৫৮ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ৩০ জুলাই, ২০২১ / ১৩ শ্রাবণ, ১৪২৮
গড়ে উঠল তথ্যমিত্র কর্মীদের রাজ্য সংগঠন
ইন্দ্রজিৎ ঘোষ
সরকারের ঘোষণা ডিজিটাল ইন্ডিয়া। ভার্চুয়াল পরিষেবা, ই-গভর্নেন্স সার্ভিস, অনলাইন পরিষেবা আজকের দিনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লকডাউনের সময় আরো গুরুত্ব বেড়েছে।
কিন্তু যেটা বাস্তব, ভারতের বেশিরভাগ মানুষের ক্ষমতা নেই নিজের ডিজিটাল সার্ভিস নিজের করার। শহরের তুলনায় গ্রামীণ ক্ষেত্রে সমস্যা আরো গভীরে।
তাদের ভরসা 'কমন সার্ভিস সেন্টার' বা 'তথ্যমিত্র কেন্দ্র'। এই তথ্যমিত্র কেন্দ্রগুলির পরিকাঠামো কেমন? কীভাবে কাজ হয়? জনগণের তথ্যের নিরাপত্তা কতটা? লভ্যাংশ কোথায় যায়? সরকারের ভূমিকা কী? কেমন আছেন এই তথ্য মিত্র কেন্দ্রের কর্মীরা?
সবটাই আস্তে আস্তে জানার চেষ্টা করব।
সভ্যতার বিকাশের পথে কম্পিউটার আবিষ্কার প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটায়। কম্পিউটার তৈরির শুরুর দিকে গণনা বা হিসেব রক্ষণাবেক্ষণের কাজেই ব্যাবহার হতো। ইন্টারনেট ব্যবস্থা আবিষ্কার হওয়ার পর এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। যোগাযোগ ব্যাবস্থার গতি বাড়ে কয়েক হাজার গুণ। নতুন সুযোগ-সুবিধা মানুষ পেতে শুরু করে। বদলে যায় জগৎ।
১৯৮০ সালে আমেরিকাতে উন্নততর কম্পিউটার ব্যবস্থা কাজে লাগিয়ে Europe's Tele-Cottage and Community Technology Centres (CTCs) গড়ে ওঠে।
১৯৮৫ সালে ইউরোপের সুইডেনের গ্রামীণ এলাকায় Information and Communication Technologies (ICT) সুবিধাসম্পন্ন community গড়ে ওঠে এবং অনেকেই ব্যবহারের সুযোগ পেতেন।
G2C (Government 2 Citizen), B2C (Business 2 Citizen), Utility, Health, Tele-Medicine, Education ইত্যাদি পরিষেবা সহ আরও নতুন নতুন পরিষেবা শুরু হয়।
১৯৯০ সালে telecentres দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আফ্রিকা, এশিয়া, এবং ল্যাটিন আমেরিকাতে। সারা বিশ্বে যা “Telecentre Movement” হিসেবে উল্লেখিত হয়।
ভারতে “Telecentre Movement”
গ্রামীণ এলাকায় শুরু করার চেষ্টা চলতে থাকে ১৯৯২ সালে। কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবস্থা ভারতে চালু না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছিল না। ১৯৯৪ সালে ভারতে ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর পাকাপাকিভাবে চালু হয়। ১৯৯৮ সালেই ‘telecentre movement’-এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন পাইলট প্রজেক্ট শুরু হতে থাকে। মূলত কেন্দ্র সরকার, রাজ্য সরকার, এনজিও, এবং প্রাইভেট এজেন্সির মাধ্যমে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘‘জ্ঞনদ্যুৎ” মধ্যপ্রদেশে, ‘‘সারি’’ তামিলনাডুতে বুন্ডেলখণ্ডে “তারহাট’’। এছাড়াও, বিভিন্ন রাজ্য সরকার, এনজিও এবং প্রাইভেট এজেন্সিগুলির মাধ্যমে।
১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে ভারতের বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকায় “Telecentre Movement”-এর বিকাশ হতে থাকে। ২০০০ সালে ভারত সরকার প্রতিষ্ঠা করে Ministry of Electronics and Information Technology এবং ই-গভর্নেন্সের সার্ভিস। সর্বনিম্ন ১২-পয়েন্টের নূন্যতম অ্যাজেন্ডা চিহ্নিত হয়েছিল।
২০০৪ সালে মে মাসে Ministry of Electronics and Information Technology এবং Ministry of Panchayet Raj এর মধ্যে মউ স্বাক্ষরিত হয়। তার ফলশ্রুতিতে সমস্ত রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের Department of Panchayet and Rural Devalopment-এর অধীন SDA (State Designated Agency) স্বায়ত্তশাসিত নোডাল এজেন্সি করা হয়। যেমন পশ্চিমবঙ্গের Department of Panchayet and Rural Devalopment-এর আওয়তায় West Bengal State Rural Devalopment Agency (WBSRDA)। ২০০৩-২০০৪ অর্থ বছরে ১৯৬১ সালের সোসাইটি আইনে যুক্ত করা হয়।
তারপর, ২৫ নভেম্বর, ২০০৫ তারিখ ‘The Hindu’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয় ‘Mission 2007’।
১৫ আগস্ট, ২০০৭ তারিখের মধ্যে Department of Electronics and Information Technology, Government of India মিশন ঘোষণা করে সারা ভারতের গ্রামীণ এলাকায় ১ লক্ষ ICT (Information Communication Technology)-সুবিধাসম্পন্ন Community Service Centres চালু হবে।
১. AISECT ২. BASIX ৩. CMS ৪. Consortium of Tera Software ৫. NICT ৬. Spanco ৭. SREI-Sahaj ৮. UTL ৯. Zoom ১০. Times ১১. AID ১২. Sark ১৩. 3i 14. J&K Bank ১৫. Reliance ইত্যাদি বেসরকারি সংস্থাকে অনুমতি দেওয়া হয়।
পরে এই নিয়ে আলোচনা করব।
Service Centre Agency (SCA) হলো The Prime Driver। প্রত্যেকটি SCA প্রত্যেকটি রাজ্যের State Designated Agency (SDA) এবং NLSA (National Level Service Agency) দ্বারা পরিচালিত হয়। SCA (Service Centre Agency)-এর কাজ হলো CSC Scheme বাস্তবায়ন করা।
২০০৬ সালে SCA হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে SHREI-Sahaj ও Reliance এবং পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত দপ্তরের সহযোগিতায় বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু হয়।
২০০৭ সালের ২৬ জানুয়ারি “প্রজাতন্ত্র দিবসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে CSC (Common Services Centre Scheme) ঘোষণা করেন এবং প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থান ও বাড়তি ঝামেলা ছাড়াই সহজে পরিষেবা পাওয়ার বিষয়ে এই প্রকল্পের মাহাত্ম জনগণের সামনে তুলে ধরেন । ২০০৭ সালের মে মাসে CSC Scheme-এর জন্যে Department of Information Technology Government of India কর্তৃক Guidelines for Implementation of the Common Services Centers (CSC) Scheme in States প্রকাশিত হয়।
তারপর ১০ জুলাই ২০০৭ তারিখ পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত দপ্তরের WBSRDA-এর e-Governance Cell থেকে ‘সংবাদ বিবৃতি’ প্রকাশিত হয়।
২০০৮ সালে No.1518(8)/P&RD/Com/CSC/5M-8/04 তারিখ ২২.০২.২০০৮ উল্লেখিত অফিস মেমো নং-1718 তারিখ ০৭/০৩/২০০৭ NeGp (National e-Governance Plan)-এর অধীন ৬৭৯৭ টি ‘Common Service Centre’ বাংলায় বলা হলো 'তথ্যমিত্র কেন্দ্র'।
শুরুতে এই তথ্যমিত্র কেন্দ্রের জন্য সরকারি জায়গাতে (ব্লক অফিস, পঞ্চায়েত অফিস, লাইব্রেরি...) ১৫০ স্কোয়ার ফুট জায়গা, বিদ্যুৎ সংযোগ, ও ইন্টারনেট পরিকাঠামো ব্যাবস্থার দায়িত্ব ছিল সার্ভিস সেন্টার এজেন্সিগুলির।
যারা তথ্যমিত্র কেন্দ্রের কর্মী তাঁদের Telecenter Entrepreneurs course করিয়ে পরীক্ষা নিয়ে যুক্ত করা হতো। তাদের বলা হয় Village Lavel Entrepreneur (VLE). এদেরকে বিভিন্ন পোর্টালে ঢুকে কাজ করতে হয়। তাঁদের একটা আইডি ও পাসওয়ার্ড থাকে যেখান থেকে তাঁরা বিভিন্ন পোর্টালে কাজ করতে পারেন।
সে ক্ষেত্রেও প্রচুর সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে এই VLE-দের। কিন্তু সরকারের ঘোষণার পরও অনেক পোর্টালে ঢুকে কাজ করতে পারছেন না। আধার কার্ড বা বিভিন্ন ব্যাঙ্কিং সেক্টরের সহ অনেক কাজ করতে পারছেন না।
সরকার সারা দেশে ইন্টারনেট পরিকাঠামোর উন্নতির কথা ভাবছে না। প্রত্যন্ত গ্রামে অনেক তথ্যমিত্র কেন্দ্রে দিনের অনেক সময় ইন্টারনেট থাকছে না।
কাজ করার পর অনেক সময় কমিশন পাওয়া যাচ্ছে না। কম কমিশন দেওয়া হচ্ছে।
বেসরকারি সংস্থাগুলি লভ্যাংশের কারণে বেআইনিভাবে টার্গেট বেঁধে দিচ্ছে।
সাথে রাজনৈতিক প্রচার ‘মন কি বাত’-এর প্রচার করতে হবে বলে চাপ আসছে।
আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে সমস্যা আরো গভীরে।
আমাদের রাজ্যে রাজনৈতিক কারণে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পগুলির অন্য নামে রাজ্যের আলাদা পোর্টাল করা হয়। 'আয়ুস্মান ভারত' বাংলায় 'স্বাস্থ্যসাথি' হয়ে যায়। এমন অনেক উদাহরণ আছে।
রাজ্যের আলাদা পোর্টাল করা হয়, সেই পোর্টালগুলিতে তথ্যমিত্র কেন্দ্রের কর্মী ভিএলই-দের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। রাজ্য সরকার আলাদা করে বাংলা সহায়তা কেন্দ্র খুলেছে। কিন্তু পরিকাঠামো নেই। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে জনগণ। কাজ পাচ্ছেন না ভিএলই-রা।
দেশজুড়ে এই সময় এক রেশন কার্ড করার কাজ চলছে আমাদের রাজ্যে এই কাজ ঠিক হচ্ছে না। কারণ আমাদের রাজ্যে এই পোর্টাল অফ করে অন্য পোর্টাল খোলা হয়েছে।
রাজ্য সরকার আমাদের রাজ্যের তথ্যমিত্র কেন্দ্রের সাথে বৈমাত্রিক আচরণ করছে।
বিভিন্ন জায়গা থেকে উৎখাত করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হচ্ছে।
এক যন্ত্রণাময় পরিবেশ।
শুরুতে ভিএলই-দের একটা ভাতা দেওয়া হতো। বর্তমানে আর দেওয়া হয় না। এখন জম্মুকাশ্মীর বাদে আর কোথাও ভিএলই-দের ভাতা দেওয়া হয় না। এখন কমিশন ভিত্তিতে কাজ করতে হয়।
যদিও ভাতা পাওয়া আইনসঙ্গত, কারণ এই কেন্দ্র থেকে যা কাজ হয় তা আধার, ভোটার, প্যান, পাসপোর্ট, রেশন কার্ড... যাইহোক সেটা সরকারি কাজ। জনগণকে এই পরিষেবা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব। এই পরিষেবা দিতে গেলে সরকারের পরিকাঠামো, অফিস, লোক সব লাগত।
লোক লাগলে তার বেতন সামাজিক সুরক্ষা সব দিতে হতো। সরকার সুকৌশলে এই পরিষেবাগুলিকে আউটসোর্সিং করে সব দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। নূন্যতম দায়িত্ব নিচ্ছে না।
উল্টে এই কাজগুলি বেসরকারি হাতে ছেড়ে দিয়েছে। বেসরকারি হাতে ছাড়ার এক সমস্যা, এই কাজ করার জন্য কর্মীরা শোষিত হচ্ছে।
আর তার সাথে সারাদেশের জনগণের বিশাল ইনফরমেশন কর্পোরেটদের হাতে সরাসরি চলে যাচ্ছে। আমার আপনার যাবতীয় তথ্য, ব্যাঙ্ক ডিটেলস সব। আজকের যুগ, তথ্যের যুগ। যার কাছে যত তথ্য সে তত ধনী। তথ্য সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নগ্ন রূপ আজ সারা বিশ্ব দেখছে।
আর আমাদের দেশের সরকার সুকৌশলে কর্পোরেটদের প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে সেই কাজ করছে।
২জি কেলেঙ্কারি এমনি এমনি হয়নি।
কর্পোরেটরা একদিকে জনগণের থেকে লুট করছে, অন্য দিকে তথ্যমিত্র কেন্দ্রের কর্মী ভিএলই-দের তীব্র শোষণ করছে।
এমতাবস্থায় সারা বাংলার তথ্যমিত্র কেন্দ্রের কর্মীরা তীব্র আন্দোলনে নেমেছেন। গত ২২ মার্চে বিক্ষোভ মিছিল করা হয়। ডেপুটেশন দেওয়া হয় ন্যাশনাল ই গভর্নেন্স সার্ভিসের নোডাল এজেন্সি সি এস সি ই-গভর্নেন্স সার্ভিস ইন্ডিয়া লিমিটেড এর দপ্তরে।
গত ২৪ জুলাই সিআইটিইউ রাজ্য দপ্তর শ্রমিক ভবনে কনভেনশন করা হয়। তৈরি করা হয় তথ্যমিত্র কেন্দ্রের কর্মী ভিএলই-দের প্রথম রাজ্য সংগঠন। সারা ভারতে এই প্রথম কোনো রাজ্যে এই ফিল্ডে এভাবে সংগঠিত ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি হলো।
আগামী ১১ আগস্ট সংগঠনের পক্ষ থেকে রাজ্য সরকারের নোডাল এজেন্সি পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত দপ্তরের WBSRDA-এর ই- গভর্নেন্স সার্ভিস সেন্টারে ডেপুটেশন দেওয়া হবে।
দাবিগুলি হল -
১) কেন্দ্রীয় সরকারের সব প্রকল্প সব পোর্টাল এই রাজ্যের জন্য চালু করতে হবে।
২) তথ্যমিত্র কেন্দ্রের কর্মীদের অবিলম্বে বেতন, সামাজিক সুরক্ষা (পিএফ, ইএসআই, বোনাস...) চালু করতে হবে।
৩) কোনো সেন্টার উৎখাত করা যাবে না।
৪) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সমস্ত প্রকল্প প্রাইভেট এজেন্সির হাতে নয়, সরকারের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। জনগণের সমস্ত তথ্য কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না।
৫) বিনা পরীক্ষায় বিনা ট্রেনিংয়ে কাউকে ভিএলই করা যাবে না৷ এবং এরিয়া ভিত্তিতে ফর্মুলা মেনেই নূতন ভিএলই নিয়োগ করতে হবে।
৬) টার্গেটে বেঁধে চাপ সৃষ্টি চলবে না।
৭) প্রকল্পগুলির কাজের কমিশন কী হবে তা ভিএলই-দের সাথে আলোচনা করে করতে হবে। আর সারা দেশে কমিশনের হার এক হতে হবে।
৮) নূতন প্রকল্প আসলে দ্রুত ট্রেনিংয়ের ব্যাবস্থা করতে হবে।
সংগঠন নূতন লড়াইয়ের ময়দানে। অভিজ্ঞতা হয়তো কম, কিন্ত জেদ আছে অদম্য। তাই দাবি আদায়ে জান কবুল লড়াই চলবে।