৬০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ৩০ জুন, ২০২৩ / ১৪ আষাঢ়, ১৪৩০
প্রতিরোধের মেজাজে মনোনয়নের পর অকুতোভয়ে চলছে লালঝান্ডার প্রচার
মধুসূদন চ্যাটার্জি
আপনারা শান্তিপূর্ণভাবে ভেতরে ঢুকুন। স্থানীয় এক পুলিশ কর্তার এই নির্দেশ কানে যাওয়ার পরই চারপাশ থেকে ভেসে এলো,
- ‘আমাদের দেখে কি মনে হচ্ছে আমরা এই ব্লক অফিসে অশান্তি করতে এসেছি? বাইরে যারা আমাদের দেখে গালমন্দ করছে, দেখে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছে তাদের আগে সামলান, আমাদিকে দেখতে হবে না। আর বাইরে মুখে গামছা বেঁধে যারা দাঁড়িয়ে আছে, গরমের জন্য যদি গামছা নিয়ে থাকে তাহলে ঠিক আছে, কিন্তু ওই গামছার আড়ালে যদি রক্তচক্ষু লুকিয়ে থাকে, হামলা করতে আসে তাহলে কিন্তু একজনও পার পাবে না। জেনে রাখুন এটা ২০১৮ নয়।’
মানুষের মেজাজের আঁচ পাবার পরই ওই পুলিস আধিকারিকের মুখের চেহারা বদলে গেল। পিঠে হাত দিয়ে একজনকে বললেন,
- ‘রাগছেন কেন? আমরা তো আছি। কাউকে এখানে ঢুকতে দেওয়া হবেনা। বাইরে যা পারছে করুক। না, যা পারছে নয়, এখানে ১৪৪ধারা আছে তো? তাহলে কেন বাইরে ঘাসফুলের ঝান্ডা লাঠিতে ঢুকিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছে ওরা? ওদের কি কোনো কর্মসূচি আছে?’
এবার আর কোনো উত্তর দিলেন না ওই পুলিশ কর্তাটি। নিজের মোবাইলে ফেসবুক পেজ খুলে বসলেন। আর যাঁদের সঙ্গে কথোপকথন হচ্ছিল তারাও কোনো পাত্তা দিলেন না। সোজা বিডিও অফিসে একে একে ঢুকে গেলেন। বাইরে তখন রাজ্যের শাসকদলের আস্ফালন, পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালিগালাজ চলছে।
রানিবাঁধের বিক্রমডিহি গ্রামে প্রার্থী সহ বামফ্রন্ট কর্মীদের ভোটপ্রচার।
ঘটনাস্থল বাংলার জঙ্গলমহল বাঁকুড়ার রানিবাঁধ ব্লক অফিস। এই প্রতিবেদকের সামনেই গত ৯ জুন এই ঘটনাটি ঘটে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমার প্রথমদিনেই মিছিল করে বামফ্রন্টের সিপিআই(এম) প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে এসেছিলেন। বাইরে তাঁদের উদ্দেশে কটুক্তি করে তৃণমূল কংগ্রেসের লোকজন। কোনো পাত্তা না দিয়েই তাঁরা সোজা ব্লক অফিসে চলে এসেছিলেন। পুলিসকে বুঝিয়ে দেন পাঁচ বছরে পরিবর্তনের দৃশ্যপট কেমন হতে পারে।
এই পাঁচবছরে তৃণমূলের পঞ্চায়েত মানুষের কী কাজ করল, নিজেদের সম্পত্তি কতটা বেড়েছে সে সব এখন প্রকাশ্যেই চর্চা হচ্ছে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ, আসল কথা হলো এবছর নির্বাচনে মানুষের মনোভাব কী?
পঞ্চায়েত নির্বাচনের বহু আগে বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে ‘চোর ধরো জেলে ভরো’, এই পঞ্চায়েত চাই না’, ‘রেগার কাজ দিতে হবে, মেটাতে হবে বকেয়া মজুরি - এই দাবিতে জেলা জুড়ে লালঝান্ডার মিছিল, পঞ্চায়েতে পঞ্চায়েতে ডেপুটেশন দেওয়া হয়। অসংখ্য মানুষ তাতে যোগ দেন। এমনকী তৃণমূল কংগ্রেসের পতাকা নিয়ে রাজনীতি করা বহু গরিব জনমজুরও এতে যোগ দেন। তাঁদেরও কাজ নেই। পরিবারের ছেলেরা পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বাইরে কাজে চলে গেছে। অসহায় এই মানুষগুলো লালঝান্ডাকেই তখন থেকে ধরেছেন। গ্রামের পর গ্রামের মানুষ বলছেন - এখন মিছিল, ডেপুটেশন হচ্ছে ঠিক আছে, আসল হলো পঞ্চায়েত ভোট। আমরা লালঝান্ডাকে ময়দানে শক্তি নিয়ে দেখতে চাই। আমরা পাশে থাকছি। লালঝান্ডার কর্মীরাও শক্তি পেয়েছেন। লড়াই করেই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
প্রায় একই ঘটনা ঘটে সোনামুখীতেও। সেখানেও বাইরে থেকে মস্তানবাহিনী নিয়ে আসা হয়েছিল। পুলিশকে বামফ্রন্টের কর্মী-প্রার্থীরা জানান, কেন বাইরে থেকে লোকজন এসে ব্লক অফিস ঘিরে আছে। পুলিশ কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উলটে অভিযোগ করা মহিলা, পুরুষদের নাম, মোবাইল নম্বর, ঠিকানা নিতে থাকে। আর পুলিশের সামনেই চলে হামলা। এতে কার্যত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় মানুষের। হাতে সামনে যে যা পেয়েছিলেন তাই নিয়েই তৃণমূলের বাহিনীর উপর তেড়ে যান। প্রাণ ভয়ে পালায় রাজ্যের শাসকদলের মস্তানবাহিনী। এর পর পুলিশ ময়দানে নামে তৃণমূলীদের বাঁচাতে। মানুষ নির্বিঘ্নে মনোনয়নপত্র জমা দেন। পরে আর একদিনের জন্যও মস্তানি করতে আসেনি তৃণমূলবাহিনী। একইভাবে বিষ্ণুপুর, ওন্দা, বাঁকুড়া ১, এবং ২ ব্লক, মেজিয়া, শালতোড়া, ছাতনা, রাইপুর, সারেঙ্গা, হিড়বাঁধ, তালডাংরায় বামফ্রন্টের প্রার্থীরা সাহসিকতার সঙ্গে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। কোতুলপুর, পাত্রসায়ের, জয়পুরে তৃণমূলবাহিনী সরাসরি পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে ৮ জুন থেকে এলাকা দখল করে নেয়। প্রার্থীদের বাড়ির বাইরেই বের হতে দেয়নি। নামানো হয় তীব্র সন্ত্রাস। জেলা বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে জেলাশাসক পুলিশ সুপারকে জানানো সত্ত্বেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কিন্তু এই চারটি ব্লকেও জেলাপরিষদের সমস্ত আসনেই প্রার্থী দিয়েছে বামফ্রন্ট। এখন এই এলাকার জেলাপরিষদের প্রার্থীদের নিয়ে প্রচারও চলছে। মানুষ একটা ভোটের সুযোগ পেয়েছেন, সেটাই ব্যবহার করতে চান।
এখন জেলাজুড়ে চলছে প্রচার। যা ২০১৮ সালে করা যায়নি। প্রতিদিনই প্রার্থীরা পাড়া, মহল্লার বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। ছোটো ছোটো বৈঠক হচ্ছে। সব কাজই হচ্ছে অকুতোভয়ে। মানুষের কথা একটাই এই পঞ্চায়েত মানুষের জন্য কী করল সেটা আগে বলতে হবে। তারপর তৃণমূল ভোট চাইবে।