৬০ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৩ আশ্বিন, ১৪২৯
উৎসবের মরশুমে বাংলার অন্নদাতারা কেমন আছেন?
সুপ্রতীপ রায়
রায়গঞ্জে ব্যারিকেড ভেঙে সিপিআই(এম) কর্মীদের জেলাশাসক দপ্তর অভিযান।
উৎসবের মরশুম। মুখ্যমন্ত্রী অনেক আগেই পূজার বাজনা বাজিয়েছেন। সরকারি ছুটি দিয়ে দুর্গাপূজার প্রাক্ শোভাযাত্রা হয়েছে। ক্লাবগুলির অনুদানের টাকার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে। আসলে বাস্তব সত্যকে চাপা দেওয়ার জন্যই এসব। উৎসবের মরশুমে অন্নদাতারা কেমন আছেন? এরাই জনগণের সিংহভাগ।
রাজ্য সরকার চাষিদের বিপদে ফেলে কৃষিকে করপোরেট হাঙরের মুখে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা পাকা করেছে। সারে কালোবাজারি আমাদের রাজ্যে বৈধ রূপ পেয়েছে। মমতা ব্যনার্জির সরকার যত বিজ্ঞাপনই দিক না কেন ফসলের ন্যায্য মূল্য অধরা। কৃষি ও গ্রামীণ মজুরদের হাতে কাজ নেই। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না পাওয়ার জন্য চাষির লোকসানের বহর বাড়ছে। রাজ্য সরকার ঘোষিত মূল্যে ফসল কিনছে না।‘কৃষক বন্ধু’র নামে ধোঁকা দেওয়া হচ্ছে।
গ্রামে শিবির করে ধান সহ সমস্ত ধরনের ফসলের সরকারি দাম নির্ধারণ করে কেনার কথা রাজ্য সরকার অনেকবার বললেও তা যে স্রেফ ভাঁওতা ছাড়া কিছুই নয় তা প্রমাণিত। প্রকল্পের মাধ্যমে ভিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। মূল লক্ষ্য ভোট। কৃষকদের স্থায়ী সমস্যা সমাধানে কোনো পরিকল্পনা রাজ্য সরকার গ্রহণ করেনি। বাংলার কৃষকরা বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। কৃষকদের বাঁচানোর জন্য পৃথক কোনো ব্যবস্থা গত ১১ বছরে তৃণমূল সরকার করেনি।
গত ১১ বছরে তৃণমূল সরকারে আসার পর একাধিক প্রকল্প ঘোষণা করেছে। কিন্তু সেগুলির কয়টি চালু আছে? কোনো প্রকল্প কী কৃষকের কাজে লেগেছে? ‘সুফল বাংলা’ নামে একটি সরকারি প্রকল্প চালু করা হয়েছিল। যদিও সেটি কার্যত অকার্যকর অবস্থায় রয়েছে। অন্নদাতাদের বাঁচানোর জন্য রাজ্য সরকার ফসলের দাম নির্ধারণ,সরকারি উদ্যোগে ফসল ক্রয় করা,ন্যায্য মূল্যের দোকানের মাধ্যমে বিক্রি করার ব্যবস্থা করলে বোঝা যেতো অন্নদাতাদের সঙ্গে ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর সরকার আছে। ২০১১-র নির্বাচনের আগে ব্লকে ব্লকে কিষান মান্ডি, বহুমুখী হিমঘর স্থাপন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু তা প্রতিশ্রুতিই থেকেছে। রূপায়িত হয়নি।
রাজ্যের সমবায় ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বামফ্রন্ট সরকার সমবায়ের মাধ্যমে সার,বীজ সরবরাহ করে প্রান্তিক ও দরিদ্র চাষিদের বাঁচিয়েছিল। কৃষি সমবায়গুলিতে গণতান্ত্রিক পরিচালন ব্যবস্থা নেই। সেসব লাগামহীন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। বাস্তবে কৃষি নিয়ে কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেই।
সারের কালোবাজারি প্রকাশ্যে চলছে। খোলা বাজারে এমআরপি’র থেকে ৩০০/৩৫০ টাকা বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে। তৃণমূলের মদতে এসব চলছে। সারের কালোবাজারি চাষিদের সমূহ বিপদে ফেলেছে। সার ব্যবসায়ীরা যে সার বিক্রয় করছেন তা ঘোষিত দামের থেকে অনেক বেশি।
বামফ্রন্ট সরকারের সময় বর্গা আইন কৃষকের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তৃণমূলের জমানায় বর্গা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ব্যাপক বর্গা উচ্ছেদ হয়েছে। জমির মালিকরা এখন জমি লিজ দিচ্ছে। এই অংশ ফড়ে বা দালালদের কাছে তাদের জমির কাগজপত্র ভাড়া দিচ্ছে এবং তাদের সরকারি দরে ফসল বিক্রির টাকা থেকে একটা কমিশন দিতে হচ্ছে, আবার নিজেরা অন্য কাজ করে আয় করছে। প্রকৃত গরিব কৃষক অনেকের কাছে জমির কাগজপত্র না থাকার ফলে সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এমনকী কিষান মান্ডিতে ফসলও বিক্রি করতে পারেন না। বাংলার প্রকৃত কৃষক মরশুমি ভিত্তিতে কৃষক অনুদান, ফসলের বিমা ও সরকারি মান্ডিতে তারা ফসল বিক্রি করার অধিকার থেকে বঞ্চিত। বাংলায় গ্রামীণ ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বাড়ছে।
মমতা ব্যানার্জির দাবি, বাংলায় কৃষকের আয় বেড়েছে। চাষে লাভ হচ্ছে। এটি নির্মম রসিকতা ছাড়া আর কিছুই নয়। গত ৪ জুন’২২ ‘ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি’তে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রামাণিক দেখিয়েছেন বাংলার কৃষকের প্রকৃত অবস্থা কী। চাষে লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। গ্রামীণ পরিবারগুলির আয়ের বেশিরভাগই আসে অকৃষি ক্ষেত্র থেকে। প্রামাণিক পূর্ব বর্ধমান, পুরুলিয়া, জলপাইগুড়ি ও উত্তর দিনাজপুর জেলার উপর সমীক্ষা চালিয়ে দেখিয়েছেন, গ্রামীণ পরিবারগুলির গড় মাসিক আয় ৮,২৭০ টাকা। এর মধ্যে কৃষিকাজ থেকে আসে ২,৪৮৭ টাকা বা মোট আয়ের ৩০ শতাংশ। ৪৬ শতাংশ আয়ের উৎস মজুরি অথবা ভাতা। প্রান্তিক কৃষক পরিবারগুলির আয়ের ৮৬ শতাংশ আসে অকৃষি ক্ষেত্র থেকে। প্রান্তিক ও ছোটো চাষিদের আয়ের উৎস ঠিকা কাজ থেকে।
মমতা ব্যানার্জি মুখে যাই বলুন না কেন, তিনি আসলে করপোরেট বান্ধব। কৃষিতে তৃণমূলের আমলে প্রকৃত বরাদ্দ কমেছে। প্রকৃত ঋণের সুযোগ কমার ফলে চাষি মহাজনি ঋণের ফাঁদে পড়ছে। চরম সংকটে অন্নদাতারা।
বাংলায় গত কয়েকবছরে কৃষি জমিতে চুক্তি চাষের প্রবণতা বেড়েছে। মোট কৃষির যে উৎপাদন তাতে বড়ো অবদান থাকে গরিব চাষির। কিন্তু এই গরিব চুক্তি চাষিদের স্বার্থ রক্ষায় সরকার উদাসীন। আমাদের রাজ্যে আলু সহ বিভিন্ন ফসলে চুক্তি চাষের প্রসার ঘটেছে। ঠিকা চাষও বাড়ছে। মৌখিক চুক্তির ভিত্তিতেই জমি ঠিকা নেওয়া হয়। কিন্তু লাভ কোথায়? ঠিকা চাষে জমির মালিক ভাড়া বাবদ অর্থ বা ফসলের ভাগ পায়। চাষের সমস্ত খরচ ঠিকা চাষির।
ভাগ চাষের ক্ষেত্রে মালিক সার,কীটনাশক সহ চাষের বিভিন্ন খরচের ৫০ ভাগ বহন করে। কিন্তু ট্রাকটর, শ্রমিকদের দাম সবটা মেটানোর পর লাভ বলে কিছু থাকে না। ভাগচাষিদের সমবায় থেকে ঋণ পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বর্তমানে গরিব ভূমিহীনরা ব্যয় সাধ্য চাষ করতে পারেন না। এঁরা যাবেন কোথায়?
১৯ নভেম্বর ’২১ নরেন্দ্র মোদি যখন তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন তখন আমাদের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন,‘‘আমি কৃষক আন্দোলনের পক্ষে ছিলাম’’। মিথ্যা কথা বলায় দক্ষ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। মমতা ব্যানার্জি ও তাঁর দল কখনই এই ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না। ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল - এমএসপি’র স্বীকৃতি চাই। আমাদের রাজ্যে এমএসপি’র হাল কী? সে চিত্র ভয়ঙ্কর। এমএসপি’র সব সুবিধাটা প্রকৃত কৃষক পান না। কৃষকের ফসলের দাম লুট করছে গ্রামে গ্রামে তৃণমূলের মস্তানরা। তারাই কৃষক সেজে সুবিধা নিচ্ছে। কৃষকরা ফসলের ন্যায্য দাম পান না। ওটা চলে যাচ্ছে তৃণমূলের গুন্ডা, দালাল, ধানকল মালিকদের পক্ষে।
পাটচাষিদের অবস্থা কেমন? আমাদের রাজ্যের পাট চাষের ক্ষতি বাড়ছে,সংকট দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে।বাংলায় প্রায় ৪০ লক্ষ পাট চাষি। জমিতে পাট চাষ করে লাভ প্রায় থাকে না বললেই চলে। পাট বিক্রির দাম গত কয়েক বছরে নিম্নগামী। ফড়েদের দাপট বাড়ার ফলে পাটচাষি লাভের মুখ দেখতে পান না। চটকলগুলির এজেন্ট বা আড়তদাররা পাট চাষিদের ঠকায়। রাজ্য সরকার নির্বিকার।
আবার জেসিআই পাট চাষিদের নানাভাবে হয়রান করে। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, চাষিরা জেসিআই-কে তাদের পাট বিক্রয় করতে পারে না। ফলে চাষি ফড়েদের খপ্পরে পড়ে। কম দামে পাট বিক্রয়ে সহায়তা করে। এটা পরিষ্কার জেসিআই’র কর্মীদের সহায়তা করে। জেসিআই’র কর্মীদের সঙ্গে ফড়ে ও বড়ো বড়ো আড়তদারদের অনৈতিক বোঝাপড়া থাকে। বিগত কয়েক বছরে জেসিআই ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দিয়ে পাট ক্রয়ের পরিমাণ কমিয়েছে।
এখনও পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম। ফলে দক্ষিণবঙ্গে পাট উৎপাদক জেলাগুলির চাষিরা বিপদে রয়েছেন। পাট ভেজানোর জলের অপ্রতুলতার কারণে পাটের দাম অনেকটা নেমে গেছে। পাট উৎপাদন এবছর কম। কিন্তু কোনো সরকারি সহায়তা নেই। বাংলার বাজারে পাটের দাম নিয়ন্ত্রণ করে বড়ো ব্যবসায়ীরা। পাটের এমএসপি কুইন্টালে যা হওয়া উচিত ছিল তার থেকে কেন্দ্রীয় সরকার যে ঘোষণা করেছে তা অর্ধেক।
ধান চাষিদের অবস্থা কেমন? তৃণমূলের আমলে ধান চাষিরা ধান বিক্রির সময় ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পান না। গত কয়েক বছরে সরকার যত বেশি ধান কিনেছে তত বেশি পকেট ভরতি হয়েছে দালালদের। ধান বিক্রি নিয়ে সরকার যে সব নিয়ম ফাঁদেন তাতে বিপদে পড়েন গরিব চাষিরা। সরকার যে ধান কেনেন তার বেশিরভাগটাই সরবরাহ করে ফড়েরা।
সরকারের কাছ থেকে ধান বিক্রির খবর চাষিদের কাছ থেকে আগে পায় গ্রামের তৃণমূলের মাতব্বর ও দালালরা। অনেক কষ্টে চাষি ধান বিক্রয়ের টোকেন পেলেও বিক্রির তারিখ পড়ে অনেক দেরিতে। মান্ডিতে ধান বিক্রি করতে গিয়েও ফেরত আসতে হয়। ফলে সে অভাবী বিক্রয়ে বাধ্য হয়, আবার চালকল চাষির কাছ থেকে ধান কিনলেও কুইন্টাল পিছু অনেকটা ধান বাদ দেওয়া হয়।
গত কয়েক বছরে বাংলার কৃষি ক্ষেত্রে ফড়েরাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মূল চাষিকে বিপদে ফেলে চালকল মালিকদের এজেন্ট, হিমঘরের মালিক, বড়ো ব্যবসায়ী,সার-বীজের ডিলারদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবার খাদ্য দপ্তর, চালকল মালিক ও তৃণমূলী নেতাদের আঁতাতের ফলে অনেক ধান কেনা হয় কেবল মাত্র কাগজে কলমে। ধান অডিট করার কোনো ব্যবস্থা এ রাজ্যে নেই। ফলে ধান চাষিরা সমূহ বিপদে।
আলু বা পেঁয়াজের ক্ষেত্রে সরকারি কোনো সহায়ক মূল্য নির্দিষ্ট করা হয় না। পেঁয়াজ চাষিরা লোকসানে পড়েছেন পরিবর্তনের জমানায়। অবৈধ মজুতদারি বেড়েছে। পেঁয়াজ চাষের ক্ষেত্রে একটা বড়ো সমস্যা বর্ষার সময় বীজ সরবরাহ। বীজের দাম ব্যাপক বেড়েছে। রাজ্য সরকারের এবিষয়ে হেলদোল নেই। রাজ্য সরকার উদ্যোগী হয়ে যদি বীজ উৎপাদন করত তাহলে চাষি লাভবান হতো। আলু চাষিরাও বিপদে।
আসলে তৃণমূল সরকার অন্নদাতাদের সরকার নয়। এ সরকার আদানিদের সরকার। কৃষকদের স্বার্থ বলি দিয়ে আদানিদের স্বার্থ রক্ষা করছে। মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কায় পাওয়ার গ্রিডের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ লাইন কৃষকদের কৃষি জমির উপর দিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। কৃষকের জমির সর্বনাশ করে আদানি গোষ্ঠী তাদের উৎপাদিত সমগ্র বিদ্যুৎ বাংলাদেশে পাঠিয়ে বিপুল লাভ করতে চাইছে। এদের পাহারাদার মমতা সরকার।
পশ্চিমবাংলায় বড়ো বড়ো রাইস মিল কিনছে আদানি গোষ্ঠী। আমাদের রাজ্যে চালের বাজার দখল করতে চাইছে আদানি - পূর্ণ সহায়তা দিচ্ছে মমতা সরকার। পশ্চিমবঙ্গের চালের বাজার দখলের জন্য আদানি কোম্পানি জলের দরে রাইস মিল আগামীদিনে কিনবে। কৃষকের সর্বনাশ করে আদানিদের স্বার্থ রক্ষা করছে তৃণমূল সরকার। ইতিমধ্যে আদানি-উইলমার কোম্পানির ফরচুন ব্রান্ডের ভোজ্য তেল, আটা, চাল সহ খাদ্য দ্রব্য গ্রামের মুদির দোকানেও পাওয়া যাচ্ছে। চাষিরা মার খাচ্ছে। আমাদের রাজ্যেও খাদ্যপণ্যের বাজার করপোরেটদের দখলে চলে গেছে। করপোরেট সংস্থা কৃষকদের অভাবী বিক্রয়ের সুযোগ নিয়ে তাদের কাছে ধান বিক্রিতে প্রলুব্ধ করবে। বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হবে কোম্পানি রাজ। কৃষকদের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে চুক্তি চাষ বাড়বে। কার্যত করপোরেট সংস্থা চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে।
উৎসবের মরশুমে অন্নদাতারা বিপদে। তাই আগামীদিনে আরও বড়ো আন্দোলন গড়ে উঠতে চলেছে করপোরেট রাজের বিরূদ্ধে।