৬০ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ৩০ জুন, ২০২৩ / ১৪ আষাঢ়, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (সতেরো)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
ভাগবত গীতা বা গীতা
ভাগবত গীতা বা গীতা হিন্দুধর্মের অন্যতম ধর্মগ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃত। আদালতে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা সাক্ষ্য দিতে এই গ্রন্থে হাত রেখে ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করেন। বিভিন্ন ধারার প্রবক্তারা তাদের মতো করে গীতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। এটা ঠিকই, গীতার বহু ব্যাখ্যা রয়েছে। গীতা সম্পর্কিত শঙ্করের ভাষ্যই প্রাচীনতম, যা পাওয়া যায় সেগুলির মধ্যে। তবে শঙ্করের ভাষ্য থেকে এটা উপলব্ধি করা যায় যে, এর পূর্বেও গীতার আরও ভাষ্য ছিল।
● গীতার মূল তত্ত্ব হলো, শঙ্কর অর্থাৎ আদি শঙ্করাচার্যের মতে, মুক্তি (মোক্ষ) একমাত্র সঠিক জ্ঞানের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব। কর্তব্য পালনের সঙ্গে যুক্ত জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি সম্ভব নয়। শঙ্করের বক্তব্য হলো অজ্ঞানতার পর্যায়ে আমাদের পক্ষে কর্তব্য পালন ভালো। কিন্তু জ্ঞানের স্তরে উন্নীত হওয়ার পর তা মোটেই ভালো নয়। ব্রাহ্মণের সাথে একাত্মতায় সঠিক জ্ঞানের উন্মেষ ঘটে, অজ্ঞানতা অপসারিত হয় দ্বৈততা সম্পর্কিত ধারণা এবং তাকে কেন্দ্র করে সমস্ত দায়িত্ব ও কার্যধারা অন্তর্হিত হয়। গীতা সম্পর্কিত ব্যাখ্যায় শঙ্করের বক্তব্য হলো, মনকে শুদ্ধতার স্তরে উন্নীত করার জন্য বিভিন্ন কর্তব্য পালন খুবই প্রয়োজন, এই বিশুদ্ধ মননের মাধ্যমে সঠিক জ্ঞান অর্জন সম্ভব। শঙ্করের ‘ভাগবতগীতা ভাষ্য’-র উপরে ব্যাখ্যা দিয়েছেন আনন্দ জ্ঞান, রামানন্দ, ও যমুনাচার্য নামে তিন ব্যক্তি প্রমুখ।
● বৈদিক ধর্ম এক সময়ে শৈব, বৈষ্ণব, শাক্ত ইত্যাদি নানাভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এছাড়াও অসংখ্য গ্রাম্য দেবতা ও ঈশ্বরও ছিল। বৈদিক ধর্ম এইভাবে বহু ঈশ্বরবাদে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। কোনো একটি একক প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্ব দাবি করতে পারেনি। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে লড়াই হয়েছে। বিশেষকরে শৈব ও বৈষ্ণবদের মধ্যে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ বেঁধে যেত। অদ্বৈতবাদের আবির্ভাবে ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায়গুলির মধ্যে কিছু সাধারণ বিষয় (common factor) চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। প্রতিটি সম্প্রদায় বেদ, উপনিষদ ও সূত্রগুলিকে নিজস্বভাবে ব্যাখ্যা করে। এই ব্যাখ্যাগুলিকে ভিত্তি করে বেদ, উপনিষদের উপর একচেটিয়া অধিকার প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে এইগুলির অনুশীলনে উদ্যোগী হয়। এই সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে এক সংহতির প্রক্রিয়াও শুরু হয়। সমগ্র ভারত চেতনা ধীরে ধীরে সংহত হয় ও আজকের ভারতের হিন্দুত্বের আকার ধারণ করতে থাকে। অদ্বৈতবাদের এক্ষেত্রে যেমন ভূমিকা ছিল, আবার ভাগবত গীতাও অদ্বৈতবাদের পর এই প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পলন করে। তাই তো আমরা দেখি, বর্তমান সময়ে ভাগবত গীতা গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু ধর্মগ্রন্থ।
● গীতায় ব্যক্ত দর্শনের সাথে সাংখ্য দর্শনের সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিষ্কার। আবার বেদান্ত দর্শনের সাথেও গীতার পার্থক্য অত্যন্ত স্পষ্ট। এ ব্যাপারে এখানে বিশদ আলোচনার সুযোগ নেই। গীতায় উপনিষদের প্রভাব স্পষ্ট। গীতায় কোনো ক্ষেত্রেই ‘ব্রাহ্মণ’কে চূড়ান্ত বাস্তবতা বলে স্বীকার করেনি। ‘মায়া’ কে ‘গুণ’-এর অন্যতম হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দার্শনিক ‘শ্রীধর’ মায়া-কে ঈশ্বরের শক্তি হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
● ভগবান বিষ্ণুর অবতার শ্রীকৃষ্ণের মুখ নিঃসৃত বাণী বলে ‘গীতা’-কে মনে করা হয়। শঙ্কর ছিলেন শৈব। শৈব সংস্কারবাদের পক্ষে তাঁর অবস্থান থাকলেও তিনিই ‘গীতা ভাষ্য’ রচনা করেছিলেন। বৈষ্ণববাদীরা শঙ্করের অধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন করেনি। গীতা হলো অর্জুনের প্রতি স্বয়ং ঈশ্বরের উপদেশ। তবে, যুদ্ধ শুরুর প্রাক্ মুহূর্তে (কৌরব ও পাণ্ডবদের যুদ্ধ) যুদ্ধক্ষেত্রে দুই যুদ্ধাগ্রহী দলের সামনে এমন নির্মোহ সুদীর্ঘ কথোপকথন অন্যান্য সেনা ও রাজন্যবর্গের কেমন লেগেছিল সে বিষয়ে ‘গীতা’ কিন্তু নীরব। অর্জুনের প্রশ্ন ছিল এই যুদ্ধ তিনি পরিত্যাগ করবেন কী না? এই প্রশ্নের উত্তর কৃষ্ণ যা দিয়েছিলেন, দুইজনের যে কথোপকথন - তাই নিয়েই গীতা।
● ঐতিহাসিকদের মতে মহাভারতে গীতার অন্তর্ভুক্তি অনেক পরে। গীতায় ৭০০টি শ্লোক রয়েছে। ১৮টি অধ্যায়ে শ্লোকগুলি বিভক্ত। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে গীতা রচিত। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের এটাই মত। কেউ কেউ গীতাকে প্রথম শতাব্দীর সৃষ্টি বলে ব্যাখ্যা করেন। এটা প্রথম দিকের চিরায়ত সংস্কৃতে রচিত।
● ভারতে সুদীর্ঘকাল ধরে গীতা ও মহাভারতের লেখক হিসাবে ব্যাস মুনিকে চিহ্নিত করা হয়। তবে গীতা দীর্ঘকাল পরিচিতির আড়ালে ছিল। একে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে আদি শঙ্করাচার্য তাঁর ব্যাখ্যার মাধ্যমে একে জনপ্রিয় করেন।
● তবে মহাভারত ও গীতা, এই দুইয়ের ভাষাগত পার্থক্য প্রায় শতাধিক বর্ষের। গীতার ব্যাকরণ ও বাক্যশৈলী অবশ্যই উন্নততর। সুতরাং, বলা যেতে পারে যে, কিছু বুদ্ধিমান মানুষ তাদের দার্শনিক চিন্তার সংকলন কৃষ্ণের নাম ব্যবহার করে প্রকাশ করার মাধ্যমে কর্তৃত্ব বজায় রাখার প্রয়াস গ্রহণ করেছিলেন। গীতায় ১৮টি অধ্যায়ের কথা বলা হয়েছে। অধ্যায়গুলিকে ‘যোগ’ নামে অভিহিত করা হয়। প্রতি যোগ বিভিন্ন দার্শনিক ভাবনা ও পরস্পর বিরোধী চিন্তা ভাবনা প্রকাশ করে। এখানে সাংখ্যযোগ ও কর্মযোগ দুটি বিপরীতধর্মী ভাবনার প্রকাশ ঘটেছে। একটি ক্ষেত্রে অর্জুনকে পার্থিব স্বাচ্ছন্দ্য ও ক্ষমতা ভোগের কথা বলা হয়েছে, অন্য ক্ষেত্রে এই বিশ্ব অলীক বা ভ্রম বলা হয়েছে। পরিশেষে ঈশ্বর তার প্রকৃত রূপ (বিশ্বরূপ) অর্জুনকে (যা আর কারো কাছে দৃশ্যমান নয়) তুলে ধরে বলেন, হত্যাকারী ও নিহত উভয়ই তাঁর নিজস্ব রূপ। সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্ত করতে পারি যে, গীতা দ্বিমুখী উদ্দেশ্য নিয়ে রচিত। প্রথম উদ্দেশ্য ছিল, বৌদ্ধ, জৈন ও লোকায়ত দর্শনের চ্যালেঞ্জের পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন দার্শনিক মতগুলিকে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সমন্বিত রূপ দেওয়া ও দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল, জনগণের মানসিকতায় শ্রেণিগত মতাদর্শ তুলে ধরা।
● গীতা বর্ণ ব্যবস্থাকে স্বীকৃতি দিয়ে ঘোষণা করেছিল যে, ঈশ্বরই ন্যায়সঙ্গত চারটি বর্ণ সৃষ্টি করেছেন।
● গীতা কর্মফল ও পুনর্জন্মের দর্শনকে সমর্থন করে।
● গীতা নিঃশর্তভাবে ঈশ্বরে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। এর অর্থ হলো প্রশ্নহীন, যুক্তিহীন, অনুসন্ধিৎসাহীন আনুগত্য। সত্যানুসন্ধানের কোনো প্রয়োজন নেই, বৈজ্ঞানিক জ্ঞানচর্চার প্রয়োজন নেই।
● গীতার পরামর্শ হলো কোনো ফলের আশা না করে মানুষ দায়িত্ব পালন করবে। সেই জন্যই আমরা দেখি, বর্তমান ভারতের শাসকশ্রেণি সম্ভাব্য সমস্ত উপায়ে গীতার আদর্শ প্রচারকে শ্রেয় মনে করে। আজ আমরা শুনছি, নিয়মিত পাঠক্রমের অংশ হিসাবে স্কুলে গীতা পড়ানো হবে। গোরক্ষপুরের গীতা প্রেস বিভিন্ন ভাষায় বারো কোটিরও বেশি এই বই অর্থাৎ গীতা মুদ্রণ ও বিতরণ করেছে। এমনকী গীতার ভাষ্যগুলি বক্তৃতার আকারে দৃশ্যশ্রাব্য মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। আমাদের মতাদর্শগত সংগ্রামে মানুষের মধ্যে গীতার প্রভাব একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই বিষয়ে আমাদের চর্চা চালিয়ে যেতে হবে।
ভক্তি আন্দোলন
● অদ্বৈতবাদী দর্শন ও গীতার দর্শনের সাহায্যে ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর মধ্যে শাসকশ্রেণি তার শ্রেণিশাসন ও বর্ণ ব্যবস্থাকে সুসংহত করেছিল। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ব্রাহ্মণ্যবাদের আধিপত্যকে পথ দেখিয়েছিল। সামন্তবাদ তার বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। নতুন পরিস্থিতিতে ধর্মীয় ও মতাদর্শগত ধ্যান ধারণায় নতুন সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। দক্ষিণ ভারতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে শৈব ‘নায়ানার’ ও বৈষ্ণব ‘আলোয়ার’ সম্প্রদায় এই ভক্তি আন্দোলনের প্রচার করেছিলেন।
● ভক্তি আন্দোলনের বার্তা ছিল, ঈশ্বর কারো একার নয়, কোনো আচার অনুষ্ঠানের পরিবর্তে সম্পূর্ণ ভক্তি ঈশ্বর উপাসনার একমাত্র উপায়। ঈশ্বর সর্বব্যাপী, তাই মন্দিরে তার সন্ধানের প্রয়োজন নেই। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র সবার ঈশ্বর এক, মৃত্যুর পর সবারই এক পরিণতি। নিষ্ঠার সঙ্গে প্রার্থনা করলে সকলেই মোক্ষ বা পরিত্রাণ লাভের যোগ্য। ভক্ত ও ভগবানের সম্পর্ক রাজা ও রাজ্যের মতোই সহজ।
● ভক্তি আন্দোলনে ব্যক্তিগত ঈশ্বর এবং ভক্ত-র ঈশ্বরের প্রতি পারস্পরিক গভীর আবেগপূর্ণ সংযুক্তি এবং ভালবাসার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভাগবত গীতায় বলা হয়েছে, ভক্তির পথ অথবা ভক্তিমার্গ অন্য দুই ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির থেকে উন্নততর। দুইটির একটি হলো জ্ঞানের পথ এবং অপরটি হলো ritual ও ভালো কাজের পথ (কর্ম)। ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল দক্ষিণ ভারতে সপ্তম থেকে দশম শতাব্দীতে। আলভার ও নায়ানার তামিল ভাষায় পদ্য রচনা করেছিলেন। পদ্যগুলি যথাক্রমে বিষ্ণু ও শিবের প্রতি নিবেদন করা হয়েছিল। পূর্বে তামিল ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। ভক্তি আন্দোলন দ্রুত দক্ষিণ থেকে উত্তর ভারতে প্রসারিত হয়। দশম শতাব্দীতে সংস্কৃতে প্রকাশিত ভাগবত পুরাণে উল্লেখযোগ্য আকারে ভক্তি দর্শনের প্রকাশ ঘটে। ঈশ্বরের কাছে নিজেকে সমর্পণের যে ঐতিহ্য ইসলাম ধর্মে রয়েছে তার প্রভাব পড়েছিল ভক্তি ধারণা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে। কবির (১৪৪০-১৫১৮) ইসলাম ধর্ম থেকে সুফির উপাদান উপস্থিত করলেন।
● ভক্তি আন্দোলনের প্রাচীন সাধক রামানুজ একাদশ শতাব্দীতে অদ্বৈতবাদের একটি ধারা, বিশিষ্ট অদ্বৈত প্রচার করেছিলেন। তিনি ধর্মতত্ত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জনমানসে পবিত্র মন্ত্র ও তার সারমর্ম প্রচার করেছিলেন। রামানুজের ভাবনা মনুস্মৃতির বিরুদ্ধে ছিল। আবার তিনি বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভক্তিবাদে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কৃষ্ণকে ভালবাসা (প্রেম)-এর ঈশ্বর হিসাবে বর্ণনা করে তাঁর ‘ভাগবত পুরাণ’ জনপ্রিয় হয়েছিল। কবি তুলসীদাস লোকপ্রিয় হিন্দি রামায়ণের রচয়িতা। তুলসীদাসের রামায়ণে রাম কোনো অতিমানব নন বরং একজন অনুকরণযোগ্য আদর্শ মানুষ। ভক্তি আন্দোলনে প্রার্থনার কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম না থাকায় গ্রামে গ্রামে রামের মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্রাহ্মণদের আচার-অনুষ্ঠানের প্রাধান্য এই মন্দিরগুলিতে ছিল না। ভজন গান উপাসনার নতুন প্রকরণ হয়ে ওঠে। বাংলায় ভক্তি আন্দোলনের পথিকৃৎ চৈতন্য কৃষ্ণকে পুরুষাকারের প্রতীক গণ্য করে নর-নারী নির্বিশেষে ভক্তদের প্রেমিক (নারী শক্তি) রূপে সার্বজনীন ভালবাসা প্রচার করেন। কনৌজের রামানন্দ রামভক্তির কথা বলেন ও সমস্ত বর্ণের মানুষদের নিয়ে পঙক্তি ভোজনের মাধ্যমে সামাজিক সংস্কার করেন।
(ক্রমশ)