৫৮ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ৩০ জুলাই, ২০২১ / ১৩ শ্রাবণ, ১৪২৮
১৯৬৯ সালের ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ প্রসঙ্গে
প্রভাত পট্টনায়েক
দেশের প্রধান প্রধান ১৪টি ব্যাঙ্ককে জাতীয়করণ করা হয়েছিল ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই। বর্তমানে ৫২ বছর পরে সেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে পুনরায় বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য উঠে আসছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই একটা প্রশ্নের জন্ম দেয় - ব্যাঙ্কগুলোকে সম্পূর্ণরূপে জাতীয়করণ করা হয়েছিল কেন? সাধারণভাবে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের ফলে কী কী সুফল পাওয়া গেছে, সেই প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্নের উত্তর আলোচিত হয়। এই উত্তর সঠিক ও যথাযথ; তবে একইসঙ্গে এটাও মাথায় রাখা দরকার যে, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পিছনে সামগ্রিকভাবে প্রেক্ষাপট কী ছিল। এই আলোচনা অত্যন্ত জরুরি; কারণ সেই প্রেক্ষাপট বিচার না করে আজকের এই ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণের প্রসঙ্গটি আলোচনা করা যায় না।
ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ কোনো সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ ছিল না; যদিও সেই সময়ে বহু প্রগতিশীল কংগ্রেসী মানুষ তাকে সমাজতান্ত্রিক পদক্ষেপ বলেই দাবি করেছিলেন। আবার অতি-বামপন্থার সাথে যুক্ত মানুষজন এই পদক্ষেপকে অত্যন্ত মামুলি কাজ বলে যেভাবে সমালোচনা করেছিলেন, গুরুত্বের দিক থেকে তা এতটাই মামুলি কিছু বাঁধা-ধরা কাজ ছিল না, যেটা পুঁজিপতিদের পক্ষে গ্রাহ্য না করার মতো একটা যৎসামান্য বদল নিয়ে এসেছিল। লেনিন যে বইয়ের সাহায্য নিয়ে তাঁর সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কিত তত্ত্বটি গড়ে তুলেছিলেন, সেই দ্য ফিনান্স ক্যাপিটাল গ্রন্থের লেখক তথা মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ রুডলফ হিলফারদিং একথা আলোচনায় নিয়ে এসেছিলেন যে, প্রথম সারির আধডজন জার্মান ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করা হলে জার্মান পুঁজিবাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। একথা সত্য ঠিকই; তবে তা একটা নিরর্থক আশাবাদ মাত্র। পুঁজিবাদের অধীনে ব্যাঙ্কগুলোকে যে পথে ব্যবহার করা হতো, তার থেকে ভিন্নতর উপায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে যতক্ষণ না ব্যবহার করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পুঁজিবাদের মেরুদণ্ড ভাঙা যাবে না। আর সেই কাজ করার জন্য জাতীয়করণের কর্মসূচিকে আরও অনেক বেশি সুযোগ সহ প্রসারিত করার কথা ভাবতে হতো - কেবলমাত্র ছ’টি ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের বাইরে এই কর্মসূচিকে বেরোতে হতো।
এমন একটা বাস্তবতা থাকার পরেও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাওয়াটা বড়োই ভুল হবে যে, ব্যাঙ্কগুলো জাতীয়করণ হোক বা না হোক, তাতে পুঁজিপতিদের ক্ষেত্রে ইতর বিশেষ তফাৎ ঘটে। তার কারণ, ব্যাঙ্কের হেফাজতে থাকা আর্থিক সম্পদকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে একচেটিয়া পুঁজিপতিদের যে সামর্থ্য আছে, তাকে দুর্বল করে দেওয়া স্পষ্টতই তাঁদের কাছে একটা বিপর্যয়, যেটা তারা হিংস্রভাবে ঠেকাতে চায়।
ভারতের প্রেক্ষিতে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ কর্মসূচি ছিল আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের লক্ষ্যে গৃহীত সেইসব কৌশলের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ, যে সমস্ত কৌশল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে তৃতীয় বিশ্বের আর পাঁচটা দেশের মতোই ভারতও অনুসরণ করেছিল। দেশে দেশে চলা উপনিবেশ-বিরোধী নানান সংগ্রাম থেকেই বাস্তবে এইসব কৌশলের জন্ম ঘটেছিল। তবে সেক্ষেত্রে এই সংগ্রামের শীর্ষ থেকে বুর্জোয়া নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়া যায়নি। সুতরাং ঔপনিবেশিক শাসন-পরবর্তীকালে গৃহীত উন্নয়ন কৌশল কোনোভাবেই সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছিল না; বরং একটা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যেই ছিল। সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ছিল সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে কিছুটা স্বাধীন এবং সেই কারণে স্বদেশীয়ানার যথেষ্ট চওড়া ভিতের ওপরে গড়ে তোলা। তার জন্য ছোটো কৃষকের হাতে থাকা চাষ-আবাদ ও ছোটো পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে, তাদের একটা ধাপ পর্যন্ত উন্নত করতে তারা বাধ্য হয়েছিল। সাধারণভাবে পুঁজিবাদের ক্ষেত্রে যেটা ঘটে থাকে - ছোটো ছোটো চাষ-আবাদ ও পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে জোর করে দখল করা এবং তাদের ধ্বংস করে দেওয়া - এক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি।
অন্য কথায় বলা হলে, এই উন্নয়ন কৌশল একদিকে যেমন সমাজতন্ত্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে ছিল না; তেমনই অন্যদিকে পুঁজিবাদের যে চরিত্র গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তা সহায়ক হয়ে উঠেছিল সেটাও কোনোভাবে ধ্রূপদী পুঁজিবাদ ছিল না। এই কৌশলের ক্ষেত্রে মুখ্য হলমার্ক ছিল বৃহৎ পুঁজির (সাধারণভাবে যার অবস্থান বড়ো বড়ো শহরকেন্দ্রিক) আওতা থেকে কিছুটা স্বাধীন এবং একটা মাত্রা পর্যন্ত সুরক্ষা কবচের ঘেরাটোপে থাকা ছোটো পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা ও ছোটো কৃষকের হাতে থাকা চাষ-আবাদ। তাদের বাইরে থাকা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা দ্বারা তাদেরকে গায়ের জোরে দখলে নিয়ে আসার বিরোধী ছিল ওই কৌশল; যদিও বা কৃষক ও জমিদারদের সংমিশ্রিত উপাদানে গঠিত একটা পুঁজি-কেন্দ্রিক প্রবণতা হিসাবে এই ব্যবস্থার মধ্যেও পুঁজিবাদ গড়ে ওঠে। ফলে এই সবকিছুকে প্রভাবিত করার জন্য একজন বিনিয়োগকারী তথা নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রক হিসাবে সেই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রাষ্ট্রের একটা ভূমিকা ছিল। ধ্রূপদী পুঁজিবাদ থেকে এই অবস্থার বেশ কিছুটা পার্থক্য থাকায় এই ধরনের কৌশলকে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হতো - জওহরলাল নেহরু’র ‘‘সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের সমাজ গড়ে তোলার প্রক্রিয়া’’ শব্দগুচ্ছ থেকে মিখাল কালেস্কির দেওয়া নাম ‘‘অন্তবর্তীকালীন শাসন ব্যবস্থা’’। এই কৌশলের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের সমালোচনায় একথা বলা হয়নি যে, এই কৌশল ধ্রপদী পুঁজিবাদের থেকে কোনোভাবে আলাদা নয়; বরং তাঁদের সমালোচনায় এটা বলা হয়েছিল যে, আজ না হয় কাল, এই ব্যবস্থা একদিন ধ্রূপদী পুঁজিবাদে পরিণত হবে (বস্তুতপক্ষে সেই প্রক্রিয়াই এখন ঘটছে)।
এক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুতর বিষয় আছে। ধ্রূপদী পুঁজিবাদের দিকে কোনো একটা পদক্ষেপ হলে এক্ষেত্রে তার ফলাফল হয়ে দাঁড়াতো এই উন্নয়ন-কৌশলের যতটুকু যা স্বাধীনতা, বৃহৎ পুঁজির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে বিসর্জন দেওয়া। তখন এই উন্নয়ন-কৌশলের অর্থ হয়ে উঠতো বড়োমাপের বৈষম্যমূলক উন্নতির একটা পথ, যা সাম্রাজ্যবাদের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে। উপনিবেশ-বিরোধী সংগ্রামের একটা অভীষ্টরূপে দেশ গড়ে তোলার যে প্রক্রিয়া, এই পথ সেক্ষেত্রে অন্তর্ঘাতী হয়ে উঠতো।
এই উন্নয়ন-কৌশলের ক্ষেত্রে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; যদিও বা তার প্রভাব শুরুর দিকে বোঝা যায়নি, বরং খানিকটা পরের দিকে বোঝা গিয়েছিল। যেহেতু ঋণ ব্যবস্থা পুঁজির ওপর হুকুম চালানোর বিষয়টাকে তুলে ধরে, তাই ঋণের সামাজিক, ভৌগোলিক ও ক্ষেত্রীয় বণ্টন হলো কোনো দেশ তার উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী চরিত্রের পথ ধরে চলছে, তা বোঝার একটা মৌলিক নির্ধারক। সুতরাং ধ্রূপদী পুঁজিবাদের থেকে ভিন্নতর হচ্ছে এই শাসনব্যবস্থা, যেটা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু পুঁজিবাদকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, এবং তার সাথে সাথে ছোটো পণ্য-উৎপাদন ব্যবস্থা ও কৃষকের হাতে থাকা চাষ-আবাদ সুরক্ষিত থাকে;, যেহেতু উন্নয়ন-কৌশল গ্রহণে কিছুটা স্বাধীনতা থাকে, বৃহৎ পুঁজির অস্তিত্বও থাকে - তাই ঋণ বণ্টনের ওপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার বিষয়টি হয়ে ওঠে শাসনব্যবস্থা পরিচালনার একটা মৌলিক হাতিয়ার, যে হাতিয়ার ব্যবহার করা সম্ভব কেবলমাত্র ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের সহায়তায়। ঋণ বণ্টন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের একটা উপায় হিসাবে ‘‘ব্যাঙ্কের ওপরে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ’’ কায়েম করার বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকার কিছুদিনের জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের ‘সামাজিক নিয়ন্ত্রণ’ অকার্যকার হওয়ার কারণে ঋণ বণ্টন ব্যবস্থার ওপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েমের লক্ষ্যে একমাত্র কার্যকর উপায় হিসাবে তখন ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পথে হেঁটেছিল সরকার।
১৯৬৯ সালের ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পথ ধরেই তার কিছুদিন পরে দ্বিতীয় দফায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে চলা ছোটো ছোটো কিছু ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করা হয়। এই ঘটনার একটা দারুণ প্রভাব পড়েছিল। এর ফলে কৃষি ও ছোটো পণ্য উৎপাদন-ব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল। এর পরিণতিতে কৃষকের ওপরে চেপে বসা পুরনো মহাজনী ব্যবস্থার মুঠি কিছুটা আলগা হয়ে পড়ে। ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের ফলে গোটা দেশজুড়ে ব্যাঙ্ক পরিষেবার বিস্তার ঘটেছিল; তার সাথে সাথে উৎপাদন-কাজ ও ফাটকা কারবারের মধ্যে একটা দেওয়াল তোলারও চেষ্টা করা হয়েছিল, যার ফলশ্রুতি হিসাবে একটা বিষয় নিশ্চিত করা হয় যে, ধ্রূপদী পুঁজিবাদের ক্ষেত্রে ঋণের টাকা যেভাবে ফাটকা কারবারে ব্যবহৃত হয়, এক্ষেত্রে সেটা করা যাবে না। এটা বাস্তব যে, অপেক্ষাকৃত সঙ্গতিসম্পন্ন কৃষকরাই ঋণের সিংহভাগ পেয়েছিল। তথাপি প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের সামাজিক বণ্টন আগের চাইতে অনেক বেশি প্রসারিত হয়েছিল; বলা ভালো, পুঁজিবাদী দুনিয়ার যে-কোনো দেশের ঋণ বণ্টন ব্যবস্থার থেকেও বাস্তবে অনেক বেশি প্রসারিত। এই উন্নয়ন-কৌশল ব্যতীত সবুজ বিপ্লব ঘটতে পারতো না। বাস্তুতন্ত্র সম্পর্কিত ফলাফলের বিচারে সবুজ বিপ্লব প্রসঙ্গে কোনো মানুষের বিরুদ্ধ মত থাকলেও, একথা তো অস্বীকার করা যায় না যে, বৃহৎ শক্তির নেতৃত্বে চলা ‘খাদ্য সাম্রাজ্যবাদের’ কবল থেকে ভারতকে মুক্ত করেছিল এই সবুজ বিপ্লবই।
যাই হোক, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের লক্ষ্যে গৃহীত কৌশল আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির বিশ্বজুড়ে উত্থানের হাত ধরে ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছে। এই উত্থানের সাথে যুক্ত হয়েছে ভারতের বৃহৎ বুর্জোয়ারা। বৃহৎ পুঁজির কবল থেকে কিছুটা স্বাধীন সেই উন্নয়ন-কৌশল অনুসরণে চলা প্রকল্পগুলো বাতিলের দলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। নয়া-উদারবাদী নীতির যুগ শুরু হওয়ার সাথে সাথে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোকে বেসরকারিকরণ করার পক্ষে একটা ধুয়ো উঠেছিল, যার মূল গায়েন ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ (আর, যে কাজটি তারা করেছিল ল্যারি সুমেরস্, টিম গেইথনারের মতো গুপ্তচরদের মাধ্যমে)। সেই বক্তব্যের স্থানীয় সমর্থকরা তখন থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের লাভ-ক্ষতির হিসাব-নিকাশ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছিল। তাদের সেইসব প্রশ্ন সম্পূর্ণত অবৈধ; কারণ ব্যাঙ্ক জাতীয়করণের পুরো বিষয়টাই ছিল যে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলোর ভিন্নতরভাবে কাজ করা উচিত।
নয়া-উদারবাদের মোদ্দা কথা হলো ধ্রূপদী পুঁজিবাদকে তার অন্তর্নিহিত সমস্ত প্রবৃত্তি সমেত এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। এর অর্থ হলো ছোটো পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা ও কৃষকের হাতে থাকা চাষ-আবাদের ওপরে দখলদারি কায়েম, রাষ্ট্রকে তার নিয়ামক ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থেকে হটিয়ে দেওয়া এবং আয় ও সম্পদের বিপুল বৈষম্য সৃষ্টি ও সেই বৈষম্যের বৃদ্ধি। কৃষকদের আত্মহননের বিপুল সংখ্যার মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত তাঁদের চরম দুর্দশা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো জরুরি পরিষেবা প্রদানকারীর ভূমিকা থেকে রাষ্ট্রকে গুটিয়ে নেওয়া এবং জাতীয় আয়ে জনসংখ্যার ধনীতম এক শতাংশের ভাগ ১৯৮২ সালের ৬ শতাংশ থেকে ২০১৩-১৪ সালের ২২ শতাংশে বৃদ্ধি (যা কিনা গত এক শতকের নিরিখে সর্বোচ্চ হার) - এইরকম সবকিছুই নয়া-উদারবাদের মর্মবস্তুকে চিহ্নিতকারী সমস্ত সূচক। ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার বেসরকারিকরণের দাবি এই অ্যাজেন্ডারই অংশ।
নয়া-উদারবাদ যেভাবে এগিয়ে চলেছে, তার অ্যাজেন্ডাগুলো সেইভাবে আরও বেশি প্রকট ও বেহায়া হয়ে উঠেছে। বিশ্বজোড়া মহামারির অছিলায় শ্রম অধিকারগুলোর ওপরে যে আক্রমণ চালানো হয়েছে, তা এই বক্তব্যকেই প্রতিফলিত করে। ঠিক একইভাবে তার প্রতিফলন ঘটছে তিনটে কৃষি আইনের মধ্যে দিয়েও। এই তিনটে আইনের নিট ফল হবে পুঁজিপতিদের দখলদারির জন্য কৃষকের হাতে থাকা চাষ-আবাদকে উন্মুক্ত করে দিয়ে তার ধ্বংসসাধন। প্রকৃত প্রস্তাবে মোদী সরকারের প্রতিটি আর্থিক পদক্ষেপ - সেটা জিএসটি হোক বা নোটবন্দি অথবা কৃষি আইন - তা যে যাই হোক না কেন, প্রত্যেকটির লক্ষ্য ছিল যে-কোনো ধরনের ছোটো উৎপাদন ব্যবস্থাকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া; তার চাহিদা ছিল নয়া-উদারবাদী অ্যাজেন্ডা মোতাবেক পুঁজির আদিম পঞ্জীভবনের প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ব্যাঙ্কগুলোকে পুরোপুরিভাবে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হলে তারা ঠিক এই ভূমিকাটাই পালন করবে - যতটুকু প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ কৃষিক্ষেত্র পায়, সেটা প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে (কৃষিক্ষেত্রে ঋণ দিতে না চাওয়ার এই প্রক্রিয়া নয়া-উদারবাদী জমানায় বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে) এবং কৃষকের হাতে থাকা চাষ-আবাদকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার গতি দ্রুততর করে তোলার বিষয়টা নিশ্চিত করা হবে।
এই ধ্বংসের প্রভাব কেবলমাত্র অর্থনীতির আবর্তেই আটকে থাকবে না। আমরা আগেই বলেছিলাম যে, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের লক্ষ্যে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা ছিল দেশ গড়ে তোলার কর্মসূচির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ; আর দেশ গড়ে তোলার এই চিন্তাভাবনা জন্ম নিয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামের অংশ হিসাবে। আমাদের মতো দেশে পুঁজির আদিম পুঞ্জীভবন অর্থনীতিতে হানা দেওয়ার কারণে উচ্ছেদ হওয়া ছোটো ছোটো উৎপাদকদের শ্রমের সক্রিয় বাহিনীতে জায়গা করে দিতে পারবে না ধ্রূপদী পুঁজিবাদ। এমনকি ইয়োরোপের ক্ষেত্রেও সেটা ঘটেনি; তবে ‘নতুন পৃথিবী’র উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য গণহারে দেশ ছাড়ার হিরিক সামাজিক সঙ্কটকে ঠেকিয়ে দিতে পেরেছিল। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বেরিয়ে আসা ‘ব্যর্থ’ রাষ্ট্রগুলো আবার যেভাবে তাদের সাবেকি সাম্রাজ্যবাদী প্রভূদের পায়ে ধরার জন্য লাইন লাগিয়েছে, সেই লাইনে ভারত যদি দাঁড়াতে না চায়, তাহলে পুঁজির এই আদিম পুঞ্জীভবন প্রক্রিয়ার বিরোধিতা করতেই হবে; আর এই বিরোধিতার মধ্যে অবশ্যই থাকবে তিনটে কৃষি আইনের বিরোধিতা, ব্যাঙ্কগুলোকে বেসরকারিকরণের বিরোধিতা। এই বিরোধিতাই আজকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
অনুবাদঃ জয়দীপ ভট্টাচার্য