৬০ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৪ পৌষ, ১৪২৯
জলপাইগুড়িতে অনুষ্ঠিত হলো রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির রাজ্য বিংশতিতম সম্মেলন
সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশে বক্তব্য রাখছেন সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সভাপতি কে হেমলতা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ গত ২৪-২৬ ডিসেম্বর জলপাইগুড়ি জেলা সদরে অনুষ্ঠিত হলো রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটির রাজ্য বিংশতিতম সম্মেলন। এর আগে কলকাতা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় রাজ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলেও জলপাইগুড়ি জেলায় রাজ্য সম্মেলন এই প্রথম। তাই এই সম্মেলনকে ঘিরে জলপাইগুড়ি জেলার রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা ছাড়াও অন্যান্য অংশের মানুষের মধ্যেও আগ্রহ ছিল তুঙ্গে। গত ১৬ মে অভ্যর্থনা কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রসঙ্গত, ওইদিনই একটি দানমেলা সংগঠিত করার মধ্য দিয়ে সম্মেলন তহবিল সংগ্রহের কাজও শুরু হয়েছিল। সংগঠনের নেতৃত্ব-কর্মী-সদস্য-সদস্যা এমনকী তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও দানমেলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য এগিয়ে আসেন।
রাজ্য সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কয়েক মাসব্যাপী বহুমাত্রিক প্রচার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। এই প্রচার পরিকল্পনার কেন্দ্রে শুধুমাত্র কর্মচারীরই ছিলেন না, ছিলেন জলপাইগুড়ি জেলার খেটে খাওয়া অংশের জনজাতি মানুষও। ৮ জুলাই প্রয়াত জননেতা কমরেড জ্যোতি বসুর জন্মদিবসে এক স্বেচ্ছা রক্তদানের কর্মসূচি আয়োজনের মধ্যে দিয়ে প্রচারের কাজ শুরু হয়। তারপর ধাপে ধাপে প্রাণী স্বাস্হ্য পরীক্ষা শিবির, মা ও শিশুদের স্বাস্হ্য পরীক্ষা শিবির, জনস্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কিত প্রচার, বিভিন্ন সমসাময়িক বিষয়ের ওপর সুপরিচিত ঐতিহাসিক, অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের নিয়ে আলোচনা সভা/সেমিনার, স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অঙ্কন প্রতিযোগিতা, জলপাইগুড়ি জেলার প্রসিদ্ধ লোক সংগীত প্রতিযোগিতা, বাইক রালি, পুরুষ ও মহিলাদের পৃথক ম্যারাথন দৌড় ইত্যাদির মাধ্যমে রাজ্য সম্মেলনের বার্তা জেলার প্রত্যন্ত ব্লক পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া হয়। পাশাপাশি দেওয়াল লিখন, পোস্টারিং, সম্মেলনের লোগো সংবলিত রক্ত পতাকা ও রঙিন ফ্লেক্সে সাজানো হয় গোটা জলপাইগুড়ি শহরটিকে।
২৩ ডিসেম্বর, সম্মেলনের আগের দিন অনুষ্ঠিত বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী মিছিল গোটা জলপাইগুড়ি শহর পরিক্রমা করে। ওই মিছিলে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত প্রতিনিধিরা ছাড়াও জেলার কর্মচারীরাও বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেন। শহরের বিভিন্ন অংশে সিআইটিইউ, কৃষক সভা, ছাত্র, যুব ও মহিলাদের সংগঠন, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের কো-অর্ডিনেশন কমিটি, পেনশনার্স সমিতি এবং ১২ জুলাই কমিটির পক্ষ থেকে মিছিলকে উষ্ণ অভিবাদন জানানো হয়। স্লোগান মুখরিত মিছিল দেখতে রাস্তার দুধারে সাধারণ মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। মিছিল শেষে সম্মেলন স্থল রবীন্দ্র ভবনে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চলচিত্র পরিচালক প্রয়াত সত্যজিৎ রায়ের নামাঙ্কিত প্রগতিশীল পুস্তক বিপণির উদ্বোধন করে বক্তব্য রাখেন কর্মচারী আন্দোলনের প্রবীণ নেতা প্রবীর মুখার্জি।
রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে আজীবন বামপন্থী প্রয়াত চলচ্চিত্র পরিচালক তরুণ মজুমদারের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে জলপাইগুড়ি শহরের নামকরণ করা হয়েছিল তরুণ মজুমদার নগর। সংগঠনের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত কমরেড মলয় রায়ের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সম্মেলন স্থল রবীন্দ্র ভবনের নামকরণ করা হয়েছিল মলয় রায় মঞ্চ। প্রয়াত বিশিষ্ট অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সহ জেলার কর্মচারী আন্দোলনের প্রয়াত নেতৃবৃন্দের স্মরণে একাধিক তোরণ শহরের বিভিন্ন প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছিল।
২৪ ডিসেম্বর সকাল ন’টায় রক্তপতাকা উত্তোলন ও শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। রক্তপতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের সভাপতি আশিস ভট্টাচার্য । উদ্বোধনী অধিবেশনে স্বাগত ভাষণ দেন অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব তমোজিৎ রায়। রাজ্য সম্মেলন উদ্বোধন করেন সারা ভারত কৃষক সভার অন্যতম সহ সভাপতি হান্নান মোল্লা। তিনি তাঁর বক্তব্যে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের শ্রমিক-কৃষক নীতির বিরুদ্ধে সর্বস্তরে মেহনতি মানুষের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর জোর দেন।তিনি আরও বলেন, ঐক্যবদ্ধ ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন যা মোদি সরকারকে পিছু হঠতে বাধ্য করেছিল, তা আগামী দিনে সংগ্রাম-আন্দোলনের আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে। এছাড়াও উদ্বোধনী অধিবেশনে কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারীদের কো-অর্ডিনেশন কমিটি, কলেজ শিক্ষাকর্মী সমিতি, কেএমডিএ এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশন সহ বিভিন্ন ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতৃবন্দ সম্মেলনকে শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন।
এরপর প্রতিনিধি অধিবেশনের শুরুতে সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন পেশ করেন যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ গুপ্ত চৌধুরী। খসড়া প্রস্তাবাবলি পেশ করেন অন্যতম সহ সম্পাদক দেবব্রত রায় এবং সমর্থন করেন অপর সহ সম্পাদক অনুপ বিশ্বাস।স্বাধীনতার ৭৫ বছর এবং তেভাগা আন্দোলন, নৌবিদ্রোহ, ডাক ও তার ধর্মঘটের ৭৫ বছর উপলক্ষে ৪ টি বিশেষ প্রস্তাব সহ মোট ২৮ টি প্রস্তাব সম্মেলনে উত্থাপিত হয়। তিন বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন কোষাধ্যক্ষ লিটন পান্ডে।সংগঠনের নিয়মাবলির সংশোধন ও সংযোজন সংক্রান্ত প্রস্তাব পেশ করেন যুগ্ম সম্পাদক বিশ্বজিৎ গুপ্ত চৌধুরী এবং সমর্থন করেন দপ্তর সম্পাদক অভিজিৎ বোস।
সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ওপর দু’দিনব্যাপী আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত সমিতি, জেলা ও অঞ্চল কমিটিগুলির পক্ষ থেকে ৪জন মহিলা সহ মোট ৫৭ জন প্রতিনিধি অংশ নেন। ২৫ ডিসেম্বর সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে বক্তব্য রাখেন সম্মেলনের বিশেষ অতিথি সারা ভারত রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি সুভাষ লাম্বা। তিনি তাঁর বক্তব্যে বিভিন্ন প্রদেশের কর্মচারী আন্দোলনের একটি চিত্র তুলে ধরেন।এদিন সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে বক্তব্য রাখেন ১২ জুলাই কমিটির অন্যতম আহ্বায়ক মনোজ সাউ। সাধারণ সম্পাদক বিজয় শঙ্কর সিংহ উত্থাপিত চুক্তি ভিত্তিক কর্মচারীদের সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত একটি বিশেষ প্রস্তাব উপস্থিত ৭০০-র অধিক প্রতিনিধি বিপুল করতালির মাধ্যমে গ্রহণ করেন।
তৃতীয় তথা শেষ দিনে সম্মেলন মঞ্চে বক্তব্য রাখেন প্রধান অতিথি সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সভাপতি কে হেমলতা। তিনি সংগঠনের মুখপত্র সংগ্রামী হাতিয়ার পত্রিকার বিশেষ সংখ্যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। কে হেমলতা তাঁর বক্তব্যে শ্রমিক শ্রেণি তথা শ্রমজীবী মানুষের ওপর নয়া উদারবাদী অর্থনীতির বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব ব্যাখ্যা করেন। খসড়া প্রস্তাবাবলি ও আয়-ব্যয়ের হিসাবের ওপর প্রতিনিধিদের বক্তব্যের পর জবাবি ভাষণ দেন যথাক্রমে দেবব্রত রায় ও লিটন পান্ডে।
প্রতিনিধিরা তাদের আলোচনায় ক্ষোভের সঙ্গে কর্মচারীদের দাবিদাওয়ার প্রতি রাজ্যের বর্তমান সরকারের চূড়ান্ত অনীহা এবং স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় প্রশাসন পরিচালনার প্রসঙ্গগুলি তুলে ধরেন। দু’ঘণ্টার কর্মবিরতি ও বিধান সভা অভিযানের মতো সাম্প্রতিক আন্দোলনের কর্মসূচিগুলির সাফল্যকে সংহত করে আগামী দিনে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের চাহিদাও তাদের বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছিল। সমস্ত আলোচনা গুটিয়ে জবাবি ভাষণ দেন বিজয় শঙ্কর সিংহ। প্রসঙ্গত, গত নভেম্বর বিধানসভা অভিযান চলাকালীন ৪৭ জন কর্মী-নেতৃত্বকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ২৪ নভেম্বর তাঁরা আদালত থেকে শর্ত সাপেক্ষ জামিন পান। আগামী ১১ জানুয়ারি, ২০২৩ পরবর্তী শুনানির দিনে ওই ৪৭ জনের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানিয়ে ১০ জানুয়ারি সারা রাজ্যে বিক্ষোভের কর্মসূচির সিদ্ধান্ত সম্মেলন মঞ্চ থেকে গৃহীত হয়।
সম্মেলনে উত্থাপিত সমস্ত দলিল সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। প্রতিনিধিদের সামাজিক সাংগঠনিক পরিচিতি সংক্রান্ত তথ্য পেশ করেন ক্রেডেন্সিয়াল কমিটির আহ্বায়ক সুমন কান্তি নাগ। অভ্যর্থনা কমিটির সম্পাদক মনোজিৎ দাসও বক্তব্য রাখেন। সভাপতি আশিস ভট্টাচার্য এবং সহ সভাপতিদ্বয় গীতা দে ও মানস দাসকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী তিনদিনব্যাপী সম্মেলনের কাজ পরিচালনা করেন।
রাজ্য সম্মেলন থেকে ১০৩ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি সহ পদাধিকারীরা নির্বাচিত হন। নির্বাচিত পদাধিকারীরা হলেন - সভাপতি মানস দাস, সহ সভাপতিত্রয় প্রশান্ত সাহা, রবীন্দ্রনাথ সিংহরায় ও নিবেদিত দাসগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ গুপ্ত চৌধুরী, যুগ্ম সম্পাদক দেবব্রত রায়, সহ সম্পাদকদ্বয় প্রণব কর ও শাশ্বতী মজুমদার, দপ্তর সম্পাদক প্রশান্ত চন্দ, কোষাধ্যক্ষ লিটন পান্ডে। সম্মেলন মঞ্চেই নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভা থেকেই পদাধিকার সহ ২৮ জনের কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলী গঠন করা হয়। সংগঠনের মুখপত্র ‘সংগ্রামী হাতিয়ার’-এর সম্পাদক এবং সহযোগী সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন যথাক্রমে মানস কুমার বড়ুয়া ও সুমন কান্তি নাগ। আন্তর্জাতিক সংগীতের মধ্য দিয়ে প্রতিনিধি অধিবেশনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
ওইদিনই রবীন্দ্র ভবন সংলগ্ন প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ। সভাপতিত্ব করেন মানস দাস। প্রারম্ভিক বক্তব্য রাখেন বিশ্বজিৎ গুপ্ত চৌধুরী। প্রধান বক্তা ছিলেন কে হেমলতা। তিনি আগামী ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য শ্রমিক-কৃষক-খেত মজুরদের যৌথ সংসদ অভিযানের দাবিগুলিকে ব্যাখ্যা করেন। এই সমাবেশে প্রতিনিধি ও ওই জেলার কর্মচারীরা ছাড়াও চাবাগানের শ্রমিকরাও বিপুল সংখ্যায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে জলপাইগুড়ি জেলার ঘটনাপ্রবাহ এবং সত্যজিৎ রায় পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলির ওপর নির্মিত দুটি প্রদর্শনী ছিল সম্মেলন স্থলের দুটি বিশেষ আকর্ষণ। প্রগতিশীল পুস্তক বিপণি থেকে মোট ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার পুস্তক প্রতিনিধিরা ক্রয় করেছেন। ৪০০-র বেশি স্বেচ্ছাসেবক-স্বেচ্ছাসেবিকা ছাড়াও কর্মচারী পরিবারের সদস্য-সদস্যারাও প্রতিনিধিদের অভ্যর্থনা ও আপ্যায়নে অংশ নেন।