৬০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ৩০ জুন, ২০২৩ / ১৪ আষাঢ়, ১৪৩০
সন্ত্রাসকে রুখে ভোটপ্রচারে বামফ্রন্ট কর্মীরা
সুপ্রতীপ রায়
নদীয়া জেলায় ২০১৩ এবং ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে বেলাগাম সন্ত্রাস করেছিল শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল আমলে পঞ্চায়েত নির্বাচনগুলিতে এ জেলার বেশিরভাগ মানুষ ভোট দিতে পারেননি। গণনা কেন্দ্র লুট হয়। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনে এ জেলার অবস্থা কী?
নদীয়া জেলায় জেলা পরিষদের মোট আসন ৫২,পঞ্চায়েত সমিতির মোট আসন ৫৪৯, গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট আসন ৪০১১ এবং গ্রামীণ বুথের সংখ্যা ৩৭৮২। এ জেলাটি বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। ১৮টি ব্লকের মধ্যে ৯টি ব্লক সীমান্ত লাগোয়া। মনোনয়নপত্র পেশের আগেই বোঝা গিয়েছে মানুষ এবার ছেড়ে কথা বলবেন না। মিডিয়ায় প্রচারকে ভ্রান্ত প্রমাণ করে মনোনয়ন পেশ পর্বে বামেরা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তৃণমূলের বিরুদ্ধে মূল প্রতিপক্ষ বামফ্রন্ট। গ্রাম পঞ্চায়েত স্তরে ৯০ শতাংশের বেশি, পঞ্চায়েত সমিতি স্তরে ৯৯ শতাংশ ও জেলা পরিষদ স্তরে ১০০ শতাংশ আসনে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। প্রশাসনের একটা অংশের তীব্র অসহযোগিতার ফলে বেশ কিছু ওবিসি এবং এসটি সার্টিফিকেট করাতে পারেননি বেশ কয়েকজন বামফ্রন্ট প্রার্থী। না হলে ১০০ শতাংশ আসনেই প্রার্থী দিতে পারত বামফ্রন্ট। বিজেপি মনোনয়ন পত্র পেশের ক্ষেত্রে বামেদের থেকে অনেক পিছিয়ে। মনোনয়ন পত্র দাখিলের পর প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের জন্য তৃণমূল চাপ দিলেও সাহসী বামফ্রন্ট প্রার্থীরা প্রত্যাহার করেননি।
নদীয়ার করিমপুর ১ নং ব্লকের ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের সবগুলি অঞ্চলেই প্রচারে অনেক এগিয়ে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা। এই ব্লকের পিপুশবেরিয়া,মধুগাড়ি,শিকারপুর, হোগলবেড়িয়া বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী। এই অঞ্চলগুলিতে তৃণমূল সমাজবিরোধীদের জড়ো করছে। যদিও বামফ্রন্ট প্রার্থীরা সাহসের সঙ্গে প্রচার করছেন। বিজেপি চড়া সাম্প্রদায়িক প্রচার করছে। এবারের নির্বাচনে সিপিআই(এম)’র প্রচারের কৌশল কী? এ প্রশ্নের উত্তরে সিপিআই(এম) জেলা কমিটির সদস্য সন্দীপক ব্যানার্জি জানালেন, ‘‘নিবিড় প্রচারের উপর বামফ্রন্ট জোর দিচ্ছে। বারে বারে আমাদের প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়ি যাচ্ছেন। মানুষের সাড়া মিলছে।’’ ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর বেশ কিছু মানুষ বিজেপি-মুখী হয়েছিলেন। এদের একটা অংশ বিজেপি ছেড়েছেন। করিমপুর ১ নং ব্লক এলাকার বেশ কিছু আসনে তৃণমূল - বিজেপি'র বোঝাপড়া পরিষ্কার হচ্ছে। এদের টার্গেট সিপিআই(এম)।
নদীয়া জেলার সীমান্তবর্তী একটি ব্লক করিমপুর ২ নং ব্লক। এই ব্লকে মুসলিম সংখ্যালঘু অংশ প্রায় ৪৫ শতাংশ। মোট ১০ টি গ্রাম পঞ্চায়েত। এর মধ্যে নারায়ণপুর ২, নন্দনপুর, মুরুটিয়া, দীঘলকান্দি গ্রাম পঞ্চায়েত বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা। নির্বাচনের দিন ঘোষণার সন্ধ্যা থেকেই বামফ্রন্ট প্রার্থীরা প্রচারে নেমে পড়েছেন। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামগুলিতে লালঝান্ডা ছাড়া অন্য দলের ঝান্ডা অনেক কম। শাসক তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্ব তীব্র। সিপিআই(এম) করিমপুর ২ এরিয়া কমিটির সম্পাদক লিয়াকত হোসেন জানালেন, ‘‘ভোটের দিন বুথ রক্ষা করাটাই চ্যালেঞ্জ।’’
এ জেলার তেহট্ট ১ ও তেহট্ট ২ ব্লকে সিপিআই(এম) দাপটের সঙ্গে প্রচার করছে। প্রচারে সিপিআই(এম)'র থেকে অনেক পিছিয়ে তৃণমূল ও বিজেপি। এই দুটি ব্লকের পলাশীপাড়া ও তেহট্ট বিধানসভা কেন্দ্রের বিধায়ক মানিক ভট্টাচার্য ও তাপস সাহা। উভয়েই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত। এই নির্বাচনে দুর্নীতি প্রধান ইস্যু। তেহট্ট ১ ও তেহট্ট ২ দুটি ব্লকেই বামফ্রন্টের জয়ের সম্ভবনা প্রবল।
জেলার চাপড়া ব্লক সীমান্তবর্তী। মহেশপুর,হাটখোলা, পিপড়াগাছি গ্রাম পঞ্চায়েত সীমান্ত লাগোয়া। মুসলিম সংখ্যালঘু অংশের বসবাস প্রায় অর্ধেকের উপর। ২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের পর নদীয়ার যে ব্লকগুলিতে তৃণমূল চড়া সন্ত্রাস নামিয়ে এনেছে তার মধ্যে চাপড়া আন্যতম। মোট ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত। সন্ত্রাসকে উপেক্ষা করেই সিপিআই(এম) কর্মীরা সাহসী প্রচারে নেমেছেন। কুখ্যাত সমাজবিরোধীদের বিরুদ্ধে সিপিআই(এম) যে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে তা টের পাওয়া গেল মনোনয়ন পেশের সময়। হৃদয়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বেদবেড়িয়া গ্রামে সিপিআই(এম) প্রার্থীদের তৃণমূল আটকাবার চেষ্টা করলেও প্রতিরোধ করেই প্রার্থীপদ দাখিল করেছেন সিপিআই(এম) প্রার্থীরা। ২২ জুন চাপড়ার হাতিশালা গ্রামে সিপিআই(এম) প্রার্থী জুলেখার বাড়ি তৃণমূল আক্রমণ করলেও জুলেখাকে দমানো যায়নি। কৃষ্ণনগর১ গ্রাম পঞ্চায়েতের দিগনগর,চক দিগনগর, জোয়ানিয়া-ভালুকা সহ সর্বত্র সিপিআই(এম) প্রার্থী সহ কর্মীরা ইতিমধ্যেই দুবার ভোটারদের বাড়ি বাড়ি প্রচার সেরে ফেলেছেন।
নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া। এই ব্লকের মোট সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে গোবিন্দপুর, হাটখোলা, টুঙ্গি-ভাজনঘাট বাংলাদেশ লাগোয়া। বিজেপি বিকৃত ও সাম্প্রদায়িক প্রচার করছে। বিজেপি'র প্রচার মুখ্যত সিপিআই(এম)-র বিরুদ্ধে।
নদীয়া জেলার নাকাশীপাড়া ব্লকে মোট ১৫টি গ্রাম পঞ্চায়েতে ঐক্যবদ্ধভাবে বামফ্রন্ট প্রচারে নেমেছেন। বিজেপি তীব্র সাম্প্রদায়িক প্রচার সংগঠিত করছে। এ ব্লকে উভয় ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বাস।
কৃষ্ণনগর ব্লক ২ ব্লকের ধুবুলিয়া ১, ধুবুলিয়া ২, সাধন পাড়া ১, সাধনপাড়া ২, নওপাড়া ১, নওপাড়া ২, বেলপুকুর সর্বত্র লালঝান্ডায় আকাশ ছেয়ে গেছে। মানুষ দলে দলে সিপিআই(এম)র বৈঠকী সভাগুলিতে অংশ নিচ্ছেন।
পরিবর্তনের জামানায় চাকদহ ব্লকে ধারাবাহিক সন্ত্রাস চালিয়েছে তৃণমূল। চাকদহ ব্লকের ১০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের সর্বত্র সিপিআই(এম) দাপটের সঙ্গে প্রচার করছে। কল্যাণী ব্লকের মদনপুর, সগুনা, গ্রাম কাঁচরাপাড়া সর্বত্র মানুষ প্রকাশ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিচ্ছেন। হরিণঘাটা ব্লক ও নবদ্বীপ ব্লকে প্রচারে ঝড় তুলেছেন বামেরা।
রানাঘাট মহকুমার শান্তিপুর ব্লকে আড়বান্দি ১, আড়বান্দি ২, নবলা, বাবলা, হরিপুর, বেলগড়িয়া ১, বেলগড়িয়া ২, ফুলিয়া টাউনশিপ, রানাঘাট ব্লক ২-এর দত্তফুলিয়া, কামালপুর, আইশমালি, নোকারি, গাংনাপুর, বৈদ্যপুর ১, বৈদ্যপুর ২, আড়ংঘাটা, যূগলকিশোর, রানাঘাট ব্লক ১-এর বারাসত, কালীনারায়ণপুর-পাহাড়পুর, রামনগর ১, রামনগর ২, হবিবপুর, পায়রাডাঙা সহ সর্বত্র সিপিআই(এম) প্রচারে এগিয়ে। নবদ্বীপ ব্লকে সিপিআই(এম) প্রচারে মানুষের সাড়া পাচ্ছে। সিপিআই(এম) নবদ্বীপ পূর্ব এরিয়া সম্পাদক আয়েব নবি শেখ জানালেন, ‘‘মানুষ তৃণমূল ও বিজেপি-কে হারানোর জন্য প্রস্তুত’’।
নদীয়া জেলার সন্ত্রাস কবলিত ব্লকগুলির মধ্যে হাঁসখালি ব্লক অন্যতম। এই ব্লকের গাজনা, রামনগর-বড়চুপড়িয়া গ্রাম পঞ্চায়েত সম্পূর্ণ বাংলাদেশ লাগোয়া। তৃণমূলের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকট। একারণেই এখানে প্রকাশ্যে খুন হয়েছেন তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস, দলের ব্লক সভাপতি দুলাল বিশ্বাস। গত ১১ বছরে ১৩ জন খুন হয়েছে। খুন করা হয়েছে বাদকুল্লার সিপিআই(এম) নেতা বাবুলাল বিশ্বাসকে। এহেন হাঁসখালিতে লড়াই গড়ে তুলেছেন বামফ্রন্ট প্রার্থীরা। ৩৮ নম্বর জেলা পরিষদ আসনে বামফ্রন্টের সিপিআই(এম) প্রার্থী সুশীল ঘোষ জানালেন,‘‘লড়াইয়ের ময়দানে এক ইঞ্চি জমিও ছাড়া হবে না।’’ তৃণমূল যে এই ব্লকে সংকটে আছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে। কারণ নবজোয়ার কর্মসূচিতে কিছুদিন আগে বাদকুল্লায় অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন। পুনরায় ২৭ জুন বাদকুল্লায় আসছেন।
প্রচারপর্বে নদীয়াতে বিজেপি এবং তৃণমূল প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। কোনো কোনো ব্লকে বিজেপি তৃণমূলের থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করছে। বেশ কিছু আসনে বিজেপি এবং তৃণমূলের গোপন বোঝাপড়ার খবর আসছে। তৃণমূলের স্থানীয় মাফিয়াদের শক্তি হ্রাস পেলেও পুলিশের একটা অংশ সরাসরি তৃণমূলের হয়ে কাজ করছে। জেলার গ্রামীণ গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে এটাই দুশ্চিন্তার। তবে প্রতিরোধের মেজাজ নিয়েই বামেরা ময়দানে।