ সৃষ্টির দায় রয়েছে এবং যারা সবচাইতে বেশি বঞ্চিত, তার অগ্রগতিতেই গণতন্ত্রের অগ্রগতি একথা আমরা বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র ছাড়া সমতা সম্ভব নয়, সমতা ছাড়া অর্থহীন নারীমুক্তি। ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, ভাষা, জাতিগোষ্ঠীর মেয়েদের মধ্যে ঐক্য আনতে পারে শুধু রুজিরুটির লড়াই তো নয়, বহুত্বের প্রতি সম্মানবোধ যার আবশ্যিক অঙ্গ সেই বৃহত্তর গণতান্ত্রিক চেতনাও। আমাদের পূর্বসূরিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় থেকেই বহুকে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রয়াস পেয়েছিলেন এই পারস্পরিক সম্মানবোধের ভিত্তিতেই। আজও ভয়ের জমানা থেকে মুক্তি পেতে সেটাই আমাদের মন্ত্র। এলড়াই শুধু মেয়েদের লড়াই নয়, সকল গণতান্ত্রিক মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই।