৫৯ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৫ পৌষ, ১৪২৮
“আমরা কোথাও যাব না, জমি দিব না, কয়লা খনি চাই না”
প্রসঙ্গ-রাজ্য সরকারের প্রকল্প
গৌতম ঘোষ
দেওচা-পাঁচামিতে মহিলাদের প্রতিরোধ।
“দেওচা-পাঁচামি-দেওয়ানগঞ্জ-হরিণসিংহা কোল ব্লক” এলাকায় সাত-আটটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকাভুক্ত দশ-বারোটি গ্রাম জুড়ে অনেক গভীরে কয়লা রয়েছে। এই অঞ্চলের বসবাসকারীদের অধিকাংশই জনজাতি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এছাড়াও ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং তপশিলি জাতির বসবাস। ‘দেউচা পাঁচামি কোল ব্লক’-এর গভীরতা অনুযায়ী মজুত চিত্র নিম্নরূপ -
গভীরতা [মিটার] (মিলিয়ন টন) | কয়লা (মিলিয়ন টন) |
০-৩০০ | ১৫২.২ |
৩০০-৬০০ | ১০৭৮.৩৯ |
৬০০-১২০০ | ৭৯৫.০৩ |
মোট | ২০২৫.৬২ |
এছাড়া ‘দেওয়ানগঞ্জ হরিণ সিংহ কোল ব্লক’-এ আছে ৩৮.২ মিলিয়ন টন কয়লা - মোট ২০৬৩.৬৪ মিলিয়ন টন। কয়লা ঢাকা আছে অত্যন্ত কঠিন ২২৫ থেকে ২৪৫ মিটার ব্যাসল্ট পাথর দ্বারা । এই গভীরতায় ওই ব্যাসল্ট পাথর ভেদ করে কয়লা উত্তোলন বিদেশি টেকনোলজি ও উন্নততর যন্ত্র ব্যবহার করেই সম্ভব। এই কারণে ২০১১ সালে সংসদে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের রাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বীরভূমের দক্ষিণ পশ্চিম দিকে ১০বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সি থেকে জি গ্রেডের আনুমানিক ২০২৫ মিলিয়ন টন কয়লা মজুত থাকলেও কোল ইন্ডিয়া এই প্রকল্প গ্রহণ করছে না। ২০১৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এই কয়লা ব্লক থেকে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, তামিলনাডু, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ এবং কর্ণাটকের সরকারকে কয়লা উত্তোলনের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু অন্য রাজ্যগুলি পিছিয়ে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পিডিসিএল ২০১৮ সালে এই কয়লা তোলার বরাত পায়। এই পুরো বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার সাধারণ মানুষের কাছে কোনো তথ্য সরবরাহ করছে না। তথ্যের গোপনীয়তার কারণে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন ও সংশয় থেকে যাচ্ছে।
এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য জরুরি বিষয় হলো -
● যে কোনো প্রকল্প করতে গেলে তার প্রকল্প রিপোর্ট, ফিজিবিলিটি রিপোর্ট খুবই জরুরি। এগুলি কোনো গোপন বিষয় নয় তাই সর্বসাধারণের সামনে আনা উচিত।
● বিদেশি টেকনোলজি, মেশিনারি কী শর্তে নেওয়া হচ্ছে বা হবে তাও জানাতে হবে।
● এই এলাকার মানুষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এই প্রকল্প রূপায়ণে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কেন?
● ক্ষতিপূরণের প্যাকেজ সম্পর্কে ধোঁয়াশা কেন?
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে কী কী ক্ষতি হতে পারে
● টোপোগ্রাফির পরিবর্তন
প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম যে বৈশিষ্ট্যগুলি এই অঞ্চলের বিশেষত্ব সেগুলি নষ্ট হবে এবং কৃষিযোগ্য জমি ও অন্যান্য জমির ক্ষতি হবে -
ক) প্রকল্প এলাকায় চাষযোগ্য জমি ধ্বংস হবে।
খ) প্রকল্প এলাকায় সব ধরনের অকৃষি জমি ধ্বংস হবে।
গ) প্রকল্প এলাকার বাইরের কৃষিজমি ধ্বংস হবে।
● ভূগর্ভস্থ জলের গুণগতমান পরিবর্তন হবে। রাসায়নিক ব্যবহারের ফলে জল ব্যাপক মাত্রায় দূষিত হবে
যেহেতু এই কয়লা ব্লক কঠিন পাথরের স্তরে আচ্ছাদিত, স্বাভাবিকভাবে মিথেন কনসেনট্রেশনের সম্ভাবনা থাকবেই। বায়ুমণ্ডলে এর প্রভাব পড়বে।
● বিশাল পরিমাণ ব্লাস্টিং-এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া
অতিরিক্ত বিস্ফোরক ব্যবহারের ফলে বিষাক্ত গ্যাসে পশুপক্ষী ও মানুষের জীবন হানিকর হবে।
খনি এলাকায় জলের মধ্যে নাইট্রাস ও নাইট্রিক অ্যাসিড থাকে। তার ফলে জলের মধ্যে নাইট্রাস ফিউম তৈরি হবে, যা জীবন হানিকর এবং নার্ভের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। এরপর খনি থেকে যে জল তোলা হবে তা বিষাক্ত, ফলে সংশ্লিষ্ট বিশাল এলাকাজুড়ে প্রকৃতি-পরিবেশ তথা জীব বৈচিত্র্য ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এই এলাকার জনজাতি সহ অন্যান্য গরিব মানুষের অংশ পাথর খাদান শিল্পের সঙ্গে যুক্ত। যদিও এই শিল্পের ক্ষেত্রে অনেক খারাপ প্রভাবও আছে।
এই কয়লা খনি থেকে উত্তোলন যন্ত্রনির্ভর। তাই শ্রমনিবিড় নয়। তার ফলে অসংখ্য মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়বে।
এই অংশের মানুষ বলতে শুরু করেছেন যে, সব খনিজ সম্পদ কি জনজাতি মানুষের বসবাস এলাকার নিচেই থাকে? প্রশ্ন তুলছে ধনী অংশের মানুষের বসবাসকারী এলাকায় কি এই প্রকল্প করার কথা ভাবা হতো?
এই এলাকায় মানুষের কথা শুনতে পৌঁছে গিয়েছিল সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির একটি প্রতিনিধি দল। এলাকার মানুষ তাঁদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন এই এলাকা ছেড়ে তাঁরা যাবেন না। খনি তাঁরা চান না। জনজাতি অংশের কেউই লেখাপড়া শেখা সত্ত্বেও গত ১০ বছরে কোনো সরকারি চাকরি পায়নি। তাই তাঁরা প্যাকেজ সম্পর্কে কোনো কথা শুনতে রাজি নন। তাঁরা সকলকে তাদের আন্দোলনের পাশে থাকতে আরজি জানিয়েছেন।
ইতিমধ্যেই এলাকার মানুষের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে “ভূমি রক্ষা কমিটি”। তাদের আহ্বানে সারা দিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন সেভ ডেমোক্রেসির নেতৃত্ব। ভূমি রক্ষা কমিটির আন্দোলনের পাশে থাকার এবং আইনি সহায়তা সহ সবরকমের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন সেভ ডেমোক্রেসির প্রতিনিধিরা। সেভ ডেমোক্রেসির সভার পরেই তৃণমূল কংগ্রেস প্রশাসনের সহযোগিতায় এলাকায় খনির পক্ষে প্রচার করতে গিয়ে তাড়া খেয়েছেন জনজাতি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু অংশের মহিলাদের কাছ থেকে। পরে পুলিশ গিয়ে মহিলাদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ করে, তাদের চিকিৎসা করাতেও বাধা দেয়। এর প্রতিবাদে জেলাজুড়ে সিপিআই(এম) বীরভূম জেলা কমিটির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও পথ অবরোধ করা হয়।
দেওচা-পাঁচামিতে আদিবাসী অধিকার মঞ্চের প্রতিবাদ মিছিল।
পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী অধিকার মঞ্চ এবং সামাজিক ন্যায় মঞ্চের পক্ষ থেকে মহম্মদ বাজারে প্রতিবাদ মিছিল হয়েছে। সেখান থেকে তৃণমূল কংগ্রেস ও পুলিশ প্রশাসনকে বৃহত্তর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়।
সম্প্রতি ডিএম-এসপি’র নেতৃত্বে সভা করে ওই এলাকায় বহিরাগতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেভ ডেমোক্রেসির পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির পক্ষ থেকে রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এলাকার মানুষদের আন্দোলনের সঙ্গে সিপিআই(এম) সক্রিয়ভাবেই থাকবে।
[লেখক সিপিআই(এম) বীরভূম জেলা সম্পাদক।]