৫৯ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৫ পৌষ, ১৪২৮
গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার অঙ্গীকার
সিপিআই(এম) পূর্ব বর্ধমান জেলা ২৫তম সম্মেলনে
শংকর মুখার্জি
পূর্ব বর্ধমান জেলা সম্মেলনে উদ্বোধনী বক্তৃতা দিচ্ছেন শ্রীদীপ ভট্টাচার্য।
সংগঠনকে সুবিন্যস্ত করে জেলায় গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার অঙ্গীকার জানিয়ে শেষ হলো সিপিআই(এম) পূর্ব বর্ধমান জেলা ২৫তম সম্মেলন। গত ২৫-২৬ ডিসেম্বর বর্ধমান শহরে টাউন হলে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন উপলক্ষে বর্ধমান শহরের নামকরণ করা হয়েছিল কমরেড নিরুপম সেন নগর। প্রতিনিধি অধিবেশন হয় কমরেড উদয় সরকার কক্ষে (টাউন হল) কমরেড আব্দুর রাজ্জাক মণ্ডল-কমরেড সাধনা মল্লিক মঞ্চে। জেলার ৭,৫৭৯ জন পার্টি সদস্যের মধ্য থেকে নির্বাচিত ৩৩১ জন প্রতিনিধি ও দর্শক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। প্রসঙ্গত, গত শতকের ত্রিশের দশকে অবিভক্ত বাংলায় যে পাঁচটি জেলায় পার্টি সংগঠনের জেলা কমিটি গড়ে উঠেছিল তার মধ্যে বর্ধমান ছিল অন্যতম। ১৯৩৫ সালে হাটগোবিন্দপুরে প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে গৃহীত রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ নমনীয়তা সম্পন্ন এবং উপযুক্ত শ্রেণি ও সামাজিক বিন্যাসের ওপর পার্টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত শ্রেণিমিত্রসহ সামাজিক দিক থেকে পশ্চাৎপদ অংশের ওপর পার্টির ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করা আজকের পরিস্থিতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মতাদর্শগত চেতনায় সমৃদ্ধ পার্টি ছাড়া শাসকশ্রেণির বহুমাত্রিক আক্রমণের মোকাবিলা সম্ভব নয়। এই বিষয়কে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিতে হবে। পার্টির সর্বস্তরে কমিউনিস্ট নৈতিকতা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সম্মেলনে ২২দফা আগামী কাজ গৃহীত হয়েছে। সম্মেলনে পার্টির রক্তপতাকা উত্তোলন করেন জেলার প্রবীণ পার্টি সদস্য অধিক্রম সান্যাল। উনি ১৯৫৩ সালে অবিভক্ত পার্টিতে সদস্যপদ লাভ করেন।
খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন সম্মেলনে পেশ করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক। প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় ৩১টি এরিয়া কমিটি ও গণফ্রন্টগুলি থেকে ৪৮জন প্রতিনিধি অংশ নেন। প্রতিবেদনটি সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়। আগেই ঠিক হয়েছিল, ২০২২ সালের ১৫-৩০ জানুয়ারি জেলাজুড়ে গণ অর্থ সংগ্রহ হবে। সকল পার্টি সদস্য ও কর্মীর অংশগ্রহণে এই কর্মসূচিকে ব্যাপক চেহারা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে সম্মেলনে।
পূর্ব বর্ধমান জেলায় ছয়টি পুরসভা। আসন্ন পুর নির্বাচনে সাধারণ মানুষের ভোটাধিকারকে নিশ্চিত করাই অন্যতম প্রধান কাজ। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে শাসকদলের যেকোনো ধরনের আক্রমণ প্রতিরোধে শক্তি অর্জনের ওপর সম্মেলনে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। সম্মেলনের একেবারে শেষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে বিমান বসুও প্রতিনিধিদের উদ্দেশে জান লড়িয়ে নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানান। এপ্রসঙ্গে তিনি বলেন, পার্টিতে নিষ্ক্রিয় সদস্য থাকলে নতুন প্রজন্মের যারা নতুন স্বপ্ন নিয়ে পার্টিতে আসছেন তাদের সামনে বাধার প্রাচীর তৈরি হবে। কোনো লড়াইতেই সর্বশক্তি নিয়ে নামা যাবে না। মানুষের বিশ্বাস ও ভরসা অর্জনেও বাধা তৈরি হবে। এগুলিকে কাটাতে পারলেই পার্টির শক্তিবৃদ্ধির যে কথা বলা হচ্ছে তা বাস্তবে পরিণত হবে।
খেতমজুর ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু কথা সম্মেলনে আলোচিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গৃহীত আগামী কাজে যা নির্ধারিত হয়েছে তা হলোঃ খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন প্রসারিত করো। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ২৬ হাজার টাকার দাবিতে গড়ে তোলো প্রচার আন্দোলন। খাস ও বর্গা জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কৃষকদের সংগঠিত করে তাদের জমি দখলের আন্দোলন। মাইক্রোফিনান্স কোম্পানিগুলির অত্যাচার থেকে ঋণগ্রহীতাদের রক্ষা করতে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিরোধ। এই প্রতিটি ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক অগ্রগতি ঘটাতে গেলে গ্রামাঞ্চলে কৃষক, খেতমজুর ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ঐক্য গড়ে তোলায় সর্বাধিক মনোনিবেশ করতে হবে পার্টি সংগঠনকে।
এছাড়াও পার্টি সংগঠনের যে বিষয়গুলিতে গুরুত্ব সহকারে নজর দিতে হবে বলে সম্মেলন নির্দেশ দিয়েছে তা হলোঃ নিষ্ক্রিয়তামুক্ত পার্টি গড়ায় যত্নশীল প্রয়াস গ্রহণ। পুনর্নবীকরণ ও নতুন সদস্যপদ দানে ৫দফা মানদণ্ড কার্যকর করা। গণসংগ্রহে জোর দেওয়া। সহায়ক গ্রুপ ও বুথ টিম গড়ে তোলা। তরুণ, মহিলা, শ্রমজীবী এবং পিছিয়ে পড়া অংশ থেকে পার্টিতে অন্তর্ভুক্তি। সন্ত্রস্ত এলাকাগুলিতে সন্ত্রাসমুক্ত করা এবং বন্ধ পার্টি-গণসংগঠনের দপ্তর খোলার লক্ষ্যে পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ।
রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশের সময়ে পার্টি সংগঠন প্রসঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেন বিদায়ী সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক। জেলায় মোট শাখার সংখ্যা ৬৯০টি। ৭২ শতাংশ শাখাতেই সহায়ক গ্রুপ আছে। তবে ৫,৫৩৮টি বুথের সবগুলিতে বুথ কমিটি নেই। প্লেনামের সিদ্ধান্ত ছিল পার্টি তহবিলের ৭০ শতাংশই গণসংগ্রহের মাধ্যমে সংগৃহীত হবে। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, জেলায় এই হার ৭২ শতাংশ। অচিন্ত্য মল্লিক বলেন, গতবছর জেলার ৮০ শতাংশ পরিবারের কাছে অর্থ সংগ্রহের জন্য যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ৫০ শতাংশ পরিবারের কাছে যাওয়া গেছে। এতে ৬৫লক্ষ টাকা সংগৃহীত হয়েছে। বিগত সময়ে জেলায় মজুরি এবং জমির লড়াইয়ে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে বলে তিনি জানান।
প্রতিবেদনে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছেঃ জেলায় প্রায় ১হাজার বিঘার উপর জমি থেকে গরিবদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। জেলার তিনটি এরিয়া কমিটিতে জমি পুনর্দখল হয়েছে। আরও কয়েকটি এলাকায় প্রস্তুতি চলছে। এছাড়াও জেলার কিছু জায়গায় কৃষিজমি রক্ষা ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে বেশ কিছু স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ হচ্ছে। এই সব বিক্ষোভকে সংগঠিত রূপ দেবার কথা বলা হয়েছে সম্মেলনে।
পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ জরুরি
বামপন্থী গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রধান পূর্বশর্তই হলো সিপিআই(এম)’র স্বাধীন শক্তির বিকাশ। আর স্বাধীন শক্তির বিকাশের ক্ষেত্রে পার্টি শাখার ভূমিকা সর্বাধিক। সম্মেলন উদ্বোধন করতে গিয়ে একথা বলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সাম্রাজ্যবাদ ও লগ্নিপুঁজি কখনই চায় না পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের অগ্রগতি ঘটুক। জনগণের মধ্যে, মেহনতি মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি করতে তারা সবসময়ে মতাদর্শগত প্রচার চালায়। অন্যদিকে, হিন্দু্ত্ববাদীদেরও লক্ষ্য হচ্ছে শ্রেণিগত ঐক্য ভেঙে দেওয়া। একে আরও সংহত করতে তারা চালায় ফ্যাস্তিস্ত আক্রমণ আর অপবিজ্ঞানের প্রচার। কমিউনিস্ট ও বামপন্থীদের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে বিজেপি এবং তৃণমূলের ভূমিকা অভিন্ন। এই সব প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে কমিউনিস্টদের ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের মধ্যেই নির্ভর করছে এদেশের ভবিষ্যৎ।
আন্দোলন-সংগ্রাম প্রসঙ্গে শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ঐক্যবদ্ধ লড়াই কী হতে পারে তা আমাদের অনুপ্রেরণা কৃষক আন্দোলন। শ্রমিকরাও দুদিনের ধর্মঘট ডেকেছে। সারা দেশেই আন্দোলন-সংগ্রামের এক উন্নত মেজাজ পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরাজ্যে শ্রেণি ও জনগণের সাথে যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে তা কাটিয়ে সামনের দিকে এগোতে চাই ছকভাঙা আন্দোলন। এমন আন্দোলন যা শাসকের রাতের ঘুম কেড়ে নেবে। এপ্রসঙ্গে তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, আন্দোলনের বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক আছে। সমস্ত অংশের মানুষকে জড়ো করতে গেলে স্থানীয় আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এইসব দাবি আদায়ের মধ্যদিয়ে জনগণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠবে।
উদারনীতির তিন দশকে গ্রামীণ এলাকায় অকৃষি ক্ষেত্রে যুক্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে। এপ্রসঙ্গে আলোকপাত করে শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বলেন, এদের সংগঠিত করার সব কাজটা কৃষক সভা এবং খেতমজুর ইউনিয়ন একা পারবে না। তাই গ্রামীণ সর্বহারা-আধা-সর্বহারাদের সংগঠিত করতে গ্রামীণ শ্রমিক ফেডারেশন গড়ে তুলতে হবে আমাদের। ঠিক একইভাবে শহরাঞ্চলেও বাড়ছে অসংগঠিত ক্ষেত্র এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এদেরও সংগঠিত করতে শ্রমিক সংগঠনের সাথেই নাগরিক সমাজের নতুন নতুন সংগঠন গড়তে হবে।
প্রতিকূলতার মধ্যেও এগিয়ে যাওয়ার কাহিনি
প্রতিবেদনের ওপর প্রতিনিধিরা ৭ ঘণ্টা ১৭ মিনিট আলোচনা করেন। প্রতিনিধিদের আলোচনায় জেলায় পার্টির রাজনৈতিক-সাংগঠনিক এবং আর্থ-সামাজিক বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। তাঁদের মতে বহু কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। তা সফলও হচ্ছে। কিন্তু আন্দোলন প্রতীকী স্তরেই রয়ে যাচ্ছে। তবে এর মধ্যেও গলসীতে খাসজমির আন্দোলন সফল হয়েছে। কালনার ১২ টা গ্রামে খেতমজুরদের আন্দোলনে ৫০ টাকা দৈনিক মজুরি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, মেমারী, খণ্ডঘোষ প্রভৃতি স্থানে জমি থেকে কৃষকদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তা পুনর্দখলে আন্দোলন হবে। মজুরি আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রতিনিধিদের অভিজ্ঞতা হলো, খেতমজুদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন শুরু হলেই তৃণমূলের পক্ষ থেকে একটা মজুরি ঘোষণা করে দিয়ে আন্দোলনকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। মেমারী, মঙ্গলকোট, রায়না, কেতুগ্রাম প্রভৃতি স্থানে এখনও সন্ত্রাস আছে। আছে আক্রমণ। এর মধ্যেও অন্য ছবিও রয়েছে। জনগণকে সাথে নিয়ে কীভাবে এলাকা সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে, পার্টি দপ্তর আবার খোলা গেছে সে কথা সম্মেলন শুনেছে বর্ধমান সদরের প্রতিনিধির কাছ থেকে। এখানে তৃণমূল ও পুলিশের হুমকি আক্রমণকে পরাস্ত করে শ্রমিকরা আন্দোলনের মাধ্যমে রাইস মিলে বোনাস আদায় করেছে। রেশন ডিলারদের দূর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের পাকড়াও করে অর্থ, খাদ্য দ্রব্য ফেরত দিতে কীভাবে বাধ্য করা হয় এবং পঞ্চায়েত দপ্তরে তালা লাগিয়ে গ্রামবাসীরা কীভাবে দূর্নীতির অর্থ প্রধানকে দিয়ে ফেরত করেছিল তা জানিয়েছেন মেমারী-২-এর প্রতিনিধি।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে নজিরবিহীন সন্ত্রাস এবং লোকসভা-বিধানসভা নির্বাচনে অভিজ্ঞতার কথা বস্তুনিষ্ঠভাবেই আলোচনা করেছেন প্রতিনিধিরা। করোনা মহামারীর সময়ে পার্টি, গণসংগঠনের কর্মীরা এবং রেড ভলান্টিয়াররা কীভাবে আর্ত-পীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং এই কাজে ব্যাপক অংশের মানুষ কীভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছে তার জীবন্ত বিবরণ শোনা গেছে প্রতিনিধিদের বক্তব্যে। মাইক্রোফিনান্স, সমবায়, মহিলাদের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতনের বিরুদ্ধে, সেচ ও কৃষি সমস্যা, রেগার কাজ, আইসিডিএস এবং মিডডে মিল বন্ধের চেষ্টা, কাটোয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের দাবি সহ প্রভৃতি জলন্ত বিষয়গুলিকে নিয়ে জেলাজুড়ে আন্দোলন জরুরি বলে প্রতিনিধিরা মত প্রকাশ করেছেন।
শ্রেণিসংগ্রামকে ভুলিয়ে দেবার চেষ্টা চলছে
শ্রেণিসংগ্রাম ভিন্ন রাজনীতির কোনো অস্তিত্ব নেই। ক্ষমতা অর্জন করতে কিংবা ক্ষমতা ধরে রাখতে এটা করতেই হবে। এই শ্রেণিসংগ্রামকেই ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। - সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে শেষদিনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এই কথা বলেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায়চৌধুরী। তাঁর মতে, আন্দোলন-সংগ্রাম সহ সমস্ত রাজনৈতিক ঘটনায় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাটাই সব নয়। তার ভিতরে দ্বান্দ্বিক বিষয়গুলি আছে। আবেগ বা মনগড়া ধারণা দিয়ে বিশ্লেষণ করলে চলবে না। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বগুলিকে খুঁজে বার করতে হবে।
আভাস রায়চৌধুরী বলেন, শ্রেণি একটা সামগ্রিক পরিচয়, বুনিয়াদি পরিচয়। কিন্তু এখন সংকীর্ণ পরিচয়গুলিকে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে। যে গণতান্ত্রিক পরিসর আছে দক্ষিণপন্থী রাজনীতি তা ভেঙে দিতে চাইছে। আজকে যারা লুট করছে তাদের দিকেই রাজনৈতিক ভারসাম্য ঝুঁকে রয়েছে। এটা যেমন বিশ্ব প্রেক্ষিতে সত্য, সত্য স্থানীয় ভিত্তিতেও। সামগ্রিক এই প্রবণতাই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বোধগুলিকে নষ্ট করছে। শ্রমিকশ্রেণির অধিকার চেতনাকে ভেঙে দিচ্ছে। একটাই উদ্দেশ্য, যাতে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন দানা না বাঁধতে পারে। নয়াউদারনীতির বিকল্পের জন্য সংগ্রাম যেন না গড়ে ওঠে। সিপিআই(এম)-কে কোণঠাসা করতে তৈরি করা হচ্ছে তৃণমূল এবং বিজেপি’র বাইনারি রাজনীতি। নয়াউদারবাদী দর্শনের আরেকটা অভিমুখ হলো, ব্যক্তিগত ভোক্তা তৈরি করো। তৃণমূলও এরাজ্যে তাই করছে। তবে আমাদের ওই ব্যক্তিগত ভোক্তা তৈরি করার সরকারি প্রকল্পগুলিতে ইতিবাচক হস্তক্ষেপ করতে হবে।
লড়াইটা বহুমাত্রিক
বিজেপি-তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াইটা বহুমাত্রিক। রাজনৈতিক-সাংগঠনিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তা চালাতে হবে - সম্মেলনের একেবারে শেষপর্বে অভিনন্দনসূচক বক্তব্যে এই পরামর্শই দিলেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র।
বহুমাত্রিক লড়াইয়ের জন্য দরকার শক্তিশালী পার্টি সংগঠন। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত হলো, তৈরি করতে হবে সব গণফ্রন্টের প্রাথমিক কমিটি এবং পার্টির বুথ কমিটি। এই সাংগঠনিক কাঠামোকে নিয়ে গ্রাম পঞ্চায়েত ও শহরাঞ্চলে ওয়ার্ড ভিত্তিতে সংগঠিত করতে হবে আদায়যোগ্য দাবিতে আন্দোলন। শ্রেণিভারসাম্যে পরিবর্তন করতে গেলে তা নিচের দিক থেকেই শুরু করতে হবে। গণআন্দোলন, শ্রেণিআন্দোলন ব্যতিরেকে পার্টির সংগঠন বৃদ্ধি কখনই সম্ভব নয়। নয়াউদারনীতির ফলে গ্রাম-শহর উভয় জায়গায় অসংগঠিত ক্ষেত্র বাড়ছে। বর্তমানে শ্রমিকশ্রেণির বৃহত্তম অংশই হলো অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। শ্রমিকসহ গ্রাম-শহরের সর্বহারা ও আধা-সর্বহারাদের সংগঠিত করতে চারটি শ্রেণিফ্রন্ট - ট্রেড ইউনিয়ন, কৃষক, খেতমজুর এবং বস্তিফ্রন্টকে পালন করতে হবে বিশেষ দায়িত্ব। এসবের মধ্যদিয়ে যেমন গণসংগ্রাম গড়ে উঠবে, তৈরি হবে নতুন ক্যাডারও। বদলাবে পার্টির চেহারা। বড়োও হবে পার্টি। এছাড়া নেই কোনো ভিন্ন পথ। আর পার্টির শক্তি না বাড়লে কোনো ফ্রন্টই সফলভাবে সাকার পাবে না।
সম্মেলন পরিচালনা করেন অমল হালদার, সুকান্ত কোঙার, সাইদুল হক, অর্পণা সাহা, সনাতন টুডুকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।