৬০ বর্ষ ৮ সংখ্যা / ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২২ / ১৩ আশ্বিন, ১৪২৯
মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (তিন)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● বিজ্ঞানের প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনায় যে কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, মানবসভ্যতার বিকাশের ধারায় বিজ্ঞানের উদ্ভব ঘটেছে। মানব ও প্রকৃতির আন্তঃসম্পর্কই মানব অস্তিত্বকে সম্ভব করে। এই আন্তঃসম্পর্কের ধারায় মানুষ প্রকৃতির গভীরে যত প্রবেশ করেছে, বিজ্ঞান ততই উন্নত হয়েছে। চর্চার বিভিন্নতার ফলে বিজ্ঞানের নানান শাখা গড়ে উঠেছে। প্রকৃতিবিজ্ঞানের যেমন বিভিন্ন শাখা, সমাজবিজ্ঞানেরও বিভিন্ন শাখা। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মধ্যে কার্যকর সাধারণ সূত্র রয়েছে। এই সাধারণ সূত্রগুলির চর্চাই দর্শনের বিষয়বস্তু।
● বিজ্ঞানের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বিজ্ঞানের উদ্ভব মানব সভ্যতার গর্ভে। বৃহত্তম বস্তু ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান বিজ্ঞানকে অবলম্বন করেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বস্তুজগতের অসীমতার ধারণা বিজ্ঞানই শক্তিশালী করে চলেছে। অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মানব মননকে মুক্ত করে চলেছে বিজ্ঞান। বাস্তবতার প্রতিফলন বিজ্ঞান - বহু বাধা অতিক্রম করতে হয়েছে বিজ্ঞানকে। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান অগ্রসর হয়েছে - সত্য জয়যুক্ত হয়েছে। যে-কোনো বস্তুর অভ্যন্তর, বস্তুর মধ্যেকার পারস্পরিক সম্পর্ক সম্বন্ধে সঠিক ধারণা বিজ্ঞানই উপস্থিত করেছে। একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে সমগ্র বিজ্ঞানের জগতে যে বিপুল অগ্রগতি ঘটছে, তার দ্বারা বস্তুবাদই ক্রমান্বয়ে পুষ্ট হচ্ছে। বর্তমান সময়ে ‘বিজ্ঞান মনস্কতা’ শব্দটি অত্যন্ত পরিচিতি লাভ করেছে। যুক্তিহীনতা, কূপমণ্ডুকতা, কুসংস্কার, মৌলবাদী ধারণাগুলির পরিসর সংকুচিত করে চলেছে বিজ্ঞান। যুক্তি ও যুক্তিবোধকে সঠিক ধারায় প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানই সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার।
● বস্তুবাদের আলোচনায় স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদ, অধিবিদ্যক বস্তুবাদ ও যান্ত্রিক বস্তুবাদ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা আমরা করব। তারপর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ প্রসঙ্গে আলোচনা করব।
স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদ
● বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতার সাধারণীকরণের মধ্য দিয়েই প্রাচীন যুগে স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। ভারতের প্রাচীন যুগে লোকায়ত, চার্বাক স্কুলের দার্শনিকরা ছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদী। প্রসঙ্গত, প্রাচীনকাল থেকে ভারতে বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশ ঘটেছিল। লোকায়ত, চার্বাক দর্শনগুলি ছিল আপসহীন বস্তুবাদ। প্রাচীন চীনা দর্শনেও স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদের অস্তিত্ব ছিল। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক জেবাক্লিটাস, ডেমোক্রিটাস, এঁরাও স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদী। স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদ প্রকৃতিজগতের বস্তুময়তার ওপর জোর দিয়েছিল। তবে স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদ বস্তুকে বিকাশের স্তরে দেখতে সমর্থ হয়নি।
অধিবিদ্যক বস্তুবাদ [Metaphysical Meterialism]
সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতকে অধিবিদ্যক বস্তুবাদের বিকাশ ঘটে। ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন, জন লক, ডাচ দার্শনিক ফিললোজা, ফরাসি দার্শনিক জুলিয়েন মেত্রি, দিদেরো, হেলভেসিয়াস, জার্মান দার্শনিক ল্যুদভিগ ফয়েরবাখ ছিলেন অধিবিদ্যক বস্তুবাদী।
অধিবিদ্যক বস্তুবাদের মূল বক্তব্য নিচে দেওয়া হলো -
(ক) বস্তু ও ঘটনাসমূহ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। বস্তুসমূহ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কহীন। ঘটনাসমূহের মধ্যে কোনো সম্পর্ক নেই। পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে বিচারের কোনো কারণ নেই। সমস্ত কিছুকে বিচ্ছিন্নভাবে বিচার করতে হবে।
(খ) বস্তুজগৎ যে গতির মধ্যে বিরাজ করছে, সেই গতি বাইরে থেকে সঞ্চারিত হয়েছে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, বাইরে থেকে এই গতি কে সরবরাহ করে?
(গ) পরিবর্তন বস্তু বা ঘটনার ক্ষেত্রে যা ঘটে, তা কেবলমাত্র পরিমাণগত পরিবর্তন। গুণগত রূপান্তরের কোনো প্রশ্ন নেই। অধিবিদ্যক বস্তুবাদ নতুন ঘটনা বা নতুন বস্তুকে গুণগত রূপান্তরের ভিত্তিতে বিচার করে না। সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে বিচার করে। এই বস্তুবাদ কেবলমাত্র পরিমাণগত পরিবর্তনকেই বিবেচনা করে।
(ঘ) গতি সর্বসময়েই চক্রাকারে ঘটে। তার অর্থ পুনরাবর্তন স্বাভাবিক। গতির ফলে নতুন ও উন্নততর স্তরে বিকাশ অধিবিদ্যক বস্তুবাদ স্বীকার করে না। একথা উল্লেখ করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক যে, বর্তমান সময়ে নানারূপে, নানাভাবে অধিবিদ্যক বস্তুবাদ বিরাজ করছে।
যান্ত্রিক বস্তুবাদ
● বস্তুজগৎ হলো যন্ত্রবৎ, অর্থাৎ যন্ত্রের মতো। স্যার আইজাক নিউটনের গতিসূত্র (Theory of Motion) যান্ত্রিক বস্তুবাদকে ব্যাপকভাবে পুষ্ট করল। যন্ত্রের ক্ষেত্রে যেমন বাইরে থেকে শক্তির প্রয়োজন হয়, যান্ত্রিক বস্তুবাদও অভ্যন্তরীণ কারণে বিকাশের ধারণাকে নস্যাৎ করে। বাইরে থেকে শক্তির প্রয়োগই বিকাশ সম্ভব করে। এইভাবে যান্ত্রিক বস্তুবাদের মধ্যে ভাববাদ নিহিত থাকে। কারণ বাইরে শক্তির অর্থ অতিন্দ্রীয় শক্তি। বাইরে থেকে প্রযুক্ত শক্তির বক্তব্য যান্ত্রিক বস্তুবাদের মধ্যে স্ববিরোধিতা তৈরি করে। বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দুর্বল হয়। একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, যান্ত্রিক বস্তুবাদ ও অধিবিদ্যক বস্তুবাদের মধ্যে রয়েছে প্রচুর সাদৃশ্য।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ
● ঊনবিংশ শতাব্দীতে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উদ্ভব ঘটে। অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রকৃতি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটে। এই সময়কালে বহু আবিষ্কারের মধ্যে তিনটি আবিষ্কারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন।
(ক) শক্তির সংরক্ষণ ও রূপান্তরের তত্ত্ব - এই তত্ত্বের মূল কথা হলো, শক্তিকে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। শক্তিকে এক রূপ থেকে আর এক রূপে রূপান্তরিত করা যায়।
(খ) কোষ বিভাজনের তত্ত্ব - প্রাণীদেহের মৌলিক উপাদান হলো কোষ। কোষ বিভাজনের মধ্য দিয়ে কিভাবে বহু কোষের বিকাশ ঘটে, তার সন্ধানও দিলো এই তত্ত্ব। কীভাবে এক-কোষী প্রাণী থেকে বহু-কোষী প্রাণীর উদ্ভব হলো তার সদ্ধান দিলো বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার।
(গ) ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব - প্রকৃতি জগতে নিরন্তর যে বিবর্তন ধারা, তার মধ্যদিয়ে প্রাণ সরল, রূপ থেকে জটিল রূপ পরিগ্রহ করে চলেছে। এইভাবে প্রাণের বিবর্তন ধারাতেই প্রকৃতিজগতের বুকে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। প্রকৃতি বিজ্ঞানের তিনটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, যেগুলির কথা পূর্বে উল্লেখ করা হলো - যথাক্রমে শক্তির সংরক্ষণ ও রূপান্তরের তত্ত্ব, কোষ বিভাজনের তত্ত্ব, বিবর্তন তত্ত্ব প্রকৃতিজগৎ সম্পর্কে মানব ধারণাকে বহুগুণ সমৃদ্ধ ও উন্নত করল। বস্তুজগৎ যে নিরন্তর বিকাশ ধারার মধ্যে বিরাজ করছে, তা উপলব্ধি করাও সম্ভব হলো। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উদ্ভব ঘটল অর্থাৎ বস্তুবাদ সুসংহত ও সুসামঞ্জস্যপূর্ণ রূপ পরিগ্রহ করল। বিকাশের সর্বাঙ্গীণ ও সুগভীর মতবাদ হিসাবেই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের উদ্ভব ঘটল। কমরেড লেনিনের কথায় - ‘‘বিকাশের সবচেয়ে সর্বাঙ্গীণ, সবচেয়ে বিষয়সমৃদ্ধ এবং সবচেয়ে সুগভীর তত্ত্বই হলো দ্বন্দ্বতত্ত্ব।’’
● ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের বক্তব্য - ‘‘দ্বান্দ্বিকতা হলো বহিঃবিশ্ব এবং মানব চিন্তনের যে গতি, তার সাধারণ নিয়মের বিজ্ঞান।’’
● দ্বন্দ্বিকতার ব্যাখ্যায় লেনিন বললেন, ‘‘একটি সমগ্রকে খণ্ডিত করা এবং খণ্ডিত অংশের পরস্পর বিরোধী অংশকে জানা এটিই হলো দ্বন্দ্বিকতার মর্মবস্তু।’’
● অষ্টাদশ শতকের যান্ত্রিক বস্তুবাদ জোর দিয়ে বলে যে, মানুষ হলো তার পরিবেশের সৃষ্টি। আর ভাববাদীদের বক্তব্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা বলে পরিবেশ মানুষই সৃষ্টি করেছে। এই দুই বক্তব্যের মধ্যেই একদেশদর্শিতার দোষ রয়েছে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এই দুই বক্তব্যের মধ্যেকার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের বক্তব্য হলো, মানুষ ও তার পরিবেশ অর্থাৎ প্রকৃতি ও সমাজের মধ্যে ধারাবাহিক পারস্পরিক ক্রিয়া চলছে। মানুষ ও প্রকৃতি জগতের পারস্পরিক ক্রিয়ার অভিজ্ঞতার নির্যাসই হলো জ্ঞান। জ্ঞান ও সক্রিয় কার্যধারার (শ্রমের প্রয়োগে) মধ্য দিয়ে নিজের চারপাশের অর্থাৎ পরিবেশের পরিবর্তন ঘটানো সক্ষম। যান্ত্রিক বস্তুবাদীরা একথা মানতে নারাজ। ভাববাদীরা আবার মানতে রাজি নয় যে, বাস্তুব অবস্থাকে ভিত্তি করেই চেতনা তথা জ্ঞান গড়ে ওঠে। তারা তো বলে যা প্রত্যক্ষ করছি, তা তো সেই অতীন্দ্রীয় শক্তির সৃষ্টি। অতিন্দ্রীয় শক্তি তথা পবিত্র চেতনা তারই সৃষ্টি সমস্ত কিছু - সেই অতিন্দ্রীয় শক্তি যেমন বোধগম্যতার বাইরে, ঠিক তেমনই তার সৃষ্টি সমস্ত কিছুর সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করা অসম্ভব।
● দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদকে যখন মানব সভ্যতার বিকাশ অনুসন্ধানে প্রয়োগ করা হয়, তাকে বলে ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। মার্কসীয় দর্শন বলতে বোঝায় দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ।
● বস্তুবাদী দর্শন সবসময়ে সমাজের শোষিতশ্রেণির দর্শন হিসাবে ভূমিকা পালন করেছে। স্বতঃস্ফূর্ত বস্তুবাদ দাস সমাজে শোষিত অংশের দর্শন হিসাবে ভূমিকা পালন করেছে। সপ্তদশ-অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে উদীয়মান পুঁজিপতি শ্রেণির দর্শন হিসাবে অধিবিদ্যক বস্তুবাদী দর্শন বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আবার ঊনবিংশ শতাব্দীতে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সর্বাধিক শোষিত সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণির দর্শন হিসাবে ভূমিকা পালন করছে।
(ক্রমশ)