৬০ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৪ পৌষ, ১৪২৯
এনআরএলএম - জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশনঃ এ রাজ্যে কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা
ঈশিতা মুখার্জি
২০১১ সালে জাতীয় স্তরে চালু হলো গ্রামীণ জীবিকা মিশন। উদ্দেশ্য ছিল গ্রামে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি যাতে সরকারি সহায়তায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। বলা বাহুল্য, এই স্বনির্ভরগোষ্ঠীগুলির বেশির ভাগটাই মহিলা পরিচালিত। ২০০১ সাল থেকেই জাতীয় স্তরে মহিলাদের স্বনির্ভরগোষ্ঠীর গুরুত্ব বোঝা যাচ্ছিল। নয়া উদারীকরণের নীতির ফলে যে বেকারি বাড়বে তার আশঙ্কায় ছিল নানা দেশ। বেজিং ১৯৯৫-এর পর মহিলাদের ক্ষমতায়নের কথাও চলে এলো সব নীতিতে। এই ক্ষমতায়নের এক অস্ত্র ছিল স্বনির্ভর গোষ্ঠী। সেই নীতি পরিবর্তন হতে হতে বর্তমানে এই নীতিতে দাঁড়িয়েছে। জীবিকা যখন অনিশ্চিত তখন সরকারকে সেই জীবিকার ব্যবস্থা করতে হয়, এই কথা আমাদের দেশে একসময় সহজ ছিল। কিন্তু নয়া উদারীকরণের ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা আমাদের বুঝিয়ে দিল যে, বেকারি থাকবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এই প্রকল্পগুলিকে উদারীকরণের মানবিক মুখ বলে চালু করা হয়েছিল। একই সাথে মহিলাদের প্রশ্নটি জুড়ে গিয়েছিল। এ হলো এই প্রকল্প চালুর ইতিহাস। বর্তমানে বিজেপি শাসনে সব কিছুতেই নতুন নাম দেওয়া হয়েছে। তাই এর নাম আজীবিকা। এই প্রকল্প দেশের সব গ্রামীণ এলাকায় চালু নেই। বর্তমানে দেশে গ্রামীণ ৬৮৮৯টি ব্লকে এই প্রকল্প চালু আছে, ৮৭৪ লক্ষ পরিবার এর ফলে উপকৃত বলে সরকার জানাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্প ২৩টি জেলায় ৩৪৫টি ব্লকে, ৩৩৪৯টি গ্রাম পঞ্চায়েতে, ৪৮৬৬৭টি গ্রামে চালু আছে। পশিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও সব প্রকল্পের নাম বদলান। তিনি এই প্রকল্পের নাম দিয়েছেন আনন্দধারা। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের তথ্য জানাচ্ছে যে, ১০৮ লক্ষ পরিবারকে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠনের কাজে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেছে। মোট যে পরিমাণ টাকা সরকারি সহায়তা পেয়েছে এই গোষ্ঠীগুলি তার পরিমাণ ৮৯৭৭৩.৩০ লক্ষ। কৃষিকাজকেও এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এই প্রকল্পে মোট মহিলা কিষানের সংখ্যা ১০৬৫৪৭। কিন্তু এখনও পর্যন্ত উদ্যোগীর কোনো সংখ্যা পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এই প্রকল্প থেকে এখনও কোনো উদ্যোগীর খোঁজ অন্তত সরকারি খাতায় নেই। ওদিকে প্রতি বাজেটেই মোদি সরকার এই প্রকল্পে বরাদ্দ অর্থ কমিয়ে দেয়। রাজ্যে সব প্রকল্প মিলে মিশে চলে, ফলে রাজ্যে গ্রামীণ পরিবারগুলি কোন প্রকল্প থেকে কতটা উপকৃত, কোন প্রকল্পের আওতায় আদৌ তারা আছে, মাঝে মাঝে তা বোঝা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এ বিষয়ে পরিচ্ছন্ন পরিসংখ্যান প্রকাশও করে না। ২০১০-১১ সালে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি যে অবস্থায় ছিল, এ রাজ্যে দেখা যাক ২০১১ সালের পর কী অবস্থা হয়েছে তাদের এই প্রকল্পের আওতায়। ২০১০-১১ সালে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ভিত্তি খুব শক্ত ছিল। কিন্তু পর পর বছরগুলিতে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির ব্যাঙ্কের আমানত বাড়েনি। প্রতি গোষ্ঠী পিছু গড় টাকা ব্যাঙ্কের কমে গেছে এমনই রিপোর্ট জানাচ্ছে। সেই তুলনায় ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলির উপর স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলির নির্ভরতা বেড়েছে, তাদের দাপট ও অত্যাচারও বেড়েছে, কারণ সরকারি সহায়তা, ব্যাঙ্ক সহায়তা কমেছে এবং অর্থের প্রয়োজন বাড়ছে। স্বনির্ভর গোষ্ঠী খাতায় কলমে থাকলেও গোষ্ঠী ভেঙে গেছে। ব্যাক্তিগতভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ছে গ্রামীণ মানুষ। সরকারি পরিসংখ্যানে এই তথ্য ধরা পড়বে না। এক সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে অন্য সংস্থাকে ঋণ ফেরত দিচ্ছে। এইভাবে মুনাফা বাড়ছে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার। অর্থকষ্টে ধুঁকছে গ্রামীণ মানুষ।
পশ্চিমবঙ্গে এই প্রকল্প বেসরকারি লগ্নির দিকে মোড় নিয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। ২০১৭ সালের একটি রিপোর্টে প্রকাশ হয় যে, আনন্দধারা ফিউচার গ্রুপের সাথে যোগ দিয়ে বিগ বাজারের সাথে সংযোগ স্থাপনে গেছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যোগীদের উৎপাদিত পণ্য বিগ বাজারে চড়া দামে বিক্রি হয়েছে; কিন্তু শিল্পদ্যোগীরা ক্রমেই ঋণগ্রস্ত হয়ে গেছে, এও সম্ভব হয়েছে রাজ্য সরকারি সহায়তায়। ২০১৭ সালের রিপোর্ট পিটিআই সূত্রে জানা যায়।
তথ্য সেভাবে না পাওয়া গেলেও পুরুলিয়া, হুগলি, বীরভূম সহ কিছু কিছু জেলায় বিভিন্ন গবেষকেরা সামাজিক সমীক্ষা করেছেন। সেই সমীক্ষার ফলাফল তারা বিশ্লেষণ করে বলছেন যে, এই প্রকল্পের সার্থকতা থাকা উচিত ছিল, এটি মহিলাদের সহ গ্রামীণ পরিবারগুলির ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এই প্রকল্পের যে ব্যাপ্তি সরকারি রিপোর্টে, মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় থাকে, গ্রামীণ পরিবারের ভোগব্যয়টা সেই পরিমাণে বাড়ছে না। এ ছাড়া এই প্রকল্পের সাফল্য যা সরকার জানাচ্ছে তা থাকলে গ্রামীণ পরিবারগুলি কেন ক্ষুদ্র সংস্থার ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ছে। প্রশ্ন আরও আছে। তারা বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে উঠে আসা তথ্যে জানাচ্ছেন যে, কেন সরকারি রেকর্ডেও সফল উদ্যোগীর সংখ্যা সেভাবে নেই। কিন্তু আমরা দেখেছি তথ্য আছে শুধু মুখ্যমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায়। সমীক্ষায় আরও প্রকাশ পেয়েছে যে, আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে এই প্রকল্প রূপায়ণে বৈষম্য রয়েছে। বিশেষ করে জঙ্গলমহলের জন্য এ কথা প্রযোজ্য। একশো দিনের কাজ বা রেশন ব্যবস্থার প্রাপ্তি গ্রামে অনিশ্চিত। সেই তুলনায় আনন্দধারা বা আজীবিকা এবং আবাস যোজনা যেহেতু সরাসরি পরিবার চিহ্নিত করে সংগঠিত হয়, তাই গ্রামীণ মানুষের চাহিদার নিরিখে এই প্রকল্প দুটির উপর গ্রামীণ পরিবারগুলির খুব ভরসা। আবাস যোজনার দুর্নীতির কথা প্রকাশ্যে চলে এসেছে। আজীবিকা বা আনন্দধারা নিয়ে এই দুর্নীতি প্রকাশিত সেভাবে নয় কারণ, বেসরকারি মুনাফার ব্যবস্থা করে দিয়েছে এই প্রকল্প। সরকারি প্রকল্প হলেও বেসরকারি ক্ষেত্রের সাথে হাত মেলানো; ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার পথ খুলে দেওয়া - এ সব কিছুই এই প্রকল্পের জন্য সম্ভব হয়েছে। বহুদিন ধরে সারা দেশে দাপট দেখালেও পশ্চিমবঙ্গে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার দাপট বেড়েছে আনন্দধারার হাত ধরে বলা চলে। কেরালার কুদুম্বশ্রী প্রকল্প মহিলাদের সরকারি স্বনির্ভরগোষ্ঠীর প্রকল্প । সেই প্রকল্প সারা দেশে সহ বিশ্বে সফল প্রকল্প বলে স্থান করে নিয়েছে। এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের হাত ধরে স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি তৈরি হয়েছিল। সেই গোষ্ঠী সংখ্যাও সেভাবে বাড়েনি দেখা যায়। এই প্রকল্পে যে টাকা গোষ্ঠীগুলিতে ঘুরে চলে, সেই টাকাও সে পরিমাণে বাড়েনি এত বছরেও। ওদিকে রেকর্ড বেকারিতে আক্রান্ত দেশ, গ্রামীণ ভারতের আর্থিক বিপর্যয়ের ব্যাপ্তি আমরা জানি। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামীণ মানুষ এর বাইরে নয়; তাহলে খাতায় কলমেও এই প্রকল্পের সেভাবে ব্যাপ্তি কেন করা গেল না। নানা সাময়িক প্রকল্পের চাপে পড়ে এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পতে কি এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর মন নেই? বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার সবসময় মানুষের আপতকালীন নির্বাচনের আগে কয়েকদিনের প্রকল্প, স্বল্পমেয়াদি প্রকল্পে জোর দিয়েছে, কারণ এর ফল সরাসরি তারা ভোটবাক্সে দেখতে চেয়েছে। প্রকল্পের নাম বদলে বদলে গেছে, প্রকল্পের আওতার পরিবারগুলি বদলে বদলে গেছে, কিন্তু কোনো দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল আসেনি কারণ দীর্ঘমেয়াদি কোনো ফল এই সরকারগুলি চায় না। তাই গ্রামীণ মানুষের আদৌ দারিদ্র্য মোচন হলো কিনা - এ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। কত গ্রামীণ পরিবার এই প্রকল্পের আওতায় পড়ে দারিদ্র্য সীমার উপরে উঠতে পারল, এই তথ্য কোনো পরিসংখ্যানে নেই। এই প্রকল্পের আওতায় পরিবারের শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগছে কিনা, এই তথ্য সংগ্রহ করা হয় না। এই প্রকল্পের আওতায় পরিবারগুলিতে ক্ষুধা আছে কি না, এ সম্পর্কে কিছু জানা যায় না। এই প্রকল্প সম্পর্কে যা জানা যায় তা হলো ঋণগ্রহীতারা টাকা ফেরত দিচ্ছে কি না ; কীভাবে তারা টাকা ফেরত দিচ্ছে ব্যাঙ্কে সেই খোঁজ কেউ রাখে না। তাই ক্ষুদ্র ঋণসংস্থার খোঁজ নেই সরকারি খাতায়।
বিকল্প ছিল পশ্চিমবঙ্গের ২০১১ সালের আগে সমবায় ব্যাঙ্কের মাধ্যমে ঋণদান এবং কেরালার কুদুম্বশ্রী প্রকল্প। ২০০০ সাল থেকেই বেসরকারি ঋণদান সংস্থাগুলি এই বাজারে ঢোকার চেষ্টা করছিল। এ দুই রাজ্যে তারা এই দুই প্রকল্পের জন্য বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালের পর এ রাজ্যে সেই বাধা আর রইল না। কেন্দ্রের সরকার প্রতি বাজেটেই এই প্রকল্পে ব্যয় সঙ্কোচন করে যাচ্ছে। আগামী বাজেটেও সেই একই আশঙ্কা আছে। একই আশঙ্কা আছে রাজ্য বাজেট ঘিরেও। ইতিমধ্যেই এই প্রকল্পের শ্রমজীবী মানুষজন অন্যান্য প্রকল্পের শ্রমজীবী মানুষের সাথে তাঁদের দাবির সমর্থনে দেশজোড়া প্রতিরোধ আন্দোলনে শামিল হতে শুরু করেছে।
পঞ্চায়েত দপ্তরের আওতায় এই প্রকল্প রূপায়িত হয়। রাজ্যের সব গ্রামীণ এলাকায় না হলেও কোথায় কোথায় এই প্রকল্প আছে, ক'টি ক্লাস্টার আছে, তার কিছু খবর সরকারি ওয়েবসাইটে মেলে। তা কতটা সঠিকভাবে রূপায়িত হচ্ছে তার নজরদারি প্রয়োজন। এ শুধু প্রকল্পের শ্রমজীবীদেরই দাবি নয়, গ্রামীণ মানুষের বেঁচে থাকা নিয়ে যারা ভাবনা চিন্তা করেন, সকলকেই এই নজরদারি চালানো প্রয়োজন। ব্লক আধিকারিকের কাছে তথ্য থাকে, সেই তথ্য বাইরে আসে না। প্রকাশ্যে সব তথ্য আনতে হবে, এই দাবি সজোরে তোলার প্রয়োজন আছে। সঠিক তথ্য প্রকাশিত হোক - এই দাবি বিজেপি সরকারের কাছেও তোলার আছে; এই দাবি রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের কাছে তোলার দাবি আছে। রাজ্যের মানুষকেও এই দাবির সমর্থনে আজ এগিয়ে আসতে হবে।