E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২ / ১৪ পৌষ, ১৪২৯

প্রয়োগ সম্পর্কে

মাও সে-তুঙ


জন্মঃ ২৬ ডিসেম্বর, ১৮৯৩    মৃত্যুঃ ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬

এই প্রবন্ধটির বক্তব্যগুলি কমরেড মাও সে-তুঙ ১৯৩৭ সালে ইয়েনানে জাপ-বিরোধী সামরিক ও রাজনৈতিক কলেজে প্রদত্ত ভাষণে উপস্থিত করেছিলেন। প্রবন্ধটির মূল বিষয়কে অক্ষুণ্ণ রেখে কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে প্রকাশ করা হলো।
________________________________________

জ্ঞান ও প্রয়োগের মধ্যে জানা ও করার মধ্যে সম্পর্ক প্রসঙ্গে

মার্কসের আগে বস্তুবাদ মানুষের সামাজিক প্রকৃতি এবং তার ঐতিহাসিক বিকাশ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে জ্ঞানের সমস্যাকে বিচার করত। এই কারণে ঐ বস্তুবাদ সামাজিক প্রয়োগের ওপর জ্ঞানের নির্ভরশীলতা, অর্থাৎ উৎপাদন ও শ্রেণি-সংগ্রামের ওপর জ্ঞানের নির্ভরশীলতা উপলব্ধি করতে অক্ষম ছিল।

সর্বোপরি, মার্কসবাদীরা উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানুষের কার্যকলাপকেই সবচেয়ে মূল বাস্তব কার্যকলাপ বলে এবং তার অন্যান্য সকল কার্যকলাপের নির্ধারক বলে মনে করে। মানুষের জ্ঞান প্রধানত তার বৈষয়িক উৎপাদনের কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে, এবং এই কার্যকলাপের মধ্য দিয়েই সে ক্রমে ক্রমে প্রকৃতির ঘটনা, বৈশিষ্ট্য ও নিয়মগুলিকে এবং তার নিজের ও প্রকৃতির মধ্যেকার সম্পর্ককে বুঝতে সক্ষম হয় এবং এই উৎপাদনী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে সে ক্রমশ মানুষের সঙ্গে মানুষের নির্দিষ্ট সম্পর্কগুলিকেও বিভিন্ন পরিমাণে বুঝতে সক্ষম হয়। উৎপাদনের কার্যকলাপ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই জ্ঞান কিছুতেই অর্জিত হতে পারে না। শ্রেণিহীন সমাজে প্রত্যেক মানুষই সমাজের একজন সদস্য হিসেবে অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে সাধারণ প্রচেষ্টায় যোগ দেয়, নির্দিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কে প্রবেশ করে এবং মানবজাতির বৈষয়িক জীবনের প্রয়োজন মেটাবার জন্য উৎপাদন-কর্মে লিপ্ত হয়। আবার সকল রকমের শ্রেণিবিভক্ত সমাজেই বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির সদস্যরাও বিভিন্নভাবে নির্দিষ্ট উৎপাদন সম্পর্কগুলিতে প্রবেশ করে এবং মানবজাতির বৈষয়িক জীবনের প্রয়োজন মেটাবার জন্য উৎপাদন-কর্মে লিপ্ত হয়। এ-ই হচ্ছে মানুষের জ্ঞানবিকাশের মূল উৎস।

মানুষের সামাজিক অনুশীলন উৎপাদন-কর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা গ্রহণ করে আরও অনেক রূপ - শ্রেণিসংগ্রাম, রাজনৈতিক জীবন, বৈজ্ঞানিক ও শিল্পকলা। সংক্ষেপে বলতে গেলে, সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ সমাজের বাস্তব জীবনের সকল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করে। তাই মানুষ, কেবল তার বৈষয়িক জীবনের মধ্য দিয়েই নয়, তার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের (উভয়ই ঘনিষ্ঠভাবে বৈষয়িক জীবনের সঙ্গে জড়িত) মধ্য দিয়েও, বিভিন্ন পরিমাণে, মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভিন্ন ধরনের সম্পর্ক সম্বন্ধে জানতে পারে। এইসব অন্যান্য ধরনের সামাজিক প্রয়োগের মধ্যে বিশেষকরে বিভিন্ন ধরনের শ্রেণি-সংগ্রামই মানুষের জ্ঞানের বিকাশের ওপর গভীর প্রভাব বিস্তাব করে। শ্রেণি-বিভক্ত সমাজে প্রত্যেকেই একটা নির্দিষ্ট শ্রেণির সদস্য হিসেবে বাস করে, তাই ব্যতিক্রমহীনভাবে সব রকমের চিন্তাধারার উপরেই শ্রেণির ছাপ থাকে।...

মার্কসবাদীরা মনে করে যে, মানুষের সামাজিক প্রয়োগই বহির্জগৎ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের সঠিকতা যাচাই করার একমাত্র মাপকাঠি। আসলে যা ঘটে তা এই যে, মানুষ যখন সামাজিক প্রয়োগের প্রক্রিয়ার (বৈষয়িক উৎপাদন, শ্রেণি-সংগ্রাম অথবা বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রক্রিয়ার) মধ্যে তার প্রত্যাশিত ফললাভ করে, তখনই কেবল মানুষের জ্ঞানের সঠিকতা প্রমাণিত হয়। যদি কোনো মানুষ কাজে সাফল্যলাভ করতে চায় অর্থাৎ প্রত্যাশিত ফল পেতে চায়, তাহলে তার নিজের চিন্তাকে অবশ্যই বিষয়গত বহির্জগতের নিয়মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তুলতে হবে। যদি তা না হয় তাহলে সে প্রয়োগে ব্যর্থ হবে। ব্যর্থ হয়েই মানুষ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে এবং নিজের চিন্তাকে সংশোধন করে বহির্জগতের নিয়মের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তোলে। তখন মানুষ তার বিফলতাকে সফলতায় পরিবর্তিত করতে পারে। ‘বিফলতাই সফলতার জননী’ এবং ‘ঠেকে শেখা’ বলতে এটাই বুঝায়। দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব প্রয়োগকে প্রথমে স্থান দেয়। এই তত্ত্ব মনে করে যে, মানুষের জ্ঞানকে তার প্রয়োগ থেকে কোনভাবেই বিচ্ছিন্ন করা যায় না। যেসব ভ্রান্ত মতবাদ প্রয়োগের গুরুত্বকে অস্বীকার করে অথবা জ্ঞানকে প্রয়োগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে, দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব সেইসব মতবাদের বিরোধী। তাই লেনিন বলেছিলেন, ‘‘প্রয়োগ (তত্ত্বগত) জ্ঞানের চেয়ে অনেক বড়ো, কারণ তার যে শুধু সার্বজনীনতার গুণই আছে তাই নয়, তাতে আছে আশু বাস্তবতার গুণও।... জ্ঞান বা তত্ত্বের সত্যতা বিষয়ীগত অনুভূতির দ্বারা নির্ধারিত হয় না, নির্ধারিত হয় সামাজিক প্রয়োগে তার বাস্তব ফলাফলের দ্বারা। সামাজিক প্রয়োগই সত্যের একমাত্র মাপকাঠি হতে পারে। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্বে প্রয়োগের দৃষ্টিভঙ্গিই হলো প্রথম এবং মূল দৃষ্টিভঙ্গি।’’

কিন্তু মানুষের জ্ঞান কীভাবে প্রয়োগ থেকে উদ্ভূত হয় এবং আবার প্রয়োগেরই সেবা করে? আমরা যদি জ্ঞানের বিকা‍‌শের প্রক্রিয়ার দিকে তাকাই, তাহলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।

প্রয়োগের প্রক্রিয়ায় মানুষ প্রথমে শুধুমাত্র বিভিন্ন বস্তুর বাহ্য রূপ, তাদের পৃথক পৃথক দিক এবং তাদের পরস্পর-বহিঃসম্পর্কগুলোকেই দেখতে পায়। বস্তুগুলোর বাহ্যরূপ তাঁদের মস্তিষ্কে নানা ছাপ ফেলে, এবং এইসব ছাপের মধ্যেকার বহিঃসম্পর্কের একটা ভাসাভাসা ছবি এঁকে দেয়। এইটিই হলো জ্ঞানের প্রথম পর্যায়। এই পর্যায়ে মানুষ তখনও গভীর ধারণা গঠন করতে পারে না, পারে না কোনো যুক্তিসিদ্ধ সিদ্ধান্ত টানতে।

সামাজিক প্রয়োগ চলার সঙ্গে সঙ্গে, যে বিষয়গুলো মানুষের প্রয়োগের মধ্যে মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূতির ও ছাপগুলোর জন্ম দেয়, সেই বিষয়গুলোর বহুবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তখন মানুষের মস্তিষ্কে জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা আকস্মিক পরিবর্তন (অর্থাৎ দ্রুত-অতিক্রমণ) ঘটে এবং ধারণা গঠিত হয়। এই ধারণাগুলো তখন আর বস্তুগুলোর বাহ্য রূপ, তাদের পৃথক পৃথক দিক এবং তাদের বহিঃসম্পর্ক নয় - সেগুলো তখন বস্তুর সারাংশকে সমগ্রতাকে এবং অন্তঃসম্পর্ককে আয়ত্ত করে। ধারণা এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যে শুধুমাত্র পরিমাণগত পার্থক্যই নয়, গুণগত পার্থক্যও রয়েছে। এইভাবে আরও এগিয়ে গিয়ে বিচার ও অনুমানের সাহায্যে যুক্তিস‌ঙ্গত সিদ্ধান্তে আসা সম্ভবপর হয়। এইটি হলো জ্ঞানের দ্বিতীয় পর্যায়।... কোনো বস্তুকে জানার সমগ্র প্রক্রিয়ার ধারণা, বিচার এবং অনুমানের এই পর্যায় হচ্ছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। এই পর্যায় হচ্ছে ধারণাত্ম (rational) জ্ঞানের পর্যায়। জানার আসল কাজটি হলো ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্য দিয়ে চিন্তায় পৌঁছানো, ধাপে ধাপে বাস্তব বস্তুর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয়ে, তার নিয়মবিধি সম্পর্কে এবং একটি প্রক্রিয়া ও আরেকটি প্রক্রিয়ার মধ্যেকার অন্তঃসম্পর্কের বিষয়ে উপলব্ধিতে পৌঁছানো, অর্থাৎ যৌক্তিক জ্ঞানে পৌঁছানো। আবার বলা যায়, যৌক্তিক জ্ঞানের সঙ্গে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের তফাৎ এখানেই যে, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান বস্তুর পৃথক পৃথক দিক, বাহ্য রূপ এবং বহিঃসম্পর্কের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, আর যৌক্তিক জ্ঞান সামনের দিকে একটা বড়ো ধাপ অগ্রসর হয়ে বস্তুর সমগ্রতা, সারাংশ ও অন্তঃসম্পর্কে গিয়ে পৌঁছায়, এবং পারিপার্শ্বিক জগতে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে প্রকাশ করে। সুতরাং যৌক্তিক জ্ঞান পারিপার্শ্বিক জগতের বিকাশকে তার সমগ্রতায়, তার সমস্ত দিকগুলির অন্তঃসম্পর্কের মধ্যে আয়ত্ত করতে সক্ষম।

অনুশীলনের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত এবং অগভীর থেকে গভীরের দিকে অগ্রসরমান এই জ্ঞান-বিকাশের প্রক্রিয়ার দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদী তত্ত্ব মার্কসবাদের আবির্ভাবের আগে কেউ কখনো উপস্থিত করেনি। মার্কসীয় বস্তুবাদই সর্বপ্রথম এই সমস্যার সঠিক সমাধান করে, বস্তুবাদী ও দ্বান্দ্বিক উভয় দিক থেকেই জ্ঞানের ক্রমগভীর গতিকে দেখিয়ে দেয়, এবং দেখিয়ে দেয় যে, সমাজে মানুষ তার উৎপাদন ও শ্রেণি-সংগ্রামের জটিল ও নিয়মিতভাবে পুনরাবর্তনশীল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে যৌক্তিক জ্ঞানে এগিয়ে যায়।...

মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতে, জ্ঞানের প্রক্রিয়ার দুটো পর্যায়ের প্রত্যেকটিরই নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। নিম্ন পর্যায়ে জ্ঞান আত্মপ্রকাশ করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান হিসেবে, আর উচ্চতর পর্যায়ে তা আত্মপ্রকাশ করে যৌক্তিক জ্ঞান হিসেবে। কিন্তু উভয় পর্যায়ই জ্ঞানলাভের একক প্রক্রিয়ার অংশ। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান এবং ধারণাত্মক জ্ঞান গুণগতভাবে পৃথক, কিন্তু পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন নয় - প্রয়োগের ভিত্তিতে তারা ঐক্যবদ্ধ।...

জ্ঞানলাভের প্রক্রিয়ায় ক্রম অনুযায়ী সর্বপ্রথম আসে ইন্দ্রিয়লব্ধ অভিজ্ঞতা। আমরা যে জ্ঞানের প্রক্রিয়ায় সামাজিক প্রয়োগের তাৎপর্যের উপর বিশেষ করে জোর দিই তার কারণ, একমাত্র সামাজিক প্রয়োগই মানুষের জ্ঞানের জন্ম দিতে পারে এবং মানুষকে বাস্তব বহির্জগৎ থেকে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতা অর্জনে চালিত করতে পারে। অভিজ্ঞতা থেকেই জ্ঞানের সূচনা - এই হলো জ্ঞানতত্ত্বের বস্তুবাদ।...

ধারণাত্মক জ্ঞান নির্ভর করে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞানের ওপর, এবং ইন্দ্রিয়‌গ্রাহ্য জ্ঞানকে উন্নীত করতে হয় ধারণাত্মক জ্ঞানে - এটাই হচ্ছে দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদের জ্ঞানতত্ত্ব।...

কিন্তু জ্ঞানের গতির এখানেই শেষ নয়। যদি জ্ঞানের দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদী গতি ধারণাত্মক জ্ঞানে এসে থামত, তাহলে কেবল অর্ধেক সমস্যার সমাধান হ‍‌তো। এবং মার্কসবাদী দর্শনের দিক থেকে তাতে শুধুমাত্র যে অর্ধাংশটি খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়, সেই অর্ধাংশুটুকুরই সমাধান হতো। মার্কসবাদী দর্শনের মতানুসারে, বাস্তব জগতের বিধিনি‌য়ম বোঝা এবং এইভাবে তাকে ব্যাখ্যা করতে পারাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নয়, বরং সমস্যাটা হচ্ছে বাস্তব বিধিনিয়মের জ্ঞানের সাহায্যে জগৎটাকেই পুরোপুরি বদলে দেওয়া। মার্কসবাদী দৃষ্টিতে তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ এবং এর গুরুত্ব পরিপূর্ণভাবে প্রকা‍‌শিত হয়েছে লেনিনের এই বক্তব্যেঃ ‘‘বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন হতে পারে না।’’ কিন্তু মার্কসবাদ তত্ত্বের গুরুত্বের উপর জোর দেয় ঠিক এবং শুধুমাত্র এই কারণেই যে, তত্ত্ব কর্মের পথনির্দেশ করতে পারে। যদি আমাদের একটা নির্ভুল তত্ত্ব থাকে, কিন্তু যদি তা নিয়ে শুধু বক্‌বকই করা হয়, যদি তাকে খোপের মধ্যে রেখে দেওয়া হয় এবং কাজে লাগানো না হয়, তাহলে সেই তত্ত্বটি যত ভালোই হোক না কেন তার কোনো তাৎপর্যই থাকে না। প্রয়োগ থেকে জ্ঞানের শুরু হয়, এবং প্রয়োগের মাধ্যমে অর্জিত তাত্ত্বিক জ্ঞানকে আবার অবশ্যই প্রয়োগে ফিরে আসতে হবে। জ্ঞানের সক্রিয় ভূমিকা কেবলমাত্র যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে ধারণাত্মক জ্ঞানে সক্রিয়ভাবে দ্রুত অতিক্রমণের মধ্যে ব্যক্ত হয় তা-ই নয়, বরং আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে এ‍‌ই যে, ধারণাত্মক জ্ঞান থেকে বিপ্লবী প্রয়োগে দ্রুত অতিক্রমণের মধ্যেও তা অভিব্যক্ত হয়। যে-জ্ঞান জগতের নিয়মবিধিকে আয়ত্ত করে, তাকে অবশ্যই আবার জগৎকে পরিবর্তন করার প্রয়োগে নিয়োজিত করতে হবে, তাকে নতুন করে কাজে লাগাতে হবে উৎপাদনের প্রয়োগে, বিপ্লবী শ্রেণি-সংগ্রাম ও জাতীয় সংগ্রামের প্রয়োগে এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োগে। এটা হচ্ছে তত্ত্বের পরীক্ষা ও বিকাশসাধনের প্রক্রিয়া, জ্ঞানের সমগ্র প্রক্রিয়ারই ধারাবাহিকতা। তত্ত্ব বাস্তব সত্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিনা - এ‍‌ই সমস্যার পুরোপুরি সমাধান পূর্বোক্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য থেকে ধারণাত্মক পর্যায়ে জ্ঞানের গতির মধ্যে হয়নি এবং হতেও পারে না। সমস্যাটির পুরোপুরি সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে ধারণাত্মক জ্ঞানকে আবার সামাজিক প্রয়োগে চালিত করা, তত্ত্বকে প্রয়োগ করা এবং এতে প্রত্যাশিত উদ্দেশ্য সাধিত হয় কিনা তা দেখা।...

প্রয়োগের মাধ্যমে সত্যকে আবিষ্কার করুন, এবং আবার প্রয়োগের মাধ্যমে সত্যকে যাচাই এবং বিকশিত করুন। ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জ্ঞান থেকে শুরু করুন এবং তাকে সক্রিয়ভাবে ধারণাত্মক জ্ঞানে উন্নীত করুন। তারপর ধারণাত্মক জ্ঞান থেকে শুরু করুন এবং বিষয়ীগত ও বিষয়গত এই উভয় জগৎকে পরিবর্তন করার জন্য সক্রিয়ভাবে বিপ্লবী প্রয়োগে পরিচালনা করুন। প্রয়োগ, জ্ঞান, আবার প্রয়োগ এবং আবার জ্ঞান - এ‍‌ই প্রক্রিয়ার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে অন্তহীন চক্রাবর্তে, এবং প্রত্যেকটি চক্রাবর্তের সাথে সাথে প্রয়োগ ও জ্ঞানের অন্তর্বস্তুটি উচ্চতর স্তরে উত্তীর্ণ হয়। এই হলো দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের সমগ্র জ্ঞানতত্ত্ব, এই হলো জানা এবং করার ঐক্যের দ্বান্দ্বিক-বস্তুবাদী তত্ত্ব।