৫৯ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৫ পৌষ, ১৪২৮
শ্রেণিআন্দোলন গণআন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে হবে
সিপিআই(এম) পশ্চিম বর্ধমান জেলা ২৫তম সম্মেলনের আহ্বান
শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়
পুঁজিবাদী নীতির কারণে শহর এবং গ্রামে সর্বহারা এবং আধা সর্বহারার সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে মানুষের ক্ষোভ। বুথস্তরে আদায়যোগ্য দাবির সপক্ষে তাদের ঐক্যবদ্ধ করে এগোতে হবে। শ্রেণিআন্দোলন, গণআন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শক্তি সংহত করে, সমন্বিত করে গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে হবে। সিপিআই(এম) পশ্চিম বর্ধমান জেলা ২৫তম সম্মেলন থেকে এই আহ্বানকে সামনে রেখে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন প্রতিনিধিরা।
পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে থাকা পশ্চিম বর্ধমান জেলাকে কলকারখানায় কর্মরত দেশের বিভিন্ন অংশের মানুষের সমাবেশের জন্য কেউ কেউ বলেন মিনি ভারত। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে বিভিন্ন সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে আসেন রুজির টানে। এখানে বন্ধ কারখানা এবং খনির সংখ্যা অনেক। তার দায় কিছু কেন্দ্রের, কিছু রাজ্যের। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের নীতির ক্ষতের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততায় ২৭ এবং ২৮ ডিসেম্বর এই জেলার অন্ডালের খান্দরার বিধানচন্দ্র প্রতিবন্ধী কর্মকেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হলো এই সম্মেলন। সিপিআই(এম) পশ্চিম বর্ধমান জেলার ২৫তম সম্মেলন শুরু হয় পতাকা উত্তোলন এবং শহিদ বেদিতে মাল্যদানের মধ্য দিয়ে। রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন সিপিআই(এম)নেতা বিবেক চৌধুরী। শহিদ বেদিতে মাল্যদান করেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র, প্রবীণ নেতা মদন ঘোষ, রামচন্দ্র ডোম, অমিয় পাত্র, আভাস রায়চৌধুরী পার্টি নেতা অচিন্ত্য মল্লিক, পূর্ব বর্ধমান জেলা সম্পাদক সৈয়দ হোসেন, বংশগোপাল চৌধুরী এবং জেলা সম্পাদক গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি। সম্মেলনের উদ্বোধন করেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোম।
সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতভাবে ৫০ জনের জেলা কমিটি নির্বাচিত হয়েছে। সম্মেলন মঞ্চ থেকে ৪৮ জনের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। দুজনকে পরবর্তীতে নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। সম্মেলন মঞ্চে নতুন জেলা কমিটির প্রথম বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। এই বৈঠক থেকে জেলা সম্পাদক হিসেবে গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন। দুদিন ধরে চলা এই ২৫তম সম্মেলনে ৩৩৫জন প্রতিনিধি এবং ৩৮জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। বংশ গোপাল চৌধুরী, বিপ্রেন্দু চক্রবর্তী, বিবেক চৌধুরি, জি কে শ্রীবাস্তব, জাহানারা খান ও বীরেশ মণ্ডলকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করে।
সম্মেলনের উদ্বোধন করে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোম।
বুথ স্তরে শক্তিকে সংহত করে দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ধারাবাহিক সংগ্রাম করতে হবে
সম্মেলনের উদ্বোধন করে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোম বলেন, একদিকে আর্থিক মন্দা অন্যদিকে অতিমারী এই দুয়ের কারণে শ্রমজীবী মানুষ ও সাধারণ মানুষের ওপর শোষণ যন্ত্রণার বোঝা বেড়েছে। আমাদের দেশের এবং রাজ্যের যে সরকার তাদের শ্রেণি চরিত্রের কারণে ধান্দার পুঁজিবাদকে স্থায়ী করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। অন্যদিকে তীব্র শোষণে জর্জরিত সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাদের প্রতিবাদ আন্দোলনের উপর দমননীতি চলছে। তা সত্ত্বেও মানুষের প্রতিরোধ বেড়েই চলেছে। এটাই ইতিবাচক উপাদান। ইতিহাসের এটাই স্বাভাবিক ধারা। লাল ঝান্ডা শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির দিশা দেখাবে।
তিনি বিশ্বের মহামন্দা ও সাম্প্রতিক কোভিড পরিস্থিতি সম্পর্কে পুঁজিবাদী দেশ এবং সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক তুলে ধরে বলেন, ভাইরাসের বিরুদ্ধে সম্যক প্রতিরোধের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রের শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিও জনস্বাস্থ্যের এই বিপর্যয় মোকাবিলার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছে। এই অতিমারী জনিত পরিস্থিতিতে ধান্দার পুঁজিবাদীদের পৌষ মাস। তারা শুধু লুটেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ বেপরোয়াভাবে লুট হয়েছে। সেই লুট বিস্তৃত হয়েছে আমাদের ভূখণ্ডেও। পুঁজিবাদী দুনিয়ায় মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতায় ঘাটতির কারণেই এই বিপর্যয়ের মধ্যে অনেক অবাঞ্ছিত জীবনহানি ঘটেছে। যা প্রত্যাশিত ছিল না। অন্যদিকে চীনসহ সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ায় দেশগুলি বিকল্প দিশা দেখিয়েছে। সেখানে সংক্রমণ থেকে প্রাণহানির ঘটনা অনেক কম। শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্যের কারণে এই বিপর্যয়ের মাত্রা আলাদা। আমাদের রাজ্যে এক্ষেত্রে আমাদের রেড ভলেন্টিয়াররা যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছেন। এই বিপর্যয়ের সামনে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে যে দৃষ্টান্ত তাঁরা স্থাপন করেছেন সেটাই আমাদের পাথেয়। যুগে যুগে জনগণের বিপর্যয়ের মুখে প্রতিকূলতার মুখে যা কমিউনিস্টরা বরাবর করে এসেছে।
তিনি বলেন, বিগত পার্টি কংগ্রেসের যে মূল্যায়ন ছিল গত চার বছরের মধ্যে তার অনেক ঘটনাই বাস্তব। সারা দুনিয়া জুড়ে দক্ষিণপন্থীদের প্রতিক্রিয়ার শক্তি সংহত হয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে বিশ্ব মহামন্দা, ২০০৯ সাল থেকে যার সূচনা এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থা তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। সেই মহামন্দা আরও গভীরতর তীব্রতর হয়েছে - সেটাই ছিল পর্যালোচনা। নয়াউদারবাদী অর্থনীতি এই মন্দার কারণ। কিন্তু এর থেকে বেরিয়ে আসার কোনো দাওয়াই আবিষ্কার করতে পারছে না তারা। তাই এখন বুর্জোয়া পণ্ডিতদের আবার নতুন করে কার্ল মার্কসের দাস ক্যাপিটাল পড়তে হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে প্যারি কমিউন-এর উল্লেখ করে তিনি বলেন, ব্যর্থতা এবং সাফল্য থেকে কমিউনিস্টরা শিক্ষা নেয়। প্যারি কমিউন-এর ব্যর্থতা সত্ত্বেও আজকে আমরা সেই পথ ধরেই এগোচ্ছি। সারা দুনিয়াতে কমিউনিস্টদের যে অগ্রগতি, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অগ্রগতি সেই পথেই। এই সময়কালে চীনকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের নেতৃত্বে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও তাকে প্রতিহত করা যাবে না। সমাজতান্ত্রিক যে দর্শন এবং তার কর্মসূচি এই সংকট এবং তথাকথিত যে মহামন্দা তাকে অতিক্রম করার স্পর্ধা রাখে। যা কমিউনিস্টদের দ্বারা নির্দিষ্টভাবে সমাজতান্ত্রিক বিকল্প। ওরা কিউবাকে নতুন করে অবরুদ্ধ করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু কিউবার মানুষ তাকে প্রতিরোধ করার জন্য রুখে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, কখনোই ফ্যাসিবাদী শক্তি চিরদিনের জন্য শ্রমজীবী মানুষের লড়াই আন্দোলনকে, মুক্তির আন্দোলনকে দমন করতে পারে না। এই সময়কালে নয়া ফ্যাসিবাদীদের দাপাদাপি বাড়লেও লাতিন আমেরিকা যে দিশা দেখিয়েছে তাকেও উল্লেখ করতে হবে। দীর্ঘ ৪৫ বছরের জুন্টা শাসনের পর চিলিতে বামপন্থী গ্যাব্রিয়েল বোরিক বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় রাষ্ট্রপতি পদে বিজয়ী। এগুলো হচ্ছে বামপন্থীদের দিশা।
দেশের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশে বিগত সাত বছর ধরে যে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তি দেশ পরিচালনা করছে, সংঘ পরিবার পরিচালিত যে রাজনৈতিক শক্তি তা নয়া উদারবাদী নীতিকে আরও আগ্রাসী করে কিভাবে কর্পোরেট পুঁজিকে তুষ্ট করা যায় তার একের পর এক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের নীতি ঢালাও বেসরকারিকরণ, রাষ্ট্রীয় পুঁজির প্রাতিষ্ঠানিক লুট, তা চলছে। জনস্বাস্থ্যের এই বিপর্যয়ের সুযোগ নিয়ে আজকে সর্বগ্রাসী আক্রমণ নামিয়ে এনেছে।
তিনি বলেন, আমাদের রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো আজ আক্রান্ত। ফ্যাসিবাদী শক্তি তথাকথিত হিন্দুরাষ্ট্র হিন্দুত্ববাদী দর্শনের ভিত্তিতে যা আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠা করতে চায় সেই ঘোষিত এজেন্ডাকে কার্যকর করার চেষ্টা করছে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে চলছে বহুমাত্রিক আক্রমণ। শিক্ষা থেকে সংস্কৃতি সর্বত্র এই বহুমাত্রিক আক্রমণ চলছে। নতুন শিক্ষানীতি হলো আমাদের দেশে নতুন করে মানুষের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন নিয়ে আসার পরিকল্পনা। আমাদের মতো একটা দারিদ্র্যপীড়িত দেশে বিকল্পের নামে একটা শিক্ষা ব্যবস্থা যা গত দু'বছর ধরে চলছে সেটা ভয়ংকরভাবে সমাজে বিভাজন নামিয়ে এনেছে। উচ্চস্তরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হলেও প্রাথমিক শিক্ষা থেকে আদিবাসী, তপশিলি, গরিব, সংখ্যালঘু, শ্রমজীবী অংশের ছেলেমেয়েরা আজকে শিক্ষার অঙ্গন থেকে ছিটকে গেছে। তারা আর কখনো স্কুলে ফিরবে না। বাল্যজীবনে তাদের কর্মসংস্থানের নানা জায়গায় যুক্ত হতে হয়েছে। তাদের জন্য কোনো বিকল্প ব্যবস্থা হয়নি।
তিনি বলেন, এইরকম একটা পরিস্থিতিতে বিদ্বেষের রাজনীতি জাতি-ধর্ম-বর্ণ সম্প্রদায় ভাষা প্রাদেশিকতা এই বহুমাত্রিকতার মেরুকরণ শাসকের হাতিয়ার। উত্তর আধুনিকতার যুগে পরিচিতিসত্তার রাজনীতিকে ব্যাপকভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে।
তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস-এর ডাকে ধর্ম সংসদ সম্পর্কে বলেন, ধর্ম সংসদ থেকে আওয়াজ উঠছে সংখ্যালঘু মানুষকে নিধন করার। পাঁচটা রাজ্যে নির্বাচনকে সামনে রেখে ফতোয়া জারি হচ্ছে। মানুষকে খুন করার নাৎসিদের যে অভিযান এ যেন তারই পদধ্বনি আমরা শুনছি। প্রকাশ্যে এই ফতোয়া জারি করার পরেও সরকার শাসনব্যবস্থা নীরব। এ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি।
তিনি বলেন, ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে যে মতাদর্শগত সংগ্রাম তা একমাত্র কমিউনিস্টরাই, বামপন্থীরাই করতে পারে। বহুমাত্রিক মতাদর্শগত সংগ্রাম করার জন্যই আমাদের, কমিউনিস্টদের সামগ্রিকভাবে সেই প্রস্তুতি দরকার।
তিনি বলেন, রাজ্যে যে সরকার তা হচ্ছে লুম্পেনদের পার্টি দ্বারা পরিচালিত। তৃণমূল এবং বিজেপি-কে মুখ্য ভূমিকায় রেখে বাম গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ সরকারকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। এই দুই শক্তির টিকি বাধা একটাই জায়গায় - সেটা হচ্ছে নাগপুর। তা আজ ঠারেঠোরে প্রকাশিত।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে কমিউনিস্টদের, বামপন্থীদের দিকেই মানুষ তাকিয়ে আছেন। বিশেষত ২০২১-এর নির্বাচনের পর মানুষের মোহভঙ্গ হচ্ছে। আরএসএস-এর সুচতুর ছকে আদিবাসী থেকে শুরু করে তফশিল অংশের মানুষ, শ্রমজীবী অংশের মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। মতুয়াদের নিয়ে সংঘ পরিবার বিজেপি নতুন সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিল। তারা বুঝেছে। মোহভঙ্গ হচ্ছে।
তিনি বলেন, গ্রামীণ সর্বহারা সহ শহরের বস্তি অংশের সর্বহারা যে মানুষদের থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হয়েছিল তাদের সঙ্গে আবার নতুন করে সংযোগ স্থাপন করতে হবে। সেই মানুষদের ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ওটাই আমাদের শ্রেণিভিত। এই কাজ আমাদের করতে হবে। কৃষক আন্দোলন থেকে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিয়েই আমাদের রাজ্যে দেশে একদিকে সংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক আন্দোলন, অসংগঠিত ক্ষেত্রের বিপুল শ্রমিকদেরকে এবং গ্রামীণ সর্বহারা খেতমজুর বর্গাদারদের সংগঠিত করে ঐক্যবদ্ধ করেই বৃহত্তর শ্রমজীবী মানুষের ঐক্য তৈরি করায় যে কাজ তা আমাদের, কমিউনিস্টদেরই করতে হবে। বুথ স্তরে আমাদের সেই শক্তিকে সংহত করতে হবে। লড়াই সংগ্রাম আন্দোলনের আদায়যোগ্য দাবি নিয়ে ধারাবাহিকভাবে সংগ্রাম করতে হবে। তা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সমাজতন্ত্র স্থাপনের বড়ো লড়াইয়ের আগে বাকি ছোটো ছোটো লড়াই। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার এবং পার্টির কর্মসূচিগত বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই আমাদের সংসদের ভিতরে লড়াই, সংসদের বাইরে লড়াই অর্থাৎ শ্রেণিআন্দোলন, গণআন্দোলন, সামাজিক আন্দোলন এই তিন আন্দোলনকে সংহত করে, সমন্বিত করে এই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে। ওটাই আমাদের সম্মেলনের অভিমুখ।
সম্মেলনে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন পেশ করে বিদায়ী কমিটির সম্পাদক গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি বলেন, গণ বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার সঙ্গে গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার গুণগত ফারাক বুঝতে হবে আমাদের। আমাদের এই জেলায় বন্ধ শিল্প কারখানা খোলা, অধিগৃহীত জমিতে শিল্প গড়ে তোলা, নতুন শিল্প গড়ে তোলার লড়াই পার্টিকে শক্তিশালী করার সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর মধ্য দিয়েই পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। তবেই গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার প্রত্যাশাকে ছুঁতে পারা যাবে।
বক্তব্য রাখছেন সূর্য মিশ্র।
রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রতিবেদন
রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে পার্টির নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধির জন্য স্বাধীন কার্যক্রমের প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে জেলা পার্টি নিজস্ব পরিকল্পনা মতো কোভিড-এর বিরুদ্ধে ত্রাণের দাবিতে আন্দোলন, এএসপি সহ, রাষ্ট্রায়াত্ত কারখানাগুলোকে বাঁচানোর আন্দোলন, বিদ্যুতের মাসের বিল মাসে দেওয়ার আন্দোলন, যাদের রেশন কার্ড নেই তাদের রেশন কার্ড দেওয়ার দাবিতে আন্দোলন, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে আদায়যোগ্য দাবি নিয়ে আন্দোলন কয়লা খনি অধ্যুষিত এলাকায় শহর ও গ্রামের মানুষের পূনর্বাসনের আন্দোলন, রানীগঞ্জকে নতুন মহাকুমা শহরে পরিণত করার আন্দোলন, আসানসোল ও দুর্গাপুর কর্পোরেশনের অধিকাংশ এলাকায় নাগরিক পরিষেবার দাবি নিয়ে আন্দোলন, বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে অভিযান এবং অবরোধ গরিব মানুষের গৃহনির্মাণ প্রকল্পে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, খেতমজুরদের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন, বস্তিবাসীদের উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়াই, দুর্গাপুরে ডিভিসি’র বাঁধ বারবার ভাঙায় সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, জেলাজুড়ে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুর্যোগ পীড়িতদের সাহায্যে আন্দোলন ইত্যাদি সংগঠিত হয়েছে। এই আন্দোলনগুলিতে সবসময় সাফল্য লাভ করা গেছে এমন নয়। সব লড়াইয়ের মধ্যে অসাফল্যের একটা বিমুর্ত সম্ভাবনা থাকে। লড়াইয়ের উদ্দেশ্য হলো এই সম্ভাবনাকে কম করে যাতে সাফল্যের সম্ভাবনা বেশি থাকে তার প্রতিফলন ঘটানো। এই লক্ষ্য নিয়েই লড়াইগুলো করে জনসমর্থন এসেছে এবং পার্টি সংগঠন শক্তিশালী হয়েছে এবং রাজ্যের শাসকদল ও কেন্দ্রের হামলাকে এখানে কিছুটা রুখতে পারা গেছে।
এটা লক্ষ্য করা গেছে, সারা বছর যে সমস্ত জায়গায় পার্টির কর্মসূচি চলেছে সেখানে শাসকদলের মিথ্যা মামলা এবং পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে হামলা করার ক্ষমতা কমেছে। তবে বেশ কিছু জায়গায় সন্ত্রাসজনিত কারণে দুর্বলতা রয়ে গেছে। সেটা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হচ্ছে। বস্তিবাসী আদিবাসী তপশিলি দলিত অংশের মধ্যে সামাজিক নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে পার্টি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অনুঘটক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের আরও বেশি বেশি করে পার্টির মধ্যে আনার প্রচেষ্টা চলছে এই সমস্ত লড়াই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে।
সম্মেলনকে অভিনন্দন জানিয়ে আভাস রায়চৌধুরী বক্তব্য রাখছেন।
প্রস্তাব সমূহ -
দু'দিনের সম্মেলনে ‘জনগণকে বাঁচাও দেশ বাঁচাও’ আহ্বানে ২৩-২৪ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থন সহ মোট ২৮ টি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এই প্রস্তাবগুলির মধ্যে রয়েছে কৃষি আইনের বিপক্ষে, রক্ষা করো পশ্চিম বর্ধমান, লিঙ্গ সমতার পক্ষে, দেউচা-পাচামি প্রকল্পের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে, জাতীয় শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে, ডেসমন্ড টুটু’র মৃত্যুতে শোকপ্রস্তাব, কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজক অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা সহ একাধিক প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।
প্রতিনিধিদের আলোচনা
প্রতিনিধিদের আলোচনায় উঠে এসেছে বিকল্পের নানা দিক। সেখানে উঠে এসেছে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের পার্টি গণ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হলে কাজ থেকে ছাঁটাইয়ের প্রসঙ্গ, তাদের কাছে নীরব সমর্থন পাওয়ার প্রসঙ্গ সহ লড়াই করে দাবি আদায়ের সাফল্যের কথা। উঠে এসেছে অজয়ের তীর বরাবর সন্ত্রাসের মধ্যেও গোপনে সংগঠন গড়ার কথা। উঠে এসেছে রেড ভলেন্টিয়ারদের ভূমিকা এবং রেড ভলেন্টিয়ার পরিচালিত বিকল্প স্কুলে আদিবাসী তপশিলি অংশের মানুষের সন্তানদের পড়তে আসার কথা। উঠে এসেছে চেতনার মান উন্নত করার জন্য পার্টি পত্রপত্রিকা পড়ার আগ্রহের কথা। গণ সংগ্রহে মানুষের সাড়া। উপভোক্তা ভিত্তিক রাজনীতিতে মানুষের অনীহার কথা ভিন রাজ্যে থাকা এরাজ্যে কর্মরত অসংগঠিত এবং সংগঠিত ক্ষেত্রের চাকুরিজীবীদের, শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠনের দাবি সমূহের প্রতি সহমত পোষণ করা এবং তার দাবি-দাওয়া আদায়ের সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার উজ্জ্বলদিকের বিষয়টিও।
প্রতিনিধিদের আলোচনার শেষে জবাবি ভাষণে সম্পাদক গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি বলেন, মার্কসবাদের দর্শন থেকে সরব না। আমাদের আগামীদিনে যোদ্ধা সুলভ মনোভাব নিয়ে পার্টির স্বাধীন শক্তি বৃদ্ধি থেকে নির্বাচনী সংগ্রামের ময়দানে অংশ নিতে হবে। ইস্পাত কঠিন মানসিকতা নিয়ে মতাদর্শে দৃঢ় থাকতে হবে। জেগে থাকতে হবে।
সম্মেলনে সঙ্গীত পরিবেশন করেন লহরী সংস্থা এবং গণনাট্য সংঘের আসানসোল শাখা।
প্রতিবেদনে উল্লিখিত আগামী দিনের কাজ -
● পার্টিকে গণলাইন সম্পন্ন বৈপ্লবিক পার্টিতে পরিণত করতে হবে।
● প্রত্যেকটি পার্টি সদস্যকে প্লেনাম নির্দেশিত ৫ দফা কাজ সময়ে করতেই হবে।
● গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা নীতিসমূহ পার্টির সর্বস্তরে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
● সর্বস্তরে পার্টি কেন্দ্রকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে।
● ত্রুটি সংশোধন এবং আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়া পার্টির মধ্যে লাগাতার চালিয়ে যেতে হবে।
● জেলার মধ্যে সন্ত্রাসমুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতেই হবে।
● বুথ পার্টি টিম সব এলাকায় গড়ে তুলতে হবে এবং পরিচর্যা করতে হবে।
● পার্টি সভ্যপদে মহিলা সদস্য সংখ্যা ২৫ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে।
● পার্টির মোট খরচের ৭০ শতাংশ গণসংগ্রহের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হবে।
● পার্টি সভ্য পদে যুব সদস্যসংখ্যা ২০ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে।
● সমস্ত গণফ্রন্ট এবং সামাজিক ফ্রন্টগুলির সভা নিয়মিত করা, সভ্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা, স্বাধীন কার্যক্রমের ওপর জোর দেওয়া সহ নিয়মিত ফ্রন্ট এবং সামাজিক ফ্রন্টগুলির সাব কমিটি, ফ্রাকশন কমিটি এবং পার্টি টিমের সভা করতে হবে।
● পার্টি ও গণফ্রন্টের পত্রিকার প্রচার বৃদ্ধি করা এবং পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
● সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহারে পার্টির নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে।
● সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিস্ত শক্তিকে রোখার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে।
● বাম গণতান্ত্রিক এবং বাম সহযোগী শক্তিসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে জোরদার সংগ্রাম জারি রাখতে হবে।
● বামফ্রন্টকে শক্তিশালী করতে হবে।
● এর সাথে সাথেই সামাজিক ভারসাম্যের পরিবর্তনের জন্য পার্টির নিজস্ব শক্তি বৃদ্ধি ঘটাতে হবে।