E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ৩০ জুন, ২০২৩ / ১৪ আষাঢ়, ১৪৩০

পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০২৩

তৃণমূল-বিজেপি’র ভাঁওতা ধরে ফেলেছেন উত্তরবঙ্গের জনজাতি মানুষ

কিশোর দাস


৮ই জুলাই ২০২৩, পশ্চিমবঙ্গের দশম পঞ্চায়েত সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন আর ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন এক নয় তা মনোনয়নপর্বে শাসক তৃণমূল দল উপলব্ধি করতে পেরেছে। বিজেপি বুঝে গেছে এবারের পঞ্চায়েত ভোটে ২০১৪-২০২১ সালের নির্বাচনগুলির মতো হিন্দুত্ববাদ, মিথ্যাচার, ছলচাতুরী জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। মিথ্যাচার, প্রতিশ্রুতি, প্রলোভন, ভয়ভীতি, দৈহিক আক্রমণ, পুলিশ দিয়ে অত্যাচার, মিথ্যা মামলা ইত্যাদি গত ১১ বছর ধরে বিরোধীদের বিশেষকরে সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীদের উপরে অত্যাচার, খুন-সন্ত্রাস সংগঠিত করে গরিব মানুষকে সন্ত্রস্ত করে ভয়ের চাবুকে তৃণমূলের প্রতি আনুগত্য দেখানোর পরিবেশ রাজনীতিকে বহাল রাখতে চাইছে তৃণমূল। গ্রাম বাংলার বাস্তব চিত্রটা এই মুহূর্তে ঠিক সেই জায়গায় অবস্থান করছে না। পঞ্চায়েত ভোট ঘোষণার বহু আগে থেকেই গ্রামের গরিব মেহনতি মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত মনোভাব রাজ্যজুড়েই পরিলক্ষিত হয়েছে। লুঠের পঞ্চায়েত নয় - এবারে চাই দুর্নীতিমুক্ত মানুষের পঞ্চায়েত। অন্যদিকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করে দেশজুড়ে হিন্দুত্বের তাস ব্যবহার করে আরএসএস তার প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পরে নিজেদের উত্থান ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।

আরএসএস-বিজেপি দেশে সরকার গড়ে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে ক্রমশ মরিয়া হয়ে উঠেছে। তৃণমূল রাজত্বে পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস’র, সক্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে বহুলাংশে। রাজ্যে তৃণমূল সরকার নিজেদের সুবিধামতো সাম্প্রদায়িক কার্ড ব্যবহার করছে। রাজ্যে তৃণমূল-বিজেপি’র বোঝাপড়ার রাজনৈতিক বন্ধুত্ব চলছে। আর তার ভিত্তিতেই পশ্চিমবঙ্গে দ্বিদলীয় রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া উভয় দল এবং ধর্ম-সম্প্রদায় ইত্যাদির মধ্য দিয়ে উত্তরের জেলাগুলিতে জাতি-জনজাতি, দলিত সম্প্রদায়ের বিভেদের রাজনীতিকে ব্যবহার করে এসেছে প্রতিটি নির্বাচনে এবং সাম্প্রতিককালের নির্বাচনগুলিতে তারা সাফল্যও পেয়েছে।

বিজেপি উদারনীতি কার্যকর করতে অত্যন্ত তৎপর। কৃষিআইন, প্রচলিত শ্রমআইন সংস্কার করেছে করপোরেটের স্বার্থে। মানুষ কাজ হারাচ্ছে। দারিদ্র্য, অভাব, বৈষম্য, বুভুক্ষা সমস্ত কিছুই বৃদ্ধি পেয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি বড়োই সঙ্গীন। আয়ের তুলনায় ব্যয় লাগামহীনভাবে বৃদ্ধিতে বিশাল পরিমাণ ঋণের জালে জর্জরিত পশ্চিমবঙ্গ। এহেন পরিস্থিতিতে গোটা রাজ্যের সাথে উত্তরের জেলাগুলির মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। ১০০ দিনের কাজের টাকা মানুষ পাচ্ছেন না এক বছরের অধিক সময় অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরেও। বকেয়া টাকা এবং নতুন-করে কাজের কোনরকমের সম্ভাবনা নেই পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পরেও। পঞ্চায়েতগুলিতে কাজের বকেয়া বাবদ কেন্দ্রের কাছে প্রাপ্য টাকা রূপায়িত প্রকল্পে সঠিকভাবে খরচ হয় নি। রাস্তা, কালভার্টসহ একাধিক প্রকল্প কাজ সম্পন্ন হয়েছে বলে পঞ্চায়েতগুলি রিপোর্ট করলেও বাস্তবে সেই সব প্রকল্প করতে একটি কানাকড়িও খরচ হয় নি। মুলত লুঠ হয়েছে সরকারি সমস্ত টাকা। খেয়েছে তৃণমূলের পঞ্চায়েত থেকে সর্বস্তরের নেতা নেত্রী। মানুষ তা ভালো করে জানে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের দাবিতে মানুষ সোচ্চার হোক, সংগঠিত হোক, হক আদায়ের দাবিতে জাতপাত-সম্প্রদায়-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত গরিব মানুষ ঐক্যবদ্ধ হোক - শাসক তৃণমূল এবং বিজেপি তা কখনোই চায় না বরং এই প্রশ্নে সুকৌশলে বিভিন্ন জনজাতি আদিবাসীদের ও সাধারণের মধ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ করে তাদের ভোটব্যাঙ্ক অক্ষত রাখার কৌশল অবলম্বন করেছে। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলার জাতি-জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ স্বাধীনতার পর থেকে বুর্জোয়া দলগুলির এই ধরনের অপকৌশলের ফাঁদে পা রেখেছেন, ঠকেছেন বার বার। পৃথিবী জুড়েই পরিচিতিসত্তার রাজনীতির উত্থান ও প্রভাব বাড়ছে। শুধুমাত্র উন্নয়ন,অর্থনৈতিক বৈষম্য, বঞ্চনাকে কেন্দ্র করে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি সীমাবদ্ধ থাকে না।

আত্মমর্যাদা ও আত্মশাসনের অভাববোধ থেকে দেশের বা রাজ্যের একটি অংশের মানুষের মধ্যে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি প্রভাব বিস্তার করে। পৃথিবীর বহু দেশে পরিচিতিসত্তার উপাদানগুলিকে কেন্দ্র করে বড়ো ধরনের আন্দোলন ঘটতে দেখা গেছে, বহুদেশের সরকারের পতন ঘটেছে। পরিচিতসত্তার উপাদানগুলি সবটাই খারাপ, ক্ষতিকারক ভেবে বিরোধিতা করা ভারতের মতো বহুত্বের দেশে বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের দেশে বা রাজ্যে পরিচিতসত্তার রাজনীতি অমূলক নয় বরং থাকতে বাধ্য। বুর্জোয়া দলগুলি কৌশল হিসাবে পরিচিতসত্তার রাজনীতিকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে কমিউনিস্ট মতাদর্শের মূল লক্ষ্য শ্রেণি ঐক্য ও শ্রেণি সংগ্রামের ভিতকে ধ্বংস করে। বামপন্থীদের দায়িত্ব পরিচিতসত্তার প্রশ্নের মধ্যে যে সমস্ত গণতান্ত্রিক উপাদান আছে সেগুলিকে চিহ্নিত করা এবং তা আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য ব্যবহার করা। উত্তরের পরিচিতসত্তার রাজনীতির প্রেক্ষাপট এর বাইরে নয় বরং পরিচিতসত্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সংগঠন এবং তারা পরিচিতিসত্তার রাজনীতির মধ্যেই সবটার সমাধান সম্ভব বলে মনে করছে - যা একেবারেই ভুল। তৃণমূল পরিচিতসত্তার রাজনীতির ক্ষতিকারক উপাদানগুলিকে ব্যবহার করে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পথকে সুগম করেছিল।

বিজেপি ধর্ম ও পরিচিতিসত্তার রাজনীতিকে ব্যবহার করে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে ভোটব্যাঙ্ক বৃদ্ধিও কিছুটা নিশ্চিত করেছে। বিগত লোকসভা ও বিধানসভার ফলাফলে তা স্পষ্ট হয়েছে। বিজেপি তার সাংসদ, বিধায়ক ও মন্ত্রীদের দিয়ে পরিচিতসত্তার রাজনীতির সম্পূর্ণ লাভালাভের জন্য এখন রাজ্যভাগের কথা পরিকল্পিতভাবে উস্‌কে দিয়ে জল মাপার চেষ্টা করছে।

শাসক তৃণমূল বিভিন্ন উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে পরিচিতসত্তার রাজনীতিকে উজ্জীবিত করছে। রাজবংশী উন্নয়ন পর্ষদ, নমঃশূদ্র উন্নয়ন পর্ষদ, দার্জিলিঙের ১৫টি উপজাতি বা সমাজভিত্তিক অনেকগুলি অ-বিধিবদ্ধ পর্ষদ গঠন করেছে। রাজবংশী ভাষা একাডেমি, কামতাপুর ভাষা একাডেমি গঠন করেছে।

আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের সময়ে পরিচিতিসত্তার সংগঠনগুলির আধিপত্য-দৌড়ঝাঁপ খুব একটা লক্ষ করা যাচ্ছে না, যতটা অতীতের যে কোনো নির্বাচনে পরিলক্ষিত হতো। বিজেপি- তৃণমূল দুটি দলই যে কোনো নির্বাচনে পরিচিতি সংগঠনগুলির কর্মকর্তাদের নানা আশ্বাস, প্রতিশ্রুতি-প্রলোভন ও অর্থ সরবরাহ বাস্তবে স্বাভাবিক পর্যায়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তৃণমূলের প্রতি মানুষ এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে প্রচারে তৃণমূল দল মানুষের সাড়াও ঠিকমতো পাচ্ছে না। বিজেপি’র প্রতিও গ্রাম বাংলার মানুষের মোহ কেটেছে। জাতি-জনজাতি, ধর্ম-সম্প্রদায়ের বিরোধ লাগিয়ে তৃণমূল এবং বিজেপি পঞ্চায়েত বোর্ড দখল করে পুনরায় দুর্নীতিযুক্ত লুঠেররাজ বহাল রাখতে চায়। জনজাতির মানুষ ঐক্যবদ্ধ শ্রেণি আন্দোলনে তা ব্যর্থ করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।