৬০ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৩ আশ্বিন, ১৪২৯
উৎসবের আলো ম্লান ওদের বঞ্চনার গাথায়
ইন্দ্রজিৎ ঘোষ
শহর কলকাতা এখন সেজে উঠছে তার প্রিয় উৎসবে। আর যে হাতেগোনা কয়েক দিন। বিগত দু’বছরের অতিমারী শেষে শহর এখন সুস্থ, তাই এবার উৎসবের আন্দোচ্ছ্বাস চরমে... প্রতিদিনের আলাদা আলাদা প্ল্যানে তাই আলাদাই গন্ধ। শরতের নীল আকাশ, পুকুরে পদ্ম, কাশ ফুলে ভরে উঠেছে নদীর চর, শিউলি ফুলে ভরেছে উঠোন, সাথে ঢাকের বাদ্যি।
‘‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির...’’
উৎসবমুখর বাঙালির আলাদাই উন্মাদনা...
কিন্তু এবারও উৎসবের আমেজ নেই ওদের চোখে... ওরা আজও বসে আছে উজ্জ্বল শহরের অন্ধকার এক কোণে। ওদের চোখে ‘পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি’।
যেখানে ওদের বসতে গেলেও অনুমতি নিতে হয়েছে আদালতের। কারণ অনুদানের আলোর ঔজ্জ্বল্যে স্থান হয়নি যোগ্য প্রাপকের। তাই ওরা এখনো অন্ধকারে।
শারদ উৎসবের কয়েকটা দিন বসতে দেবে না প্রশাসন। উৎসব মিটে গেলে আবার অবস্থান আন্দোলন চলবে।
ওরা কারা? ওরা হবু শিক্ষক। ওরা সমাজ গড়ার কারিগর। ওরা আমার আপনার ঘরের ভবিষ্যৎ।
৫৬০ দিন বৃষ্টি ভিজে, প্রখর দাবদাহে, হাড়হিম ঠান্ডায় ফুটপাথে চাকরি চেয়ে আন্দোলনে।
মা-বাবা সারাজীবন দাঁতে দাঁত চেপে নিজের শখ আহ্লাদকে উপেক্ষা করছেন এই বিশ্বাসে যে, সন্তানের হাত ধরে হাল ফিরবে সংসারের। সন্তানের ঝোলাতে ডিগ্রি আছে কিন্তু ঘুষ দেবার মতো সামর্থ্য নেই।
বিএ, এমএ, এমএসসি, বিএসসি, বিএড পাশ করা কয়েক লক্ষ বাংলার সন্তান রোজ হতাশায় তলিয়ে যাচ্ছে আর চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখছে তার সংসারটাকে! সেও তার যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ চায়।
টিভি খুললেই রাজনৈতিক তরজা। পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাত। কোটি কোটি টাকা উদ্ধার, প্রাক্তন মন্ত্রীর একাধিক বান্ধবী, নামে-বেনামে সম্পত্তি, কয়লা, বালি, গোরু, চাকরি চুরির নিদারুণ বাস্তব। আর শাসকের নিদারুণ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি।
বারবার স্বপ্ন ভাঙে বাংলার যুব সমাজের।
শহরের প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার বুকে ওরা চালিয়ে যাচ্ছে ওদের লড়াই। সমস্ত যোগ্যতার পরেও ওরা শাসকের ‘খেলা হবে’ স্লোগানের শিকার হওয়া একটা প্রজন্ম। কিন্তু ওরা কী শুধুই নিজেদের প্রাপ্যটুকু বুঝে নেওয়ার লড়াই লড়ছে? ভিটেমাটি ছেড়ে পুলিশের লাঠি জলকামান সহ্য করছে। ভেবে দেখলে দেখা যায় ওরা লড়ছে বৃহত্তর লড়াই।
একটা পরীক্ষার দুর্নীতি হয়েছে এমন নয়। আজ কলকাতায় সল্টলেক মিলিয়ে প্রায় ৭ জায়গায় আন্দোলন করছে ৭ রকম চাকরিপ্রার্থীরা।
ধর্মতলার গান্ধীমূর্তির নিচে বসে আছে এসএসএসটি (নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের চাকরিপ্রার্থীরা) পরীক্ষা দেয়নি, পরীক্ষায় পাশ করেনি, ইন্টারভিউ দেয়নি, Rank যাদের পিছনে তারা চাকরি করছে, আর যোগ্যতা থাকার পর ঘুষ দিতে না পারার অপরাধে ওরা আজ বঞ্চিত।
আদালতে প্রমাণিত দুর্নীতি হয়েছে। মন্ত্রীর জেল হয়েছে, প্রাক্তন এসএসসি-র চেয়ারম্যান জেলে, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান জেলে, তাও ওরা সুবিচার পাচ্ছে না।
তার একটু দূরে মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির পাদদেশেও অনেকে বসে আছে অনেকদিন। বসে আছে ২০১৪ সালের প্রাইমারি টেট পাশ করা যুবক-যুবতীরা। ২০১৭ ও ২০২১ সালে অসংখ্য ভুয়ো নিয়োগের কারণে এই যোগ্যরা আজ বঞ্চিত।
আদালতের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত করছে। চাকরি খোয়া গেছে অনেকের। প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মানিক ভট্টাচার্যকে সিবিআই জেরা করছে প্রতিদিন, জেলে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা মানুষ বলছে। তাও সরকার ওদের চাকরি দিচ্ছে না। ৮টা বছর ওদের জীবন থেকে কেড়ে নিল।
পাশেই বসে আছে এসএসসি গ্রুপ সি, গ্রুপ-ডি।
ভুয়ো নিয়োগের কারণে যোগ্যরা আজ বঞ্চিত। আদালতের নির্দেশে চাকরি গেছে অনেকের, সিট ফাঁকা, তারপরও ওরা নিয়োগ পাচ্ছে না।
তার পাশে বসে আছে সরকারি দপ্তরে গ্রুপ-ডি পোস্টে নিয়োগের কর্মপ্রার্থীরা। ২০১৬ সালে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে বসে আছে। লাগাতার আন্দোলন করেছে। খালি গায়ে মিছিল করেছে। সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বারবার তারপরও নিয়োগ নেই।
২০১৫ সালে আপার প্রাইমারি (৫ম থেকে ৮ম) শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছিল।
২০১৬ সালে ফল প্রকাশ। তারপর ইন্টারভিউ, দুর্নীতির অভিযোগে আদালত পুরো প্যানেল বাতিল করে। পরে আবার ইন্টারভিউ। ৬ বছরে একটাও সিট বাড়েনি। অসংখ্য আন্দোলনের পর অসংখ্য প্রতিশ্রুতি, কিন্তু নিয়োগ নেই। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরও নিয়োগ করছে না ২০১৪ সালে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের পাশ করা শিক্ষক হওয়ার প্যানেলে থাকা চাকরি প্রার্থীদের।
২০১৭ সালে নোটিফিকেশন করে ২০২০’তে পরীক্ষা নিয়ে ২০২১ সালে রেজাল্ট প্রকাশ করেছে প্রাইমারিতে শিক্ষক নিয়োগের জন্য। ১ বছর হতে চলল কোনো কারণ ছাড়াই নিয়োগ নেই।
গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজু গাজী নামে এক পরীক্ষার্থী এই বঞ্চনার প্রেক্ষিতে আশার আলো দেখতে না পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেন।
২০১৬ সালের পর এই রাজ্যে যারা বিএড, ডিএলএড করেছেন তাদের চাকরি পাওয়া তো দূরের কথা তারা একটা পরীক্ষায় বসার সুযোগও পেল না।
এছাড়াও স্বাস্থ্য দপ্তরে, বিদ্যুৎ দপ্তরে, পুলিশ কর্মী নিয়োগেও ব্যাপক দুর্নীতি। ২০২০ সালের পর রাজ্য সরকারের কোনো দপ্তরে নিয়োগের কোনো নোটিফিকেশন নেই।
রাজ্যের যুব সমাজ কর্মসংস্থানের দাবিতে লড়াই করছে। তারা ইনসাফ চায়।
গত কয়েকদিন আগেও মুখ্যমন্ত্রী সাড়ম্বরে নেতাজি ইন্ডোরে পালন করেছেন ‘উৎকর্ষ বাংলা’ - যেখানে পরেরদিনই দেখা যায় নিয়োগপত্র ভুয়ো।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, কারিগরি শিক্ষামন্ত্রী তাঁরা সই করলেন, ঘোষণা করলেন, অথচ তারা জানলেনই না যে, কাগজগুলো আসল কী নকল!!! এত অযোগ্য মন্ত্রীসভা পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে সর্বপ্রথম। বাংলার আজ এমনই অবস্থা যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থেকে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের চেয়াররম্যান - যাদের কিনা সই থাকে মার্কসিটে তাঁরাই আজ জেলে।
এদের অযোগ্যতার দায়ে বাংলার যুব সমাজের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকারে। উৎসবের আলো-গন্ধ বাংলার যুবদের কাছে আজ ম্লান।
আদালতের নির্দেশে সিবিআই-ইডি তদন্ত করছে। আদালতের নির্দেশেই দোষীরা সামান্য হলেও শাস্তি পাচ্ছে। ববিতার মতো আইনি লড়াই করে ইনসাফ পাচ্ছে কয়েকজন।
প্রতিদিনের রাস্তার লড়াই বড়ো হচ্ছে। এই লড়াইতে চাপে পড়ছে লুটেরা শাসকের দল। পিছু হটছে। আশার আলো দেখছে বাংলার যুব সমাজ। আর এই লড়াইয়ের অন্যতম কারিগর তারা নিজেরাই। এটাই বাংলার যুব সমাজের লড়াকু সৈনিকদের টিম স্পিরিট। ইনসাফ সভা, তাই বড়ো উৎসব।