৬০ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৩ আশ্বিন, ১৪২৯
ব্রিটিশ বিরোধী মুক্তিসংগ্রামে মুসলিমদের ভূমিকা
(১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহ এবং তার আগে ও পরে)
সেখ সাইদুল হক
ব্রিটিশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামে মুসলিমদের ভূমিকা সম্পর্কে ইতিমধ্যেই এই পত্রিকায় দুটি (২৬ আগস্ট ও ২ সেপ্টেম্বর সংখ্যা) সময়োপযোগী নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে বঙ্গভঙ্গ রদ-পরবর্তী সময় হতে ১৯৪৬ পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে আলোচিত হয়েছে। কিন্তু আলোচনা অসমাপ্ত থাকবে যদি আমরা ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে এবং তার আগে ও পরে ব্রিটিশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামে মুসলিমদের ভূমিকাটিকে সামনে না আনি। তাই এই নিবন্ধে আমি ওই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করতে চাইছি।
অবশ্য এই প্রশ্ন আসতে পারে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর অবদান পৃথকভাবে আলোচনা সমীচীন কীনা? কেননা স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগাবান করতে হিন্দু-মুসলমান কাজ করেছে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তথাপি বর্তমান প্রেক্ষাপটে একথা বলা যেতে পারে আমাদের দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে কমিউনিস্টদের ভূমিকাকে যেমন আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে, সেইভাবে মুসলিমদের অবদানকেও সেভাবে প্রচার করা হয়নি। তবে আশার কথা যে বর্তমানে এই বিষয়ে প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে, বহু আলোচনা হচ্ছে, আরও গবেষণা হওয়া দরকার। বিখ্যাত লেখক খুশবন্ত সিং একটি প্রবন্ধে লিখেছেন জনসংখ্যার তুলনায় স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিমদের অবদান অনেক বেশি। আমরা কতজন জানি দিল্লির ইন্ডিয়া গেটে যে ৯৫৩০০ জন স্বাধীনতা সংগ্রামীর নাম উল্লেখিত আছে তার মধ্যে ৬১ হাজার জনের বেশি হলেন মুসলিম অর্থাৎ ৬৫ শতাংশের কাছাকাছি। স্বল্প পরিসরে এই নিবন্ধে আমি বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না চেয়ে কেবল স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী মুসলিম অংশের উল্লেখযোগ্য কিছু নাম যেমন উল্লেখ করব, তেমনি এমন কয়েকজনের কথা বলব যাদের সম্পর্কে আমরা সেভাবে জানিনা। সত্যি বলতে কি সেভাবে জানানো বা প্রচার হয়নি। এর একটা কারণ হতে পারে দেশভাগের পর এদের অনেকেই পাকিস্তানে থেকে গেছেন বা পাকিস্তান চলে গেছেন। তাই আমরা সেভাবে আর তাঁদের মনে রাখেনি, বা রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু স্বাধীনতা আন্দোলন অবিভক্ত ভারতের আন্দোলন। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে যাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনো ভূমিকাই ছিল না সেই সংঘ পরিবার ও তার প্রচারকেরা যখন মুসলিমদের দেশের শত্রু বানাতে চাইছে, স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের অংশগ্রহণকে মুছে দিতে চাইছে তখন এই ধরনের আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক। ইতিহাসবিদেরই এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
উল্লেখযোগ্য কিছু নাম
ব্রিটিশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য যে নামগুলি সম্পর্কে আমরা কমবেশি জানি তাঁরা হলেন, হায়দার আলি, টিপু সুলতান, বাঁশের কেল্লা খ্যাত তিতুমীর (নিশার আলি), মীর কাশেম, মজনু শাহ, শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুরশাহ জাফর, খান আব্দুল গফফর খান (সীমান্ত গান্ধী), মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, রফি আহমেদ কিদোয়াই, মহম্মদ আলি জিন্না, করিম চাকলা, আগা খান, স্যার সৈয়দ আহম্মেদ, নবাব আব্দুল লতিফ, ফজলুল হক, মৌলানা ভাসানি, আল্লামা ইকবাল, সৈয়দ আমির আলি, বরকতউল্লা, বদরুদ্দিন তাওয়াজি, ডঃ জাকির হোসেন, ডঃ এম এ আনসারি, সৈয়দ হাসান ইমাম, মাজহারুল হক, আব্দুল বারি প্রমুখ। যাঁরা স্বাধীনতা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন এবং পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সমৃদ্ধ করেছেন তাঁরা হলেন, মুজফ্ফর আহ্মদ (কাকাবাবু), আব্দুল হালিম, শওকত ওসমানি, হায়দার আমির খান, অরুণা আসফ আলি, হাজরা বেগম, আবদুল্লাহ রসুল, মনসুর হবিবুল্লাহ প্রমুখ। ব্রিটিশ বিরোধী মুক্তি সংগ্রামে কাজি নজরুল ইসলামের ভূমিকাটিকেও আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। যারা খিলাফত আন্দোলন, সত্যাগ্রহ আন্দোলন, গদর পার্টির আন্দোলন এবং ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহে অংশ নিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম করেছিলেন সেই সংখ্যালঘু অংশের নামগুলিও আমরা আলোচনায় আনি। কিন্তু যে নামগুলি প্রায় চর্চায় আসে না তাঁদের কয়েকজন সম্পর্কে এখানে উল্লেখ করতে চাইছি। তবে এই বিষয়ে আরও প্রামাণ্য পুস্তক রচনার দায়িত্ব ইতিহাসবিদদেরই নিতে হবে।
১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভ করলেও এটা বলা যেতে পারে যে, ১৮০৩ সালে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি দিল্লির মসনদে বসার পরই সারা ভারতে ব্রিটিশ কোম্পানির রাজত্ব শুরু হয়। আর উপমহাদেশে ইংরেজ বিরোধী আজাদি সংগ্রাম শুরু হয় প্রকৃত অর্থে ১৮০৩ সাল হতেই। ওই সময় মূলত মুসলমানরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম পরিচালনা করতেন শাহ ওয়ালিউল্লাহের চিন্তা ও দর্শনের আলোকে। ১৮০৩ সাল হতে ১৮৫৭ সালের আগেই আগ্রা, লক্ষ্ণৌ, কানপুর, মীরাট ইত্যাদি অঞ্চলে যেখানে মোগল শাসকের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল, সেখানে ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম সাম্রাজ্যকে ঘিরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। এটা কেবল ধর্মীয় কারণে ছিল না যে, মুসলিমদের ক্ষমতা চলে গেল। বরং বড়ো কারণ ছিল বণিকের মানদণ্ড কীভাবে রাজদণ্ডে পরিণত হচ্ছিল তা তারা উপলব্ধি করেছিলেন। আর এই ব্যাপারে শাহ ওয়ালিউল্লাহের জীবনবোধ ও দর্শন তাঁদেরকে পরিচালিত করেছিল। ওয়াল্লিউল্লাহের বক্তব্যে ধর্মীয় উপাদান থাকলেও তিনি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে দেশের পরাধীনতাকে মানতে পারেন নি। তিনি মোগল শাসনকেই রক্ষা করতে চেয়েছিলেন, কেননা তিনি মনে করতেন মোগলরা ভারতে এসে ভারতীয় জীবনের সাথে একাত্ম হয়েছেন। তাই মোগল শাসন মানে ভারতীয় শাসন। ভাবনা চিন্তায় তিনি ছিলেন উদারবাদী। প্রসঙ্গত, ১৮৫৭ সালে প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনানীরা ব্রিটিশদের সরিয়ে ভারতীয় হিসাবে শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকেই পুনরায় মসনদে বসাতে চেয়েছিলেন।
১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ ও পরবর্তী ঘটনাবলি
১৮৫৭ সালে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামে আহমেদউল্লাহ শাহ-এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। তিনি উত্তরপ্রদেশের ফৌজাবাদকে কেন্দ্র করে আওয়াধ অঞ্চলকে ব্রিটিশ শাসন হতে মুক্ত করেন। তিনি ছিলেন ওই এলাকার ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের আলোকবর্তিকা ও হিন্দু মুসলিম ঐক্যের প্রতীক। তাঁর মাথার দাম ছিল সেই সময় ৫০ হাজার টাকা। ব্রিটিশ এজেন্ট পাওয়ানের রাজা জগন্নাথ সিং তাঁকে মিত্রতার নামে ডেকে পাঠিয়ে হত্যা করেন।
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ মাদ্রাসা (দরুল-উল-উলুম) ছিল ব্রিটিশ বিরোধী ঘাঁটি। অথচ আমরা অনেকেই তা জানি না। বরং কেউ কেউ মনে করি দেওবন্দ মাদ্রাসা মুসলিম মৌলবাদী তৈরির আঁতুড়ঘর। দেওবন্দের কথা এলেই এসে যায় শ্যামলীর সশস্ত্র সংগ্রামের কথা। ১৮৫৭ সালের ১০ মে উত্তরপ্রদেশের শ্যামলী জেলার থানা ভবন এলাকায় ধর্মীয় নেতা ইমদাদুল্লা মাক্কি ও তাঁর প্রধান কমান্ডার মোঃ কাশেম নানাতোবির নেতৃত্বে সশস্ত্র লড়াই শুরু করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাহিনীকে পরাজিত করে এবং ওই এলাকায় সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বাহাদুর শাহ জাফরের গ্রেপ্তারের পর ওই সরকারের পতন ঘটে। এই সৈনিকেরা ব্রিটিশদের পাতা ফাঁদে পা না রেখে শ্যামলীর ময়দান হতে ফিরে গিয়ে তাদের পন্থা ও পদ্ধতি পরিবর্তন করেন। মোহাম্মদ কাসেম নানাতোবির নেতৃত্বে শাহ ওয়ালিউল্লাহর আদর্শের উপর ভিত্তি করে দেওবন্দ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই মাদ্রাসার সাথে যুক্ত মাওলানা মহমাদ্দুল হাসান, আতাউল্লাহ বুখারি, মাওলানা হোসাইন আহমেদ, মাওলানা গোলাম হোসেন ব্রিটিশ বিরোধিতা করে বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। দেওবন্দের সাথে যুক্ত আর একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন মৌলানা ওবায়দুল্লা সিন্ধি। তিনি শিখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেও শাহ ওয়ালিউল্লাহর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি দেওবন্দ দারুল উলুম থেকে দ্বীন শিক্ষা গ্রহণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দেন। তিনি ও মামমাদুল হাসান ১৯১৫ সালে দিল্লির ফতেপুর মসজিদে নাখরাতুল মাআরিফ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলেন। যার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন হাকিম আজমল খান, যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন এবং কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতিও হয়েছিলেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে দেওবন্দে একটি গোপন সভায় ঠিক হয় ১৯১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লিতে অভু্ত্থান ঘটানো হবে। সেই উদ্দেশ্যে তুর্কি ও আফগান সরকারের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মোহমাদ্দুল হাসান ও ওবাইদুল্লা সিন্ধিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওবাইদুল্লা সিন্ধি কাবুলের যান। তিনি সেখানে কাবুলের আমিরের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন এবং পেশোয়ার ও জালালাবাদ এলাকার দুর্ধর্ষ উপজাতিদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে দেন। কাবুলে তিনি রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও মৌলবি বরকতুল্লাহের সাথে মিলে নির্বাসিতদের নিয়ে একটি সরকার গঠন করেন। মাহমাদুল হাসান সাহায্যের জন্য তুরস্ক যান। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের পরাজয়ের ফলে দিল্লি অভিযান পরিকল্পনা বাতিল হয়। মৌলানা সিন্ধি কাবুলের ঘটনা প্রবাহ একটি রেশমি কাপড়ের উপর লিখে মহামাদ্দুল হাসানের কাছে পাঠাতেন। একেই ইতিহাসে রেশমি রুমাল আন্দোলন বলে বর্ণনা করা হয়। নেতাজি ওবাইদুল্লা সিন্ধির সংস্পর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং মওলানা জিয়াউদ্দিন ছদ্মবেশে কাবুলে আসেন। ওবাইদুল্লা সিন্ধি ১৯২৫ সালে স্বাধীন ভারতের একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রকাশ করেন। যেখানে তিনি ভারতকে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র রূপে মান্যতা দেন।
ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য নাম হলো, ৫ বার জেল খাটা মৌলানা মোহাম্মদ আলি এবং মৌলানা শওকত আলি, যাঁরা আলি ব্রাদার্স নামে বিখ্যাত হয়েছিলেন এবং ইংরেজ বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা “কমরেড এবং হামদার্দ’’ নামে দুটি ইংরেজবিরোধী পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। তাঁদের মা আবিদা বানো স্বরাজ আন্দোলনে ছেলেদের সাথে যোগ দেন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেন এবং মহাত্মা গান্ধীর কাছে আম্মাজান হয়ে উঠেছিলেন। তিমি বি আম্মা নামেও পরিচিত ছিলেন।
আমরা কতজন মনে রেখেছি বেগম হজরত মহলকে, যাঁর মাঝে ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাই-এর ছায়া খুঁজে পাওয়া যায়। ফৈজাবাদের গরিব পরিবারের মেয়ে নাবালিকা অবস্থায় বিক্রি হন। তারপর আওয়াধের নবাব ওয়াজেদ আলি শাহের উপপত্নী হন। পরে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর মর্যাদা পান। তাঁদের পুত্রের নাম বির্জিশ কদর। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৮৫৬ সালে আওয়াধ দখল করে। নবাব ওয়াজেদ আলি কলকাতার মেটিয়াবুরুজে আশ্রয় নেন। কিন্তু বেগম হজরত মহল পুত্রকে মুকুট পরিয়ে রাজমাতা হিসাবে শাসনভার গ্রহণ করেন। তাঁরই নেতৃত্বে ওখানকার তুলা ও নীলচাষিরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সামরিক বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। বেগম হজরত মহল চুনাহাটের ঐতিহাসিক লড়াইয়ে ব্রিটিশ কোম্পানি বাহিনীকে পরাস্ত করে দশ মাস শাসন চালান। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড়ো সেনাবাহিনী তাঁরই ছিল। হাতির পিঠে সওয়ার বেগমের যুদ্ধের গল্প আজও ফেরে মানুষের মুখে মুখে। ব্রিটিশদের উন্নত যুদ্ধাস্ত্রের কাছে তাঁর যোদ্ধারা পরাস্ত হন। পরাজিত হওয়ার পর অন্যান্যদের সাথে তিনি নেপালে চলে যান। নেপালের কাঠমান্ডুতে মারা যান। তাঁরই আহ্বানে ২২৫ জন মহিলা গণিকা বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে একত্রিত হয়েছিলেন। তাঁদের অনেককেই ফাঁসি দেওয়া হয়। তাঁরই আহ্বানে ১৮৫৭ সালে বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন মোজাফফর নগরের আসগরি বেগম, যাঁকে ব্রিটিশরা জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।
কানপুরের গণিকা আজিজুন বাই দেশভক্তির কারণে ব্রিটিশ শাসন মেনে নেননি। তিনি ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে পুরুষদের পোশাক পরে লড়াই করেছিলেন। ধরা পরলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হয়। মোজাফফর নগরের এক মুসলিম গুজ্জর পরিবারের মেয়ে হাবিবা বানু ওই বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেন। তাঁকে সহ আরও ১২ জন মহিলা যোদ্ধাকে ব্রিটিশরা ফাঁসি দিয়েছিল। আমরা কতজন তাঁদের মনে রেখেছি? আমরা জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানি, কিন্তু অনেকেই ভুলে গেছি ডঃ সাইফুদ্দিন কিচলুর কথা। যিনি জার্মান হতে ওকালতি পাশ করে এসে কংগ্রেসে যোগ দেন। এবং তাঁরই নেতৃত্বে ওখানে প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। কিচলুকে ব্রিটিশরা দ্বীপান্তরে পাঠান, তাঁর স্ত্রীর জেল হয়।
সেই সময় বাংলাতে বিপ্লবী দল ছিল অনুশীলন ও যুগান্তর। এখানে সাধারণভাবে মুসলিমদের নেওয়া হতো না। অপরদিকে ইনকিলাব পার্টিতে সকলের প্রবেশাধিকার ছিল। এর নেতা ছিলেন পালোয়ান শিশু খান। তিনি ইংরেজ বাহিনীর সাথে সশস্ত্র যুদ্ধে নিহত হন। বিপ্লবী বীর ক্ষুদিরাম কিংসফোর্ডকে মারতে চেয়েছিলেন, পারেননি। ধরা পড়ে তিনি ফাঁসির মঞ্চের জীবনের জয়গান গিয়েছিলেন। উধম সিং জেনারেল ডায়ারকে মেরেছিলেন। তাঁদেরকে সঠিক ভাবেই শহিদের মর্যাদা আমরা দিয়েছি। কিন্তু কতজন মনে রেখেছি শের আলি আফ্রিদিকে। তিনি জন্মেছিলেন বর্তমান পাকিস্তানের খাইবার পাস এলাকায় জামরুদ গ্রামে। তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য ১৪ বছর আন্দামানে জেল খেটেছিলেন। ওই সময় ১৮৭২ সালে বড়োলাট লর্ড মেয়ো আন্দামান জেল পরিদর্শনে এলে, তিনি সুযোগ বুঝে শাবলের আঘাতে তাঁকে হত্যা করেন। শের আলির ফাঁসি হয়। ইতিহাসে তাঁর জায়গা হয়নি। একইরকমভাবে ইতিহাসে স্থান পাননি আবদুল্লাহ। যিনি ১৮৭১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর কুখ্যাত ব্রিটিশ বিচারপতি নরম্যানকে প্রকাশ্য দিবালোকে কোর্টের সিঁড়িতে ছুরিকাহত করে খুন করেন। পরে তাঁরও ফাঁসি হয়। চৌরিচৌরার ঘটনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শহিদ লালমহম্মদকে আমরা কতজন মনে রেখেছি। কতজন মনে রেখেছি আহম্মেদ কোরবান হোসেনকে যিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গেয়েছিলেন।
উত্তরপ্রদেশের কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলার আাসামি আসফাকুল্লাহ খান এবং রামপ্রসাদ বিসমিলকে আমরা ভুলে যেতে পারি না। তাঁদের দুজনেরই ফাঁসি হয়েছিল ১৯২৭ সালে। আমরা ভুলে যেতে পারিনা স্বাধীনতা সংগ্রামী মাওলানা রশিদ আহমেদকে, ইংরেজরা যাঁকে জেলে ফাঁসি দিয়েছিল। আমরা ভুলে যেতে পারি না খাজা আব্দুল মজিদকে, যিনি ইংল্যান্ডে ব্যারিস্টার ছিলেন। দেশে ফিরে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করেন এবং ব্রিটিশরা তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখে। আমরা ভুলে যেতে পারিনা সংস্কৃতিমনস্ক স্বাধীনতা সংগ্রামী মৌলানা হসরত মোহানিকে, যিনি ৬ বছর ব্রিটিশদের জেলে ছিলেন। তিনি সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য লড়াই করেছেন। বামপন্থী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগান তারই দেওয়া। তিনিই প্রথম ১৯২১ সালে কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি তোলেন। তাঁকে সমর্থন করেন স্বামী কুমারানন্দ। স্বাধীনতা আন্দোলনে আমরা সঠিকভাবেই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি খান আব্দুল গফফর খানকে। কিন্তু আরেকজন বালুচিস্তানের সীমান্ত নেতা আব্দুল সামাদ খানকে ভুলে যেতে পারি না।
১৯২৯ সালে গঠিত হয় ন্যাশনালিস্ট মুসলিম পার্টি। যাঁরা ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে শামিল হওয়ার জন্য মুসলিমদের কাছে আবেদন জানায়। ১৯২৯ সালেই মৌলানা হাবিবুর রহমান লুধিয়ানির নেতৃত্বে গড়ে ওঠে মজলিস-ই-আহরার। এঁরা মুসলিমদের কাছে আহ্বান জানায়, কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেবার জন্য।
দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা
মুসলিম লিগ লাহোর অধিবেশনে দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান ভাগের প্রশ্ন তোলে। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা প্রচার করেন ভারতের মুসলিমরা বেশিরভাগ ছিলেন মুসলিম লিগের সমর্থক এবং তারা ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগের পক্ষে। কিন্তু একেবারেই তা নয় বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন হিন্দু মুসলিম ঐক্যবদ্ধ ভারতের পক্ষে। বরং বলা যায়, হিন্দু্ত্ববাদীদের তাত্ত্বিক নেতা গোলওয়ালকার প্রথম দ্বিজাতি তত্ত্বের স্লোগান তোলেন। ভারতের জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের বড়ো অংশ ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগের বিরুদ্ধে ছিলেন। সিন্ধের দুবারের প্রিমিয়াম (প্রধানমন্ত্রী) আল্লাবক্স দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। তিনি ইংরেজদের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ উপাধি পদত্যাগ করেন এবং মুসলিম লিগের দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করে বহু মুসলিম সংগঠনকে একত্রিত করে ১৯৪০ সালে দিল্লিতে আজাদ মুসলিম কনফারেন্স করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি খুন হন। ১৯৪৩ সালেই দিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয় দলিত মুসলিমদের সংগঠন “সর্বভারতীয় মোমিন” কনফারেন্স। তারাও দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করে। জামাতি উলামায়ে হিন্দ প্রধান মাওলানা আসাদ মাদানি ও তাঁর সংগঠন দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করেন। দেওবন্দ মাদ্রাসার উলেমারা দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করেন। খাকসার আন্দোলনের নেতৃত্ব, কৃষক প্রজা পার্টি, আলহাদিস পার্টি দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধিতা করে। কংগ্রেসের মধ্যে খান আব্দুল গফ্ফর খান, মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ নেতৃত্ব দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরোধী ছিলেন। সেই সময় কমিউনিস্টরা হিন্দু মুসলিম ঐক্য অটুট রেখে অবিভক্ত স্বাধীন ভারতের কথা বলেছিলেন। সেই সময় কাশ্মীরের জনগণ এবং তাদের নেতা আব্দুল্লাহ অবিভক্ত ভারতের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। দেশভাগ ছিল ব্রিটিশ ষড়যন্ত্রের ফল। এতে কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। স্বাধীনতা আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ ও হিন্দুত্ববাদীদের কোনো ভূমিকাই ছিল না।
বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন
রাজনৈতিক আন্দোলনের পীঠভূমি বাংলাকে ধর্মের ভিত্তিকে বিভক্ত করার প্রস্তাব করেন লর্ড কার্জন। এর বিরুদ্ধে বাংলার গণতান্ত্রিক জনমত সোচ্চার হয়। বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতায় ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর রবীন্দ্রনাথ পদব্রজে এসে নাখোদা মসজিদের ইমামের হাতে সম্প্রীতির রাখি পরিয়ে দেন। লর্ড কার্জনের বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের প্রধান সহায়ক হন ঢাকার খাজা পরিবারের প্রধান নবাব সলিমুল্লা। কেউ কেউ প্রচার করার চেষ্টা করেন, বেশিরভাগ মুসলমান বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু তা একেবারেই নয়। ঢাকার খাজা পরিবারের সদস্য খাজ আতিকুল্লা বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে দাদা ভাই নৌরোজির সভাপতিত্বে কলকাতায় কংগ্রেসের ২২তম অধিবেশন হয়। ওই অধিবেশনে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রস্তাব উত্থাপন করেন খাতা আতিকুল্লা। প্রস্তাব সমর্থন করেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। জাতীয়তাবাদী মুসলিমদের বড়ো অংশ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। যেমন বোগরার নবাব আব্দুর শোভন চৌধুরী, সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মহামেডান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি খান বাহাদুর মহম্মদ ইউসুফ, বরিশালের চৌধুরী গোলাম আলি মোল্লা, ফরিদপুরের চৌধুরী আলিমুজ্জামান, বর্ধমান জেলা কংগ্রেস নেতা আবুল কাশেম, হুগলির আবুল হোসেন, কলকাতার আইনজীবী এবং টাঙ্গাইলের জমিদার আব্দুল হালিম গজনবি, চট্টগ্রামের জমিদার আনোয়ার আলি খান, বোখরার জমিদার হাফিজুল রহমান চৌধুরী, যশোরের স্বদেশি আন্দোলনের নেতা দ্বীন মহম্মদ, দ্য মুসলমান পত্রিকার সম্পাদক মুজিবর রহমান প্রমুখ বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল এবং আব্দুল হালিম গজবি মুসলিম লিগ বিরোধী বেঙ্গল মহমেডান অ্যাসোসিয়েশন গঠন করেন এবং বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করেন। বরং এখানে উল্লেখ্য যে, হিন্দুত্ববাদীদের তাত্ত্বিক নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বঙ্গভঙ্গের সমর্থক ছিলেন।
স্মরণে রাখতে হবে
নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনী ছিল হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের মূর্ত প্রতীক। নেতাজির সবচেয়ে বিশ্বস্ত সঙ্গী ছিলেন আবিদ হোসেন, শাহানওয়াজ খান, আজিজ আহম্মেদ খান, কর্নেল জিলানি, লেফটান্যান্ট কিয়ানি, আব্দুল করিম গনি, ক্যাপ্টেন রশিদ আলি প্রমুখ। ১৯৪১ সালে নেতাজির জয়হিন্দ স্লোগান তৈরি করেন আবিদ হাসান। ১৯৪২ সালে আগস্টে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ডাক দেন মহাত্মা গান্ধী। ওই স্লোগান তৈরি করেন গান্ধীর সহযোগী ইউসুফ মেহের আলি। বেগম সুরাইয়া তাওয়ালজি বর্তমান ভারতের ত্রিবর্ণ রঞ্জিত পতাকার নকশা তৈরি করেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম যে সাংবাদিক শহিদ হন তিনি ছিলেন মওলানা মহম্মদ বকর। আমির হামজা এবং মেমন ইউসুফ মারকানি নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীকে সেই সময় কোটি টাকার বেশি সাহায্য করেন। বোম্বাইের ব্যবসায়ী ওমর সোভানি গান্ধীকে স্বাধীনতা লড়াইয়ের জন্য ব্ল্যাঙ্ক চেক দিয়েছিলেন। ভগত সিং-এর আদর্শ অনুপ্রাণিত হয়ে আব্বাস আলি স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগ দিয়ে শহিদের মৃত্যু বরণ করেন। দেশাত্মবোধক সঙ্গীত “সরফরওয়সি কি তামান্না” লেখেন বিসমিল আজিমাবাদি। “সারে জাঁহা সে আচ্ছা” লেখেন ইকবাল। স্বাধীনতার লড়াইয়ে ব্রিটিশদের গুলিতে প্রাণ দেন ব্রিটিশ বাহিনীর একসময়ের সুবেদার বিজনৌরের বকত খান। নৌ বিদ্রোহ স্বাধীনতা আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী অন্যান্যদের সঙ্গে তাজ মহম্মদ, ফজলে মহম্মদ, দ্বীন মহ্ম্মদ, সুলেমান, এব্রাহিম এবং আব্দুল আলি সহ আরও অনেকের কথা আমরা ভুলতে পারিনা। তাই স্বাধীনতার ৭৫ বছর পালনের সময় আমরা যেন স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম জনগণের অবদানকে স্মরণে রাখতে পারি।