৬০ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৪ পৌষ, ১৪২৯
ভারতের ধারণা
আবুবকর সেখ
আমাদের দেশ এই ভারতের ধারণা দীর্ঘদিন ধরেই বিকশিত হয়েছে। কীভাবে ভারতের ধারণা বিকশিত হয়েছে এবং কীভাবে ভারত জাতিরাষ্ট্রের চেহারা নিয়েছে এবং এই জাতিরাষ্ট্র আজ কোন বিপদের সামনে তা অবশ্যই আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
আমরা আমাদের দেশের ইতিহাসের খুব খারাপ সময়ে আছি। কেননা যুক্তিবাদী যারা বিজ্ঞানমনস্কতায় বিশ্বাস করেন যেমন - দাভোলকর, পানসারে, কালবুর্গি - তাঁদের হত্যা করা হয়েছে। গো রক্ষার নামে মহম্মদ আখলাককে হত্যা করা হয়েছে। ‘তেরা নাম মহম্মদ’ - শুধু মুসলিম নাম হওয়ার অপরাধে এক প্রবীণকে হত্যা করা হলো ভোপালে।প্রাচীন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে রাম মন্দির তৈরি করা হচ্ছে। শুভ্র সমুজ্জ্বল তাজমহল সম্পর্কে বিকৃত প্রচার চালানো হচ্ছে। জ্ঞানবাপী মসজিদের ফোয়ারা নিয়ে বিভ্রান্তিকর প্রচার চলছে। উত্তরপ্রদেশ, গুজরাটের পর জাহাঙ্গিরপুরীতে সংখ্যালঘু মুসলিমদের দোকান, বাড়ি এমনকী মসজিদের দরজাও ভেঙে দেওয়া হয়েছে। সিএএ-এনআরসি’র জুজু তো আছেই। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরে শিক্ষায়তনে যাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পৌরাণিক কাহিনি পড়ানো হচ্ছে। প্রগতিশীল বিজ্ঞান ভাবনা থেকে পড়ুয়াদের পশ্চাদমুখী করে তোলা হচ্ছে যা দেশের সামনে এক গভীর বিপদ হিসেবে দেখা দিচ্ছে। এই ধরনের অসংখ্য সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ত ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের সুনাম মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
বিজেপি এবং তার অভিভাবক আরএসএস বলতে ভালোবাসে যে, ভারত জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে ঋগ্বেদের সময় থেকে। কিন্তু বাস্তবে না ঋগ্বেদ, না অপর তিন বেদ বা তার পরের ব্রাহ্মণ এমনকী উপনিষদের সময়েও ভারত শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় না।
আমাদের দেশের নাম প্রথম পাওয়া যায় প্রাকৃত ষোল মহা-জনপদে। মহা-জনপদ বলতে বোঝাত কম্বোজ বা কাবুল থেকে পূর্ব বিহারের অঙ্গ পর্যন্ত। তবে পুরোটাই সীমাবদ্ধ ছিল উত্তর ভারতে, তখনও ভারত বলতে আজ যা বুঝি তা হয়নি।
দেশ হিসেবে ভারতের ধারণাটি প্রথম প্রকাশ পায় মৌর্য সম্রাট অশোকের সময়। অশোকের শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে কান্দাহার এবং কাবুলের উত্তর অংশ থেকে কর্নাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে এবং সেগুলো ছিল প্রাকৃত ও গ্রিক ভাষায় লেখা। এই রাজনৈতিক ধারণা থেকেই ভারতের উৎপত্তি। প্রথমে নাম ছিল জম্বুদ্বীপ যা অশোক তাঁর শিলালিপিতে ব্যবহার করেছিলেন জাম ফলের দেশ অর্থে। ভারত শব্দের উল্লেখ মেলে ওডিশায় প্রাকৃত লেখা একটি শিলালিপি থেকে, হাথিগুম্ফায়। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে কলিঙ্গ রাজা খরাবেলা এই শিলালিপি তৈরি করেছিলেন।
ভারতীয় এবং পারসিকদের মধ্যে পাঞ্জাব থেকে দক্ষিণে কথা বলার মাধ্যম হিসেবে প্রাকৃত ব্যবহার হতো, আর সংস্কৃত ছিল পুরোহিতের ভাষা। যারফলে ইরানিরা আমাদের ‘হিন্দু’ নাম দেয়।আর হিন্দু শব্দটি হলো সিন্ধু নদের পারসি রূপ। তাই, সিন্ধুর পূর্বে সমস্ত অঞ্চল হিন্দু এবং তা থেকেই ইন্ডিয়া’র উৎপত্তি।
গ্ৰিকরা যখন আমাদের দেশে আগমন করে তখন তারা এই ‘হিন্দু’কে বলত ‘ইন্দু’। তারা ‘হ’ উচ্চারণ করতে পারত না। আবার চীনের মানুষদের কাছে ইন্ডিয়ার ‘ইনতু’ নামের উৎস একই। এরপর পারসি নাম ‘হিন্দুস্তান’ এসেছে। সংস্কৃতে হিন্দুস্তান বলে কোনো শব্দ নেই। সংস্কৃতে স্থান মানে কোনো একটি নির্দিষ্ট কেন্দ্র। পারসিতে ‘স্তান’ জুড়ে দেওয়া হয় কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চল বোঝাতে। সেই কারণেই কাজাকিস্তান, সিয়েস্তান, গুরজিস্তান, হিন্দুস্তান এবং আরও এমন শব্দ এসেছে। এই হিন্দু শব্দটি এবং এমন বিভিন্ন শব্দ এসেছে ভারতের বাইরে থেকে। আমাদের দেশে আজ যারা হিন্দুত্বের কথা বলে সংখ্যালঘু মুসলমানদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলছেন এবং যা কিছু বিদেশি তা বর্জনের কথা বলছেন তারা ভুলে যান যে, হিন্দু শব্দটির উৎসের বিচারে ইরানি।
বিশ্ববন্দিত ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের মতে, ‘‘চতুর্দশ শতকের আগে সংস্কৃতে ‘হিন্দু’ শব্দটি পাওয়া যায় না। সংস্কৃতে প্রথম ব্যবহার পাওয়া যায় বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শিলালিপিতে যেখানে বিজয়নগরের সম্রাটরা নিজেদের ‘হিন্দু রায়া সুরতরন’ বা ‘হিন্দু রাজাদের সুলতান’ বলেছেন। তাই, আমাদের দেশ এবং নাম বৈচিত্র্যের বৈশিষ্ট্যের ইঙ্গিত দেয়, যা ইরানি থেকে আসা হিন্দু নামটিতেই ভালোভাবে বোঝা যায়। অনেক পরে চতুর্দশ শতকে যা সংস্কৃতে জায়গা পায়।’’
আজ একথা প্রমাণিত, দেশ হিসেবে ভারতের ধারণাটি প্রাচীন। কিন্তু প্রাচীন ভারতে কখনো সংস্কৃতে কোনো শ্লোক রচিত হয়নি যেখানে ভারতের জন্য দেশপ্রেমের অভিব্যক্তি রয়েছে।
১৩১৮ তে ইরানি কবি আমির খসরুর দীর্ঘ পদ্য ‘নুহ সিপিহির’- এ দেশপ্রেমের স্তুতি ও ভারতীয়দের প্রশংসা রয়েছে।
দেশপ্রেম আরও তীব্রতর হয় মুঘল শাসনকালে, বিশেষকরে সম্রাট আকবর ও আবুল ফজলের মাধ্যমে। তাঁরা বলেন, ভারত একটি বিশেষ দেশ, ভারতে বহু ধর্মীয় সম্প্রদায় রয়েছে। তাই সহিষ্ণুতা অবশ্যই থাকা উচিত। একত্রিত ‘সুলহ-ই-কুল’ বলতেন যার অর্থ ‘নিবিড় শান্তি’। আবার সম্রাট জাহাঙ্গীর বলেছেন, তুরানে কেবল সুন্নিদের এবং ইরানে কেবল শিয়াদের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো হয়। কিন্তু ভারতে সব ধর্মের প্রতি সহিষ্ণুতা দেখানো হয়। তাই মুঘলদের অভিজ্ঞতা এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নতুন এই উপাদান সংযোজিত হয়েছে।
বর্তমানে দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি মুসলমান শাসকদের উপর দোষারোপ করে অমুসলিমদের উপর আক্রমণকারী হিসেবে। ১৫২৬ সালে পানিপথের প্রথম যুদ্ধে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর পরাজিত করেন ইব্রাহিম লোদিকে। এক্ষেত্রে উভয়েই মুসলিম শাসক ছিলেন। সামন্ততন্ত্রে রাজত্ব প্রসারে ধর্ম কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা উপকথা দিয়ে ইতিহাস মুছতে চায়। দর্শনের জায়গায় ধর্মতত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই আরএসএস ইতিহাস বিকৃত করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ও মেরুকরণ শক্তিশালী করে তুলছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সম্বন্ধে আধুনিক রচনা ও প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীতে এবং তখন থেকে বিংশ শতাব্দী পর্যন্ত মতবাদের দিক দিয়ে তিনটি ধারা লক্ষ করা যায় - প্রাচ্যবাদী, হিতবাদী ও জাতীয়তাবাদী। এই হিতবাদীরা হলেন উনিশ শতকের বিশেষ প্রভাবশালী ব্রিটিশ দার্শনিক। ‘সাম্প্রদায়িকতা ও প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনা’ প্রবন্ধে ইতিহাসবিদ রোমিলা থাপার বলেন, ‘‘হিতবাদীদের মধ্যে জেমস্ মিল ভারতীয় ঐতিহাসিক চিন্তাধারার ওপরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁর ‘ব্রিটিশ-ভারতের ইতিহাস’-এর সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক বোধহয় তা এক হিসেবে ভারতীয় ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যার সূচনা করেছিল এবং পরে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ঐতিহাসিক সমর্থন জুগিয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ভারতীয় ইতিহাসকে তিনটি পর্বে ভাগ করার রীতি প্রচলন করেন। এই তিনটি অধ্যায় হলো হিন্দু সভ্যতা, মুসলমান সভ্যতা এবং ব্রিটিশ সভ্যতা (বিচিত্র হলো, খ্রিস্টান সভ্যতা নয়)।’’ (পৃষ্ঠা-১৪)।
জেমস্ মিল দেশের ইতিহাস চর্চা সঠিকভাবে না করায় বিপত্তি বেড়েছে। ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে উৎপাদন সম্পর্ক কি তার সঠিক মূল্যায়ন করতে না পারলে বিভ্রান্তি থেকে যায়।
‘মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি’ নিবন্ধে হরবংশ মুখিয়া বলেন, ‘‘মধ্যযুগীয় ভারতের ইতিহাস যাকে বলা হয় তা প্রকৃত ইতিহাসের অংশমাত্র, এবং যে দিকটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয়, আসলে তার গুরুত্ব খুবই কম। সমাজবিবর্তনের ক্রমবিকাশ আর উৎপাদন পদ্ধতির অদলবদল, এবং তার ফলে সমাজের গড়নের পরিবর্তন - এই সবই হলো প্রকৃত ইতিহাসচর্চার উপজীব্য। এইভাবে রচিত ইতিহাসই হতে পারে অতীতসমাজের সামগ্ৰিক ইতিহাস, এখানে শাসকের ব্যক্তিগত ধর্ম কী ছিল সেটা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। প্রকৃতপক্ষে যে ধরনের রাজনৈতিক ইতিহাস আমরা পড়ে এসেছি তাও শাসকশ্রেণির বংশবিবরণী ছাড়া কিছুই নয়।’’ (পৃষ্ঠা-৩৭)
কোনো কোনো ইতিহাসবিদ হিন্দুধর্মের শাসকরা অহিংসার নীতিতে চলতেন বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু অহিংসার তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক তাৎপর্যের মধ্যে তফাৎ করা দরকার। কার্যত হিংসা নীতি কতটা পরিহার করা হতো, সে-বিষয়ে অল্পই প্রমাণ আছে। আক্রমণ প্রায়ই হিংসাত্মক রূপ নিতো। ভারতীয় ঐতিহ্যের বড়ো বড়ো ঘটনাই হিংসার সঙ্গে জড়িত। মহাভারতের যুদ্ধ ও ভগবদ্গীতা তার উদাহরণ। অথচ বেশিরভাগ প্রচলিত ইতিহাসের বইতে গজনীর মামুদ মন্দির ও প্রতিমা ধ্বংকারীরূপেই চিত্রিত হয়েছেন। কারণ তিনি মুসলমান ছিলেন।
আবার হিন্দু রাজাদের মধ্যেও কেউ কেউ মন্দির ও প্রতিমা ধ্বংস করেছিলেন কীনা এই প্রশ্নটি উঠলেই অবশ্য অন্য ধরনের যৌক্তিকতা খোঁজা হয়। এবিষয়ে রোমিলা থাপার বলেন, ‘‘একাদশ শতকে কাশ্মীরে হর্ষ নামক একজন রাজার কথা জানা যায়, অত্যন্ত সংগঠিতভাবে মন্দির ধ্বংসের কাজে লেগেছিলেন। কলহনের রাজতরঙ্গিণী থেকে জানা যায় যে, হর্ষ ‘দেবোৎপাটননায়ক’ (আক্ষরিক অর্থে, যিনি দেবতাদের উৎপাটিত করার কাজে নিযুক্ত হয়েছেন) নামে বিশেষ একজন কর্মচারীকে নিযুক্ত করেছিলেন যার প্রধান কাজ ছিল মন্দির লুঠ করা।’’ (পৃষ্ঠা-২৭)
আমাদের দেশে হিন্দুত্বের ও সাম্প্রদায়িকতার রাজনৈতিক কর্মসূচির কথা ভেবেছিলেন সাভারকর। মুঞ্জে তা আরও স্পষ্ট করেছিলেন এবং হেগড়েওয়ার পরিশেষে ১৯২৫ সালে আরএসএস প্রতিষ্ঠা করে রূপায়ণের পথে অগ্রসর হন। মুঞ্জে ইতালিতে মুসোলিনির ফ্যাসিস্ত ব্রিগেড থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন। পরে তিনি পুনেতে ভোনসালা মিলিটারি একাডেমি শুরু করেন।
স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস’র ভূমিকা প্রসঙ্গে ইরফান হাবিব বলেন, ‘‘হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস’র সমস্যাও এক। আরএসএস ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কী করেছিল তারা? কেন স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে জেলে যায়নি? এতোই যদি বিরাট দেশপ্রেমিক তাহলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোনো লড়াই করলেন না কেন? একই ঘটনা হিন্দু মহাসভার ক্ষেত্রেও। সাভারকর আন্দামানে গিয়ে নিজের দেশপ্রেমিক অতীতকে পুরো মুছে ফেলে ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন, বললেন ব্রিটিশ সরকারের বিরোধিতা করবেন না। তিনি শুধু মুসলিমদের বিরোধিতা করেছেন এবং মহম্মদ আলি জিন্নারও আগে দ্বিজাতি তত্ত্বের সওয়াল করেছেন।’’ (পৃষ্ঠা-১৮)
এখন আরএসএস ভগৎ সিংয়ের কথা বলে। ভগৎ সিংয়ের সঙ্গে আরএসএস’র কোনো সম্পর্ক ছিল না। ভগৎ সিং লিখেছিলেন, ‘কেন আমি নাস্তিক’। তিনি বলেছিলেন জাতীয় আন্দোলনের বিরোধীদের মধ্যেই সবচেয়ে বিপজ্জনক ছিল হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা। আবার বল্লভভাই প্যাটেলও মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ অনুগামী ছিলেন।
সঙ্ঘ আবার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর কথাও বলেন। সুভাষচন্দ্র কখনও হিন্দু রাষ্ট্রের কথা বলেনি। আজাদ হিন্দ ফৌজের জাতীয় সঙ্গীত ছিল ইকবালের ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা’। আজাদ হিন্দ ফৌজের সরকারি ভাষা ছিল উর্দু ও হিন্দি। সুভাষচন্দ্র বলতেন ‘জয় হিন্দ’। সঙ্ঘ ‘জয় হিন্দ’ ও ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলে না। মৌলানা হাসরত মোহানী’র ইনকিলাব জিন্দাবাদ জাতীয় আন্দোলনে দেশের মাটিতে ভগৎ সিং জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
সম্প্রতি রামনবমী ও হনুমানজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা মুসলমানদের ভীতসন্ত্রস্ত করে রাখার জন্য দেশময় আস্ফালন দেখিয়েছে যা মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। এটা একটা বড়ো বিপদের দিক।
জার্মানিতে নাৎসিরা যেভাবে জাতিগত বিদ্বেষ ও হিংসা ছড়িয়েছিল, আরএসএস-ও সেই পথের পথিক। সঙ্ঘের গুরু গোলওয়ালকর ইহুদি-বিরোধী নীতির জন্য হিটলারের প্রশংসা করে বলেছিলেন, ভারতেও মুসলিমদের বিরুদ্ধে এই পথ নেওয়া উচিত। মুসলিম-বিরোধী জিগির জারি রেখেই এখনও তারা এগোবে। হিন্দুত্বের ধারণার কোনো বিরোধিতাই তারা সহ্য করবে না। ইতিহাসকে বিকৃত করতে তারা উঠেপড়ে লেগেছে। এমনকী সাধারণ ইতিহাস বইয়েও যদি লেখা থাকে ঋগ্বেদ ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে লেখা হয়েছিল তাতেও ওই বই রোষের শিকার হচ্ছে। কেননা আরএসএস বেদকে ৮০০০ বছর আগে নিয়ে যেতে চাইছে।
বর্তমানে সঙ্ঘ যেকোনো বিরোধিতা সহ্য করতে রাজি নয় (যদিও সরকার বিরোধিতা ও রাষ্ট্রের বিরোধিতা এক জিনিস নয়)। ব্রিটিশ ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ আইন দেশের জনগণের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করত। এই আইন ১৩২ বছরের পুরনো। সম্প্রতি সুপ্রিমকোর্ট এই আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্থগিতাদেশ জারি করেছেন।
দেশের গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদে সঙ্ঘ নিজেদের লোকজনকে বসিয়েছে। তাই দেশের সংবিধান ও তার ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখা বিশেষ প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, আধুনিক ভারতের নেতা জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে সঙ্ঘের সদস্য নাথুরাম গডসে হত্যা করেছিলেন, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র করতে না পারার জন্য।
আরএসএস যে কথাই বলুক না কেন আমরা জানি দেশে জাতীয় আন্দোলনে মুসলিমরা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানটি প্রথম দিয়েছিলেন উর্দু কবি মৌলানা হাসরৎ মোহানী। ১৮৫৭ সালে আজীম উল্লাহ খান ‘মাদারে ওয়াতান’, ‘ভারতকী জয়’ স্লোগান দিয়েছিলেন। ‘জয় হিন্দ’ স্লোগান আবিদ হাসান সাফরানি, ‘ভারত ছাড়ো’ ও ‘সাইমন গো ব্যাক’ স্লোগান ইউসুফ মেহের আলি, ১৯২১ সালে ‘সারফোরোসি কি তামান্না আব হামারা দিল মে হ্যায়’ স্লোগান বিসমিল আজীমবাদী প্রমুখ মুসলিম লেখক ও বুদ্ধিজীবীরাই দিয়েছিলেন। ইকবালের ‘সারে জহাঁ সে আচ্ছা হিন্দুস্থাঁ হামারা’র পাশাপাশি সুরাইয়া তৈয়েবজি জাতীয় পতাকায় তিন রং প্রদান করেন। কোনো আরএসএস, ভিএইচপি কিংবা বিজেপি এই অবদান রাখতে পারেনি।
১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব সর্বপ্রথম ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন করে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সূচনা করে। কিন্তু ১৮৪৩ সালে কার্ল মার্কস ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের এই ধারণাকে আরও অগ্ৰসর করে নিয়ে যান এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র সৃষ্টির কথা বলেন এবং সর্বশেষ ধর্মের সম্পূর্ণ অবলুপ্তির প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেন।
১৮৪৩ সালে মার্কস তৎকালীন জার্মানির ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইহুদিদের সমস্যা ও সমাধানসূত্র প্রদান করেছিলেন তা আজ ভারতের মতো বহু ধর্ম, বহু জাতি এবং বহু ভাষা বিশিষ্ট দেশের সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রযোজ্য। ভারতের ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা লাভ হচ্ছে, সেই প্রসঙ্গে বলা যায় ভারতের ধর্মীয় সংখ্যালঘুর জটিল প্রশ্নটির সমাধানে মার্কসের বক্তব্য আজও প্রাসঙ্গিক। সুতরাং, ভারতের ধারণাকে বাঁচাতে হলে জাতীয় স্তরে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক জনগণের শক্তিশালী ঐক্য গঠন করা প্রয়োজন। এই শক্তিশালী ঐক্যই সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ত সঙ্ঘ ও বিজেপি’র হাত থেকে দেশকে রক্ষা করতে সক্ষম হবে এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।