৫৮ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ৩০ জুলাই, ২০২১ / ১৩ শ্রাবণ, ১৪২৮
সম্প্রতি প্রয়াত পার্টি নেতৃবৃন্দের স্মরণসভা
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দেশ ও রাজ্যের বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন-জীবিকার স্বার্থে ও গণতন্ত্র রক্ষায় লড়াই-আন্দোলনে বামপন্থীদের উপযুক্ত ভূমিকা পালনের কথা গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ। সাম্প্রতিককালে প্রয়াত পার্টির রাজ্য ও জেলা স্তরের কয়েকজন প্রয়াত নেতা-নেত্রীর স্মরণসভায় একথা উল্লেখ করেছেন পার্টির নেতৃবৃন্দ। প্রসঙ্গত, গত ২৫ জুলাই তমলুকে কমরেড নির্মল জানা এবং বহরমপুরে প্রয়াত দুই পার্টিনেতা কমরেড আবুল হাসনাত খান ও কমরেড তিমির ঘোষ; ২০ জুলাই বর্ধমানের কাটোয়ায় কমরেড সাধনা মল্লিক এবং ১৫ জুলাই কৃষ্ণনগরে কমরেড আশু ঘোষের স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এই সভাগুলিতে নেতৃবৃন্দ আহ্বান জানিয়েছেন, যে আদর্শ ও নীতি প্রতিষ্ঠার জন্য এবং বর্তমানে তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও গরিব মানুষের রুটি-রুজির ওপর ভয়ঙ্কর আক্রমণ নেমে এসেছে তা রুখতে প্রয়াত পার্টি নেতা-নেত্রীরা জীবনভর যে লড়াই করেছেন, তা আমাদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
কমরেড নির্মল জানা স্মরণসভা
২৫ জুলাই তমলুকের নিমতৌড়িতে জেলা পার্টি অফিসে প্রয়াত কমরেড নির্মল জানার স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। কমরেড নির্মল জানা ১৭ এপ্রিল করোনায় আক্রান্ত হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০। বিমান বসু তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, কমরেড নির্মল জানা যে সময়ে পার্টির কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন, সেই সময়টা মোটেও সহজ ছিল না। অনেক সংগ্রাম-আন্দোলনের পথ পেরিয়েছেন তিনি। মার্কসীয় চিন্তাধারায় নিজেকে উদ্বুদ্ধ করে যে লড়াইয়ের বার্তা তিনি দিয়ে গেছেন, সেই পথেই বামপন্থী কর্মীদের আগামীর লড়াই লড়তে হবে। বামপন্থীদের হতশার কোনো জায়গা নেই।
তিনি বলেন, বর্তমানে সারা দেশে বিভাজনের রাজনীতি ও ফ্যাসিবাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে। তা প্রতিহত করতে গণআন্দোলন ও সংগ্রাম ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। এরাজ্যে তৃণমূল যে ২১৩টি আসনে জয়ী হয়েছে তার মানে এই নয় তা চিরস্থায়ী। সারা দেশের মানুষ অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে রয়েছেন। বেকারত্ব চরমে। এরাজ্যও তার ব্যতিক্রম নয়। এরাজ্যে ডোমের পদে চাকরির জন্য স্নাতক, স্নাতকোত্তর থেকে ইঞ্জিনিয়াররা পর্যন্ত আবেদন করেছেন। রাজ্যে কর্মসংস্থানে কী দশা তা বোঝা যাচ্ছে। অন্যদিকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ফ্যাসিবাদী কায়দায় দেশ পরিচালনা করতে চাইছে। তারা ধর্মীয় ভেদাভেদ তৈরি করছে, এরাজ্যে শাসকদের রাজনীতিও তাতে মদত দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই পরিস্থিতির মধ্যে পেট্রোল-ডিজেল সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব সীমা ছাড়াচ্ছে। এই পরিবেশ-পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে জনগণের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলে ঐক্যবদ্ধ লড়াই-আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।
স্মরণসভায় সভাপতিত্ব করেন পার্টির পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রবীন দেব, পার্টির পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক তরুণ রায়। প্রয়াত কমরেড নির্মল জানার কন্যা পৌলমি জানা প্রমুখ।
প্রয়াত নেতার প্রতিকৃতিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য তাপস সিনহা, হিমাংশু দাস, প্রবীণ কৃষক নেতা প্রশান্ত প্রধান, আরএসপি’র জেলা সম্পাদক অমৃত মাইতি, সিপিআই জেলা সম্পাদক নির্মল বেরা, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা অশ্বিনী সিনহা, সিআইটিইউ জেলা সম্পাদক সুব্রত পণ্ডা, তমলুকের সাংসদ দিব্যেন্দু অধিকারী প্রমুখ।
কমরেড তিমির ঘোষ ও কমরেড আবুল হাসনাত খান স্মরণসভা
মুর্শিদাবাদ জেলার পার্টি নেতা কমরেড তিমির ঘোষ গত ৩ জুন এবং কমরেড আবুল হাসনাত খান ৩০ এপ্রিল প্রয়াত হন। তাঁদের স্মরণে ২৫ জুলাই বহরমপুর ঋত্বিক সদনে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন সিপিআই(এম)’র প্রবীণ নেতা নৃপেন চৌধুরী। এই স্মরণসভায় প্রয়াত দুই কমরেডের সংগ্রামী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে গরিব শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে কাজ করে যাবার কথা উল্লেখ করেন নেতৃবৃন্দ। এদিনের স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোম, পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তুষার দে সহ আরএসপি, ফরওয়ার্ড ব্লক, সিপিআই এবং এসইউসিআই’র নেতৃবৃন্দ।
কমরেড তিমির ঘোষের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নেতৃবৃন্দ বলেন, ছাত্রাবস্থা থেকেই কুখ্যাত জোতদারদের বিরুদ্ধে জমির আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন তিনি। ডিওয়াইএফআই’র জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি প্রাদেশিক কৃষকসভার জেলা কমিটির সম্পাদকেরও দায়িত্ব পালন করেছেন। কমরেড তিমির ঘোষ বিভিন্ন ক্রীড়া সংগঠনের সাথেও যুক্ত ছিলেন। গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি অনেকবার শারীরিকভাবেও আক্রান্ত হয়েছিলেন।
কমরেড আবুল হাসনাত খান সম্পর্কে নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে উঠে এসেছে যুব আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কমরেড আবুল হাসনাত খান তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি সিআইটিইউ’র নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি পার্টির জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি দু’বার সাংসদ এবং চারবার বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন। মুর্শিদাবাদ জেলায় বিড়ি শ্রমিকদের আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে তিনি বিরাট অবদান রেখে গেছেন। ফরাক্কা ব্লক এলাকার মানুষের স্বার্থে, এনটিপিসি’র কর্মচারী ও ঠিকাদারদের আন্দোলন সংগঠিত করায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি অনগ্রসর শ্রেণির মানুষের উন্নয়ন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় নিরলস পরিশ্রম করে গেছেন।
কমরেড সাধনা মল্লিক স্মরণসভা
বর্ধমান জেলায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রণী সংগঠক তথা মহিলা আন্দোলনের নেত্রী কমরেড সাধনা মল্লিকের স্মরণসভা ২০ জুলাই কাটোয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। এদিন কাটোয়া নজরুল মঞ্চে আয়োজিত স্মরণসভায় বক্তব্য রাখেন পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত। তিনি বলেন, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে লালঝান্ডা হাতে চলতি সমাজব্যবস্থা বদলে দেবার লড়াই চালিয়ে গেছেন কমরেড সাধনা মল্লিক। শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থেই তিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি পার্টি সদস্যপদ অর্জন করেছিলেন। বৃন্দা কারাত বলেন, পুরুষশাসিত সমাজে অসংখ্য বাধা ভেঙেই এগোতে হয় মহিলাদের। কমরেড সাধনাকেও অনেক কষ্ট ও বাধা অতিক্রম করতে হয়েছিল। অনেক আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে তিনি মহিলা আন্দোলনের একজন জনপ্রিয় নেত্রী হয়ে উঠেছিলেন। তিনবার তিনি সিপিআই(এম) বিধায়ক হিসাবে নির্বাচিত হন। বৃন্দা কারাত বলেন, সাধনা মল্লিকরা শিখিয়ে গেছেন, যত আক্রমণ, বাধা আসুক মানুষের পাশে থেকে ধৈর্যের সাথে কাজ করে যেতে হবে আমাদের।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ এপ্রিল কমরেড সাধনা মল্লিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এদিনের স্মরণসভায় শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন পার্টি নেতা অমল হালদার। প্রয়াত কমরেডের সংগ্রামী জীবনের নানা কথা তুলে ধরেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অঞ্জু কর, আভাস রায়চৌধুরী, পার্টির পূর্ব বধর্মান জেলা কমিটির সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক। এদিনের স্মরণসভায় প্রয়াত নেত্রীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শুভপ্রসাদ নন্দী মজুমদার। উপস্থিত ছিলেন পার্টি নেতা গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি, সৈয়দ হোসেন, মহারানি কোঙার, অরিন্দম কোঙার প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সহ প্রয়াত নেত্রীর পুত্র ও ভাই।
কমরেড আশু ঘোষ স্মরণসভা
সিপিআই(এম)’র প্রাক্তন জেলা সম্পাদক কমরেড আশু ঘোষের স্মরণসভা ১৫ জুলাই কৃষ্ণনগর পাবলিক লাইব্রেরির মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়। এদিনের স্মরণসভায় উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। তিনি বলেন, আজ পৃথিবী জুড়েই লালঝান্ডার ওপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়ছে। আমাদের দেশে এমনকী রাজ্যেও আক্রমণ বাড়ছে। এরাজ্যের ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে বামপন্থীদের ১৪ জন বিধায়ক জয়ী হয়েছিলেন। কিন্তু আধা-ফ্যাসিস্ত সন্ত্রাসের জন্য তাঁরা বিধানসভায় অংশ নিতে পারেননি। কিন্তু গরিব শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের লড়াইয়ে কোনোদিন এক ইঞ্চিও জমি ছাড়েনি লালঝান্ডা। জরুরি অবস্থা জারি, ১১০০ কমরেডকে খুন করে পার্টিকে কার্যত নিষিদ্ধ করে দেওয়ার পরেও শুধু নীতি-আদর্শকে হাতিয়ার করেই লালঝান্ডার লড়াই এগিয়ে চলেছে। আন্দোলন-সংগ্রামের নানা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে ৬০ ও ৭০ দশকের আক্রমণের মুখোমুখি দাঁড়িয়েই কমরেড আশু ঘোষের মতো মানুষেরা কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রতিষ্ঠা করার কাজ করে গেছেন। তার থেকে শিক্ষা নিয়েই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরন্তর সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে।
তিনি আরও বলেছেন, তৃণমূল-বিজেপি যে নীতি নিয়ে চলেছে, তাতে সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষের ওপর সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে শোষণ-বঞ্চনা বেড়ে চলেছে। লালঝান্ডাই মেহনতি মানুষের একমাত্র মুক্তির পথ দেখাতে পারে। ইতিহাস তা বারবার প্রমাণ করেছে।
প্রসঙ্গত, ৭ মে বার্ধক্যজনিত রোগে কমরেড আশু ঘোষ প্রয়াত হন।
এদিনের স্মরণসভায় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃদুল দে। সভার শুরুতে শোক প্রস্তাব উত্থাপন ও সভাপতিত্ব করেন পার্টির জেলা সম্পাদক সুমিত দে। উপস্থিত ছিলেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য রমা বিশ্বাস, অলকেশ দাস, মেঘলাল সেখ প্রমুখ।