৬০ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৪ পৌষ, ১৪২৯
চিরবিদায় শিল্পী রবীন দত্ত
সন্দীপ দে
হঠাৎই চলে গেলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী রবীন দত্ত। ২৬ ডিসেম্বর চিকিৎসার কোনো সুযোগ না দিয়েই আকস্মিকভাবে তিনি জীবনের ছবি আঁকা থামিয়ে দিলেন। এর মধ্যদিয়ে স্তব্ধ হলো তাঁর সৃষ্টি ও সংগ্রামের দীর্ঘ অভিযাত্রা। একইসঙ্গে দেশহিতৈষী পত্রিকার একজন অন্যতম গুণগ্রাহী, শুভকাঙ্ক্ষী ও শিল্পী হিসেবে তাঁর সম্পৃক্ততার সুদীর্ঘ বন্ধনও ছিন্ন হলো। প্রকৃতির অমোঘ অনিবার্যতায় তাঁর এই চিরপ্রস্থান হলেও তাঁর সুমার্জিত বিনম্র আচরণ ও সবার সঙ্গে হার্দিক সম্পর্কের মনোরম স্মৃতিতে এবং অফুরান সৃষ্টি ও কাজের মধ্যদিয়ে তিনি বহুদিন অনেকের স্মৃতিতেই সজীব থাকবেন।
তাঁর জন্ম ১৯৪২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের বরিশাল জেলার কলসকাঠি গ্রামে।
সজীব আদর্শবোধ
রবীন দত্তের অসামান্য শিল্পনৈপুণ্যের পাশাপাশি তাঁর শিল্পীজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য দিক ছিল, তাঁর বুকের গভীরে জাগ্রত সমাজ বদলের চিরশাশ্বত স্বপ্ন ও বামপন্থার অমলিন আদর্শ - যা তিনি নিজের জীবনচর্যায় ও আপন শিল্পের ভুবনে একাত্ম করে নিয়েছিলেন এবং যা তাঁকে প্রতি মুহূর্তে প্রাণিত করেছে নিত্যনতুন ভাবনায়, নতুন সৃষ্টির উন্মাদনায়। সেজন্যই হয়ত তাঁর মধ্যে সব সময় একটা শিল্পীসুলভ অস্থিরতা বিরাজ করেছে। বামপন্থা ও কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তাঁর সংলগ্নতা তৈরি হয়েছিল পারিবারিক সূত্রেই, তাঁর মেজদা এবং ছোটো ভাই (বর্তমানে প্রয়াত) ছিলেন সিপিআই(এম)’র সদস্য। তাঁদের বাসস্থান বারাকপুরের নোনা চন্দনপুকুর এলাকায়। পার্টির ভিত্তি স্থাপনে এই পরিবারেরও বিশেষ অবদান ছিল। সত্তরের আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের ভয়ার্ত আবহে অনেক পার্টিকর্মীকে পরম মমতায় আশ্রয় দিয়েছেন রবীন দত্তের মা হেমলতা দেবী। এই এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র 'মাতৃসদন' গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও অন্যান্য অনেকের সঙ্গে ছিল তাঁদের পরিবারের অগ্রণী ভূমিকা। এই সামগ্রিক পরিবেশ-পরিস্থিতি শিল্পী রবীন দত্তের রাজনৈতিক মনন ও চিন্তাকে পরিপুষ্ট করেছিল, তাঁর মধ্যে কমিউনিস্ট মতাদর্শের আলো প্রজ্জ্বলিত রেখেছিল, যা অনির্বাণ ছিল তাঁর জীবনের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত। জীবন পরিক্রমা শেষে বিদায় বেলায়ও তাঁর বুকের ওপরে শায়িত ছিল রক্তপতাকা।
শান্তি মিছিলে চলন্ত গাড়িতে ছবি আঁকছেন রবীন দত্ত। কলকাতার রাজপথে। ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮।
শিল্পচর্চা ও সৃষ্টির ভুবনে
ছেলেবেলাতেই রবীন দত্তের মধ্যে ছবি আঁকার আগ্রহ ডানা মেলে। পরবর্তীকালে তাঁর এই আগ্রহের যথার্থ স্ফুরণ ঘটেছিল গভর্নমেন্ট কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ক্র্যাফট-এর ছাত্র হিসেবে। এই প্রতিষ্ঠানেই তাঁর সহপাঠী ছিলেন শিল্পী নিখিলেশ দাস এবং ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। এখান থেকেই তিনি কমার্শিয়াল আর্ট শাখায় কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে স্নাতক হয়েছিলেন। এরপর চিত্রকলা জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তিনি বিচরণ করেছেন। ক্ল্যারিয়ন, সৌভাগ্য অ্যাডভারটাইজিং এজেন্সি, দিশা কমিউনিকেশন প্রভৃতি বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থায় তিনি আর্ট ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করেছেন এবং পরবর্তীকালে এস. বি. অ্যাসোসিয়েটস নামে নিজের বিজ্ঞাপন সংস্থা পরিচালনা করেছেন। এই পেশাগত জীবনের বাইরেও তিনি নিরন্তর মগ্ন ছিলেন শিল্পচর্চায়। তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে কলকাতার বিভিন্ন অভিজাত প্রদর্শশালা ছাড়াও চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বাই প্রভৃতি স্থানে। আমেরিকার শিল্পসংগ্রাহকরাও তাঁর ছবি সংগ্রহ করেছেন।
রবীন দত্তের শিল্পীজীবনের অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা হলো তাঁর আঁকা কমরেড ফিদেল কাস্ত্রোর প্রতিকৃতি কমরেড হরকিষেণ সিং সুরজিতের উদ্যোগে পৌঁছেছিল স্বয়ং কাস্ত্রোর কাছে।
রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর গড়ে ওঠা রাজ্য চারুকলা পর্ষদের শুরু থেকেই রবীন দত্ত ছিলেন কার্যকরী কমিটির সদস্য। এই পর্ষদের উদ্যোগে সেসময় জেলায় জেলায় নবীন ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণের জন্য যে চিত্রাঙ্কনের কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে শিক্ষক হিসেবে বিজন চৌধুরী, প্রকাশ দাশ, নির্মাল্য নাগ, অজয় ঘোষ, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে রবীন দত্তেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
শ্রমজীবীদের স্বার্থে - সাংস্কৃতিক আন্দোলনে
রবীন দত্তের শিল্পী-জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোকোজ্জ্বল দিক ছিল তিনি তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে শ্রমজীবী মানুষের জীবন সংগ্রামের মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন এবং যাবতীয় অন্যায়, অত্যাচার, অপহ্নবের বিরুদ্ধে তাঁর ছবিকে ব্যবহার করেছেন এক তীক্ষ্ণ আয়ুধ হিসেবে। তাই তাঁর চিত্রভাষায় মূর্ত হয়েছে দুর্বার প্রতিবাদ, প্রতিরোধ আর অদম্য লড়াইয়ের চিরন্তন বার্তা।
সত্তরের সেই সন্ত্রাস-বিদ্ধ কালো দিনগুলিতে বৃহত্তর বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম সহযাত্রী হিসেবে চিত্রশিল্পীদের সমবেত করে একটি সংগঠন গড়ার লক্ষ্যে তৈরি হয়েছিল 'পেইন্টার্স ফ্রন্ট'। এই সংগঠনের অন্যতম কারিগর ছিলেন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী বিজন চৌধুরী, নির্মাল্য নাগ, অমর দে, সজল রায় প্রমুখ। জন্মলগ্ন থেকেই এই সংগঠনের অন্যতম সহযোদ্ধা হিসেবে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় থেকেছেন রবীন দত্ত।
ছোটদেরও অনবরত ছবি আঁকতে উৎসাহ যোগাতেন।
পশ্চিমবঙ্গের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ঘটনাবলির এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে সত্তরের আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনে বামপন্থী প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রবহমানতায় গড়ে উঠেছিল ‘গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী কলাকুশলী সম্মেলন’ (১৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭২)। তারপর বিভিন্ন পর্ব পেরিয়ে সময়ের দাবিতে তৈরি হয় ‘পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ’ (২৯-৩১ এপ্রিল, ১৯৮৫)। এই সুদীর্ঘ অভিযাত্রায় শিল্পী ও সংগঠক হিসেবে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন রবীন দত্ত। তিনি ছিলেন এই সংগঠনের রাজ্য সংসদ সদস্য, কিন্তু সেই ভূমিকার চেয়েও বড়ো, পরবর্তী প্রায় চার দশক জুড়ে যে সমস্ত সাংগঠনিক কর্মসূচি পালিত হয়েছে, তাতে রবীন দত্তের ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। বিশেষভাবে স্মরণীয়, এই সময়কালে সংগঠনের উদ্যোগে সাম্রাজ্যবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের যেসব প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছে, তার প্রায় প্রতিটিতেই চিত্রশিল্পীদের ছবি আঁকার কর্মসূচি ছিল অন্যতম অঙ্গ। এছাড়াও তখন দেশ, সমাজ ও মানুষের বিপদ ও সংকট তৈরির নানা অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এই সংগঠনের উদ্যোগে লেখক শিল্পীদের পদযাত্রা ও মিছিলের সামনে চলন্ত গাড়িতে প্রতিবাদের ছবি আকাঁর অভিনব কর্মসূচি জনমানসে রেখাপাত করেছিল। এই সমস্ত কর্মসূচিতে বিজন চৌধুরী, প্রকাশ কর্মকার, নির্মাল্য নাগ, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপ ভৌমিক, আশিস গুপ্ত সহ প্রবীণ-নবীন শিল্পীদের সঙ্গে রবীন দত্তের ছিল অনিবার্য অংশগ্রহণ। তিনি ব্যক্তিগতভাবে শুধু অংশগ্রহণই করেননি, এই সমস্ত কর্মসূচিকে সফল করতে বিশেষ ভূমিকা নিয়েছেন।
বৃহত্তর রাজনীতির আঙিনায়
রবীন দত্ত বিভিন্ন নির্বাচনে বামফ্রন্ট প্রার্থীদের সমর্থনে সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযানে অংশ নিয়েছেন, কার্টুন চিত্রের সংকলনের জন্য মনোগ্রাহী কার্টুন এঁকে দিয়েছেন। আবার সিপিআই(এম) সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের সম্মেলনের সাজসজ্জায় এবং চিত্র প্রদর্শনীতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। কলকাতায় অনুষ্ঠিত সিপিআই(এম)’র ষোড়শ কংগ্রেস উপলক্ষে আয়োজিত চিত্রপ্রদর্শনীর সফল রূপায়ণেও তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। একইভাবে পাটনায় অনুষ্ঠিত সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সম্মেলনের মঞ্চ, তোরণ ইত্যাদি তৈরিতে বিজন চৌধুরী, ইন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গে রবীন দত্তের শিল্পকর্মও বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। এই সূত্রেই উল্লেখ করা যেতে পারে, এই বছরেরই (২০২২) মে মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ডিওয়াইএফআই’র সর্বভারতীয় সম্মেলনের অন্যতম কর্মসূচি হিসেবে শিল্পীদের ছবি আঁকার অনুষ্ঠানে অন্যান্য শিল্পীর সঙ্গে রবীন দত্তও অংশ নিয়েছিলেন এক বিশেষ রাজনৈতিক দায়বদ্ধতায়।
প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবেও রবীন দত্তের অনুপম দক্ষতা ছিল। তেমনি লেখাতেও ছিল যথেষ্ট মুনশিয়ানা। তিনি অসংখ্য গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন, আবার প্রথিতযশা শিল্পীদের জীবন ও শিল্প সম্পর্কিত নানা প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
দেশহিতৈষী’র সঙ্গে সম্পৃক্ততা
দেশহিতৈষী পত্রিকার সঙ্গে শিল্পী রবীন দত্তের দীর্ঘদিনের যোগসূত্র ছিল। পত্রিকার কর্মীদের সঙ্গেও সম্পর্ক ছিল নিবিড়। পত্রিকার প্রয়োজনে শতব্যস্ততা সত্ত্বেও তিনি সব সময় সাড়া দিয়েছেন। পত্রিকার শারদ ও বিশেষ সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছেন, আবার বিশেষ প্রয়োজনে প্রবন্ধও রচনা করেছেন। এই সূত্রেই উল্লেখ করা প্রয়োজন প্রচ্ছদ শিল্পী হিসেবে তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্যের কথা। প্রচ্ছদ আঁকার ক্ষেত্রে তিনি যেমন সময়কে গুরুত্ব দিয়েছেন, তেমনি পত্রিকার বিষয়কে রঙে রেখায় অনবদ্য আঙ্গিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। দেশহিতৈষী’র শারদ সংখ্যার প্রচ্ছদ নির্মাণে তিনি সব সময় গুরুত্ব দিয়েছেন সময়ের নিরিখে সমসাময়িক সামাজিক-রাজনৈতিক বিশেষ পরিস্থিতিকে। যেমন ২০১৬ সালের শারদ সংখ্যার প্রচ্ছদে ছিল রাজ্যে এক ঘনঘোর প্রতিকূল পরিবেশে কমিউনিস্টদের সমস্ত বাধা পেরিয়ে অকুল দরিয়ায় দৃপ্ত ভঙ্গিতে উজানে বইঠা ঠেলে এগিয়ে যাওয়ার চিত্রকল্প। আবার ২০১৯-এ কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশকে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার উন্মাদনায় যখন দেশের ঐক্য-সংহতি, আইন, বিচার ব্যবস্থা বিশেষ করে দেশের সংবিধানকে ভূলুণ্ঠিত করতে উদ্যত, তার প্রতিবাদ হিসেবে সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সংবিধানের প্রচ্ছদকে প্রতীক হিসেবে বিশেষ কুশলতায় দেশহিতৈষী’র প্রচ্ছদে চিত্রিত করেছিলেন তিনি।
নানা সময়ে রবীন দত্ত-র করা 'শারদ দেশহিতৈষী'র প্রচ্ছদ।
২০২০-তে সময়ের দাবিতেই একদিকে গভীর চিন্তাপ্রসূত, অন্যদিকে এক হৃদয়বিদারক বাস্তবতার ছবি প্রচ্ছদে স্থান দিয়েছিলেন শিল্পী রবীন দত্ত। সকলেরই জানা, কোভিড সংক্রমণের সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে উপযুক্ত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না দিয়ে কীভাবে চরম হঠকারিতায় অপরিকল্পিতভাবে লকডাউন চাপিয়ে দিয়ে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার দেশের গরিব শ্রমজীবী মানুষ বিশেষত, পরিযায়ী শ্রমিকদের ভয়ঙ্কর সংকটের আবর্তে ঠেলে দিয়েছিল। সেই দুর্ভর পরিস্থিতি থেকে যেকোনো মূল্যে পরিত্রাণ পেতে আপন বাসভূমির উদ্দেশে দীর্ঘ পথ হাঁটার ক্লান্তিতে ট্রেনের লাইনে বিশ্রামের সময় ঔরঙ্গাবাদের অদূরে ট্রেনের ধাক্কায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় বেশ কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিকের দেহ। ট্রেন লাইনে তাদের দলাপাকানো রক্তমাংসের সাথে পড়ে থাকতে দেখা যায় কোনো জায়গা থেকে সংগ্রহ করা ক্ষুধা নিবৃত্তির রুটি। এই মর্মান্তিক ছবির সাথে পরিযায়ী শ্রমিকদের অন্তহীন পথচলার দৃশ্য এবং সেই সময়কার বিভিন্ন সংবাদপত্রের মর্মস্পর্শী শিরোনাম ও বর্ণনার অংশবিশেষ কোলাজ হিসেবে অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে প্রচ্ছদে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। ২০২১ সালে দেশব্যাপী গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনকে রং তুলির টানে বিশেষ আঙ্গিকে প্রচ্ছদে তুলে ধরেছিলেন। আর এবারের শারদ সংখ্যার প্রচ্ছদের বিষয় ছিল দেশের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর।স্বাধীনতা প্রাপ্তির এতগুলো বছর পেরিয়ে আসার পরও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিপুল অংশের মানুষ একদিকে যেমন নিদারুণ আর্থিক সংকটে জর্জরিত,অন্যদিকে তাঁরা সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পে আক্রান্ত-বিপন্ন।তারই এক বাস্তব চিত্র ধূসরপটে কালো রঙে আঁকা কিছু বিষাদগ্রস্ত মুখাবয়বের সাহায্যে অপূর্ব দক্ষতায় তুলে ধরেছিলেন রবীন দত্ত। এভাবেই তাঁর আঁকা প্রচ্ছদগুলিতে ভাষা পেয়েছিল সময় ও বাস্তবতার দাবি। তাঁর আঁকা প্রচ্ছদগুলি কেবল সময় ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকেই মূর্ত করেনি, শিল্পমানেও সেগুলির যথার্থ উত্তরণ হয়েছিল।
দেশহিতৈষী’র শারদ সংখ্যার প্রচ্ছদ ছাড়াও তিনি কার্ল মার্কসের জন্মের দ্বিশতবর্ষ, নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষের মতো বিশেষ সংখ্যাগুলিতে যে প্রচ্ছদ এঁকেছেন, সেগুলিও পাঠকমহলে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে।
দেশহিতৈষী’র পাতায় বিভিন্ন সময়ে তাঁর কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ইশা মহম্মদ এবং নিখিলেশ দাস-এর যে প্রয়াণলেখ রচনা করেছিলেন, তাতে তাঁর লেখন-দক্ষতার চিহ্ন লক্ষ করা যায়।
রবীন দত্তের মতো রাজনৈতিক চেতনাসম্পন্ন একজন কুশলী শিল্পীর জীবন-মঞ্চ থেকে এভাবে আকস্মিক প্রস্থানে শুধু তাঁর পরিবার ও শিল্প জগতের ক্ষতি হয়নি, কিছু পরিমাণে হলেও এ ক্ষতি বৃহত্তর বামপন্থী প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও। তবে এই আন্দোলনের গতিধারায় শিল্পী সংগ্রামী হিসেবে তিনি যেটুকু অবদান রেখে গেছেন, তার অনুষঙ্গেই কমরেড রবীন দত্তের স্মৃতি সমুজ্জ্বল থাকবে দীর্ঘদিন।