E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ২০ সংখ্যা / ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ / ১৫ পৌষ, ১৪২৮

সিপিআই(এম) আলি‍‌পুরদুয়ার জেলা সম্মেলনে মতাদর্শে দৃঢ় সুশৃঙ্খল মজবুত পার্টি গড়ে তোলার ডাক


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মতাদর্শে দৃঢ়, সুশৃঙ্খল-মজবুত পার্টি গড়ে তুলে গরিব শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে আন্দোলন-সংগ্রামের পথে এগিয়ে যাবার আহ্বান জানিয়ে শেষ হয়েছে সিপিআই(এম) আলিপুরদুয়ার জেলা তৃতীয় সম্মেলন। গত ২৩ ও ২৪ ডিসেম্বর কমরেড মৃণালকান্তি রায় নগরে (আলিপুরদুয়ার), কমরেড যোগেশচন্দ্র বর্মন মঞ্চে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে আগামীদিনে লড়াই-আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৪০জনের নতুন জেলা কমিটি সর্বসম্মতিক্রমে গঠিত হয়েছে। পার্টির জেলা সম্পাদক হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন কিশোর দাস।

সম্মেলনে ২৬৭ জন প্রতিনিধি এবং ৪৪ জন দর্শক উপস্থিত ছিলেন। এই সম্মেলন থেকে চা শ্রমিকদের জমির পাট্টা দেওয়া ও মজুরি বৃদ্ধি, শ্রমকোড বাতিল, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও হিন্দুত্ববাদী শক্তির ফ্যাসিস্টসুলভ অভিযানের বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সহ কয়েকটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে।

২৩ ডিসেম্বর সম্মেলনের শুরুতে আলিপুরদুয়ারের দু’টি প্রান্ত থেকে দু’টি সুসজ্জিত মিছিল আসে সম্মেলনস্থলে। সম্মেলনের রক্তপতাকা উত্তোলন করেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃদুল দে। শহিদ বেদিতে মাল্যদান করেন মৃদুল দে, অশোক ভট্টাচার্য, পার্টির জেলা সম্পাদক কিশোর দাস সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও এরিয়া কমিটির সম্পাদকরা।

সম্মেলন উদ্বোধন করেন পার্টির রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোক ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, জনবিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে আগামীদিনে সাধারণ মানুষের কাছে পার্টি কর্মীদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হবে। জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে হবে। বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকট, সারা বিশ্বে দক্ষিণপন্থার ঝোঁক বৃদ্ধি, ধর্ম-সম্প্রদায় ও পরিচিতিসত্তার রাজনীতির তৎপরতা বৃদ্ধি ইত্যাদি প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন, বিজেপি’র ভ্রান্ত অর্থনীতি-শিল্পনীতি-কৃষিনীতির কারণে দে‍‌শে বেকার সমস্যা বাড়ছে, অভ্যন্তরীণ বৃদ্ধির হার নেতিবাচক এবং ক্রমহ্রাসমান। অন্যদিকে দেশে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বেসরকারিকরণের উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্দোলন বাড়ছে।

তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তৃণমূল-বিজেপি - এই দ্বিমেরুকরণের চেষ্টা, বামপন্থীদের ক্রমশ জনসমর্থন হ্রাস ইত্যাদির উল্লেখ করে পার্টি কর্মীদের ত্রুটি সংশোধন করে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, তৃণমূল সরকার অনৈতিকতা, অসততা এবং অস্বচ্ছতা নিয়ে চলছে। এই সরকার মানুষের অধিকার কার্যত কেড়ে নিয়েছে। নির্বাচনে কারচুপি, জা‍‌লিয়াতি একটা অন্যমাত্রায় নিয়ে গেছে। বিজেপি সরকার ত্রিপুরায় নির্বাচনে যা করেছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলও একই কাজ করছে। বিজেপি পরিচিতিসত্তাকে উত্তরবঙ্গে সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করছে। আলিপুরদুয়ারে ৮০ শতাংশ আদিবাসী, রাজবংশী, রাভা, লেপচা, ভুটিয়া ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। কিন্তু এই জেলায় বামপন্থীদের ভোট সবচেয়ে কমেছে। প্রতিটি চা বাগানে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠন রয়েছে। সেখানে বামপন্থীদের ভোটপ্রাপ্তি মাত্র ৩ শতাংশ। এই গরিব পিছিয়ে পড়া মানুষের সমর্থন ‍ফিরিয়ে আনতে হবে। সংগঠনের দুর্বলতাগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে।

এরাজ্যে শাসকদল তৃণমূল ও সরকার সংস্কৃতি, সততা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটিয়েছে। আধিপত্যবাদ সর্বক্ষেত্রে রয়েছে। শাসকদল তোলাবাজি, কাটমানি ইত্যাদিকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করছে তৃণমূল কংগ্রেস। কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনে শাসকদল সম্পর্কে মানুষের চিন্তা ভাবনার পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিস্থিতি আমাদের কাজে লাগাতে হবে। পরিশেষে তিনি বলেন, পরিচিতসত্তার প্রশ্নে মানুষের আবেগকে তাচ্ছিল্য না করে যুক্তি দিয়ে তাঁদের বোঝার চেষ্টা করতে হবে। মানুষের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষার পরিবর্তন হচ্ছে। এর সঙ্গে সাযূজ্য রেখেই কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।

সম্মেলন পরিচালনা করেন কৃষ্ণ ব্যানার্জি, নিতাই পাল, সন্তোষ সরকার, অনুজ মিত্র, শিবনাথ সেনগুপ্ত, বিদ্যুৎ গুণ, বিকাশ মাহা‍‌লি, আতিউল হক, শম্ভু বর্মন এবং টগর দাসকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী।

সম্মেলনে সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন বিদায়ী জেলা সম্পাদক কি‍‌শোর দাস। তিনি বলেন, পার্টির মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন - এ‍‌ই চারটি হাতিয়ারকে একসঙ্গে ব্যবহার করে জেলার সংগঠনকে সুসংগঠিত করে তৃণমূলের পতন নিশ্চিত করা এবং বিজে‍‌পি’র উত্থানকে প্রতিহত করাই হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। সম্মেলনে আয়-ব্যয়ের হিসাব পেশ করেন রতন ঘোষ।

সম্পাদকীয় প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় ৩১জন প্রতিনিধি অংশ নেন। বিদায়ী জেলা সম্পাদক কিশোর দাস তাঁর ভাষণে সুশৃঙ্খল পার্টি গড়ার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে বলেন, পার্টি কর্মীদের উন্নত চেতনার পরিচয় দিতে হবে। আন্দোলন-সংগ্রামের নতুন নতুন পথ বের করে এগিয়ে যেতে হবে।

সম্মেলনকে অভিনন্দন জানাতে গিয়ে মৃদুল দে বলেন, সারা বিশ্বে দক্ষিণপন্থীরা আরও তৎপর হয়েছে। ভারতে মৌলবাদী শক্তি তার একটা রূপ। দেশের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে এরা ধ্বংস করতে চাইছে। এই সরকার কর্পোরেট সংবাদমাধ্যমকে স্তাবকে পরিণত করেছে। এরাজ্যেও তৃণমূল সরকার কেন্দ্রের সরকারের মতোই একই কায়দায় চলছে। যেখানে যেখানে বিজেপি বিপদে পড়েছে সেখানেই তৃণমূল ছুটে গেছে। সেজন্য তৃণমূলের গোয়ায় যাওয়া, ত্রিপুরায় যাওয়া। এরাজ্যে দুর্নীতিকে তৃণমূল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, উত্তরবঙ্গ জু‍‌ড়েই আরএসএস খুবই সক্রিয়। এরা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে, প্রলোভিত করে পরিচিতিসত্তাকে কাজে লাগিয়ে লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে অনেকগুলি আসন পায়। গরিব পিছিয়ে পড়া নিপীড়িত মানুষের ঐক্য এরা ভেঙে দিয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত লড়াই এবং জনগণের দাবি-দাওয়ার আন্দোলন জারি রাখার আহ্বান জানিয়ে তিনি ব‍‌লেন, এরাজ্যে আমরা লড়াইয়ে ছিলাম। আগামীদিনেও আমাদের লড়াই জারি রাখতে হবে। তিনি পরিশেষে বলেন, অকমিউনিস্টসুলভ ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ করে মানুষের মধ্যে যেতে হবে। যেসব মানুষ আমাদের থেকে দূরে সরে গেছেন তাঁদেরকে আমাদের দিকে নিয়ে এসে শ্রেণি ভারসাম্য বদলাতে হবে।

সম্মেলন থেকে পার্টির আগামী রাজ্য সম্মেলনের জন্য ৫জন প্রতিনিধি এবং ১জন বিকল্প প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন।

সিপিআই(এম) আ‍‌‍লিপুরদুয়ার জেলা তৃতীয় সম্মেলনে সবচেয়ে প্রবীণ প্রতিনিধি ছিলেন দিলীপ চৌধুরী (৮০) এবং সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি ছিলেন শুভঙ্কর সাহা (২৬)। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত শাসকদলের প্রতিহিংসার জে‍রে মামলা হয়েছে ৬৩ জনের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার হয়েছেন ২২ জন, জেল খেটেছেন ৫ জন। সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন ১ জন। সম্মেলনে কৃষিজীবী প্রতিনিধি ছিলেন ৭০ জন। এছাড়া মজুরি নির্ভর ৪০ জন এবং চাকুরীজীবী ছিলেন ৫৭ জন।