৬০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ৩০ জুন, ২০২৩ / ১৪ আষাঢ়, ১৪৩০
দেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে রক্ষা করাই এই সময়ে প্রধান কাজ
গড়ে তুলতে হবে বিরোধীদের পারস্পরিক সহযোগিতা ও জাতীয় স্তরে যৌথ আন্দোলন
দিল্লিতে সাংবাদিক সম্মেলনে ইয়েচুরি।
দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক চরিত্রকে রক্ষা করতে বিরোধী দলগুলির পারস্পরিক সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় স্তরের ইস্যুগুলিতে যৌথ প্রচার এবং আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এখন থেকেই রাজ্যস্তরে বিরোধী দলগুলিকে আলোচনা শুরু করতে হবে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে যাতে বিজেপি যেন ভোট ভাগাভাগির সুবিধা না পায়। গত ২৪ ও ২৫ জুন নয়াদিল্লিতে সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় দপ্তর একেজি ভবনে পলিট ব্যুরো’র বৈঠকের পর এক বিবৃতিতে এই বিষয়গুলি তুলে ধরা হয়েছে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রণে গত ২৩ জুন অনুষ্ঠিত বিরোধী দলগুলির নেতৃবৃন্দের বৈঠকে উত্থাপিত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক অধিকার এবং মৌলিক অধিকারের সাংবিধানিক নিশ্চয়তাকে সুরক্ষিত রাখার প্রসঙ্গগুলি বৈঠকে আলোচিত হয়েছে। মণিপুরের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মোদী সরকারের ব্যর্থতার তীব্র সমালোচনা করে বলা হয়েছে, অবিলম্বে হিংসা বন্ধ করে স্বাভাবিক পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার করতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাসকে প্রতিহত করে মানুষের পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠায় জনগণের সাহসিকতার সঙ্গে লড়াইয়ের কথাও বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
মণিপুরের পরিস্থিতি
গত ২৪ ও ২৫ জুন নয়াদিল্লিতে সিপিআই(এম)’র কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর একেজি ভবনে পলিট ব্যুরোর এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই বৈঠকের আলোচনার ভিত্তিতেই এদিন এই বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোদী সরকারের ব্যর্থতার কড়া সমালোচনা করা হয়েছে। পলিট ব্যুরো এই প্রসঙ্গে বলেছে, মণিপুরের পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগজনক। গত ৭ মে থেকে সাত সপ্তাহ ধরে ওই রাজ্যে জাতি সংঘর্ষ চলছে। বিজেপি’র ডবল ইঞ্জিন সরকার সেই সংঘর্ষ থামাতে পুরোপুরি ব্যর্থ। এমনকী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওই রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো মন্তব্যও করেননি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ওই রাজ্যে গিয়েছেন ২৯ মে, হিংসাত্মক সংঘর্ষ শুরু হওয়ার পুরো ২৬ দিন পরে। তারও কোনও প্রভাব পড়েনি রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকও নিষ্ফল হয়েছে। কারণ, রাজ্যে বীরেন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন অবৈধ কাজের সহযোগী বিজেপি সরকার পরিস্থিতি সামলাতে অযোগ্য বলে নিজেকে প্রমাণ করলেও মোদি সরকার ওই সরকারকে বরখাস্ত করার দাবি মানতে রাজি হয়নি।
মোদির আমেরিকা সফর
বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক আমেরিকা সফর সম্পর্কে বলা হয়েছে, এই সফরে আমেরিকা ভারতকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ‘জুনিয়র পার্টনার’ হিসাবে আরও জোরালো বন্ধনে যুক্ত করেছে। আগের সামরিক ও প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলি অনুসরণে এবার জিই-এফ ৪১৪ জেট ইঞ্জিনের যৌথ উৎপাদনের চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে, যা ভারতকে প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমেরিকার ‘বৃহৎ সহযোগী দেশে পরিণত’ করবে। বিশ্বে নিজের আধিপত্যকে শক্তিশালী করতে ভারতকে কৌশলগত অবস্থান ও সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসাবে পেতে চায় আমেরিকা, যার আসল উদ্দেশ্য চীনকে বিচ্ছিন্ন করা। তার জন্য মোদির এই সফরে ভারতে বিজেপি সরকারের আমলে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র লঙ্ঘনের ঘটনাগুলি নিয়ে কোনো কথা তোলেনি বাইডেন প্রশাসন, যা প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে। এমনকী প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা পর্যন্ত এগুলি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। মার্কিন কংগ্রেসের (সংসদ) ৭৫ জন সদস্যও মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের প্রশ্নে মোদি সরকারের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন।
অভিন্ন দেওয়ানি বিধি
বিবৃতিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে তৎপরতার বিরোধিতা করে পলিট ব্যুরো বলেছে, এই বিষয়ে ফের আলোচনা শুরু করেছে বর্তমান (২২তম) আইন কমিশন। অথচ এর আগের আইন কমিশন (২১তম) বিষয়টি নিয়ে নানা পর্যায়ে আলোচনা করে ২০১৮ সালেই বলেছিল, ‘‘এখন অভিন্ন দেওয়ানি বিধির না প্রয়োজন আছে, না এই বিধি কাম্য।’’ সিপিআই(এম) এই অবস্থানকে সমর্থন করে। অভিন্নতা আর সমতা এক নয়। পার্টি সমস্ত সম্প্রদায়ের মহিলাদের সমানাধিকারের পক্ষে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ব্যক্তিগত ও প্রথাগত আইনগুলিকে সংস্কারের মাধ্যমেই সেই লক্ষ্যে সব থেকে ভালভাবে এগিয়ে যাওয়া যেতে পারে, যে প্রক্রিয়ায় ওই সম্প্রদায়গুলির সমস্ত মহিলা ও পুরুষের সক্রিয় গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ থাকবে।
অর্থ লুটকে বৈধতা
সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাংক বৃহৎ ঋণখেলাপীদের বিশেষ ছাড় দেওয়ার যে নীতি ঘোষণা করেছে, পলিট ব্যুরো তারও জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিবৃতিতে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক সার্কুলারে ব্যাংকে জমানো জনগণের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের লুটকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিরাট অঙ্কের ঋণ নিয়ে শোধ দেওয়ার ক্ষমতা থাকলেও অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে তা পরিশোধ করেননি। রিজার্ভ ব্যাংকের সার্কুলারে এই সব ঋণখেলাপীকে সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্কের সঙ্গে এককালীন অর্থের বিনিময়ে আপস মীমাংসায় যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। অবিলম্বে রিজার্ভ ব্যাংককে এই সার্কুলার প্রত্যাহার করতে হবে, সমস্ত ঋণখেলাপীর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং ব্যাংকের পাওনা অর্থ সম্পূর্ণ পরিমাণে আদায় করতে হবে।
চালের জোগান, স্মার্ট মিটার
বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো কেন্দ্রের কাছে দাবি জানিয়েছে, আগের মতোই রাজ্যগুলিকে চাল সরবরাহ শুরু করতে হবে এবং বাতিল করতে হবে বিদ্যুতে প্রি-পেইড স্মার্ট মিটার প্রকল্প। পলিট ব্যুরো বলেছে, রাজ্যগুলিকে চাল বিক্রি না করার জন্য এফসিআই-কে নির্দেশ দিয়েছে মোদি সরকার। এই নির্দেশে মোদি সরকারের স্বেচ্ছাচারিতা ও অগণতান্ত্রিক আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলি সাধারণ মানুষকে কিছুটা রেহাই দেওয়ার জন্য যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, সেগুলি পালনে বাধা দেওয়াই এই নির্দেশের লক্ষ্য। পলিট ব্যুরো আরও বলেছে, মোদি সরকার বিদ্যুৎ গ্রাহকদের জন্য প্রি-পেইড ব্যবস্থার যে স্মার্ট মিটার প্রকল্প রূপায়ণের উদ্যোগ নিয়েছে, এখনই তা বাতিল করতে হবে। বহু রাজ্যকে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বাধ্য করা হচ্ছে। এভাবে সরকার বিদ্যুৎ বণ্টনের দায়িত্ব থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে তা বেসরকারি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীগুলির হাতে তুলে দিতে চাইছে, যাতে তাদের সর্বোচ্চ মাত্রায় মুনাফা হয়। গরিব মানুষ ও কৃষকদের উপর অসহনীয় বোঝা চাপিয়ে দেবে এই প্রকল্প।
কুস্তিগীরদের প্রতিবাদ
মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হেনস্তার ঘটনায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার যেভাবে অভিযুক্তকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে, পলিট ব্যুরো তার কড়া নিন্দা করেছে। বিবৃতিতে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, দেশের মহিলা কুস্তিগীররা বিজেপি’র এক সাংসদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার যে অভিযোগ তুলেছেন, তার প্রাথমিক তথ্যপ্রমাণ থাকলেও নির্লজ্জভাবে ওই অভিযুক্তকে আড়াল করতে ব্যস্ত মোদি সরকার এবং বিজেপি। পকসো সহ একাধিক আইনের ধারায় অভিযোগ দায়ের হলেও বিজেপি সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে তদন্তকে শ্লথ করেছে, যাতে অপ্রাপ্তবয়স্ক নির্যাতিতাকে চাপ দিয়ে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করাতে পারে অভিযুক্ত। অপ্রাপ্তবয়স্করা যেখানে যৌন নির্যাতনের শিকার, তেমন সব ঘটনায় এর গুরুতর প্রভাব পড়বে। অবিলম্বে অভিযুক্ত সাংসদকে গ্রেপ্তার করতে হবে।
আসামে আসন পুনর্বিন্যাস, স্বাস্থ্য সমীক্ষা
বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো ২০০১ সালের জনগণনার রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০২৩ সালে আসামে বিধানসভার আসন পুনর্বিন্যাসের বিরোধিতা করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশন এই পুনর্বিন্যাসের জন্য কোনো পৃথক কমিশন গঠন করেনি। রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি’র রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে সহায়তা করতেই কমিশন এই উদ্যোগ নিয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচন
পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলি বড়ো আকারের হিংসা এবং সন্ত্রাস দ্বারা চিহ্নিত করাই রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলতি পঞ্চায়েত নির্বাচনে ইতিমধ্যেই একজন তরুণ সিপিআই(এম) কর্মী মনসুর আলম, সহ ১০ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এত হিংসা এবং সন্ত্রাসের রাজনীতি সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষ গণতন্ত্রের এই হত্যাকাণ্ডকে প্রতিহত করছে এবং সাহসিকতার সঙ্গে জনগণের পঞ্চায়েত প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে নজিরবিহীন সন্ত্রাসের কারণে ৩৪ শতাংশ আসন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিস্পত্তি হয়। এবারের নির্বাচনে, এই ধরনের সন্ত্রাসকে প্রতিহত করে, প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন আসনগুলির সংখ্যা ব্যাপকভাবে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কমানো গেছে।
এনএফএইচএস-৬ সমীক্ষায় প্রতিবন্ধকতা সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি
একইসঙ্গে পলিট ব্যুরো ষষ্ঠ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা থেকে প্রতিবন্ধকতা সংক্রান্ত প্রশ্ন বাদ দেওয়ার পদক্ষেপের প্রতিবাদ জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এর আগের অর্থাৎ পঞ্চম দফার সমীক্ষায় এই সংক্রান্ত প্রশ্ন ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এবার তা পুরোপুরি বাদ দেওয়া হলো, যা একটি পশ্চাদমুখী পদক্ষেপ। ষষ্ঠ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় ওই প্রশ্নকে যুক্ত করতেই হবে। বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির পরবর্তী বৈঠক হবে নয়াদিল্লিতে, আগস্টের ৪ তারিখ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত।