E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ৩০ জুন, ২০২৩ / ১৪ আষাঢ়, ১৪৩০

পঞ্চায়েত নির্বাচনঃ পূর্ব বর্ধমান

এবার গ্রামের মেজাজ অন্যরকম, তাড়া খেয়ে পালাচ্ছে চোরের দল

শঙ্কর ঘোষাল


গ্রামে যে বিপদ তার আঁচ আগেই পেয়েছেন গরিব মেহনতি মানুষ। তাই এবার ভোটে তাঁরা অনেকটাই এককাট্টা। ২০১৮ থেকে ২০২৩’র মধ্যে যে অনেকটা ফারাক - সেই রায়না’র ৩টি আসনে ভোটের আগেই জয় ছিনিয়ে আনার বার্তা মানুষকে বাড়তি প্রেরণা দিচ্ছে। চোরেদের ভয়ে মানুষ মুখ খুলতে পারতেন না এক সময়, এখন লালঝান্ডা দেখে সাহস পাচ্ছেন শুধু তাই নয়, চোখে চোখ রেখে লড়ছেনও। পঞ্চায়েতের ঢাকে কাঠি পড়তেই এবার গ্রামের মেজাজ যেন অন্য রকম, ক্ষোভে ফুঁসছেন মানুষ। রায়নার প্রবীণ মানুষ অমর মালিক, জয়দেব সাঁতরারা নতুন প্রজন্মকে বলছেন, লালঝান্ডাটা ছাড়িস না। এটা গরিব, গতরখাটা মানুষের পতাকা। ১৯৭৮ সালে এই পতাকা গরিবের পঞ্চায়েত তৈরি করেছিল। সেই ইতিহাস এখন নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছেন ১৯৭৮’র আগের পঞ্চায়েত দেখা এই মানুষগুলো। আগে কি সুন্দর দিন চলতো - সেই পঞ্চায়েত হারানোর আপশোস এখন গ্রামের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাদের। চুরি, দুর্নীতি, স্বজনপোষণের অভিযোগ শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা। রায়না, মেমারী, জামালপুর, খণ্ডঘোষ, আউশগ্রাম থানার একাধিক বুথে বাড়ি বাড়ি ঘুরে মানুষের সাথে কথা বলে যে উপলব্ধি হয়েছে তা হলো, মানুষের স্পষ্ট অভিযোগ, শাসকদলের চোরগুলো গায়ের জোরে পঞ্চায়েত দখল করে লুট করেছে। চাকরি করে দেবে বলে টাকা নেওয়া থেকে শুরু করে ১০০ দিনের মজুরি চুরি, কাজ করে বকেয়া টাকা না পেয়ে মানুষ হন্যে হয়ে ঘুরছেন পঞ্চায়েতের দরজায়, কিন্তু হকের মজুরির টাকা মিলছে না। গ্রামে কাজ নেই, ১০০ দিনের কাজও বন্ধ, আবাস যোজনার ঘর নিয়ে অভিযোগ, প্রকৃত গরিব মানুষ ঘর পায়নি, ঘর যা এসেছে শাসকদলের নেতা, নেত্রীরা ভাগ করে নিয়েছে। খণ্ডঘোষের শেখ জাহাঙ্গীরের পেল্লাই বড়ো বড়ো প্রাসাদ থাকা সত্ত্বেও তার পরিবার আবাস যোজনায় ঘরের তালিকায় নাম তুলে নিয়েছে। গরিবের ঘর চুরি নিয়ে এমনই হাজার অভিযোগ, ক্ষোভ-বিক্ষোভ থেকেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে গরিব মানুষের এবার তীব্র ঘৃণা তৈরি হয়েছে। আউশগ্রামের সোম হাঁসদা, বাবুল হেমব্রমরা বলেছেন, এবার লাল আসছে তাই লালকেই চোরগুলো ভয় পাচ্ছে। এখানে দুই ফুলই দুর্নীতির এক পুকুরেই ফুটে আছে। গ্রামের আর্থিক অবস্থা কেমন একটু তথ্য তালাশ করলে চোখে পড়েছে। পরতে পরতে গ্রাম বাংলার মানুষের মধ্যে দারিদ্র্য, অভাব আর হাহাকার। তার মধ্যে গ্রামে দেওয়াল লেখা চোখে পড়লো মেমারীর গন্তার গ্রামে - ‘‘বুক ফুলিয়ে চলিস ভাই কীসের এত জোর? লাল ঝান্ডার কর্মীরে দাদা কেউ বলতে পারে না চোর’’। তৃণমূল মানেই চোর, লুটেরা, তোলাবাজ এটা মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। আগের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার এখন কী হাল করে ছেড়েছে তৃণমূল সেটা আর বাউরি, বাগদি, সংখ্যালঘু পাড়ায় বলে বোঝাতে হচ্ছে না। বিদ্যুৎ বিল লাগাম ছাড়া, সজলধারাতে জল কর, টিউবওয়েল ভেঙে পড়ে আছে সেটাও সারাতে হবে গ্রামবাসীকেই। পঞ্চায়েতের পরিষেবা মানে জন্ম, মৃত্যুর সার্টিফিকেট সেটাতেও পয়সা দিতে হচ্ছে।

মেমারি ২ ব্লকের সাতগেছিয়া গ্রামে শ্রমজীবী মানুষ লালঝান্ডার প্রচারে।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে পথ চলার শপথ নিয়ে ১৯৭৮ সালে রাজ্যে ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা যাত্রা শুরু করেছিল। শুধুমাত্র প্রশাসনিক নয়, আর্থিক ক্ষমতায়ন ও বিকেন্দ্রীকরণ লক্ষ্য ছিল। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র সুনিশ্চিতিকরণের লক্ষ্য ছিল - গ্রামের মানুষের উন্নয়নে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা। গ্রাম সমীক্ষার মাধ্যমে গ্রামে সম্পদ ও শ্রমশক্তিকে গ্রামীণ উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করার উদ্যোগ বামফ্রন্টের সময়ে প্রধান কাজ ছিল। সামাজিক ও আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষকে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে গ্রামোন্নয়ন ছিল মূল লক্ষ্য। কিন্তু সেই মানুষগুলিই এখন পঞ্চায়েত ব্যবস্থা থেকে ছিটকে গেছে। গন্তারের সেন পাড়ার মেনকা সেন, সুন্দরী সেন বলছেন, পঞ্চায়েত এখন ঘুঘুর বাসা। গ্রামের গণতন্ত্রও এখন পদদলিত। এক সময় বামেদের হাত ধরে ভূমিসংস্কারের সাফল্যে গরিবদের হাতে জমি যাওয়ার ফলে উধাও হয়েছিল ভাদ্র-আশ্বিন মাসে তালের মাড়ি ও চালের খুঁদ সিদ্ধ করে পেট ভরানোর দিন। কিন্তু ২০১১ সালে বামফ্রন্ট সরকার চলে যাবার পর তৃণমূলের রাজত্বে গোটা পঞ্চায়েত ব্যবস্থাই ভেঙে চুরমার হয়ে পড়েছে। একাধিক গরিব পাড়ায় এখন শুনতে পাওয়া যায় গরিবের আর সেই দিন নেই, কাজ নেই, শুধুই অভাব। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন মানুষ। তাই বাড়ির সকলেই ছেলে-মেয়েদের লেখা-পড়া শিকেয় তুলে ছুটছে ধান রোয়ার কাজ করতে তামিলনাড়ু, অন্ধ্র, কর্ণাটক, কেরালাতে। গ্রামের হালহকিকত দেখে যাঁরা একসময় ভুল করে শাসকদলে নাম লিখিয়েছিলেন ভাতার, পূর্বস্থলী, কালনা, গলসী, জামলাপুরে, সেই মানুষরাই ফিরছেন লালঝান্ডার তলায়। শুধু ফিরছেন তাই নয়, গ্রামে তৃণমূলের সন্ত্রাস, হামলার মোকাবিলা করতে গরিবের ঐক্যকে আরও মজবুত করছেন। মনোনয়নে বাধা দিতে গিয়ে তৃণমূলের হাড়ে হাড়ে মালুম হয়েছে, এটা ২০১৮ নয় ২০২৩ সাল। বড়শুল, আউশগ্রাম, গলসী, জামালপুরে প্রতিরোধের মুখে পড়তে হচ্ছে শাসকদলকে শুধু তাই নয়, মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া এই চোরগুলো দৌড়ে পালাচ্ছে জনগণের তাড়ায়।

শুধুমাত্র চুরি, দুর্নীতি, লুটের জন্য গ্রামের মানুষের তৃণমূলের উপর ঘৃণা নয়, অতীতে খেতমজুরের মজুরি আন্দোলন, বর্গা জমি রক্ষার আন্দোলন, খাস জমি কেড়ে নেবার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছে গ্রাম বাংলায় তাতে বিজেপি, কোথাও আরএসএস গরিবদের বিরুদ্ধে শাসকদলের সঙ্গ নিয়েছে। অতীত অভিজ্ঞতায় লড়াইয়ের ময়দানে গরিবরা চিনেছে লালঝান্ডাই তাঁদের প্রকৃত বন্ধু। গত ১২ বছরে কৃষক ও খেতমজুর কেউ যে ভালো নেই, তা কৃষকের জীবন-যন্ত্রণার কথা শুনলে অনুভব হবে। কেন একের পর এক কৃষক আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন শোনা যাচ্ছে তাঁদের মুখে। জেলা কৃষি আধিকারিক সুকান্ত মুখোপাধ্যায় বলতে বাধ্য হয়েছেন। ‘‘বিভিন্ন কারণে জেলায় ২৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেই অনেকেই মারা গেছেন’’। প্রশ্ন হচ্ছে, ২মাসে পূর্ব বর্ধমান জেলায় ২৭৮ জন কৃষকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনা স্বীকার করে নেওয়া হলেও এর মধ্যে বজ্রপাত ও সাপে কাটায় মৃত্যুর ঘটনা বলা হচ্ছে,অথচ আত্মঘাতী কৃষকের সংখ্যা কেন বলা হচ্ছে না? কৃষক আত্মহত্যা ধামাচাপা দিতেই কি পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে অস্বাভাবিক মৃত্যু? এর কোনো সদুত্তর দিতে পারছেন না জেলা প্রশাসনের কর্তারা। কিন্তু এই আত্মহত্যা কী কারণে?

যেদিকে চোখ দেওয়া যাবে সর্বত্রই ধু ধু মাঠ। অধিকাংশ পঞ্চায়েতেই এই মাঠগুলিতে এক সময় সোনালি পাকা বোরো ধানের শিষে ঢেউ খেলতো, এখন সেই জমি বন্ধ্যা হয়ে পড়ে রয়েছে। কৃষকের এখন চাষে অনীহা। ছোটো কৃষক শেখ সুলেমান জানিয়েছেন, গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার চাষে লোকসানের পর আর বোরো চাষ করছি না। চাষে অনীহা থেকেই কৃষক তার পরম সম্পদ সেই জমি গরিবদের চুক্তিতে চাষ করতে দিত, তারাই চাষ করতেন। ফসলের একটা অংশ পেতেন মালিক, বাকিটা গরিবরা। গত কয়েক বছরে গতর খাটিয়ে চাষ করার পর গরিবরা চুক্তিতে চাষ করে দেখছেন তাঁদের গতরের দামটুকুও যখন উঠছে না তখন গরিবরাও আর জমির ধারে কাছে যাচ্ছেন না। ফলে কৃষকের কাছে এখন জমি তো নয় যেন ‘যম’। রায়না, খণ্ডঘোষ, ভাতাড়, আউশগ্রাম, মেমারী, জামালপুরের সব জমিই চড়া রোদে ফেটে চৌচির। কৃষকরা বলছেন বিকল্প কোনো কাজ পেলে চাষ ছেড়ে দেবার কথা। কৃষকের চাষে অনাগ্রহ মানে খেতমজুরের কাজ নেই। বোরো চাষ হলে খেতমজুর যে কাজ পেতেন, এখন সেই জমি অনাবাদি হয়ে পড়ে থাকায় কাজ নেই খেতমজুরের। তাই অভাব কৃষকের ঘরে যেমন ঠিক একই অভাব গলায় ফাঁস হয়ে চেপে বসেছে খেতমজুরের ঘরেও। চাষে কৃষকের অনাগ্রহ কেন? কৃষক বিশ্বরূপ মণ্ডল জানিয়েছেন, গত কয়েক বছরে ফসলের দাম পায়নি কৃষক কিন্তু সার, বীজ, কীটনাশক, জল কিনতে খরচ হয়েছে আগের থেকে অনেক বেশি। আলু চাষের প্রসঙ্গে আসা যাক, যে ইফকো ১০:২৬:২৬ সারের দাম ছিল বস্তা পিছু ১,৪০০ টাকা, সেই সার কৃষককে কালোবাজারে কিনতে হয়েছে ২,০০০-২,২০০ টাকায়। এত দাম দিয়ে সার, কীটনাশক, বীজ কেনার পর আলু যখন উৎপাদন হলো তার মাঠে দাম ২০০-৪০০ টাকা বস্তা। লাভ তো হয়নি উলটে মহাজনের ধার করা টাকা ওঠেনি। সারের কালোবাজারির এই নৈরাজ্যের ধরন চোখে দেখেও সরকার ছিল চোখ বুজে। এইভাবে আলুতে, ধানে লোকসান করার পর মধ্যবিত্ত চাষি চাষে আগ্রহ হারিয়ে জমি ছেড়ে দিতে শুরু করে। পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই সমস্ত সংকট ও যন্ত্রণার কথাই গ্রামের শ্রমজীবী মানুষের মুখে মুখে ফিরছে।