৬০ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৩ আশ্বিন, ১৪২৯
তরুণ মজুমদার-স্মরণ সন্ধ্যা
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
তরুণ মজুমদারকে মনে রেখে আয়োজিত সান্ধ্য স্মরণ সভায় উপস্থিত সংস্কৃতিজনেরা।
তাঁর ছবিজুড়ে থাকতো ভালবাসার ছাপ। জীবনের বহুমাত্রিকতাকে আটপৌরে বাক্যের বিন্যাসে সিনেমার ভাষার পরিপূরক করে গল্প বলতেন তরুণ মজুমদার। পৃথিবীটা আরও বাঁচার যোগ্য করে তুলতে হলে জীবনকে ভালবাসতে হয়, আর সিনেমায় সেই জীবনের বর্ণনায় মিথ্যা কথা বলতে নেই - তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন একথা। ২৫ সেপ্টেম্বর তরুণ মজুমদারকে মনে রেখে আয়োজিত সান্ধ্য সভায় গানে-সুরে- কথায় এমনটাই বললেন সংস্কৃতিজনেরা।
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোকশিল্পী সংঘ, জনবাদী লেখক শিল্পী সংঘ এবং সংস্কৃতি সমন্বয় যৌথভাবে এই সভার আয়োজন করে কলকাতার সরলা রায় মোমোরিয়াল হলে।
অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জায় ব্যাকড্রপে থাকা কোলাজে চির তরুণ পরিচালকের অবয়ব এবং পাশে থাকা বাংলায় তাঁর প্রগাঢ় স্বাক্ষর গোটা অনুষ্ঠানকে আলাদা মাত্রায় পরিস্ফুট করেছিল।
আয়োজকদের পক্ষে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের রাজ্য সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায় স্বাগত ভাষণে বলেন, পূর্ণেন্দু পত্রী লিখেছিলেন - ‘‘সন্ধ্যায় কুসুমগন্ধ/ কেউবা সন্ধ্যার শঙ্খনাদ/ অনেকেই বর্ণমালা/ অল্প কেউ প্রবল সংবাদ’’ - তরুণ মজুমদারের জীবন ছিল এমনই অনেক বর্ণমালার মধ্যে প্রবল সংবাদ। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে মানুষের কথা বলেছেন। মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। শেষদিন পর্যন্ত নিজের বিশ্বাস ও আদর্শের সঙ্গে কোনো আপস করেননি। আসুন আমরা তাঁর জীবন উদ্যাপন করি।
এরপর পরিচালক মনীষ ঘোষের ২১ মিনিটের তথ্যচিত্র ‘আলোর পথিক’ প্রদর্শিত হয়। তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয় তাঁর সিনেমার সাদামাটা চরিত্রদের বহুমাত্রিক জীবনের ওঠাপড়ার আনাচে-কানাচের দ্বন্দ্ব নিয়ে সোচ্চার হওয়ার নানাদিক।
তথ্যচিত্রের রেশকে অনুষঙ্গে রেখে তরুণ মজুমদারের ছবিতে ব্যবহৃত রবীন্দ্রসঙ্গীতের মেডলি পরিবেশন করেন গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা। সভায় খালি গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করে তরুণ মজুমদার সম্পর্কে দু-এক কথায় তাঁর অনুভব তুলে ধরেন সঙ্গীতশিল্পী রূপঙ্কর বাগচি।
সভায় প্রবীণ অভিনেতা বিপ্লব চট্টোপাধ্যায় বলেন, তরুণ মজুমদার ছিলেন অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। তাঁর ছবিতে অভিনয় করার মধ্য দিয়ে জীবনে কিছু সম্পদ আহরণ করতে পেরেছিলাম। তিনি ছিলেন আমাদের অভিভাবক ও শিক্ষক। বিশিষ্ট সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত বলেন, আমার গর্বের বিষয় হলো মাননীয় তরুণ মজুমদার, যিনি বাংলা সাহিত্যের দিকপালদের গল্প নিয়ে ছবি করেছেন, তিনি আমার গল্প নিয়ে তাঁর শেষ দুটি ছবি করেছেন। আর দুঃখের ব্যাপার হলো, তিনি বেঁচে থাকলে আরও ছবি করতেন, যা আমাদের সম্পদ হতো। গল্প নির্বাচনের পরেও তাঁর মধ্যে জীবনের যুক্তির নিরিখে তার নির্মাণ যাচাই করে নেবার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আপসহীন। সিনেমার প্রতি ছিল তাঁর এতটাই দায়বদ্ধতা। সঙ্গীতবিদ কল্যাণ সেন বরাট বলেন, ছোট্টবেলা থেকে সিনেমায় গান কীভাবে প্রয়োগ করতে হয়, তা বুঝতে শিখেছি তরুণবাবুর থেকে। সংলাপ থেকে গানে আর গান থেকে সংলাপে চলে যাওয়ার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। অভিনেতা চন্দন সেন তুলে ধরেন এই জটিল সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে লড়াইয়ের প্রশ্নে তরুণবাবুর আকুতির কথা।
সঙ্গীত পরিবেশন করছেন শুভেন্দু মাইতি।
অনুষ্ঠানকে অন্যমাত্রায় নিয়ে যান গণশিল্পী শুভেন্দু মাইতি। তরুণ মজুমদারের ২৫টি ছবির সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিচালকের সম্পৃক্ততার রসায়নকে তিনি তুলে ধরেন ‘জীবনপুরের পথিক রে ভাই’ গানটির গায়নের মধ্য দিয়ে। আবিষ্ট করেন শ্রোতাদের। অনুষ্ঠানে উপস্থিত শ্রোতাদের মনের ভিতরে গুমরে ওঠে তরুণ মজুমদার নামের কিংবদন্তিকে হারানোর বেদনা।
এদিনের অনুষ্ঠানে এছাড়াও বক্তব্য রাখেন, চিত্রপরিচালক অনীক দত্ত, কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, ডাঃ অর্পিতা লাহিড়ী, শুভব্রত দে প্রমুখ। সঞ্চালনায় ছিলেন বাদশা মৈত্র, তপারতি গঙ্গোপাধ্যায় এবং রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন জয়ন্তী সরেন এবং রাজশ্রী ভট্টাচার্য। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ অভিনেতা পরান বন্দ্যোপাধ্যায়।