৬০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ৩০ জুন, ২০২৩ / ১৪ আষাঢ়, ১৪৩০
তৃণমূলের সন্ত্রাসের নীল নকশা মুছে দিয়ে চলছে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ার কাজ
জয়ন্ত সাহা
পঞ্চায়েত ভোটের ঠিক আগে থেকে কোচবিহার জেলায় রাজনৈতিক হিংসার জেরে খুন হয়েছেন বিজেপি’র দু’জন ও তৃণমূলের একজন। গত এক মাসে দুই দলের গুলিবিদ্ধ হয়েছেন অন্তত ১০ জন। রাজনৈতিক হিংসায় রক্তাক্ত হয়েছেন কম বেশি ৫০ জন। লুঠ, বাড়ি ভাঙচুর থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করাতে প্রার্থীর ছেলেকে অপহরণ কোনো কিছুই বাদ যায় নি। মিথ্যা মামলায় সিপিআই(এম) কর্মীদের জেলে পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে তুফানগঞ্জের বালাভূতে।
এই সন্ত্রাসের আবহেই কোচবিহার জেলায় গণতন্ত্র রক্ষার লড়াই চলছে গ্রামীণ এলাকার প্রতি ইঞ্চি জমিতে।
জেলার ১২৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২,৫০৭ আসন, ১২টি ব্লকের ৩৯০ আসন এবং জেলাপরিষদে ৩৪টি আসনের ২,৩৮৫টি বুথে, মোট ২২,৩০,৯৬৭ জন ভোটার এবার ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দেবার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছেন।
গত পঞ্চায়েত ভোটে ভোট লুটের নীল নকশা ছিল তৃণমূলের। এবার সেই নীল নকশা আর কাজে লাগছে না। মনোনয়ন দাখিলের দিন থেকেই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধে ভোটের ১০ দিন আগে কার্যত ব্যাকফুটে শাসক তৃণমূল।
জেলার নানা প্রান্তে লালঝান্ডা উঁচিয়ে লড়াই চলছে জোরকদমে।
মেখলিগঞ্জ ব্লকের জামালদহ গ্রাম পঞ্চায়েতের হরিরবাড়ি বুথে প্রচারে শামিল শহিদ পরিবারের গ্রাম পঞ্চায়েত প্রার্থী নুর বানু বিবি।
মেখলিগঞ্জের তিস্তা নদীর পানিয়ার চরের বাসিন্দারা লালঝান্ডা হাতে পঞ্চায়েত ভোটে লড়ছেন উচ্ছেদের ছক প্রতিহত করতে। সরকার পানিয়ার চরের বংশ পরম্পরায় বাস করা পরিবারগুলিকে ভিটে আর চাষের জমি থেকে উচ্ছেদ করে শিল্প গড়তে চায়। সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম নিজে পানিয়ার চরে গিয়ে আশ্বাস দিয়েছেন, এক জন চরবাসীকে উচ্ছেদ করতে এলে লালঝান্ডাওয়ালারা রাজ্য জুড়ে আন্দোলন করে সরকারের ভিত নড়িয়ে দেবে। চর বাঁচাও কমিটি গড়ে চলছে রাত পাহারা।
আবার তুফানগঞ্জের বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া বালাভূত গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় যে লালঝান্ডাকে তৃণমূল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল, সেখানেই পার্টি অফিস খুলে চলছে পঞ্চায়েত ভোটের লড়াই।ভোটে দাঁড়ানো ঠেকাতে বাড়ি ভাঙচুর থেকে মিথ্যা মামলা কোনো কিছুই বাদ দেয়নি তৃণমূল। ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরে দেওয়া হয়েছিল। জামিন পেয়েই ভোটে প্রার্থী হয়েছেন সিপিআই(এম) কর্মীরা। এত সন্ত্রাস দেখে শাসক দলেই ভাঙন ধরেছে।লালঝান্ডার প্রার্থীদের পক্ষে লড়ছেন তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরা।
ভোট হলে পরাজয় নিশ্চিত বুঝতে পেরে মাথাভাঙার কুর্শামারিতে সিপিআই(এম) নেতা আমজাদ হোসেন ও ছকমল মিয়াকে খুনের উদ্দেশ্যে তাঁদের বাড়িতে দরজা ভেঙে ঢুকে পরে তৃণমূলীরা। দু’জনকে না পেয়ে দু’জনের বাড়ির সমস্ত আসবাবপত্র ভেঙে ফেলে। তবুও লড়াইয়ের মাঠ থেকে সরে যায়নি সিপিআই(এম)।
সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদক অনন্ত রায় আত্মপ্রত্যয়ের সাথে জানিয়েছেন, জেলাজুড়ে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস যেখানে যেখানে লড়াইতে আছে সে সব জায়গায় ভোট গণনা অবধি লড়াই জারি রাখবে কমরেডরা।
জেলাজুড়ে বিজেপি এবং তৃণমূল বোমা বন্দুক ও গুলির রাজনীতি আমদানি করে ভোটের ময়দান থেকে সাধারণ মানুষকে সরিয়ে দিতে চাইছে।
জেলায় এত বোমা বন্দুক গুলি কোথা থেকে আসছে জেলাবাসী জানলেও জানে না শুধু পুলিশ।
অথচ, অসম থেকে কারিগর এনে দিনহাটায় কারখানা করা হয়েছে, অভিযোগ করছে বিজেপি এবং তৃণমূল। দুই দলের নেতারাই একে অন্যের দিকে অভিযোগের তীর ছুঁড়ছেন। সিতাইতে বোমা তৈরি করার সময় হাতেনাতে বোমার কারিগরদের ধরলেও জেলা জুড়ে বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের কোনো পরিকল্পনাই নেই।
একদিকে লালঝান্ডার দ্রুত উঠে আসা, অন্যদিকে তৃণমূল ও বিজেপি’র টিকিট নিয়ে দলের অভ্যন্তরের কাজিয়া এখন গোঁজ প্রার্থী দিয়ে লড়াইতে পরিণত হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যাকফুটে তৃণমূল এবং বিজেপি।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর জামালদহে হরিরবাড়িতে তৃণমূল হেরে যাবার পর ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালিয়ে খুন করে সিপিআই(এম) কর্মী রমজান মিয়াকে। এবারে সেই হরিরবাড়িতে গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে ভোটে লড়াই করছেন শহিদ রমজানের পুত্রবধূ নুরবানু বিবি।
এখানে নির্বাচনী প্রচারে বেড়িয়ে সিপিআই(এম) জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য বিপিন শীল বলেন, গত ১২ বছরে জেলায় একটাও নতুন শিল্প তালুক হয় নি। জেলায় কাজ না পেয়ে দু ‘লক্ষ যুবক ভিন রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করছে। অন্যদিকে শিক্ষিত বেকার যুবকদের থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়েও চাকরি দেয় নি। অনেককে আবার টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েও চাকরি হারাতে হয়েছে।টাকা ফেরত দিতে হবে এই ভয়ে অনেক নেতা এখন ঘরবন্দি।
তৃণমূলের সন্ত্রাসের নীল নকশা আটকে দিয়ে ‘মানুষের পঞ্চায়েত’ গড়ার প্রস্তুতি চলছে বুথে বুথে। অন্যদিকে দেওয়ালে ক্রমশ ফিকে হচ্ছে দুই ফুলের দলের প্রতীক চিহ্ন।