E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৫০ সংখ্যা / ৩০ জুলাই, ২০২১ / ১৩ শ্রাবণ, ১৪২৮

শতবর্ষের আলোকে কমরেড গুণাধার চৌধুরী

সুবিকাশ চৌধুরী


বাঁকুড়া জেলায় কৃষক আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কমরেড গুণাধার চৌধুরী ছিলেন একজন প্রথম সারির সৈনিক। বিশেষত, সিপিআই(এম) পার্টির প্রতিষ্ঠালগ্নে যে পাঁচজন কমরেড জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন তিনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত পৃথিবী ও পরাধীন ভারতবর্ষে যখন সাধারণ মানুষের দুর্দশা সীমাহীন ঠিক সেই সময়েই ১৯২১ সালের ১৭ জুলাই বাঁকুড়া জেলার জয়পুর থানার অন্তর্গত এক প্রত্যন্ত গ্রাম গাজীপুরে (মাগুরা) তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে। পিতা দুর্গাদাস চৌধুরী ও মাতা গৌরী দেবী। এ বছরের ১৭ জুলাই তাঁর জন্মের শতবর্ষ দিবস। গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করার পূর্বেই তাঁর জীবনে নেমে আসে এক চরম বিপর্যয়। মাত্র আট বছর বয়সেই পিতৃহারা হন। শুরু হয় জীবনের টানা পোড়েন। মামার বাড়ি বৈতলে নিয়ে গিয়ে তাঁকে জুনিয়র হাইস্কুলে ভরতি করা হয়। এবং পরবর্তীতে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার জন্য পাঠানো হয় জ্যাঠতুতো দিদির বাড়ি পুরুলিয়ায়। তখন থেকেই দেশের স্বাধীনতার জন্য কংগ্রেসের নেতৃত্বে যেখানে সভা হতো লুকিয়ে সেই সব সভা সমিতিতে চলে যেতেন। সেই সময় বিদেশি দ্রব্য বয়কট আন্দোলনে যোগ দিয়ে পরীক্ষা না দিয়ে গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। প্রথাগত শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে। জীবিকার সন্ধানে শুরু হয় জীবনের বিভিন্ন পেশায় যোগদান। ১৯৩৭ সালে জীবিকার সন্ধানে কলকাতায় এসে এক দোকানে কাজ শুরু করেন। সুভাষচন্দ্র বসুর ওয়েলিংটন স্কোয়ারে জনসভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য শুনে শুরু করেন খদ্দরের জামা, ধুতি ও গান্ধী টুপি পরিধান। দোকানের কাজ অপেক্ষা সভা সমিতিতে যোগদান করাতেই তাঁর আকর্ষণ তখন বেশি। কলকাতাতেও বেশিদিন থাকা সম্ভব হয়নি। তিনি গ্রামে ফিরে আসেন।

১৯৩৯ সালে শুরু হয় আর এক নতুন জীবন। জ্যাঠামশাইয়ের কর্মসূত্রে বিষ্ণুপুরে থাকার কারণে তাঁকেও নিয়ে আসা হয় বিষ্ণুপুরে। জ্যাঠতুতো দাদার কাঠগোলায় কাজে নিয়োগ করা হয়। সেই সময়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে এক নং ক্যাম্পে অ্যারোড্রাম তৈরির জন্য বিভিন্ন জিনিসপত্র সরবরাহের কাজে তাঁকে যুক্ত করা হয়। ওই সময়েই বিষ্ণুপুরে তদানীন্তন কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে যোগাযোগ গড়ে ওঠে। এই কারণে কাজ অপেক্ষা বহির্জগতের প্রতি টান বাড়তে থাকে। জ্যাঠার মৃত্যুর কারণে পুনরায় গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসেন। ১৯৪১ সালে তাঁকে বাড়িতে আটকে রাখার জন্য বিয়ে দেওয়া হয়।

গ্রামের বাড়িতে থেকেই শুরু করেন একদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনের এবং অন্যদিকে গ্রামকে গড়ে তোলার জন্য বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্ম। যেমন পাশের গ্রাম পড়াইরিতে প্রাইমারি স্কুল না থাকায় সেখানে অবৈতনিক স্কুল এবং তাতে স্বেচ্ছায় শিক্ষাদান। ব্যায়ামাগার তৈরি, যাত্রাদল গড়ে তোলা, পোস্ট অফিস তৈরির প্রচেষ্টা, গ্রামে হাসপাতাল তৈরির মতো বিভিন্ন উদ্যোগ। পোস্ট অফিস তৈরি করার জন্য অভিনব প্রচেষ্টা। পোস্ট অফিস হতে পারে যদি গ্রামে চিঠিপত্র আদান প্রদান বেশি হয়। চিঠিপত্রের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন নামে পোস্টকার্ড লিখে দূরের পোস্ট অফিসে ফেলে আসা শুরু করলেন কয়েক জন মিলে। এভাবে একটি অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া এলাকায় এক এক করে গড়ে তুলেছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আজকের দিনে যা অভাবনীয়। বিদ্যুৎ, পাকারাস্তাবিহীন, যোগাযোগহীন গ্রামেই গড়ে উঠেছিল এভাবেই প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। পরবর্তীকালে লাইব্রেরি, উচ্চমাধ্যমিক স্কুল সহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে তিনি আমৃত্যু যুক্ত ছিলেন।

১৯৪৫ সালে তাঁর স্ত্রীর অকস্মাৎ মৃত্যু তাঁকে বিচলিত করে তোলে। একটি ছোটো চিরকুট লিখে দিয়ে তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে যান। প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় তিনি পুরী, মাদ্রাজ, মুম্বাই হয়ে ওয়ার্ধাতে গান্ধীজির আশ্রমে গিয়ে হাজির হন। সেখানে তিনি স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা নেন। প্রায় একবছর সেবাগ্রামে কাটানোর পর তাঁকে কলকাতায় যেতে বলা হয়। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের আশ্রমে কলকাতায় থেকে প্রত্যক্ষ করেন ১৯৪৬ সালের ভ্রাতৃঘাতী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। সেখানেও স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকা পালন করেন। একদিকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই আর অন্যদিকে সারা বাংলা জুড়ে উত্তাল তেভাগার আন্দোলন, খবর আসে তাঁর মেজ ভাইয়ের অজানা জ্বরে অকস্মাৎ মৃত্যুর। কলকাতা থেকে বাড়ি ফেরার উদ্দেশে হাওড়া স্টেশনে এসে বাড়ির পথে না এসে চড়ে বসেন লুধিয়ানাগামী ট্রেনে এবং লুধিয়ানাতে রেলে কর্মরত তাঁর এক জামাইবাবু তাকে রেল দপ্তরের কাজে নিয়োগ করে দেন। সেখানেও তিনি স্বাধীনতার পূর্বশর্ত ভারত ভাগের এক অসহনীয় দৃশ্য দেখেন। দাঙ্গা বিধ্বস্ত, রক্তাক্ত মানুষ পাকিস্তান থেকে পাঞ্জাবে আসছেন। এই বীভৎসতার মধ্যে লুধিয়ানাতেই দেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করেন।

১৯৪৮ সালে মায়ের অসুস্থতা আর তাঁকে গৃহছাড়া অবস্থায় থাকতে দেয়নি। পুনরায় গ্রামে ফেরেন এবং মা সুস্থ হয়ে ওঠার পর পুনরায় বিষ্ণুপুরে তেলকলের কাজে যোগ দেন। কর্মসূত্রে দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করতে হতো মালপত্র কেনাবেচার জন্য। সেই কারণে স্বাধীনতার বর্ষপূর্তিতে দিল্লিতে জওহরলাল নেহরুর বক্তব্য শোনার সুযোগ ঘটে। ওই বছরই তেলকলের কাজ ছেড়ে দিয়ে এক বন্ধুর সাথে বিষ্ণুপুরে ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু তাও বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৪৯ সালের জুন মাসে তাঁর দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়। ওই সময় জগন্নাথপুর অঞ্চল জুড়ে কৃষক খেতমজুরদের প্রবল আন্দোলন স্বাধীন ভারতের গরিব মানুষের অসহনীয় অবস্থা ও জমিদারদের অবর্ণনীয় পীড়নের বিরুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে উত্তাল কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয় দিকে দিকে। গড়বেতার সন্ধিপুরে, বিষ্ণুপুরে বাঁধগাবায় ইতিমধ্যে কৃষক আন্দোলনে পুলিশের গুলি চালনায় গরিব খেতমজুরদের মৃত্যুর খবর স্ফূলিঙ্গের মতো ছড়িয়ে পড়ে চারিদিকে। ওই সময়েই জগন্নাথপুরে ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪৯ সালে কৃষক আন্দোলনেও পুলিশের গুলিতে কমরেড হানু লায়েক ও কমরেড গোবর্ধন মহাদণ্ডের মৃত্যু কমরেড গুণাধার চৌধুরীর মনে স্বাধীনতার ও কংগ্রেস সম্পর্কে মোহভঙ্গ হয়। ওই সময়েই আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট নেতা কমরেড মৃত্যুঞ্জয় ব্যানার্জি, কমরেড বিমল সরকার ও কমরেড মানিক দত্তের সাথে যোগাযোগ করেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হন। তাই ‘‘হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোন খানে’’ - করতে করতে জীবনের সঠিক পথটি বেছে নিতে ভুল করেননি যুবক কমরেড গুণাধার চৌধুরী। আর যেহেতু কংগ্রেসী কর্মী হিসাবে বিভিন্ন গ্রামে ছাত্র-যুব ও অন্যান্যদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল তাই কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে সংগঠন গড়ে তুলতে তা সাহায্য করেছিল।

১৯৫০ এর শেষের দিকেই কমরেড মৃত্যুঞ্জয় ব্যানার্জি তাঁকে পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত করে কৃষকসভার কাজে নিযুক্ত করেন। এই ঘটনাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৯৫২ সালের সাধারণ নির্বাচনে কমিউনিস্ট প্রার্থীর হয়ে অভাবনীয় প্রচার সংগঠিত করেন। সাইকেলে চেপে বিষ্ণুপুর মহকুমার বিভিন্ন থানা এলাকায় এই সময়ে কৃষক, খেতমজুরদের সংগঠিত করার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

১৯৫৬ সালে বঙ্গ-বিহার সংযুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি তাঁর মা, অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, বিধবা ভ্রাতৃবধূ সহ অন্যান্য মহিলাদের নিয়ে পায়ে হেঁটে এসে বিষ্ণুপুরে আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে তাঁর এক মাসের ও মহিলাদের ১৫দিনের জেল হয়, স্ত্রীকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই কয়েক বছরেই তাঁর অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তি ও মানসিক দৃঢ়তার কারণে তাঁকে ১৯৫৭ সালেই জেলা কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয় এবং সর্বক্ষণের কর্মী করা হয়।

১৯৫৮ সালে জেলা কৃষক সমিতির সম্পাদক নির্বাচিত হন। এবং পরে কৃষক সভায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বে আসেন এবং সেই থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি ৩১ বছর কৃষক সভার বাঁকুড়া জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।

দেশ স্বাধীন হলেও গরিব মানুষের জীবনের দুর্দশা ক্রমবর্ধমান। খাদ্যের নিদারুণ অভাব। কৃষক সভার উদ্যেগে খাদ্যের দাবিতে রাজ্যব্যাপী আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। বাঁকুড়া জেলাতেও ১৯৫৯ সালের খাদ্য ও কাজের দাবিতে আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে। বিষ্ণুপুরে সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আইন অমান্য করায় আবার তাঁর এক মাসের কারাবাস হয়।

বাঁকুড়া জেলা ছিল খরা পীড়িত জেলা। প্রায় প্রত্যেক বছরই খরা পরিস্থিতির কারণে খাদ্যাভাব লেগেই থাকত। কোনো সেচ প্রকল্প না থাকায় কৃষি ছিল প্রধান উপজীবিকা। ওই বৎসরই ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত নেয় যে, কংসাবতী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলাধার নির্মাণ করবে। কিন্তু জলাধার নির্মাণের জন্য যে অসংখ্য মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়বেন তাঁদের দিকে কোনো ধ্যান ছিল না। বিনা ক্ষতিপূরণে জমি অধিগ্রহণ করে বাঁধ নির্মাণ শুরু করে। গৃহহীনদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে জেলা কৃষক সভার নেতৃত্বে ব্যাপক আন্দোলন সংগঠিত হয়। কমরেড গুণাধার চৌধুরীর জীবনে কংসাবতী আন্দোলন নতুন মাত্রা যোগ করে। কমরেড জলেশ্বর হাঁসদাকে সম্পাদক করে কংসাবতী জলাধার প্লাবিত আঞ্চলিক কমিটি তৈরি করে আন্দোলন পরিচালনা করেন। জেলা পার্টির পক্ষ থেকে তাঁকেই এই আন্দোলনের মূল দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। দক্ষিণ বাঁকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় কৃষক, খেতমজুরদের সংগঠিত করতে সাইকেলে করে ঘুরে বেরিয়েছেন। আদিবাসী ভাষা শিক্ষা ও তাঁদের বাড়িতে থেকে তাঁদের জীবনের সাথে একাত্ম হয়ে ওই আন্দোলন সফলতা পেয়েছিল এবং এই আন্দোলনের প্রভাবেই প্রথম দক্ষিণ বাঁকুড়ায় বিধানসভা কেন্দ্রে ১৯৬২সালে কমরেড জলেশ্বর হাঁসদা সিপিআই(এম) প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন, শুধু তাই নয় বর্তমান সিপিআই(এম) জেলা দপ্তরটি শহরের বিড়ি শ্রমিকদের সাহায্যে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। কারণ ওই সময়ে শহরের অধিকাংশ পার্টি নেতৃত্ব সিপিআই দলে যোগ দিয়েছিলেন। পার্টির অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে তিনি ছিলেন আদর্শে অবিচল ও আপসহীন। সেই সময়েই গোপনে কাকাবাবুর সাথে যোগাযোগ করেন ও তাঁর নির্দেশমতো আসানসোলে কমরেড বিনয় চৌধুরীর ও পুরুলিয়ায় কমরেড নকুল মাহাতোর সাথে যোগাযোগ করে জেলা পার্টিকে পরিচালনা করতে ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হয়ে গেলে তিনি সিপিআই(এম)-এ যোগ দেন। রাজ্য ও জেলা নেতৃত্ব প্রায় সকলেই গ্রেপ্তার হলেও তিনি এক বছর দাড়ি গোঁফ রেখে আত্মগোপন করেছিলেন। এই সময়ে তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য প্রায় প্রতিদিনই তাঁর বাড়িতে রাতেরবেলায় পুলিশ ঘিরে ফেলত এবং তল্লাশি চালাত। এক বছর গ্রামের ও অন্যান্য জায়গায় তিনি পুলিশের চোখ এড়িয়ে নিজেকে আত্মগোপনে রাখতে পেরেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৬৫ সালে তিনিও গ্রেপ্তার হন এবং দেড় বছরের অধিক বর্ধমান জেলে অন্যান্য ২৬ জন নেতৃত্বের সাথে আটক রাজবন্দী হিসাবে কারাবাসে ছিলেন।

জেল থেকে ছাড়া পেয়েই পুনরায় নতুন উদ্যমে জেলাতে পার্টিকে শক্ত ভিতের ওর গড়ে তুলতে আরও বেশি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। কারণ জেলে কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙার সহ অন্যান্যদের সাহচর্য তাঁকে আরও বেশি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শিক্ষায় পরিপুষ্ট করে গড়ে তোলে।

১৯৭০-৭৭ অধ্যায় কারোরই অজানা নয়। এই সময়ে গোপনে পার্টি ও কৃষক সভার কাজ পরিচালনা করতে হয়েছে এবং এরকমই একটি গোপন সভায় ইন্দাসের কুশমুন্ডি গ্রাম থেকে তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ১৯৭১-এ পুলিশের নির্মম শারীরিক অত্যাচারে তাঁর একটি পায়ের হাঁটু প্রায় অকেজো। তার ফলে হাঁটুর যন্ত্রণা তাঁকে যতদিন জীবিত ছিলেন সহ্য করতে হয়েছিল। কিন্তু কোনোদিন কারোর কাছে অভিযোগ জানাননি। অসম্ভব সহ্য ক্ষমতা ও কষ্টসহিষ্ণু ছিলেন তিনি। জরুরি অবস্থার সময়ও তাঁকে লুকিয়ে থাকতে হয়েছিল।

১৯৭৭ ও ১৯৮২ সালে দু’বার বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন কোতুলপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে। বিধানসভার সদস্য হিসাবেও তাঁর ভূমিকা ছিল এলাকার উন্নয়নের জন্য সোচ্চার হওয়া এবং সফলভাবে ভূমিসংস্কার আইনকে কার্যকর করার জন্য কৃষক সভাকে পরিচালনা করা।

১৯৮৮ সালে তৎকালীন জেলা সম্পাদক কমরেড অশ্বিনীরাজের মৃত্যুর কারণে পার্টির জেলা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সফলতার সাথে। রাজ্য কমিটিরও সদস্য হন। ১৯৯৫ সালে শারীরিক কারণে জেলা সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি নেন, কিন্তু আমৃত্যু জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষক সভার নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করে গেছেন।

২০০০ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে তাঁর জীবনাবসান হয়। কিন্তু তিনি তাঁর সমগ্র পরিবারকে বামপন্থী আদর্শে দীক্ষিত করে গেছেন। বর্তমানেও তাঁর পরিবারের সকল সদস্যই বামপন্থী সমর্থক ও কর্মী হিসাবেই পরিচিত। গ্রামের বাড়ির বাইরে জেলা কেন্দ্রের কমিউনেই মৃত্যুর দু’মাস আগে অসুস্থ হওয়া পর্যন্ত কাটিয়ে গেছেন এবং সকলের সাথে একইভাবে থাকা খাওয়াতে অভ্যস্ত ছিলেন।

তাঁর জীবন ছিল অত্যন্ত সহজ সরল ও অনাড়ম্বর। ছিলেন অত্যন্ত শৃঙ্খলা পরায়ণ। পার্টির অভ্যন্তরীণ বিষয় যে বাইরে আলোচনা করা যায়, তা ছিল তাঁর কাছে কল্পনাতীত। পার্টি শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নে তিনি ছিলেন কঠিন ও অনমনীয়। আত্মপ্রচার বিমুখ, আদর্শে অবিচল, জনদরদী, সৎ, কোমল হৃদয়, নিষ্ঠাবান এক বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী। ছিলেন পার্টির একজন অত্যন্ত বাগ্মী প্রচারক। গরিব, খেটে খাওয়া মানুষের প্রকৃত বন্ধু। শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতার কারণে শ্রেণি শত্রুর মোকাবিলা করতে তাঁর নির্ভীকতা বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষণীয়। এরকম একজন কমিউনিস্ট কর্মীর শতবর্ষের আলোকে তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা নিঃসন্দেহে বর্তমান কঠিন সময়ে পার্টিকে পরিপুষ্ট করবে।